পাকিস্তানে বিচার বিভাগীয় ক্যু

সাইফুর রহমান তপন
Published : 11 August 2017, 07:33 AM
Updated : 11 August 2017, 07:33 AM

পাকিস্তানে সম্প্রতি যা ঘটে গেল তা সত্যিই বিস্ময়কর ও ভয়ঙ্কর। ২৮ জুলাই সেখানে সুপ্রিম কোর্ট 'অসততা'র দায়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে কলমের এক খোঁচায় ক্ষমতাচ্যুত করেছে। দেশটির সংবিধান অনুসারে সর্বোচ্চ আদালত উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে যে কাউকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে ঘোষণা করতে পারেন; আর এমন অভিযোগ মাথায় নিয়ে কেউ সেখানে সংসদের সদস্যপদ ধারণ করতে পারেন না।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস যেমনটি লিখেছে, যে পানামা পেপার্সের সূত্র ধরে সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজ শরিফকে চিরদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি পদ গ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেছে, সেখানে পুত্রকন্যাদের নাম থাকলেও তাঁর নাম নেই। ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারি পদের অপব্যবহারের কোনো অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে নেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আদালত ওই 'শাস্তি' দেওয়ার আগে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেননি। যা ন্যায়বিচারের চেতনার পরিপন্থী। মোট কথা, নওয়াজ শরিফকে আদালত শাস্তি দিয়েছে যথাযথ বিচারপ্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই।

৩০ জুলাই একটি বাংলা দৈনিক পকিস্তানের জিও নিউজে প্রচারিত সেদেশের একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে নওয়াজ শরিফ দুবাইভিত্তিক একটি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ওই নির্বাচনের মনোয়নয়নপত্রে উক্ত কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত ১০ হাজার দিরহাম বেতনের কথা উল্লেখ করেননি। আদালত একেই অপরাধ হিসেবে দেখিয়ে ওই রায় দিয়েছেন। কিন্তু উক্ত আইনজ্ঞের মতে, প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পদ থেকে অপসারণে এটা কোনো আইনি ভিত্তি হতে পারে না। তিনি বলেন, হিসাবরক্ষণের নীতিমালা অনুসারে উক্ত আয় প্রদর্শন করা বা না-করার অধিকার নওয়াজ শরিফের আছে। তাছাড়া, কারও অপ্রদর্শিত আয়ের কারণে তাঁকে সরকারি পদে অযোগ্য ঘোষণা করার সুযোগ নেই।

উক্ত আইনজ্ঞের সঙ্গে সুর মিলিয়ে পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান ইংরেজি দৈনিক ডনএর সম্পাদকীয়তেও বলা হয়েছে:

"বিশেষজ্ঞ ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মতামত এ রায় নিয়ে পরিষ্কার: নওয়াজ শরিফকে এক অস্পষ্ট ও সংকীর্ণ আইনি ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে এ রায় অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলতে পারে।"

রায়টি পর্যালোচনার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধান বিচারপতির প্রতি আহবান জানানোর পাশাপাশি ডন ওই সম্পাদকীয়তে কয়েকটি প্রশ্নের স্পষ্ট জবাবও প্রত্যাশা করা হয়েছে: আর্থিক লেনদেনের আইনি সংজ্ঞা কী? সংবিধানের ৬২(১)(এফ)এর আওতা কতটুকু এবং ঘোষিত রায়ে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ কি এটা যথাযথভাবে নির্দিষ্ট করতে পেরেছেন? কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্রে অঘোষিত বিষয়ের স্বরূপ কী, যাতে তাঁকে অযোগ্য বলে ঘোষণা করা যেতে পারে?

উল্লেখ্য, উক্ত ৬২(১)(এফ) অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে নওয়াজ শরিফকে অপসারণ করা হয়েছে, যেখানে অসততার স্পষ্ট কোনো সংজ্ঞা ছাড়াই একজন রাজনীতিবিদের জন্য কঠোর ও ব্যাপক শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সামরিক একনায়ক জিয়াউল হকের সময়ে সংবিধানে যুক্ত এ অনুচ্ছেদ ভীষণভাবে বিতর্কিত। আদালত এ অগণতান্ত্রিক বিধান ব্যবহার করে নওয়াজ শরিফকে শাস্তি দেওয়ায় তাঁর কট্টর সমালোচক বলে পরিচিত মানবাধিকার আসমা জাহাঙ্গির পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়েছেন।

এদিকে, মার্কিন বার্তা সংস্থা ব্লুমবার্গ এ পদক্ষেপের মাধ্যমে পাকিস্তানের আদালত দেশটির ভোটারদের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে বলে ব্যঙ্গ করলেও, আমাদের দেশের সুশীলতন্ত্রীদের (যারা গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে এলিটতন্ত্র কায়েম করতে চায়) মুখপাত্র বলে পরিচিত বাংলা দৈনিকটি এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, এ রায়ে নাকি প্রমাণ হয়েছে 'পাকিস্তানের বিচার বিভাগ যথেষ্ট শক্তি-সামর্থ অর্জন করেছে'। শুধু তা-ই নয়, তারা বাংলাদেশের বিচার বিভাগকেও একই রকম 'ক্ষমতাবান' হিসেবে দেখতে চায়।

