নওয়াজ শরীফের অপসারণ বনাম বাংলাদেশের অবস্থা

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 16 Nov 2011, 11:02 AM
Updated : 7 August 2017, 05:37 AM

পাকিস্তানের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে বিশ্ববাসী ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখল ২৮ জুলাই। এ দিন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মিঞা নওয়াজ শরীফকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে মেয়াদপূর্ণের ১০ মাস আগে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তবে তিনিই পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নন যাকে কোর্টের রায়ে ক্ষমতা ছাড়তে হল। পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) ইউসুফ রাজা গিলানি দেশটির ইতিহাসের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, আদালতের আদেশে যাকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছিল।

তবে শরীফই পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি তিনবার নির্বাচিত হয়ে একবারও মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। এবারের মেয়াদ নিয়ে তিনি পাকিস্তানের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী যারা কেউ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। অর্থাৎ পাকিস্তানের সত্তর বছরের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রী তাদের মেয়াদ শেষ করেননি। সেনাবাহিনীর চাপসহ নানাবিধ কারণে তাদেরকে ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই বিদায় নিতে হয়েছে।

আগের প্রধানমন্ত্রীদের মেয়াদ শেষ করতে না পারা নিয়ে বাংলাদেশের সিভিল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী মহলে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এবার নওয়াজ শরীফ কোর্ট কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে বাংলাদেশে যারা বিশেষত ডান বা দক্ষিণপন্থার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের মাঝে একটা স্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হয়েছে এ যুক্তিতে যে, একইভাবে বাংলাদেশেও কোর্টের ক্ষমতা প্রয়োগ করে বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাকে অপসারণ করা যায় কিনা এ চিন্তা মাথায় রেখে।

এ চিন্তা যারা করেন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের রাজনীতি এবং রাষ্ট্র কাঠামর মধ্য যে মৌলিক তফাত রয়েছে সে বিষয়টি তাঁরা ভুলে যান। তাদের অনেকেই মনেপ্রাণে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামো এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শ বাংলাদেশে পুনঃস্থাপন করতে চান। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, কোন কাঠামো বা আদর্শের পুনঃস্থাপন তাঁরা চান এবং কেনই-বা তা চান?

যারা দুর্নীতির দায়ে নওয়াজের অপসারণের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছেন তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করেছেন যে, পাকিস্তানের বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অধিকতর স্বাধীন এবং এর ফলে বিচার বিভাগের পক্ষে সরকারপ্রধানকে অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে যে বিষয় তারা দেখাতে চাচ্ছেন তা হল পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়েও অধিকতর গণতান্ত্রিক। কিন্তু বিষয়টা কি আসলেই তাই?

যারা পাকিস্তানকে অধিকতর গণতান্ত্রিক মনে করছেন তারা আসলেই কি বাংলাদেশকে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান? নাকি পাকিস্তানকে গণতন্ত্রের মডেল ধরে তারা একটি বিশেষ গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রকাঠামো এবং রাজনীতিতে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থানে দেখতে চান?

উল্লেখ্য যে, দেশ স্বাধীন হবার পর এতগুলো বছর পার হলেও কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমাদের জনগোষ্ঠীর অনেকেই সুযোগ পেলে খেলা থেকে শুরু করে সব কিছুতে পাকিস্তানকে মডেল রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান। জিন্নাহর যে দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল, আমাদের সমাজে সে তত্ত্বের প্রভাব এখনও কতটা গভীরে এ থেকে এটা প্রতীয়মান হয়। এ তত্ত্বের মূল কথা হল, হিন্দু এবং মুসলমান হল দুটো আলাদা জাতি এবং এর ফলে এ দু ধর্মের মানুষের পক্ষে একই দেশে একসঙ্গে বাস করা সম্ভব নয়। জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি ধর্ম। ফলে হিন্দু এবং মুসলমানের জন্য দরকার দুটো পৃথক রাষ্ট্র।

এ দ্বিজাতি-তত্ত্বের বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা কেন্দ্র করে এ বাংলায় গড়ে উঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এ জাতীয়তাবাদে ধর্মপরিচয়ের উর্ধে উঠে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বসাবাসকারী সকল মানুষকে এক জাতি হিসেবে মনে করা হয়েছিল। বস্তুত এ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই সংগঠিত হয়েছিল ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধ।

কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নানাবিধ ব্যর্থতা এবং দ্বিজাতি- তত্ত্বের আনুসারীদের বিবিধ তৎপরতার ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৭১এ পরাজিত হওয়া দ্বিজাতি-তত্ত্ব নতুন রূপে রাষ্ট্র এবং সমাজে পুনর্বাসিত হয় সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার উদ্ভাবিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণার মধ্য দিয়ে।

৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসক জিয়ার পক্ষে সরাসরি দ্বিজাতি-তত্ত্ব ভিত্তি করে জিন্নাহর মতো মুসলিম জাতীয়তাবাদের শ্লোগান তোলা সম্ভব ছিল না, তৎকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকবার পরেও। এ বাস্তবতা জিয়া উপলব্ধি করবার ফলেই দ্বিজাতি-তত্ত্বের ধারণা পুনরুজ্জীবন ঘটাবার জন্য জিয়াকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ক্যামোফ্লাজের আশ্রয় নিতে হয়েছিল।

মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলেও মুসলিম জাতীয়তাবাদের ধারণা পাকিস্তানে এগিয়ে নিয়ে যায় সেনাবাহিনী যা পরিণতিতে প্রচলিত ভাষায় যাকে 'ইসলামি মৌলবাদ' বলে, সেই মৌলবাদের রাজনীতির বিকাশ এবং জঙ্গিবাদের রাজনীতির জন্ম দেয়। বাংলাদেশেও সেনাবাহিনীর হাত ধরে দ্বিজাতি-তত্ত্বের ছায়ায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং বিকাশ ঘটে। এ জাতীয়তাবাদ পাকিস্তানের মতো ইসলামপন্থার এবং জঙ্গিবাদের রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করে।

সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ ইসলামপন্থা এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি যারা করেন তাদের মনে এ ধারণা জন্মেছিল যে, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল না আসায় আওয়ামী লীগও বোধহয় বিএনপির মতো পরিণতি লাভ করবে। অর্থাৎ আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হবে। কিন্তু ইসলামপন্থা এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের শীর্ষস্থানীয় দল বিএনপি এবং জামায়াত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে পেট্রোল বোমা-নির্ভর সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়, যা সরকার অতি অল্প সময়ে মধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

অপরদিকে, সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতা করবার সুবিধাজনক অবস্থান বেছে নেয়। ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়ের পরে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশি জাতীয়য়তাবাদ এবং ইসলামপন্থার রাজনীতি অনেকটাই কোনঠাসা অবস্থানে নিপতিত হয়েছে।

এ অবস্থায় পাকিস্তানে নওয়াজ শরীফের অপসারণের মতো ঘটনা যারা বাংলাদেশেও দেখতে চাইছেন তারা আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং উদারনৈতিক সমাজ কাঠাম বিনির্মাণের আগ্রহের চেয়ে যে কোনো মূল্যে বর্তমান সরকারের অপসারণ ঘটিয়ে ১৯৭৫পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যে ধারা শুরু হয়েছিল, সে ধারার প্রত্যাবর্তনেই বেশি আগ্রহী।

১৯৭৫পরবর্তী ধারাটি নতুন কিছু নয়। যে ভাবধারার উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল, সে ভাবধারা ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ১৯৭৫পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মোড়কে। এ ভাবধারা সমাজ এবং রাষ্ট্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সেনাবাহিনী যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, সেহেতু ইসলামপন্থা এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সব জায়গায় সেনাবাহিনীকে আরও অধিকতর ভূমিকায় দেখতে আগ্রহী।

পাকিস্তানে রাষ্ট্র এবং সমাজের সব জায়গায় সেনাবাহিনীর এ অধিকতর ভূমিকা পালনের জন্য প্রখ্যাত পাকিস্তানি বামপন্থী তাত্ত্বিক হামজা আলাভী বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই বিখ্যাত মার্কসবাদী জার্নাল New Left Review (July/August 1972) তে The State in Postcolonial Societies: Pakistan and Bangladesh শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এতে তিনি পাকিস্তানকে overdeveloped state বা 'অতিবর্ধিত রাষ্ট্র' বলেছেন।

এ ধরনের অতিবর্ধিত রাষ্ট্রে দীর্ঘ উপনিবেশিক এবং সেনাশাসনের ফলে রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন বিকশিত হতে পারে না। প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অধিকতর বিকশিত হয়। এর ফলে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যেমন আইন, বিচার, শাসন এসব বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তার বা খবরদারি করতে পারে।

পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা হামজা আলাভীর বক্তব্যের যথার্থতা দেখতে পাই। সেই ১৯৫৮ সাল থেকেই রাষ্ট্র এবং সমাজের সব জায়গায় সেনাবাহিনীর একটা প্রবল উপস্থিতি পাকিস্তানে রয়েছে এমনকি যখন প্রত্যক্ষ সেনাশাসন নেই তখনও। বস্তুত পাকিস্তানের রাজনীতি সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে তারা সবাই জানেন দেশটির রাজনীতির মূল নিয়ামক হল সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনীর অনুমোদন ছাড়া সেখানে কারও পক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের পক্ষেও। পাকিস্তানের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি কীভাবে সেনাবাহিনী বিচার বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে।

বিচার বিভাগের কোনো কোনো বিচারপতি সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে রায় দেবার চেষ্টা করলেও বেশিরভাগ বিচারপতি পাকিস্তানের ইতিহাসে সেনাবাহিনীর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে সেনাবাহিনীর ইচ্ছা অনুযায়ী রায় দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিচারপতি মোহাম্মদ মুনিরের কথা, যার পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়ার রায় পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।

বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, যিনি দেশটির খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব তিনিও সেনা-প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করে আইয়ুব খানের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। আরও বলা যায়, লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মৌলভী মুশতাকের কথা, যিনি আরেক অবৈধ সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের ইচ্ছানুযায়ী ভুট্টোর ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন। এর বিপরীতে দুচার জন সাহসী এবং ব্যতিক্রমী বিচারপতির উদাহরণ থাকলেও সার্বিকভাবে তা পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে সেনাবাহিনীর যে নিরঙ্কুশ প্রভাব তাকে নাকচ করে দেয় না।

উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের সত্তর বছরের ইতিহাসে এ দুচার জন ব্যতিক্রমী বিচারপতির দুজনই ছিলেন বাঙালি। ১৯৬১ সালে বাঙালি বিচারপতি এস এম মোর্শেদ আইয়ুব খানের রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে শুধু যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং বিকাশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাই নয়, সৎ এবং সাহসী হলে বিচারপতিরা যে অবৈধ সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন সে উদাহারণও তিনিই পাকিস্তানের ইতিহাসে তৈরি করেছেন। যদিও পরবর্তীতে আরেক বাঙালি বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী বিচারপতি মোর্শেদের পথ অনুসরণ করে প্রথমে জেনারেল টিক্কা খানকে গভর্নর হিসেবে শপথ করাতে চাননি, কিন্তু পঁচিশে মার্চের গণহত্যার পর ভয় পেয়ে যেয়ে সেনাবাহিনীর কাছে নতি স্বীকার করে শপথ করান।

এর বাইরে বলা যায়, বিচারপতি এম আর কায়ানীর কথা যিনি আইয়ুব খানের সমালোচনা করেছিলেন, অথবা আরও বলা যায় প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীর সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের দ্বন্দ্বের কথা। তবে এ সবই হচ্ছে ব্যতিক্রম, যা কখনও স্বাধীন বিচার বিভাগের উদাহরণ নয়।

নওয়াজ শরীফের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়টি কি কোর্টের স্বাধীন ইচ্ছার প্রতিফলন নাকি সেনাসদর দপ্তরের ইচ্ছার প্রতিফলন তা বলার সময় এখনও আসেনি। ইতোমধ্যে বোমা ফাটিয়েছেন তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির প্রধান ইমরান খান যার নিজের বিরুদ্ধেও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন আদেশদাতা বেঞ্চের নেতৃত্বে থাকা বিচারপতি আসিফ সায়ীদ খোসা স্বয়ং ইমরান খানকে এ মামলা দায়ের করতে বলেছিলেন।

তবে আগামী দিনগুলোতে আরও পরিস্কার হবে যে, এখানে বিচারক নিজে সেনাসদরের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন কিনা। কেননা নওয়াজ শরীফের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হবার বিষয়টি মিলিটারি এস্টাবলিস্টমেন্ট সহজভাবে নিতে পারেনি।

পাকিস্তানের দুর্নীতিবাজ প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ সেনবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ১৯৯৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন। সেনাবাহিনী কোর্ট ব্যবহার করে তাকে গ্রেপ্তার করে ছিনতাই ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় এবং দুর্নীতির দায়ে আজীবন রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করে। পরে সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় কারাদণ্ড থেকে বেঁচে গিয়ে নওয়াজ শরীফ পরিবারের ৪০ সদস্যসহ ১০ বছরের নির্বাসনে যান।

