ফিদেল কাস্ত্রো: নিবেদিত বিপ্লবী না স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 13 August 2017, 09:56 PM
Updated : 13 August 2017, 09:56 PM

History will absolve me.

সান্টিয়াগোর ব্যারাক আক্রমণ মামলার আসামি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৫৩ সালে আদালতে যে দীর্ঘ চার ঘণ্টা বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার শিরোনাম ছিল উপরে উল্লিখিত উদ্ধৃতিটি– যার মানে, 'ইতিহাস আমাকে ক্ষমা করবে'। কাস্ত্রো কি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে, পরবর্তী সময়ে কিউবার রাজনীতিতে যে ভূমিকা তিনি পালন করবেন তার জন্য তাঁকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে?

তাঁর মৃত্যুর পর আজকে এ প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে– ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণে কাস্ত্রোকে সমাজবদলের লক্ষ্যে একজন নিবেদিত বিপ্লবী না স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? মার্কিন মদদপুস্ট স্বৈরাচারী ফুলজেনসিও বাতিস্তা সরকারকে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে উৎখাত করে যে মানবিক, গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি তিনি কিউবার জনগণকে দিয়েছিলেন তা কি গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন নাকি নিজেই পরিণত হয়েছিলেন বাতিস্তার মতো স্বৈরাচারী একনায়কে?

কিউবার বিপ্লবের পর সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল কবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উত্তরে কাস্ত্রো খুব শিগগির নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা তিনি জীবদ্দশায় পালন করে যেতে পারেননি অথবা করতে চাননি। বিপ্লবের পর কাস্ত্রো প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন। কিন্তু মার্কিন মদদপুষ্ট সরকারকে উৎখাত করবার ফলে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই তাঁর প্রতি শুধু বিরুপ ছিল তা-ই নয়, তারা একে পশ্চিম গোলার্ধে সোভিয়েত আধিপত্য বিস্তারের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরম অসহযোগিতা ও বিপ্লববিরোধী মনোভাব শীতল যুদ্ধকালীন দ্বি-মেরু বিশ্বে কাস্ত্রোকে সোভিয়েত বলয়ের দিকে ঠেলে দেয়।

কাস্ত্রো আর চে গুয়েভারার নেতৃত্বে যে তরুণ বিপ্লবীরা সেদিন স্বৈরাচারী বাতিস্তার বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন তারা যতটা না বাস্তব তার চেয়ে বেশি তাড়িত হয়েছিলেন স্বপ্নের আবেশে। সন্দেহ নেই, একটা মানবিক পরিবর্তন তাঁরা চাচ্ছিলেন। স্বৈরশাসনের নিষ্পেষণ থেকে গণমানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির স্বপ্নে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত শ্রেণি থেকে আগত তরুণ বিপ্লবীরা সেদিন সংগঠিত হয়ছিলেন বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করবার জন্য।

স্বৈরাচারী বাতিস্তা নিজেও কিন্তু আরেক কিউবান বিদ্রোহের ফসল। স্বৈরশাসক জিরারদো মাচাদো যিনি স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন জেনারেল হিসেবে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে সিপাহীরা ১৯৩৩ সালে যে বিদ্রোহ করে সেটি বাতিস্তাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। কিউবার ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হল, সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও মাচাদো, বাতিস্তা এবং কাস্ত্রো তিনজনেই শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছেন একনায়কে। কাস্ত্রোর সঙ্গে প্রথম দুজনের পার্থক্য হল, ওঁরা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন অভ্যুথান ও গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে, কিন্তু কাস্ত্রোকে বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা এখনও উৎখাত করা সম্ভব হয়নি, নানাভাবে চেষ্টা করা সত্ত্বেও।

কাস্ত্রো ও তাঁর কমরেডরা দীর্ঘ একনায়কতান্ত্রিক শাসন থেকে কিউবার জনগণকে মুক্ত করবার স্বপ্ন থেকে বাতিস্তার বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করলেও, পরে কাস্ত্রো নিজেই কেন একনায়কে পরিণত হলেন? বাতিস্তা স্বৈরশাসক হলেও কিউবা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সূচকে তৎকালীন পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়ে অগ্রসরমান ছিল। কিউবার জনগণ চাচ্ছিলেন মুক্ত, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবেন, উন্নয়ন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে ভূমিকা পালন করবেন বা উন্নয়ন প্রকল্পে তাদের মতামতের প্রতিফলন থাকবে। কাস্ত্রো, চে এবং অনান্য বিপ্লবীরাও এটাই চেয়েছিলেন। তাদের এ স্বপ্নের কথা তাঁরা জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু বিপ্লবের পর এমন কী ঘটল যাতে তাদেরকে স্বপ্নের পথ থেকে সরে দাঁড়াতে হল?

