তাহলে বিচারপতিরা পদত্যাগ করবেন কীভাবে?

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 13 August 2017, 05:55 AM
Updated : 13 August 2017, 05:55 AM

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে রাজনৈতিক মাঠ গরম হয়ে উঠছে, অস্থিরতা বাড়ছে। যে যার মতো ব্যাখ্যা দিয়ে চলছে। যতটা আলোচনা হচ্ছে তার সবটাই পর্যবেক্ষণ নিয়ে এবং সেটি মূলত রাজনৈতিক। আমি ওই রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে কথা বলছি না। রায়ে আমার কাছে বড় ধরনের ত্রুটি ধরা পড়েছে। সে দিকেই আলোকপাত করতে চাই।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওই রায় অনুযায়ী বর্তমানে বিচারপতিদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সুযোগ নেই। ভুল করেই হোক আর ইচ্ছে করে, আপিল বিভাগ সংবিধান থেকে বিচারপতিদের পদত্যাগের ধারাটি ডিলিট করে দিয়েছেন।

আলোচনায় যাওয়ার আগে রায়ের ৬২ শব্দের আদেশ অংশটি হুবহু তুলে ধরছি:

Since all but one wrote separate judgments expressing their separate opinions, we unanimously dismiss the appeal, expunge the remarks made by the High Court Division as quoted in the judgment of the learned Chief Justice and also restore clause (2) (3), (4), (5), (6) and (7) of article 96 and also approve the Code of Conduct formulated in the main judgment.

দেখা যাচ্ছে, এখানে আপিল বিভাগ পরিষ্কারভাবেই সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৭ পর্যন্ত প্রতিস্থাপনের কথা বলেছে। অর্থাৎ ৯৬এ যেসব দফায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কথা বর্ণণা রয়েছে সেসব ধারা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এটি করতে গিয়ে ৮ নম্বর দফা সম্পর্কে তারা কিছু বলেননি, যা বাহাত্তরের সংবিধানে এবং ষোড়শ সংশোধনীর পর ৪ নম্বরে ছিল। ষোড়শ সংশোধনী হয়েছিল দফা ২ থেকে ৮এর জায়গায় ২ থেকে ৪এর প্রতিস্থাপন। এখন আপিল বিভাগ আবার ২ থেকে ৭ প্রতিস্থাপন করতে বলেছেন। অর্থাৎ ৮ বা আগের দফা ৪ বাদ পড়ে গেছে।

[(৪) কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।]

অর্থাৎ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কোনো বিচারপতির স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সুযোগ নেই। এটা একটা সাংবিধানিক শূণ্যতা।

বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত ধারায় বলা ছিল:

৯৬(২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না;

(৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন;

(৪) কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন।

পঞ্চম সংশোধনী এনে ২,৩,৪ সংশোধন করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংযোজন করা হয়। সেগুলো ২ থেকে ৭ পর্যন্ত সন্নিবেশিত করা হয়। তখন ৪ নম্বর দফাটি অর্থাৎ বিচারপতিদের পদত্যাগের সুযোগের বিধানটি ৮ নম্বরে চলে যায়।

ষোড়শ সংশোধনী এনে ৯৬ অনুচ্ছেদের ২,৩ ও ৪ দফা বাহাত্তরের অবিকলই করা হয়েছে। সংবিধানে কোনো ধারা আপনাআপনি বসতে পারে না। যে কারণে যখন ষোড়শ সংশধোনী আনা হয় সেখানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল, ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ (সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন ও এর দায়িত্ব) ও ৮এর পরিবর্তে দফা ২, ৩ ও ৪ প্রতিস্থাপিত হবে। এখন যখন বলা হল, ২ থেকে ৭ প্রতিস্থাপিত হবে, অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, দফা ৮এর স্থান নেই সংবিধানে।

