ধর্ম যার যার ও ব্যাখ্যাটা আমার

মামুন আল মাহতাব
Published : 13 August 2017, 05:10 AM
Updated : 13 August 2017, 05:10 AM

দৃশ্যপট: এক

আমি খুব বেশি ধার্মিক নই, তবে অবশ্যই ধর্মভীরু। এবার উলান বাটোর থেকে রওনা হবার আগের রাতে জিনিসপত্র গুছাতে গিয়ে হঠাৎ দেখি পাসপোর্ট হাওয়া। বিদেশে পাসপোর্ট হারানোর বিড়ম্বনা যে কী তা ভালোই জানা আছে। বছর তিনেক আগে অ্যামসটারডামে যাবার পথে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে পাসপোর্ট হারিয়ে ৩৬ ঘণ্টা আটকে ছিলাম। যথেষ্ট আর্থিক এবং সেই সঙ্গে মানসিক ভোগান্তির পর ইস্তাম্বুলের বাংলাদেশ কনসুলেট আন্তরিক সহায়তায় একটা ট্রাভেল ডকুমেন্ট যোগাড় করে সেবার দেশে ফিরেছিলাম।

উলান বাটোরে আমাদের দূতাবাস নেই। সবচেয়ে কাছের বাংলাদেশ দূতাবাস বেইজিংয়ে। টেনশনে ঘাম ঝরছে। জিনিসপত্র, সুটকেস, ডাস্টবিন সব ওলট-পালট করছি। হঠাৎ মনে পড়ল সন্ধ্যায় আমার ন্যাসভ্যাক গবেষক ডা. ফজলে আকবরের রুমে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম। মনে আছে মানিব্যাগটা পকেট থেকে গড়িয়ে সোফায় পড়েছিল।

রাত তখন যথেষ্ট। ডা. ফজলে আকবরের ফিরতি ফ্লাইট অনেক সকালে। তবু তাঁকে ফোনে ঘুম থেকে তুললাম। দরদর করে ঘামছি আর জোরে জোরে পড়ে চলেছি 'ইন্নালিল্লাহি… … রাজিউন'। ইস্তাবুলের ঘটনার পর আম্মা শিখিয়েছিলেন কোনো কিছু হারিয়ে গেলে এই দোয়া পড়তে, তাতে নাকি হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া যায়। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে ডা, আকবরের কথায় শান্তি ফিরে এল মনে। পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। আমি যে সোফাটায় বসেছিলাম সেটারই গদির নিচে। মনে হল, ইস, যদি ইস্তাবুলের ঘটনার সময় দোয়াটা জানতাম তাহলে সেখানে এতটা বিড়ম্বনা পোয়াতে হত না।

দৃশ্যপট: দুই

প্রিয় ছোটভাই মিলু। গণজাগরণ মঞ্চের তুখোড় সংগঠক। ছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমামের গণআদালতের সঙ্গেও। গণআদালতে গোলাম আযমের রায়ের দিন পুলিশের সঙ্গে ইটপাটকেল বিনিয়ম করতে গিয়ে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পিতাকে শেষবারের মতো দেখতে যেতে পারেননি। চ্যাম্পিয়ন ট্রফির ফাইনালের পর ফেসবুকে কক্সবাজারের এক বাংলাদেশবিরোধীর স্ক্রিনশট শেয়ার করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সে দেশবিরোধী লিখেছে:

"আজ আমাগো পশ্চিম পাকিস্তান জিতে যাচ্ছে। আমরা সকল পূর্ব পাকিস্তান তাদের প্রতি সাধুবাদ।"

পাকিস্তানের বিজয়ে সবার উচ্ছ্বাসের প্রকাশ অবশ্য এরকম নির্লজ্জ নয়। যেমন একজন সিনিয়র মেডিসিন বিশেষজ্ঞ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে যোগ্যতর দল হিসেবে পাকিস্তানের বিজয়ে একজন ক্রিকেটামোদী হিসেবে তার সন্তুষ্ট হওয়ার যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন এমনটা দেখেছি।

দৈনিক মানবকন্ঠের সম্পাদক আনিস আলমগীর উদার মানুষ। ফেসবুকে লিখেছেন:

This not love for Hussain but hatred to Yazeed.