কিউবার তরুণরা এক মহান স্বপ্ন সামনে রেখে গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ তরুণদের কেউ কমিউনিস্ট ছিলেন না। কাস্ত্রো বা চে বিপ্লবের সময় নিজেদেরকে কমিউনিস্ট বলে পরিচয়ও দেননি বা কিউবার বিপ্লবটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলেও অভিহিত করেননি। কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি এ বিপ্লবে অংশ নেয়নি। বাতিস্তাকে উৎখাত করার পর তাদের আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাবার। কিন্তু মার্কিনিদের অসহযোগিতামূলক আচরণের পর কাস্ত্রোর সামনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নেওয়া ছাড়া অন্য পথ খোলা ছিল না। অন্যদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়নও কাস্ত্রোর এ বিপ্লব পশ্চিম গোলার্ধে তার প্রভাব-বলয় বিস্তারের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। এ প্রেক্ষাপটে ফিরে তাকাই সোভিয়েত বিপ্লবের ইতিহাসের দিকে।

মানবমুক্তির মহান স্বপ্ন নিয়ে ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধিত হয়। বিপ্লবের শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল যে, ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে জারতন্ত্রের উচ্ছেদের পর কেরনস্কি সরকারের নেতৃত্বে যে সংসদীয় সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা সেনাবাহিনী এবং পেত্রোগ্রাদ (সেন্ট পিটার্সবার্গ) ও মস্কো অঞ্চলের শ্রমিক শ্রেণির সমর্থনে উৎখাত করা কতটা যৌক্তিক ছিল।

সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর রাজনৈতিক রূপ কেমন হবে তেমন কোনো মডেল লেনিন ও তাঁর দল বলশেভিকদের (পরে কমিউনিস্ট পার্টি) সামনে ছিল না। ধ্রুপদী মার্কসবাদের যান্ত্রিক ব্যাখা দাঁড় করিয়ে তাঁরা সমাজতন্ত্রের মানে করলেন রাষ্ট্র-পরিচালিত, অর্থাৎ আমলা-পরিচালিত অর্থনীতি। শাসনব্যবস্থার ভিত্তি 'প্রলেতারিয়েতের (সর্বহারা) একনায়কত্বের' বাস্তব রূপ দাঁড়াল প্রথমে দলের এবং কালক্রমে ব্যক্তির একনায়কত্বে। যা কিনা স্তালিনের আমলে চরম রূপ ধারণ করে। ব্যক্তিপুজা অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন যত দিন ছিল তার পুরো সময়জুড়ে কম-বেশি ছিল। ফলে শ্রমিক শ্রেণির নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা হলেও রাষ্ট্রপরিচালনায় তাদের তেমন ভূমিকা পালনের সুযোগ ছিল না। রাষ্ট্র পরিচালিত হত মূলত পার্টি আমলাতন্ত্রের দ্বারা। এ রাষ্ট্রে বাক এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার সুযোগ ছিল না। ধর্মীয় স্বাধীনতাও ছিল অত্যন্ত সীমিত।

মার্কসবাদের প্রবক্তারা যেখানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র শুকিয়ে যাবার ভিত্তি তৈরি হবে বলে ভেবেছিলেন সেখানে সোভিয়েতে কমিউনিস্টদের হাতে রাষ্ট্র হয়ে ওঠে আরও শক্তিশালী। সমাজের অধীন হবার বদলে, সমাজের উপর রাষ্ট্রযন্ত্র পুরোপুরি চেপে বসে। পার্টি আমলাতন্ত্র এত ব্যাপক রূপ ধারণ করে যে, শুধু পার্টি সদস্যদের জন্য পৃথক বিপণী বিতান তৈরি করা হয়, যেখানে জনগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

বাংলাদেশ থেকে সিপিবির সদস্যরা যখন সোভিয়েত পার্টির পয়সায় সেদেশে বেড়াতে যেতেন তখন তাদের কাছে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের সম্মানের প্রতীক মনে হত। কিন্তু যেটি তারা তখন বুঝতে পারেননি তা হল, সোভিয়েত ইউনিয়নে পার্টির সদস্যরা ছিল সমাজের এলিট, যারা জনগণের চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করতেন। পরিণতিতে, জনগণের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টিকে ভালোবাসার পরিবর্তে পার্টির উপর ক্ষোভের জন্ম হয়। যার বিস্ফোরণ আমরা দেখেছি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়।

