পদ্মাপাড়ের এক নায়করাজ ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 22 August 2017, 04:52 PM
Updated : 22 August 2017, 04:52 PM

এখন সিনেমা হলগুলো খালি পড়ে থাকে। একসময় আমার জন্মভূমি চট্টগ্রাম শহর ঘিরে রেখেছিল সিনেমা হল। একদিকে সিনেমা প্যালেস , খুরশিদ মহল — আরেকদিকে জলসা — একপ্রান্তে আলমাস , দিনার , সমুদ্রের দিকে যেতে বনানী অলংকার — আরও কত নামের সিনেমা হল। আজ এগুলো উধাও। গেল বার দেশে গিয়ে দেখি কোনো কোনোটা গুদাম; কোনোটি এখন কাপড়ের দোকান বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের অফিস। আমাদের সময় এসব হল ছিল বিনোদনতীর্থ। পাড়ায় মহল্লায় বাজারে হাটে রঙিন আর সাদাকালো পোস্টারে জ্বলজ্বল করা মুখ। এঁরা আমাদের সিনেমার নায়ক-নায়িকা। এঁদের মতো পোশাক বানানো, এঁদের মতো চুলের স্টাইল, এঁদের মতো কথা বলার চেষ্টা করতাম আমরা।

সেই যুগের সাদাকালো সিনেমার উজ্জ্বল তারকাদের তারকা ছিলেন তিনি। তিনি না এলে আমাদের চলচ্চিত্র জগতের নায়ক জায়গাটাই খালি থেকে যেত। বাদবাকি যাঁরা ছিলেন তাদের অবদান বা ভূমিকা খাটো না করেই বলি, আর কেউ নায়ক ছিলেন না আমাদের দেশে। যেমন ধরুন কলকাতা বা ওপার বাংলার কথা। সেখানকার সিনেমা জগত নানা কারণে আমাদের চাইতে এগিয়ে। তারা ইতিহাস ঐতিহ্য চলচ্চিত্রের আধুনিকতায় আমাদের চাইতে অগ্রগামী। সেখানেও আমরা দেখি নায়ক একজনই। তিনি উত্তম কুমার। আর অভিনেতা যদি বলি তো সৌমিত্রের মতো অভিনেতার জন্ম হয়নি খুব একটা।

একই বাস্তবতা আমাদের পদ্মাপাড়ে। নায়ক বলতে আমরা যা বুঝি, নায়ক বলতে যে মানুষটির চেহারা ভেসে ওঠে, যিনি রমনীমোহন, যিনি পর্দায় আসলেই নারী পুরুষের মনে দোলা দেন তিনিই রাজ্জাক।

কৈশোরে সাদাকালো যুগে তাঁর অভিনীত ছবিগুলোর আকর্ষণে তিনি নায়িকাদের চাইতেও এগিয়ে ছিলেন। কবরী যত দর্শক টেনেছেন তার চাইতে অধিক টানতেন রংবাজ রাজ্জাক। কখগঘঙ , এতটুকু আশা , আর্বিভাব এর সরল-সহজ প্রেমিক কিংবা দর্পচূর্ণ ছবির চাকরের ছদ্মবেশে মনচুরি করা নায়ক তিনি। হেলেদুলে নেচে নেচে গাওয়া 'নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা' এই নায়ক এসেছিলেন বেহুলার ভেলায়। জহির রায়হানের বেহুলায় তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তারপরও তাতে তিনি ছিলেন শায়িত নায়ক। উঠে দাঁড়ালেন রোমান্টিক ছবির প্রেমিক হিসেবে। স্বাধীনতার পর রংবাজে আবির্ভূত হয়েছিলেন এদেশের বদলে যাওয়া তারুণ্যের প্রতীক হয়ে।

তারপর তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আলোর মিছিলের প্রতিবাদী ভাই বা অবুঝ মনের দ্বৈত প্রেমে সফল রাজ্জাক ছড়িবে গেলেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।

একটা কথা মনে রাখা দরকার, মধ্যবিত্তই মূলত সংস্কৃতির ধারক। সেই মধ্যবিত্তের মনে দোলা দেওয়ার মতো কাজ সবাই করতে পারে না। এরা জানে বেশী বোঝে কম। ফলে মানা না-মানার দ্বন্দ্বে থাকে তারা। তাদের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন রাজ্জাক। ম্যাটিনি থেকে নাইট শো হাউসফুল নোটিশের পেছনে দাঁড়ানো এই নায়ক যখন অস্তমিত হতে শুরু করলেন মানুষও আগ্রহ হারাতে শুরু করল সিনেমার প্রতি। মনে আছে সমাধি বা অশিক্ষিত ছবির কথা। সেই গান, সেই সুর, সেই লিপ-মিলানো আজ আর চোখে পড়ে না।