তাদের এ অতিউৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে তারা চায় আদালতের এই ক্ষমতা আমাদের এখানেও একটা ওলট-পালট ঘটিয়ে দিক, যাকে ব্যবহার করে তারা তাদের ১/১১এর অপূরিত স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে। কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, সম্প্রতি ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ওই মহলের তৎপরতা এরই ইঙ্গিত বহন করছে।

দেশের ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ( যুক্তরাষ্টের ৯/১১এর আদলে যাকে ১/১১ বলা হয়) এখানে ছদ্মবেশি এক সামরিক শাসন জারি হয়েছিল। যার নেপথ্যে ছিল বিশ্বব্যাপী কথিত গণতন্ত্র রপ্তানির সোল এজেন্ট যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশীর্বাদপুষ্ট সুশীল সমাজের পুরোধা ব্যক্তিবর্গ ও তাদের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত গণমাধ্যমগুলো। রাজনীতি বিশুদ্ধকরণের নামে এরা মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে, বিশেষ করে এ রাষ্ট্রের জন্মযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগকে, নির্মূল করতে গিয়ে দেশে এক দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এর বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে ওঠেছিল। যার পরিণামে তৎকালীন সরকার তার সকল এজেন্ডা অপূরিত রেখে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিয়েছিল।

আমাদের দেশের সুশীলতন্ত্রীরা পাকিস্তানের বিচার বিভাগের যে ক্ষমতা নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত তার উৎস নিয়ে কিন্তু সেদেশেই বেশ গুঞ্জন আছে। নওয়াজের মামলাটি রেফার করে সেখানকার প্রায় সব বিশ্লেষক বলছেন, আদালত যে পানামা পেপার্স তদন্তে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, আইএসআইকে যুক্ত করেছিল তার সঙ্গে নওয়াজের মতো একজন জনপ্রিয় ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালতের এতটা সাহসী হয়ে ওঠার সম্পর্ক আছে।

এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেশিরভাগ সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করেছে দেশটির সামরিক বাহিনী, এমনকি নির্বাচিত সরকারের সময়েও এর তেমন একটা ব্যত্যয় ঘটেনি। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে, এ পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো নির্বাচিত সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। আর এ অপকর্ম সাধনে সামরিক বাহিনী বেশিরভাগ সময় দেশটির বিচার বিভাগকে সঙ্গে পেয়েছে।

পাকিস্তানের এই 'ঐতিহ্য'র সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ২০১৩ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে সেনা এস্টাব্লিসমেন্টের টানাপড়েন চলছিল। আর এ টানাপড়েনে সেনাবাহিনী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছিল ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক-বনে-যাওয়া উচ্চাভিলাষী ইমরান খানকে। যে মামলায় নওয়াজকে ক্ষমতা থেকে সরানো হল তার বাদী কিন্তু এই সাবেক প্লেবয়। আরও মজার ব্যাপার হল, ইমরান পাকিস্তানের এক টিভিতে সম্প্রতি সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের যে প্যানেল ওই রায় দিয়েছে তারই একজন সদস্য তাঁকে ওই মামলা দায়ের করতে 'পরামর্শ' দিয়েছিলেন!

এ কথা ঠিক যে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো অসংহত নয়। গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্নে এদেশের জনগণের আত্মদানের ঐতিহ্যও অন্য সব প্রতিবেশির চেয়ে বেশি। তাই এদেশে পাকিস্তানের ঘটনার পুনরাবৃত্তি খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, ১৯৪৭ সাল থেকে প্রায় দুই যুগ আমরা পাকিস্তানের উপনিবেশের মতো ছিলাম। উপরন্তু, ১৯৭৫ সালের নৃশংস আগস্ট-হত্যাকাণ্ডের পর অন্তত ২১ বছর রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে পাকিস্তানকে এক ধরনের মডেল মেনে। সুতরাং বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান এখনও ওই পাকিস্তানি লিগ্যাসি বহন করে চলেছে এমনটা বলা বাতুলতা হবে না।

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, এদেশে যে-কবার সামরিক শাসন এসেছে সে-কবারই বিচার বিভাগ ওই অবৈধ শাসনের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, এমনকি বিচার বিভাগের লোকেরা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পর্যন্ত হয়েছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হল, এ দেশের এলিটদের মাঝে রাজনীতিবিদ, আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে নাকসিঁটকানো মনোভাব প্রবলভাবে বিরাজমান তা থেকে বিচার বিভাগও মুক্ত নয়।

তাই আমাদের দেশে পাকিস্তানের মতো বিচার বিভাগীয় ক্যু ঘটা একেবারেই সম্ভব নয় এমন ভাবনা অতি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তুলনা করা খুব একটা অসঙ্গত হবে না। যে কোনো কাজে আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো, তবে তার সঙ্গে সতর্কতা ও সাবধানতা থাকলে আরও ভালো। কথায় আছে না, সাবধানের মার নেই।