স্মৃতির পাতায় আইভি রহমান

দিল মনোয়ারা মনু
Published : 24 August 2017, 03:08 AM
Updated : 24 August 2017, 03:08 AM

১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাস। বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি দুস্থ শিশুদের মধ্যে দুধ বিতরণের ব্যবস্থা নিয়েছে। সমিতির পক্ষ থেকে দুধ বিতরণ করছেন আইভি রহমান। আমার সুযোগ হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে থাকার। মাত্র সাংবাদিকতায় ঢুকেছি। সবকিছু দেখার ও জানার প্রবল আগ্রহ তখন। চোখের সামনে সেই দৃশ্য আজও অমলিন। আইভি রহমান পরেছেন অফ হোয়াইট রঙের লাল-পাড় শাড়ি, চোখে সানগ্লাস। লাবণ্য-ঢলঢল স্নিগ্ধ চেহারা। অপূর্ব লাগছিল তাঁকে। বাচ্চারাও দুধ নিতে যেয়ে অবাক হয়ে যেন তাঁকেই দেখছিল।

আজ মনে পড়ছে কত স্মৃতি, কত টুকরো টুকরো কথা। রাজনীতি সবসময় পরিচ্ছন্ন নয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু আইভি রহমান আমার সামনে এক অন্য রকম দৃষ্টান্ত ছিলেন। তাঁর মতো নির্লোভ মানুষ এদেশের রাজনীতিতে মেয়েদের সচেতন করে তোলার ব্রত নিয়েছিলেন বলেই আজ এ ক্ষেত্রে মেয়েরা এগিয়ে এসেছে। নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন তিনি একজন নির্ভীক সৈনিক। তাঁর এই মহান আত্মত্যাগ বাংলাদেশের নার আন্দোলনের মশাল হয়ে জ্বলবে চিরকাল।

আইভি রহমান সারাজীবন মাঠের রাজনীতি করেছেন। রাজনৈতিক সভার মঞ্চে উঠে ভাষণ খুব কম দিয়েছেন। সহকর্মীদের সঙ্গে মঞ্চের নিচে বসে শুনতে এবং শ্লোগান দিতেই পছন্দ করতেন বেশি। কিন্তু পোশাকে-আশাকে ছিলেন অত্যন্ত রুচিশীল, গোছানো। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রাজনীতি করতেন সক্রিয়ভাবে। কিন্তু আইভি আপার কারণে সেই সংসারও ছিল অত্যন্ত ছিমছাম এবং রুচিকরভাবে সাজানো।

নারী আসন নিয়ে যখন তুমুল বিতর্ক, পঁয়তাল্লিশ আসন নারীদের জন্য নির্ধারিত করা হল। প্রতিবাদে ফেটে পড়ল নারীসমাজ। জাদুঘরের সামনে সমাবেশ করা হল। বক্তৃতা চলছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে এল মহিলা আওয়ামী লীগ, আইভি রহমানের নেতৃত্বে। মুহূর্তেই প্রকম্পিত হল জনপদ মুহুর্মূহু শ্লোগানে। তখন আমার পাশেই বসে থাকা জনৈক নেত্রী বললেন, "নাও, এখন সমস্ত ক্রেডিট যাবে আওয়ামী লীগের ঘরে।"

আমি মনে মনে ভাবলাম, ক্রেডিট নিতে জানতে হয়। আসর গরম করার কৌশলটি রপ্ত করাও একটি বড় শিল্প।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত তখন আইভি রহমান সেখানে যেয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, "তোমাদের এই আচরণের ফলে আমি যে ছাত্রলীগ করেছি সে কথা ভাবতেও আমার লজ্জা হচ্ছে।"

অকপটে সহজ সত্য বলতে তাঁর কখনও দ্বিধা ছিল না।

২০০০ সালে নারী-শিশুনির্যাতনবিরোধী আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে তিনি মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিয়ে কাজ করেছিলেন। এই আইন প্রণয়নের দীর্ঘসূত্রতাও তাঁকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত দশককে নারী দশক এবং ১৯৭৫ সালকে নারীবর্ষ ঘোষণা করা হলে আইভি রহমান এই ঘোষণায় স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, রাজনৈতিক দিক থেকে অবহেলিত, অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্চনার শিকার এবং সামাজিক দিক থেকে প্রতিনিয়ত অমর্যাদাহীন নারীসমাজের জন্য এই ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ এই ঘোষণা এদেশের নারীআন্দোলনকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যুগিয়েছে অদম্য প্রেরণা।

তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা সেদিন আমাদের মুগ্ধ করেছিল। পাক্ষিক 'অনন্যা' র এক গোলটেবিল বৈঠকে নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। এসব ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট, কণ্ঠ থাকত দৃঢ়।

এই আসর জমজমাট করে রাখা প্রাণবন্ত মানুষটি গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার পর তাঁর প্রিয় প্রাঙ্গন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনের খোলা ট্রাকের পাশে পড়েছিলেন একা কিছুক্ষণ। ব্যাপক হতাহত ও আতংকের কারণে সবাই চারদিকে প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করছিল। স্থির হয়ে ছিল তাঁর দুচোখ। কালো-পাড়ের সাদা শাড়িটির বেশিরভাগ অংশই ছিল রক্তে ভেজা। কাপড়ের নিচের অংশ পুড়ে ছাই। ডান পায়ের মাংসপিণ্ড দলা হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের জন্য ৫২ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু কিছুতেই রক্তক্ষরণ ঠেকানো যায়নি। প্রায় তিনদিন অচেতন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

ছাত্রজীবনে সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী ছিলেন। প্রয়াত সভানেত্রী ড. নীলিমা ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর তিনি গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। নীলিমা ইব্রাহিমের সুযোগ্য অনুসারী হিসেবে এদেশের মঞ্চনাটককে গণমানুষের জন্য শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে যাদের নেপথ্যের অবদান উল্লেখযোগ্য, আইভি রহমান তাদেরই একজন। মহিলা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব তিনি উনসত্তরের গণআন্দোলনের পর থেকেই দক্ষতার সঙ্গে পালন করে এসেছেন। দুই দফায় ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী।

অন্ধ কল্যাণ সমিতিরও তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদিকা এবং গত আওয়ামী লীগ শাসনামলে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি সংস্থার বিশাল কার্যালয় ও অত্যাধুনিক অডিটরিয়াম নির্মাণ করে প্রশংসিত হন। মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। উনসত্তরের গণআন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক পুত্র ও দুই কন্যাসন্তানের জননী। সবাই বিবাহিত। ছাত্রী হিসেবে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেছেন।

ভৈরবের 'বড় বাড়ি' হিসেবে খ্যাত বাড়িটিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তখনকার জাঁদরেল শিক্ষাবিদ প্রয়াত জালালউদ্দিন আহমেদ, মা হাসিনা বেগম এখনও বেঁচে আছেন। আইভি রহমানকে স্কুলের ফাংশনে নাচতে দেখে জিল্লুর রহমান তাঁকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পছন্দ করেন এবং একা যেয়ে আইভি রহমানের বাবার কাছে ভয়ে ভয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। দুদিন পর তিনি সম্মতি দিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গাড়িতে মুজিব ও খান আতাউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বিয়ে করতে যান। এই দুজনই ছিলেন আইভি রহমান ও জিল্লুর রহমানের বিয়ের সাক্ষী। আট বোনের মধ্যে আইভি রহমান চতুর্থ। বড় বোন শামসুন্নাহার সিদ্দিকী।

আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা জিল্লুর রহমান পত্নীবিয়োগে যখন হতবিহ্বল তখন বারবার তিনি বলেছিলেন, "একা আমি বাঁচব কীভাবে! তিনি বিনীতভাবে সকলকে অনুরোধ করেছেন, আপনারা এ দেশকে বাঁচান– মৌলবাদীদের হাতে এ দেশকে তুলে দেবেন না।"

আইভি রহমান একজন আলোকিত মানুষ। তিনি ভালোবাসতেন দেশ ও দেশের মানুষকে। মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সখ্যতা। ঘাতকের গ্রেনেড সেই মাটিতেই তাঁকে লুটিয়ে দিল, মিশিয়ে দিল মাটির সঙ্গে। কিন্তু বেঁচে থাকবে তাঁর কর্ম ও প্রেরণা, যা এগিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের সূর্যসম্ভাবনার দিকে।