তবে কি বিচারপতিদের পদত্যাগের সুযোগটি ইচ্ছে করেই বাতিল করা হল? মনে হয় না। বিচারপতিরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এবং রাজনৈতিক মন্তব্য নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, ওই বিধান যে বাদ পড়ে গেল সেটা কারও চোখেই পড়ল না।

এখন প্রশ্ন হল, বিচারপতিরা পদত্যাগ করবেন কী করে? ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পর বিচারপতিদের ওই সুযোগ নেই। যে কোনো নাগরিকেরই চাকরি ছাড়ার অধিকার মৌলিক। সংবিধানের ৩২ ধারামতে আইনুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। এছাড়া আমাদের সংবিধানেই সাংবিধানিক পদগুলো থেকে কীভাবে স্বেচ্ছায় সরে যাওয়া যায় সেটা বলা আছে। যেমন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮এর দফা ৬ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনার, ১২৯এর দফা ৩ অনুযায়ী মহা হিসাব-নিরীক্ষক এবং ১৩৯এর ৩ অনুযায়ী সরকারি কর্মকমিশনের সভাপতি বা অন্য সদস্য 'রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন।' একই কথা ৯৬এর দফা ৪, পরে ৮এ এবং ষোড়শ সংশোধনীর পর আবার দফা ৪এ বলা ছিল।

কেউ রিভিউ আবেদন করলে ওই আদেশ সংশোধন করার সুযোগ আছে। কেউ রিভিউ না চাইলেও আপিল বিভাগ তাদের রায় নিজেরাই সংশোধন করতে পারে এবং সেটা তাদের করতেই হবে। নয়তো সাংবিধানিক শূণ্যতা থেকেই যাবে।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি সাংবিধানিক শূণ্যতার প্রশ্নে নয়। তবে প্রশ্নটি সাংবিধানিক এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যদের মর্যাদার। রায়ে প্রধান বিচারপতি সংসদের হাতে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা না দেওয়ার পক্ষে অনেকগুলো যুক্তি দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হল, তিনি বলেছেন:

While making provision for fifty reserved women members of Parliament is a remarkable step forward to promote women participation in our law making process, but it has focused the idea that our democracy is not mature enough that we still need to promote participation of women in the Parliament by making special provisions for them so that they can come to the Parliament without the need to go to the public. These fifty women members get elected by the rest three hundred members of Parliament based on the proportional representation of the parties who are directly elected by the public. Reserved women members of Parliament, who are not directly elected by the public, would also take part in the Judges' impeachment process, which is not acceptable in a mature democracy.

প্রধান বিচারপতির কথা অনুযায়ী বিচারপতিদের অভিশংসন প্রক্রিয়ায় যারা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নন তাদের অংশ নেওয়াটা পরিপক্ক গণতন্ত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যদের মর্যাদাটা কী দাঁড়ায়? সংসদে ওই ৫০ জন নারী সাংসদ তো ৩০০ জন সদস্যের সমান মর্যাদা পান। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৩০০ এবং সংরক্ষিত ৫০ জনকে নিয়েই সংসদ গঠিত হয়। ওই ৫০ জন সংসদ সদস্য হিসেবেই অভিহিত হন। কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ীও তারা সমান সুযোগ পাচ্ছেন। তাদের করা আইন মেনেই রাষ্ট্র চলছে।

প্রধান বিচারপতির বক্তব্য অনুযায়ী তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির সংসদ সদস্য বলে মনে হতে পারে। শুধু তাই নয়, বিচারপতিদের চেয়ে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপতির অবস্থান উপরে। সংবিধানের ৫২ ধারা অনুযায়ী সংসদ রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের ক্ষমতা রাখে। ওই অভিশংসন প্রক্রিয়ায়ও সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যরা সমানভাবে অংশ নিতে পারেন। সংবিধানের কোথাও সরাসরি নির্বাচিত এবং সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের মধে কোনো বৈষম্য আনা হয়নি।

প্রধান বিচারপতি এই প্রশ্ন তুলে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। কারণ তিনি রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়া বা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশ নেওয়া অগ্রহণযোগ্য মনে করেননি।