সুচতুর নওয়াজ যিনি কিনা একই সঙ্গে পাকিস্তানের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ২০০৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকে ম্যনেজ করে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে তিনি যখন আবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন তখন সেনাবাহিনীর পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। ফলে অনেকে এটা মনে করতে শুরু করেছেন যে, কোর্টকে ব্যবহার করে সেনাবাহিনীই আসলে নওয়াজকে সরিয়ে দিয়েছে তাদের পছন্দের কাউকে অথবা নিজেরাই ক্ষমতায় আসার জন্য।

পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আদালতে গেলেও তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে দুবাইভিত্তিক একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে থাকার কথা নির্বাচনের হলফনামায় লুকাবার অভিযোগে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হল। দেশটির সংবিধানের ৬২ ও ৬৩ নম্বর ধারা শরীফকে ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্য ব্যবহার করা হয়। সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হক রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে এই দুটি ধারা পাকিস্তানের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট কুখ্যাত সামরিক শাসকের দেখানো পথ ধরেই পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) প্রধান, নওয়াজ শরীফকে বরখাস্ত করল।

পাকিস্তানের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় সেনাশাসন থাকবার ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে একটি সেনা-অনুগত সিভিল সমাজ এবং অনুগত জনগোষ্ঠী যারা রাজনৈতিক দলের চেয়ে সেনা-শাসন পাকিস্তানের জন্য অধিক উপযুক্ত মনে করে। এছাড়া রয়েছে সেনা-অনুগত কিছু রাজনৈতিক দল।

নওয়াজ যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন যেমন ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ইমরান এবং তাঁর দল নওয়াজের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল তেমনি এখন সেনা-অনুগত সিভিল সমাজের কিছু ব্যক্তি বলা শুরু করেছেন এ রায়ের ফলে নওয়াজকে আবার ১৯৯৭ সালের মতো চিরতরে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা যায় কিনা। অর্থাৎ একটা ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে চিরতরে রাজনীতিতে নওয়াজকে নিষিদ্ধ করবার। পাশাপাশি, ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসি এবং ইমরান খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের চেহারা উন্মোচন করা হচ্ছে আর অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনী এবং আইএসআই থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।পাকিস্তানে সেনাবাহিনী এবং আইএসাইএর বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে সবচেয়ে বিপদজনক। তারপরেও কিছু সাহসী গবেষকের গবেষণায় শুধু প্রতিষ্ঠান হিসেবেই নয়, এর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্রও ফুটে উঠেছে, যদিও এ ব্যাপারে বিচার বিভাগ, সিভিল সমাজ, রাজনৈতিক দলসহ সবাই নিরব।

১৯৭১পরবর্তী পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো সামরিক শাসকই আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হননি। পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগসহ সবাই সেখানে সেনাশাসকদের দেখানো পথেই হেঁটেছেন এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে যতটা সম্ভব আপোস করেই ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছেন। যখনই আপোসরফায় বনিবনা হয়নি তখনই সেনাবাহিনী সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ পাকিস্তানে অনেকটা এরদোগান-পূর্ববর্তী তুরস্কের মতো সেনাবাহিনী নিজেদের অলিখিতভাবে Guardian Class হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে, যখনই কোনো বেসামরিক শাসককে তারা পছন্দ করেনি নির্দিধায় তাদের সরিয়ে দিয়েছে। জনগণ এবং সিভিল সমাজের একটা বড় অংশও তাদের এ কাজে সমর্থন জানিয়েছে।

অপরদিকে, বাংলাদেশে সেনাবাহিনী সম্পর্কে বেশিরভাগ জনগণের মাঝে ইতিবাচক ধারণা থাকলেও কিছু ব্যতিক্রম বাদে জনগণের কোনো অংশের কাছেই সেনাশাসন অভিনন্দিত হয়নি। পাকিস্তানে কোনো রাজনৈতিক দলই কোনো সেনাশাসকের বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। সেখানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলন করে জনতা আইয়ুব খানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এ দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে পাকিস্তানে ইয়হিয়া খানের শাসনের অবসান ঘটেছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ সেনাশাসক জিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আরেক সামরিক শাসক এরশাদকে হটাতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিল। শুধু তাই নয়, সামরিক শাসনের উত্তরাধিকার খালেদা জিয়াকেও ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছিল হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফলেই। আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার অনমনীয় ভূমিকার ফলেই ১/১১এর কুশীলবদের নির্বাচন দিয়ে সরে যেতে হয়েছিল। আর এখানেই বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের, আওয়ামী লীগের সঙ্গে মুসলিম লীগের (নওয়াজ) এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে নওয়াজ শরীফের পার্থক্য।

