এক এগারোর কুশীলবরা বসে নেই

সাইফুর রহমান তপন
Published : 28 July 2017, 08:00 PM
Updated : 28 July 2017, 08:00 PM

গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন তাঁর 'জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া' আবারও চালু করেছেন। এটা বোঝা গেল সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবসহ নগরীর কয়েকটি মোড়ে ঝোলানো কিছু প্ল্যাকার্ড দেখে। প্ল্যাকার্ডে জনগণের প্রতি জনজীবনে বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়ে মতপ্রদান এবং ঐক্য প্রক্রিয়ায় সামিল হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্ল্যাকার্ডগুলো দেখে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখা গেল, ড. কামালের এ মৌসুমী প্রকল্পের দ্বিতীয় মেয়াদে আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে গত বছরের ২০ আগস্ট, ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। সেখানে দেওয়া এক লিখিত বক্তব্যে বলা হয়:

"বিরাজমান অনভিপ্রেত অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দরকার দেশপ্রেমিক জনগণের মধ্যে 'বিদ্যমান ঐক্যকে সাংগঠনিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা।…জনগণের মধ্যে জাতীয় মৌলিক বিষয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, বিচার-বিশ্লেষণ তথা সংলাপ অনুষ্ঠিত হওয়া ও পরিস্থিতি উত্তরণে করণীয় নির্ধারণ করা।"

সম্ভবত এর ফলো-আপ হিসেবেই ওই প্ল্যাকার্ডগুলো ঝোলানো হয়েছে।

কিন্তু সত্যি বলতে কী, ইউরোপ-আমেরিকাকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের আশীর্বাদপুষ্ট আইনজীবীর এ উদ্যোগ দেখে আমাদের মধ্যে বেশ শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর কারণ হল, ড. কামাল এর আগে জাতীয় ঐক্যের দই খাওয়ানোর নামে এক এগারোর চুন খাইয়ে আমাদের মুখ পুড়িয়েছেন।

২০০৫ সাল। ড. কামাল এবারের মতোই জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেন। এর অংশ হিসেবে তিনি 'জাতীয় ঐক্য মঞ্চ' নামে একটি প্লাটফরম গঠন করলেন। এ মঞ্চের সদস্য ছিল কিছু ডান-বাম রাজনৈতিক দল এবং সুলতানা কামালের মতো সুশীল সমাজের পুরোধা বলে পরিচিত বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীর 'বিকল্প ধারা' ও কাদের সিদ্দিকীর 'কৃষক শ্রমিক জনতা দল' এর সদস্যপদ না নিলেও ড. কামালের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

উদার গণতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত এ মানুষদের তখনও এক ধরনের আবেদন ছিল। তাই শিক্ষিত সমাজের একটা অংশের মধ্যে বিশেষ করে যাদের আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সঙ্গে নিবিড় কোনো সম্পর্ক ছিল না তাদের মনে এ উদ্যোগ নিয়ে ক্ষীণ হলেও একটা আশাবাদ তৈরি হল।

কিন্তু ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে যখন ছদ্মবেশী সামরিক শাসন জারি হল, ওই মঞ্চের সদস্য ও সমর্থকদের সবাইকে দেখা গেল সমর্থন যোগাতে। ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন ওই সরকার রাজনীতিকে শুদ্ধ করার নামে যে 'মাইনাস-টু ফর্মুলা' বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল, তাদেরকে এর পক্ষে ইনিয়ে-বিনিয়ে যুক্তি উপস্থাপন করতে দেখা গেল।

শুধু তা-ই নয়, গোটা জাতি যখন দ্রুত নির্বাচন দিয়ে সরে দাঁড়াতে ওই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছিল তখনও ড. কামাল ও তাঁর অনুসারীরা গণমাধ্যমে যুক্তি দেখাচ্ছিলেন এই বলে যে, নির্বাচন নামক খেলাটি 'ফেয়ার' করতে হলে সেটি 'ডোপমুক্ত' করতে হবে– সরকার এ কাজটিই করছে– আর এ জন্য সরকারকে যথেষ্ট সময় দেওয়া প্রয়োজন।