যেসব গান কিংবদন্তী হয়ে আছে তার বেশীরভাগ সার্থকতা পেয়েছে রাজ্জাকের কারনে। মাহমুদুন্নবীর গাওয়া সেই গান 'আয়নাতে ওিই মুক দেখবে যখন"এর কথা ভাবুন। সুদর্শনা শবনম শুনছেন আর দু একটা শব্দ করছেন মাত্র। পুরোটা রাজ্জাকের কণ্ঠে গাওয়ার অমলিন স্মৃতিতে এখনও বেঁচে আছে। এমন গান আর কখনও হবে কিনা জানি না।

মানুষের জীবনে অমোঘ অনিবার্য সত্য মৃত্যু। পরিণত বয়সে তিনি বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর কীর্তি। অনেকে হয়তো জানেন না তাঁর পরিবারের ছবি-সম্বলিত একটি ভিউকার্ড আশির দশকে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যেখানে তিনি তিন পুত্র ও দুই কন্যাসহ স্ত্রী নিয়ে বসে আছেন। এই ভিউকার্ড দিয়ে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আজাদ প্রোডাক্টসের ব্যবসার শুরু। তারা বায়তুল মোকাররমের সামনে এর প্রচার-প্রসার শুরু করে আজ শিল্পপতি।

এটা যেমন ব্যবসার দিক আরেকটা দিকের কথাও ভাবুন। তাঁর মতো নায়িকাদের সঙ্গে নিবিড় হতে পেরেছে কেউ? সুচন্দা সুজাতা শাবানা ববিতা সবাইকে কেমন আপন করে বুকে টেনে নিয়ে প্রেমের আভিনয় করতেন। দেখে মনেই হত না সিনেমা দেখছি। এখন বুঝি এর শক্তি ছিল তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা। কোনো গুজব স্ক্যান্ডাল বা অপপ্রচার তাঁকে ছুঁতে পারেনি। পরিবার অন্তপ্রাণ রাজ্জাক ছিলেন ঘরমুখী। যার ঘর ঠিক নেই যার চরিত্র নড়বড়ে সে যত উপরে উঠুক পতন তার অনিবার্য। সেটা হয়নি বলেই তিনি সারাজীবন তারা হয়ে আকাশে বিচরণ করতে পেরেছিলেন।

বাংলাদেশে বলে না, দুনিয়ার প্রায় সবদেশে এখন সিনেমা জগতে এক ধরনের বন্ধ্যা সময়। হলগুলো খালি। মাছি উড়ছে। কিন্তু এর ভেতরেও রমরমা চলছে বলিউড। হলিউডকেও দমানো যায়নি। প্রযুক্তির দাপটে ঘরে বসে সিনেমা দেখার সুযোগ এসেছে বলেই কি সিনেমা হল উঠে যাবে? টিভি কি পেরেছে রেডিও বাতিল করে দিতে?

আমাদের সিনেমাও মরবে না। সিনেমার আবেদন সিনেমাতেই থাকবে। এই সত্য মেনে বলি, রাজ্জাকের আবেদনও কখনও শেষ হবে না। একেকজন মানুষ একেক সময় সময়ের হাত ধরে আসেন। জীবন রাঙ্গিয়ে দিয়ে যান তাঁরা। তাদের আগমন ও বিদায়ের পেছনে থাকে সময়ের চাহিদা। তাঁরা নিজেদের জন্য যতটা ততটাই মানুষের জন্য। এঁরা নিজেরাও টের পান না কোন সময় কীভাবে ইতিহাস হয়ে ওঠেন।

নায়করাজ রাজ্জাকের চাইতে প্রতিভাবান সুন্দর সৌম্য অনেক অভিনেতা এসেছিলেন। আসবেনও। কিন্তু তিনিই সেই মানুষ যাঁর বিভায় সাধারণ থেকে অসাধারণ গরীব থেকে ধনী সবাই আলোকিত হয়েছিল। যাঁকে দেখলেই এক ধরনের আনন্দে পুলিকত হয়ে উঠত মন। এ কাজ সবাই পারেন না।

আজ তারায় তারায় মিশে যাওয়া এই নায়কের জন্য ঘরে ঘরে শোক আর বেদনা। এটা সহজ কিছু নয়। এখন এমন সময় কেউ বিদায় নিলেও আমরা দ্বিধা বা বহুভাগে ভাগ হয়ে পড়ি। তাঁর বেলায় সেটাও হয়নি। সেদিক থেকে তিনি বাংলাদেশের ঐক্যের প্রতীকও বটে। এ কথা নিদ্বির্ধায় বলতে পারি– যত নায়ক আসুন, যত মেধা আর শ্রমের মিলন হোক– আর কোনো নায়করাজ আসবেন না আমাদের দেশে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পদ্মা মেঘনা সুরমা যমুনার তীরে তীরে থাকা মানুষের আনন্দ বিনোদনের নায়ক রাজ্জাক, আপনাকে জানাই কুর্নিশ। এই কলহ বেদনা আর সংঘাতময় সমাজে আপনি ছিলেন খাঁটি ও নির্মল আনন্দের উৎস।

শুভবিদায় নায়করাজ। আমরা আপনাকে ভুলব না।