ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়: ৭০ অনুচ্ছেদ কথকতা

তুরিন আফরোজ
Published : 19 August 2017, 07:41 AM
Updated : 19 August 2017, 07:41 AM

ষোড়শ সংশোধনীর উপজীব্য বিষয় ছিল, সংসদ কর্তৃক বিচার বিভাগীয় সদস্যগণের অসদাচারণ নিয়ন্ত্রণে অভিশংসনের ক্ষমতা প্রয়োগ। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় অপরিবর্তনীয় রেখে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, বিষয়টি অসাংবিধানিক। অন্যতম মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যে, যদি বিচারবিভাগীয় সদস্যগণের অসদাচারণ নিয়ন্ত্রণে সংসদ অভিশংসনের ক্ষমতা প্রয়োগ করে তবে তা সংবিধানের আদি ভিত্তি, যেমন ক্ষমতার বিভাজন-নীতি, আইনের শাসননীতি এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা-নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াবে। রায়ে আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে, আর তা হল, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের আলোকে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সাংসদদের হাতে থাকা বিচার বিভাগ মোটেও প্রত্যাশিত বলে মনে করে না।

ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের ২৮১-২৮২ পৃষ্ঠায় মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন:

We find no infirmity in the views taken by the High Court Division on construction of article 70; and that in view of article 70, the members of Parliament must toe the party line in case of removal of any Judges of the Supreme Court. Consequently, the Judges will be left at the mercy of the party high command. We find no wrong in taking the above view.

অর্থাৎ মাননীয় প্রধান বিচারপতি লিখেছেন:

"৭০ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যায় হাই কোর্ট বিভাগ যে মর্মাথ গ্রহণ করেছে আমরা তাতে অযৌক্তিকতা দেখি না এবং সেদিক থেকে দেখতে গেলে বলা যায় যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের তাদের পদ থেকে অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যগণ নিঃসন্দেহে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দলের হুকুম তামিল করতে বাধ্য থাকবেন। ফলশ্রুতিতে বিচারকগণ তাদের পদরক্ষার জন্য প্রতিটি মুহূর্তে রাজনৈতিক দলের উচ্চস্থানীয় নেতৃত্বের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন। আমাদের এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াতে মোটেও ভুল নেই।"

এছাড়াও ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের ২৮৪ পৃষ্ঠায় মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন:

We are of the view that in presence of article 70, it is difficult for a member of Parliament to form an opinion independently ignoring the directions given by the party high command of the political party in power.

অর্থাৎ মাননীয় প্রধান বিচারপতি লিখেছেন:

"সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের উপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক উর্ধ্বতন নেতৃত্বের নির্দেশনা উপেক্ষা করে একজন সংসদ সদস্যের পক্ষে কখনও স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকে না।"

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল মামলায় আরও তিনজন মাননীয় বিচারপতি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের অবতারণা করেছেন। রায়ের ৪২২ পৃষ্ঠায় মাননীয় বিচারপতি জনাব মো. আব্দুল ওয়াহাব মিয়া লিখেছেন:

… the risk of impeachment highly politicized will be even more prominent in the current political context of Bangladesh, especially due to the effect of article 70 of the constitution…

এছাড়া রায়ের ৫৪৯ পৃষ্ঠায় মাননীয় বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন হুবহু অনেকটা একই ভাষায় মাননীয় বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব মিয়ার লেখনীর পুনরাবৃত্তি করেছেন:

… the risk of impeachment being highly political will be even more prominent in the current political context of Bangladesh, especially due to the effect of Article 70 of the constitution of Bangladesh.

এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে মাননীয় বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব মিয়া (৪৪২-৪৪৩ পৃষ্ঠার) এবং মাননীয় বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (৫৪৯-৫৫০ পৃষ্ঠায়) নিজ নিজ রায়ে কাকতালীয়ভাবে (!) হুবহু একই ভাষা ব্যবহার করেছেন, যদিও ভাষাগত দিক থেকে মাননীয় বিচারপতি জনাব সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের বাক্যসমগ্র ব্যাকরণগতভাবে অধিকতর শুদ্ধ।

ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের ৭৯৩ পৃষ্ঠায় মাননীয় বিচারপতি মীর্জা হুসেইন হায়দার লিখেছেন:

The removal process of a Judge of the higher judiciary as laid down in the impugned 16th amendment will render insecurity in the mind of the judges thereby creating opportunity to undermine the independence of judiciary making this organ vulnerable and jeopardizing the rule of law which will create opportunity for creating political influence and pressure upon them specially when Article 70 of the Constitution is subsisting. So long Article 70 is there the independent wish of a member of the Parliament in respect of casting vote freely does not exist.

অর্থাৎ মাননীয় বিচারপতি মীর্জা হুসেইন হায়দার লিখেছেন:

"উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের যে প্রক্রিয়া বিচার্য ষোড়শ সংশোধনীতে বিধৃত করা হয়েছে তা বিচারপতিগণের মনোজগতে নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করবে; এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া যেহেতু ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানে উপস্থিত রয়েছে সেহেতু এর ফলে বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক প্রভাব এবং চাপ প্রয়োগ করার সুযোগ তৈরি হবে। সুতরাং যতদিন ৭০ অনুচ্ছেদ বহাল থাকবে ততদিন একজন সংসদ সদস্য কখনও সংসদে ভোট প্রদান করার ক্ষেত্রে স্বাধীন নন।"

ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে মাননীয় বিচারপতি মুহাম্মাদ ইম্মান আলী এবং মাননীয় বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে নিয়ে কোনো প্রকার পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করেননি। যেহেতু মাননীয় বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা পৃথক রায় না লিখে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন, সেহেতু আমরা ধরে নিতে পারি যে, আপিল বিভাগের মোট সাতজন মাননীয় বিচারকের মধ্যে পাঁচজন মাননীয় বিচারক সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিরূপ পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছেন।

আমরা সবাই জানি যে, বর্তমানে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়েরকৃত একটি রিট পিটিশনের শুনানি হাইকোর্টে চলছে। এ অবস্থায় বিচারাধীন একটি বিষয়ে আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতিগণের যে কোনো মন্তব্য হাইকোর্টে চলমান রিট পিটিশনের রায় প্রভাবান্বিত করতে বাধ্য। কেননা সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী–

"আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য… অবশ্যপালনীয় হইবে।"

যদি তাই হয়, তবে হাইকোর্ট বিভাগে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিচারাধীন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল মামলায় আপিল বিভাগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ করেছে। এখন আপিল ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ মাথায় রেখে হাইকোর্ট বিভাগ কতটা স্বাধীনভাবে তাদের বিচারিক কাজ সম্পন্ন করবে?

এভাবে বিচার বিভাগ নিজেই যখন নিজেদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে তখন তার সাংবিধানিক দায়ভার কে নেবে?