কাস্ত্রো যখন সোভিয়েতমুখী হলেন তখন তাঁর সামনে সোভিয়েত মডেলের একদলীয় শাসন গ্রহণ ছাড়া পথ ছিল না। উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর শীতল যুদ্ধকালীন দুনিয়ায় এশিয়া-আফ্রিকার দেশসমূহে উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম তীব্রতা লাভ করে। অনেক দেশ ঔপনিবেশিক শাসনের জোয়াল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সমর্থ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বলয়ভুক্ত দেশসমূহ এ মুক্তিসংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান করে। তাদের কাছে এটা পুঁজিবাদী বিশ্বের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে প্রতিভাত হয়। কেননা সব উপনিবেশ ছিল নেতৃস্থানীয় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের দখলে। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ মনে করত, এর ফলে একের পর এক রাষ্ট্র পুঁজিবাদী দুনিয়া থেকে খসে পড়বে। তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ নেতৃস্থানীয় পুঁজিবাদী দেশগুলোকে দুর্বল করে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসারের ক্ষেত্র তৈরি হবে। তাতে নতুন নতুন দেশ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বলয়ভুক্ত হবে।

পুঁজিবাদী বিশ্ব যেহেতু উপনিবেশবিরোধী মুক্তিসংগ্রাম সমর্থন করেনি, তাই মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নেওয়া ছাড়া অন্য পথ খোলা ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন এসব মুক্তিসংগ্রামকে আখ্যায়িত করেছিল 'জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব' নামে। যেটি, তাদের মতে, ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের পূর্ব ধাপ। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেমন একদলীয় শাসন ছিল, তেমনি তারা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া সদ্যস্বাধীন দেশগুলোতেও সেটাই দেখতে চাইত। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য একদলীয় শাসন অপরিহার্য মনে করা হত। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল, তাদের মতে, বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। সামান্য কিছু দেশে অবশ্য ব্যতিক্রম ঘটেছিল। তবে একদলীয় শাসন কায়েমই ছিল তখন সাধারণ ঘটনা।

এছাড়া ইঙ্গ-মার্কিন পুঁজিবাদী বলয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে যে সমস্ত রাষ্ট্র ভিন্ন অবস্থান নিতে চেয়েছে তারাও একদলীয় শাসনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও– যে দেশটি, বামপন্থীদের ভাষায়, একটি বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীন হল, সে দলও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না পেয়ে সোভিয়েত মডেলের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বেছে নেয়। বঙ্গবন্ধু, যিনি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, তিনিও একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং গঠন করেন বাকশাল।

'তৃতীয় বিশ্ব' নামে পরিচিত উন্নয়নশীল বিশ্ব এবং সদ্যস্বাধীন দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবেই শুধু চরম দরিদ্র ছিল না, বরং এটা তাদের মধ্যে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক দারিদ্রেরও জন্ম দিয়েছিল। ফলে উন্নয়ন প্রশ্নে তাদের পক্ষে নিজ নিজ দেশোপযোগী মডেল চিন্তা করার মতো ধীশক্তিসম্পন্ন জনশক্তির অভাব ছিল। উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতৃবৃন্দ সে সময় তাদের সামনে সহজলভ্য সোভিয়েত মডেলের একদলীয় শাসন অথবা ইঙ্গ-মার্কিন মডেলের পুঁজিবাদী অর্থনীতিনির্ভর এক ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল।

যারা একদলীয় শাসন গ্রহণ করেছিল তারা মনে করেছিল যে, এ ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে দেশকে সমাজতন্ত্রের পথে নিয়ে যাবে এবং সমাজতন্ত্রই হল উন্নয়ন ও মানবমুক্তির একমাত্র পথ। একদলীয় শাসন কায়েমের পিছনে কতটা চাপ সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ছিল আর কতটা তাদের দেখে তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উৎসাহিত হয়েছিলেন এ নিয়ে বোধহয় গবেষণার অবকাশ রয়েছে।

এমন প্রেক্ষিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না পেয়ে কাস্ত্রো সোভিয়েত বলয়ের সমর্থন লাভ করতে চান। ফলশ্রুতিতে সোভিয়েত ব্যবস্থা দেখে প্রভাবিত হয়েই হোক অথবা সোভিয়েতের 'পরামর্শেই'– কিউবার বিনির্মাণের প্রশ্নে এ তরুণ বিপ্লবীরা ভিন্ন কোনো উন্নয়ন মডেল চিন্তা করতে না পারার ফলে সোভিয়েত মডেলটি কিউবার জন্য বেছে নেবার সিদ্ধান্ত নেন। এতে যে কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেনি সে পার্টির সঙ্গে কাস্ত্রো এবং চের 'ছব্বিশে জুলাই আন্দোলন' (the 26th of July Movement) একীভূত হয়ে ১৯৬৫ সালে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। এভাবে কিউবায় একদলীয় শাসন কায়েমের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়।