১/১১এর সরকার হিসেবে পরিচিত ওই অবৈধ সরকার ক্ষমতা দখল করেছিল একটা ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে। ওই বছরের ২৭ জানুয়ারি নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল 'বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ' তা বর্জনের ঘোষণা দেয়। সঙ্গতভাবেই তারা অভিযোগ তুলেছিল ওই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। কারণ তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-সমর্থক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যা আবার গঠিত হয়েছিল অনেকটা জালিয়াতির মাধ্যমে।

এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। আর এর সুযোগ নিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ইয়াজউদ্দিনকে সরিয়ে ফখরুদ্দিন সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেন। যাকে সমর্থন যোগান সুশীল সমাজ নামধারী পশ্চিমা অনুদাননির্ভর একদল এনজিওপতি ও তাদের পোষ্যরা।

এবারের জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগও তিনি এমন এক সময় নিয়েছেন যখন একাদশ সংসদ নির্বাচনকেন্ত্রিক তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। উপরন্তু এ নির্বাচন কেন্দ্র করেও রাজনীতির জল ঘোলা করার চেষ্টা নানা মহল থেকে হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। অনেকে এ ব্যাপারে ড. কামালের দিকেও আঙুল তুলছেন। তাঁর বিরুদ্ধে যারা এ অভিযোগ করছেন তারা সম্প্রতি আপিল বিভাগ কর্তৃক বাতিলকৃত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী-সংক্রান্ত শুনানির সময়ে এমিকাস কিউরি হিসেবে আদালতে ড. কামালের ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত করছেন।

ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ-সংক্রান্ত ১৯৭২ সালের বিধানটি পুনরায় সংবিধানে সংযোজিত হয়। এ বিধান সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান হিসেবে ড. কামাল নিজে মূল সংবিধানে যুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ক্ষেত্রে যাঁরা সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে ড. কামাল অন্যতম। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ সংশোধনী বাতিলের রায় কেন্দ্র করে সংসদ ও বিচার বিভাগ পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেতে পারে। যা রাজনৈতিক সংকট তৈরি করবে। আর এ থেকে ফায়দা লুটতে পারেন যাঁরা তথাকথিত 'দ্বিদলীয় বৃত্ত' ভাঙার নামে দেশকে একটা 'অরাজনৈতিক' শাসনের অধীনে নিতে চান তাঁরা।

এখানে এ কথা উল্লেখ করা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ১/১১এর পরপর যে পত্রিকার সম্পাদক ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেছিলেন 'এ সরকারকে আমরাই এনেছি', সেই পত্রিকা এখনও সুযোগ পেলেই পাঠকদের বোঝানোর চেষ্টা করে যে, কথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত ওই সরকার বর্তমান সরকারের চেয়ে কত ভালো ছিল।

খুব বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই, অতিসাম্প্রতিক একটা ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। কিছুদিন আগে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম যখন ৪৮ টাকা হল তখন পত্রিকাটি লিখল যে, ফখরুদ্দিন সরকারের সময়ে এর দাম ছিল ৪০ টাকা।

আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি, কিন্তু সব কিছু বদলে দেওয়ার শ্লোগানের ধারক পত্রিকাটি ওই তুলনার মাধ্যমে ১/১১এর অরাজনৈতিক সরকারকেই বর্তমান সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখাতে চাইল। ১/১১এর সমর্থক কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীকে ২০১৪ সালের আগে বিভিন্ন টকশোতে এমনও বলতে শোনা গেছে যে, আওয়ামী লীগ বাতিল করলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবারও আসবে এবং তা আসবে এক বা দুই বছরের জন্য নয়, অন্তত ১০ বছরের জন্য।

যাহোক, ড. কামাল কিন্তু বিকল্প ধারার সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরী এবং সাত ঘাটের জল খাওয়া মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সঙ্গে নিয়ে ২০১২ সালের অক্টোবরেও জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি এমন সব লোককে নিয়ে এ ঐক্য গড়ার কাজ করছিলেন যারা তখন একদিকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, আরেকদিকে সংবিধানে তত্ত্ববধায়ক সরকারের বিধান পুনর্বহালের দাবিতে বিএনপির 'আন্দোলনে' ইন্ধন যোগাচ্ছিলেন।