তার মানে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে জেতার পর ভারতীয় অধিনায়কের বাগাড়ম্বরের পরিণতি এটি। বিনয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। বরং চ্যানেল একাত্তরের সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার মতো বলব,

"আমি সবকিছুতেই পাকিস্তানের বিপক্ষে। আর যখন পাকিস্তানের বিরোধিতা করি তখন আমি রাজনীতি করি না– ইতিহাসের কথা বলি।"

দৃশ্যপট: তিন

উলান বাটোর থেকে দেশে ফেরার রুট ছিল বেইজিং, তারপর গুয়াংজু হয়ে ঢাকা। বেইজিংয়ের ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ নিয়ে টার্মিনাল চেঞ্জ করতে হয়। মাঝে প্রায় মিনিট বিশেকের বাস জার্নি। বাসে একজন বন্ধুবৎসল চীনা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জানতে চাইল আমার দেশ কোথায়। বাংলাদেশ বলাতে সে মহাখুশি। চীনারা নাকি বাংলাদেশিদের ভাই বলে মনে করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় তারাও সহযাত্রী। কথা শুনে মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল। ভুলে গেলাম দশ মিনিট আগে কী ঘটেছিল।

গ্রিন চ্যানেল দিয়ে কাস্টমস পার হচ্ছি। হঠাৎ সামনে হাজির কাস্টমস কর্মকর্তা। পাসপোর্ট দেখে ফেরত দিয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ কী মনে পড়তে জানতে চাইলেন, "মুসলিম?"

'হ্যাঁ' বলতেই আর যায় কোথায়। মনে হল সাত রাজার ধন পেয়েছেন। একপাশে আলাদা করে নিয়ে সুটকেস ওলট-পালটের এক মহোৎব শুরু হল। এই উৎসবে যোগ দিলেন আরও দুয়েকজন কর্মকর্তা। মনে পড়ল উলান বাটোরে আমি এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় লিভার এসোসিয়েশনের যে কনফারেন্সে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলম তার অ্যাবস্ট্রাক্ট বইয়ে আমার ছবি ছাপা হয়েছিল। সহযোগী অধ্যাপকের নামের আগে সেই ছবিতে অধ্যাপক জুড়ে দিয়ে উলান বাটোরের সংগঠকরা সম্ভবত নিজেদের কনফারেন্সের সম্মান বৃদ্ধি করেছেন।

মনে পড়তেই ছবিটা বের করে তাদের দেখালাম। কাজও হল জাদুর মতো। একে আমি চিকিৎসক, তার উপর অধ্যাপক– যেন সাক্ষাৎ ফেরেশতা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে। বারবার সামনে ঝুঁকে দুঃখ প্রকাশ করছেন। একজন আমার সুটকেস গুছানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বেচারাদের অবস্থা দেখে একটু চিন্তায় পড়লাম। যেভাবে তারা ঝুঁকে ঝুঁকে সরি বলছেন, নির্ঘাত রাতে প্রত্যেককে ব্যথার ট্যাবলেট খেতে হবে।

তারপরই মনে হল, কী বিচিত্রই না আমরা আর কী প্রবল আমাদের পাকিস্তানপ্রেম! ভিরাট কোহলির একটা কথার ছুতায় আমরা ভুলে যাই তিন লাখ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর দুঃসহ স্মৃতি– নুজহাত-শমী-শাওন-তৌহিদ-তন্ময়-নটো-শোভনদের মতো আরও ত্রিশ লক্ষ শহীদসন্তানের প্রিয়জন হারানোর অব্যক্ত যাতনা। হলি আর্টিজানে আমরা ইসলামকে কলঙ্কিত করি আর আবার ওই ইসলামেরই জিকির তুলে 'পূর্ব পকিস্তানি' হিসেবে পাকিস্তানের জয়ে উল্লসিত হই কিংবা যোগ্যতর দল হিসেবে তাদের জয়ে আনান্দিত হওয়ার যৌক্তিকতা ব্যখ্যা করি।

অথচ যে চিকিৎসক পরিচয়ের কারণে চীনা কাস্টমস কর্মকর্তারা আমার সামনে বিনয়াবনত, সেই চিকিৎকদেরই আমরা পেটাই কারণে-অকারণে, ইচ্ছামতো, সকাল-বিকাল!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন ফেসবুকে লিখেছেন, তিনি 'বাংলাদেশের দালাল'। একদম সহমত। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমাদের সেই বাঙালির দরকার নেই যারা মদের পেয়ালায় ঝড় তোলে, কিন্তু শূকরের মাংস খায় না। আমার বিবেচনায় এরা যে চতুষ্পদটির মাংস খায় না তার চেয়ে নিকৃষ্টতর। রোহিঙ্গাদের নয়, এদের বরং ছেড়ে দিয়ে আসা উচিৎ বঙ্গোপসাগরের কোনো প্রত্যন্ত দ্বীপে। কারণ তাদের পাকিস্তানি পিতারাও তাদের গ্রহণ করবে না।