অনুমান করা হয় যে, সোভিয়েত তাত্ত্বিকরা কমিউনিস্ট পার্টিকে বিপ্লবীদের সংগঠন, যা 'ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলন' নামে পরিচিত ছিল তার সঙ্গে একীভূত হবার পরামর্শ দেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টিকে চাপ দিয়ে কাস্ত্রোর সংগঠনের সঙ্গে একীভূত করে। ফলে কাস্ত্রোকে এমন্ একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একীভূত হতে হয় যারা কিনা তাঁর বিপ্লবের বিরোধিতা করেছিল।

উলেখ্য যে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেছিল এর বিপরীত ঘটনা। কাস্ত্রোর সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টিতে বিলুপ্ত হয়ে যাবার ঠিক দশ বছর পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)– অনেকের মতে, সোভিয়েত পরামর্শে– দলীয় পরিচয় বিলুপ্ত করে মণি সিংহ, ফরহাদের নেতৃত্বে বাকশালে যোগদান করেছিল। কিউবা এবং বাংলাদেশ এ দুটি ক্ষেত্রেই সোভিয়েত তাত্বিকেরা মনে করেছিলেন যে, একদলীয় শাসনের মাধ্যমে দেশ দুটিতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

কাস্ত্রো, চে, রাউলসহ তরুণ বিপ্লবীরা নিজেদের স্বতন্ত্র সাংগঠনিক পরিচয় কমিউনিস্ট পার্টিতে বিলুপ্ত করবার পর সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে কিউবায় বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা আসতে থাকে। ফলে বিপ্লবের পর মানব উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত হয়। কিউবার বিপ্লবীরা বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি হাতে নেন। চিকিৎসা সুবিধা জনগণের দোরগোঁড়ায় পৌছে দিয়ে জনগণের গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থের উন্নয়নে অন্যান্য উন্নয়নশীল বিশ্বের তুলনায় অনেক এগিয়ে যায় দেশটি। কিউবার এসব অগ্রগতি অনেকটা তুলনীয় ছিল প্রথম বিশ্বের সঙ্গে।

এরপর কিউবা যে কাজ করে তা হল, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোতে বিপ্লব 'রফতানি'। অর্থাৎ কিউবার বিপ্লবীরা এ সমস্ত দেশে যেয়ে স্থানীয় বিপ্লবীদের সহায়তায় সরকারগুলোর উচ্ছদের লক্ষ্যে গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করত। এমনি এক গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করার প্রচেষ্টাকালীন ১৯৬৭ সালে কিউবান বিপ্লবের দ্বিতীয় নায়ক, আর্জেন্টিনার বিপ্লবী চে গুয়েভারা বলিভিয়ায় মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সরকারের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হতে থাকলেও যে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ কাস্ত্রোর বিপ্লবে সমর্থন দিয়েছিল তা শুধু অধরাই থেকে গেল তা নয়, বরং কাস্ত্রোর মাঝে জনগণ দেখতে পেল সেই বাতিস্তার প্রেতাত্মার পুনর্জন্ম। প্রতিশ্রুত নির্বাচন তো হলই না, নিষিদ্ধ করা হল সমস্ত বিরোধী দল, স্বাধীন গণসংগঠন, এমনকি ট্রেড ইউনিয়ন। সরকারি সংবাদপত্র এবং মিডিয়া ছাড়া আর কোনো গণমাধ্যমের অস্তিত্ব ছিল না। বরং জনগণ যাতে পুঁজিবাদী দুনিয়ার কোনো মিডিয়া, এমনকি চলচ্চিত্রের সঙ্গেও পরিচিত হতে না পারে এমন ব্যবস্থা করা হল। স্বাধীনভাবে ধর্মপালনের অধিকার থাকলেও সে অধিকারও করা হল সীমিত। বিরোধী মতের বহু মানুষ হলেন কারারুদ্ধ।

কিউবার জনগণ অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলেন, যে মানবিক গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাস্ত্রো বাতিস্তা সরকারকে উচ্ছেদ করলেন সেই কাস্ত্রোই সমস্ত বিরোধী মত প্রকাশের স্বাধীনতা স্তব্ধ করে দিলেন। তরুণ বিপ্লবীদের স্বপ্নের কিউবার সঙ্গে বাস্তবের কিউবার মিল আর খুঁজে পাওয়া গেল না কাস্ত্রোর দীর্ঘ একনায়কতান্ত্রিক শাসনে। পুরো কিউবাই যেন পরিণত হল জর্জ অরওয়েলের Animal Farm এ যেখানে সাধারণ মানুষের নিজের জীবনধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগই ছিল না।