সরকারের অভিযোগ ও মার্কিন গণমাধ্যমের খবর অনুসারে ড. ইউনূস তখন গ্রামীণ ব্যাংকে তাঁর পুরনো কর্তৃৃত্ব ফিরে পেতে ওবামা প্রশাসনকে দিয়ে সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন এতটাই টালমাটাল হয়ে ওঠে যে, দশম সংসদ নির্বাচন (যা শেষ পর্যন্ত সরকারের দৃঢ়তার কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়) অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

দেখা যাচ্ছে ড. কামাল তখনই তাঁর জাতীয় ঐক্য প্রকল্প নিয়ে তৎপর হন যখন দেশে একটা জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসে এবং সেই নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে দেশের দুই প্রধান দলের মধ্যে মতবিরোধ বাড়তে থাকে। এ থেকে কি আমরা এ মন্তব্য করতে পারি না যে, ড. কামালের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য যতটা না জনগণকে একটা বিকল্প রাজনীতি উপহার দেওয়া তার চেয়েও বেশি ১/১১ টাইপের একটা পরিস্থিতি তৈরি করে তা থেকে ফায়দা লোটা?

এ প্রশ্নের উত্তর যা-ই হোক, ড. কামালের সঙ্গী-সাথীরা কিন্তু বসে নেই। এ প্রসঙ্গে জাসদ (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রবের উত্তরার বাসায় সম্প্রতি ঈদ পুনর্মিলনীর আড়ালে যে সভা হয়ে গেল সেটির কথা বলা যায়। ওই বৈঠকে ড. কামালের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি 'অন্য ব্যস্ততার কারণে' যেতে পারেননি। তবে তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। গণমাধ্যমের খবর অনুসারে সেখানে আর যারা ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, বি চৌধুরী, তাঁর ছেলে মাহী বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না, রাজনৈতিক এনজিও 'সুজন'এর মালিক বদিউল আলম মজুমদার ও বাসদের খালেকুজ্জামান।

১/১১এর সময়ে বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী, মান্না ও বদিউল আলম মজুমদারদের কী ভূমিকা ছিল, সে সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। ওই বৈঠকের আয়োজক আ স ম রব একাত্তরে 'চার খলিফার একজন' বলে খ্যাত হলেও পরবর্তী ৪৬ বছরের বেশিরভাগ সময়ে রাজনীতির নামে কী কী অপকর্ম করেছেন, তা-ও সবার জানা।

খালেকুজ্জামান এক সময়ের কঠিন বাম হলেও অন্তত ২০০৪ সাল থেকে ড. কামালকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে যাচ্ছেন। তিনি দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর বিরোধিতার আশঙ্কায় ড. কামালের জাতীয় ঐক্য মঞ্চের সদস্যপদ না নিলেও ওই প্লাটফরমের ঘোষণাপত্র তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এমনকি ওই ঘোষণাপত্রের কয়েক হাজার কপি সেই সময় কয়েকটি জেলার বাসদ কর্মীরা বিক্রিও করেছিল, যদিও কামাল সাহেব তা বিনা পয়সায় বিলির জন্য ছাপিয়েছিলেন। ড. কামাল অনুসৃত তথাকথিত 'দ্বিদলীয় বৃত্ত' ভাঙার কৌশল বা অপকৌশলে তাঁর আস্থা এতটাই প্রবল যে, ২০১২ সালে ড. কামাল যখন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে আবারও মাঠে নামলেন তখন তিনি তাতে সিপিবিকেও নিয়ে আসেন। যদিও সিপিবি এক সময় অন্য অনেক বামপন্থী দলের মতো ড. কামালকে 'সিআইএর দালাল' বলে আখ্যা দিত। আর এ করতে গিয়ে ২০১৩ সালে তিনি তাঁর দলকেও ভাঙনের দিকে ঠেলে দেন।

এ কথা ঠিক যে জনগণের ওপর ড. কামাল ও তাঁর সহযোগীদের প্রভাব তেমন একটা নেই। এদের ওপর মিডিয়ার আলো না থাকলে এদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এটাও ঠিক যে, যারা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করেন তারা জনসমর্থনের জন্য বসে থাকেন না, সুযোগ পেলেই লক্ষ্যপূরণে লিপ্ত হয়ে পড়েন। নজরদারিতে না থাকলে তারা যে কোনো সময় একটা অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারেন।

সেদিক থেকে আ স ম রবের বাড়ির বৈঠক নিয়ে পুলিশের আচরণ একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও একেবারে অপ্রয়োজনীয় নয়।