পার্থক্যের আরও বড় দিকটি হল, নওয়াজ সামরিক শাসক কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন আর হাসিনার নেতৃত্বে জনগণ আন্দোলন গড়ে তুলে একাধিক সামরিক এবং বেসামরিক শাসককে তাদের অবৈধ ক্ষমতা থেকে তাড়িয়েছে। ১৯৯৯ সালে নওয়াজ জেনারেল পারভেজ মুশাররফ কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে কোর্ট কর্তৃক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। বর্তমান শাসনামলে ক্ষমতায় থাকবার সময়ও ইমরান খানের নেতৃত্বে তাঁর ব্যাপক দুর্নীতি বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের বেশিরভাগ জনগণ মনে করেন, নওয়াজ একজন দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ। পাকিস্তানে নওয়াজের ইমেজ বিএনপির গত শাসনামলের তারেক জিয়ার যে ইমেজ গড়ে উঠেছিল অনেকটা সেরকম।

এর বিপরীতে শেখ হাসিনার বর্তমান এবং অতীত শাসনামলে তাঁর দলের মন্ত্রী, এমপিসহ তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও ব্যক্তি হাসিনার নামে এখন পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি, এমনকি বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকেও। ১/১১এর কুশীলবরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ক্ষমতায় থেকেও তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। তাঁর দলের অনেকে দুর্নীতি সঙ্গে যুক্ত থাকলেও হাসিনা নিজে দুর্নীতিবাজ এ ধরনের কোনো ধারণা জনগণের ব্যাপক অংশের মাঝে গড়ে উঠেনি।

দুর্নীতিসহ যে কোনো বিষয়ে যখন কোর্ট রায় প্রদান করে তত্ত্বগতভাবে তা 'নিরপেক্ষভাবে' প্রদানের কথা বলা হলেও তাতে মূলত শক্তিশালী পক্ষের ইচ্ছার প্রতিফলন থাকে। বিচারপতি মোর্শেদের মতো শক্তিশালী পক্ষের বিপক্ষে গিয়ে রায় দেওয়ার নজির শুধু বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও খুব কম। বাংলাদেশেও বিচারপতিরা যেমন বি এ সিদ্দিকী, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, আহসানউদ্দিন, আবদুস সাত্তারসহ অন্যরা সামরিক শাসকদের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং শাসকদের কাজের বৈধতা দিয়েছেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চও সামরিক শাসক আইয়ুব খান প্রবর্তিত এবং জিয়াউর রহমান কর্তৃক পুনরায় চালু করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপন করেছে।

বিচার বিভাগের মতো দলমতনির্বিশেষে সিভিল সমাজ এবং রাজনীতিবিদদের একটি অংশও এদেশে সামরিক শাসকদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহয়তা করেছে। এ অংশটি সামরিক শাসকদের দ্বারা বারবার ব্যবহৃত হতে অতিউৎসাহী। এ অংশটি এটা বুঝতে অক্ষম যে, পাকিস্তানে রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপোষ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছে এবং সামরিক শাসকদের অসম্পূর্ণ কাজসমূহ সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে– বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত আওয়ামী লীগ সেনাশাসন উচ্ছেদ করেই ক্ষমতাসীন হয়েছে। এ মৌলিক পার্থক্য সিভিল সমাজ এবং রাজনীতিবিদদের ওই অংশ যতদিন বুঝতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত তারা ১/১১ আবার কবে ফিরে আসবে এ স্বপ্নে বিভোর থাকবে।

Can Pakistan Survive:The Death of a State গ্রন্থের রচয়িতা প্রখ্যাত পাকিস্তানি বামপন্থী লেখক তারিক আলি একটি লেখায় ভিন্ন প্রসঙ্গে উলেখ করেছিলেন বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্র সেনাবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানকে কীভাবে কনডমের মতো ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ প্রয়োজন শেষে ছুঁড়ে ফেলেছে। তারিক আলির এ উপমা ধার করে বলা যায় সামরিক শাসকরাও বাংলাদেশের এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ এবং সিভিল সমাজের প্রতিনিধিদের কনডমের মতো ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলেছেন।

১/১১এর স্বপ্ন-দেখা সিভিল সমাজের প্রতিনিধি এবং রাজনীতিবিদরা এখনও যে বিষয়টা বুঝতে অক্ষম তা হল, একই কনডম দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যায় না– যদি যেত তাহলে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনরা ব্যর্থ হতেন না।