কাস্ত্রোর পুরো শাসনকালেই নৌকায় করে দলে দলে মানুষ কিউবার উপকূল থেকে ৯০ মাইল দূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামিতে পাড়ি জমাত। এদের অনেকে রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে, আবার কেউ কেউ অর্থনৈতিক কারণেও এটা করত। এমনকি কাস্ত্রোর বোন জুনিয়াতা কাস্ত্রো, যিনি নিজে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কাস্ত্রোর উপর কমিউনিস্টদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরও অধিক সংখ্যক মানুষ যাতে কিউবা ছেড়ে চলে আসে তার জন্য তাদের প্রলুব্ধ করতে লাগল। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি-জমানো মানুষদের দিয়ে কাস্ত্রোবিরোধী প্রচারণা চালাতে ওরা সব ধরনের সহয়তা দিত।

কাস্ত্রোর শাসনকাল মোটামুটি এভাবেই চলছিল। কিন্তু সমস্যা বাঁধল গত শতাব্দীর নব্বই দশকে। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ব্লক তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে এ সময়। কাস্ত্রো হয়ে পড়েন 'অভিভাবকশূণ্য'। বন্ধ হয়ে গেল বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সাহায্য। কাস্ত্রো যা সারা জীবন চিন্তা করেননি সেই প্রশ্ন– অর্থাৎ তিনি তাঁর স্থাপিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারবেন কিনা– সামনে চলে এল। তিনি জানতেন যে, তিনি নিজেই তাঁর বিপ্লবটি হত্যা করেছেন স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসন কায়েমের মাধ্যমে। যেটা তিনি করে যাচ্ছিলেন সেটা হল, বিপ্লবের নাম ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকা। সমাজতান্ত্রিক বলয় ভেঙে যাবার পর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবেন কিনা কাস্ত্রোকে সে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল।

এ অবস্থায় কাস্ত্রো সেই পথ বেছে নিলেন যেটা তিনি এতদিন পুঁজিবাদী অপসংস্কৃতি বলে প্রত্যাখ্যান করে এসেছিলেন। তিনি পশ্চিমা পর্যটকদের জন্য কিউবা উন্মুক্ত করে দিলেন। ঔপনিবেশিক ধাঁচে এমন কিছু রিসোর্ট নির্মাণ করা হল যেখানে কিউবার জনগণের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। বৈদেশিক মুদ্রার জন্য এমনকি সীমিত আকারে অলিখিতভাবে পতিতাবৃত্তির অনুমতিও দেওয়া হল। শুধু তাই নয়, ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি কমিউনিস্ট বিশ্বে পারিবারিক শাসন কায়েমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, যার তুলনা একমাত্র উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দেওয়া যায়, যেখানে সমাজতন্ত্রের নামে মূলত কায়েম হয়েছে রাজতান্ত্রিক শাসন।

ইতিহাসে কাস্ত্রোর ভূমিকা যারা ইতিবাচকভাবে দেখেন তারা মূলত মানবউন্নয়ন সূচকে কিউবার অগ্রগতির দিকে আলোকপাত করে এটি করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেটি তারা উপেক্ষা করে যান তা হল, শুধু কাস্ত্রোর কিউবাতে নয়, বিভিন্ন একনায়ক, যেমন সিরিয়ার হাফিজ আল আসাদ, লিবিয়ায় মোয়াম্মার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বেও এ সমস্ত দেশে মানবউন্নয়ন সূচকে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল।

অপরদিকে, স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের হাত ধরে আরব-আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন এবং ওমানে জনগণের আর্থসামাজিক প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু ওই সমস্ত দেশের জনগণ রয়েছে কিউবার মতো গণতান্ত্রিক অধিকার এবং মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত।

কাস্ত্রো, চে, রাউল প্রমুখ তরুণ বিপ্লবীরা উন্নত, মানবিক এবং গণতান্ত্রিক কিউবা বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু বিশ্বরাজনীতির জটিল সমীকরণ যে সেই কাস্ত্রোর মাঝে ফুলজেনসিও বাতিস্তার একনায়কতান্ত্রিক প্রেতাত্মার জন্ম দেবে সেটা নিঃসন্দেহে সেদিন ওঁরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।