সিদ্দিকুরের চোখ

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 25 July 2017, 01:42 PM
Updated : 25 July 2017, 01:42 PM

পুলিশের ছোড়া টিয়ার গ্যাসের শেলের আঘাতে দুই চোখই হারাতে বসেছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান। একটি চোখে তিনি কিছুই দেখতে পারছেন না, আরেক চোখেও চলছে আলো-আঁধারির খেলা। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।

কী হবে সিদ্দিক যদি তাঁর দৃষ্টি ফিরে না পান? তাঁর গরিব মা ও ভাইয়ের যে তাঁকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন। সিদ্দিক লেখাপড়া শেষ করে ভাইয়ের পাশে দাঁড়াবেন, সংসারের হাল ধরবেন, মায়ের দুঃখমোচন করবেন। একেবারে ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন সিদ্দিক; বড় হয়েছেন দুঃখ-বেদনা সাথী করে।

তাঁর এইটুকু জীবনে দুই চোখে তিনি অনেককিছু দেখেছেন। দেখেছেন আনন্দের ছবি, দেখেছেন কষ্টের ছবি। নিজেদের দিন কাটছিল কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে। কিন্তু দুই চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল দিন বদলের। দিন তো আর চিরদিন সবার এক রকম যায় না। কিন্তু হায়! এ কী হল তাঁর? তাঁর জীবনে নেমে এল এ কোন ঘোর অন্ধকার! সংসারের আনন্দ আয়োজনের জন্য তাঁর আকুলতা এভাবে তছনছ হয়ে যাবে সেটা যে ছিল তাঁর ভাবনার বাইরে।

গত ২০ জুলাই সিদ্দিকুর রহমান কলেজের সহপাঠীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। এসেছিলেন একটি কর্মসূচিতে অংশ নিতে। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি ছিল না, ছিল না কোনো ছাত্রসংগঠনের কর্মসূচি, ছিল একেবারেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি নির্দোষ অ্যাকাডেমিক কর্মসূচি। তাও পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন নয়, রুটিনসহ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবিতে শিক্ষার্থীদের শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি। ঠিক সময়ে পরীক্ষা দিয়ে তাড়াতাড়ি শিক্ষাজীবন শেষ করে একটি চাকরি জোটানো যে তাঁর খুব জরুরি।

এই নির্দোষ আন্দোলনে এসে পুলিশি হিংস্রতায় চোখ হারাতে হবে– এটা কোনো হিসাবেই ছিল না, অথচ হয়েছে তা-ই।

রাজধানীর সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী এই কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করা হয়েছে। কলেজ সাতটি হল: ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ এবং তিতুমীর কলেজ।

এই কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হলে শিক্ষার মান উন্নত হবে, এই ছিল আশা। কিন্তু হল তার উল্টো। এই কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চলে যাওয়ায় দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শুরু হয় ঠাণ্ডা লড়াই। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপাচার্যের মধ্যে আগে থেকেই রেষারেষি আছে। এগুলো গোপন নয়, প্রকাশ্য।

শিক্ষকদের রাজনীতি ও দলবাজির কথা সুবিদিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুনুর রশিদ দুজনেই আওয়ামী পরিবারের সদস্য। আরেফিন সিদ্দিক ঢাবির প্রথম মেয়াদে উপাচার্য থাকাকালে ড. হারুন উপ-উপাচার্য ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করেন। কোনো নীতি-আদর্শগত কারণে নয়, ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বই ওই পদত্যাগের কারণ ছিল বলে জানা যায়। পরে তাঁকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হয়। কিন্তু তাতেও দুজনের দ্বন্দ্বের অবসান হয়নি।

পদ, মর্যাদা, ক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে দুজনের বিরোধ সংশ্লিষ্ট কারো কাছেই অজানা নয়। দুজনকে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বসানো হলেও দুজনের মধ্যে দূরত্ব কমেনি। সর্বশেষ ঢাকার সাত কলেজ অধিভুক্ত করা নিয়ে দ্বন্দ্ব আরও বেড়েছে। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের টানাটানিতে সাত কলেজের শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। নিয়মিত পরীক্ষা না হওয়ায় সেশনজট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থার অবসানের জন্য, নিজেদের শিক্ষাজীবনের অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য ছাত্রদের আন্দোলন করার নৈতিক অধিকার আছে।

এখন শোনা যাচ্ছে ১৮ জুলাই ঢাবির উপাচার্যের সঙ্গে সাত কলেজের অধ্যক্ষদের বৈঠক হয় এবং সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষার তারিখ ঠিক করা হয়। কিন্তু কোনো এক রহস্যজনক কারণে এই সিদ্ধান্তের কথা গোপন রাখায় শিক্ষার্থীরা ২০ জুলাই শাহবাগে অবস্থানের কর্মসূচি পালন করতে সমবেত হয় এবং সেখানেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় চোখে আঘাত পান সি্দ্দিকুর রহমান।

প্রশ্ন হল, পরীক্ষার তারিখ ঠিক হওয়ার বিষয়টি গোপন রাখা হল কেন? শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই ২০ জুলাই সকালে সিদ্ধান্ত নিয়ে শাহবাগ আসেনি। এ সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়ছিল। কলেজ কর্তৃপক্ষের সেটা না জানার কথা নয়। শিক্ষার্থীরা যদি জানত যে তাদের পরীক্ষার সময়সূচি ঠিক হয়েছে, তাহলে তো তারা শাহবাগে নাও আসতে পারত। এমন কথা কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যে বিএনপি-জামায়াত ছাত্রদের রাস্তায় নামতে প্ররোচিত করেছে। যদি সেটা তারা করেও থাকে তাতে আমি কোনো অন্যায় দেখছি না।

মূল প্রশ্ন হল, ছাত্রদের আন্দোলনে ঠেলে দিল কে বা কারা? শিক্ষার্থীরা কি 'নগ্ন' শিক্ষক রাজনীতির বলির পাঠা হয়েছে? ১৮ জুলাই ঢাবির ভিসির সঙ্গে বৈঠকে পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত কেন ছাত্ররা সেদিনই জানল না? এখন বিএনপি-জামায়াতকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

আগুন জ্বলতে দেখলে সেখানে আলু পোড়ানোর সাধ যে কারো হতে পারে। সরকার সমর্থকদের দলাদলি, এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দলাদলি যে কী দুঃখজনক পরিণতির দিকে যেতে পারে সিদ্দিকুরের চোখের আলো চলে যাওয়া তার একটি বড় প্রমাণ। চোখ হারিয়ে সিদ্দিকুর যে ক্ষতির সম্মুখীন হলেন, তাঁর পরিবারে যে ঘন অন্ধকার নেমে আসছে তা দূর করার দায়িত্ব কে নেবে?

কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু পুলিশের টিয়ার শেলে তাঁর এই অবস্থা হয়েছে, সেহেতু পুলিশকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আবার কেউ বলছেন, এ দায় সরকারের। এই দুই মতের বিরোধিতা না করে, আমি মনে করি, ঢাকা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও সিদ্দিকুরের দায় নিতে হবে। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের রশি টানাটানি সিদ্দিকুরের আজকের পরিণতির জন্য কম দায়ী নয়।

এবার আসা যাক পুলিশের আচরণ প্রসঙ্গে। আমাদের পুলিশ একটি ভালো কাজ করলে দুটি খারাপ কাজ করে। আমাদের দেশে সব সরকারের আমলেই পুলিশনির্ভরতা ব্যাতিক্রমহীনভাবেই চলে আসছে। দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহারের ফলে পুলিশ কখনও কখনও নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়ে। আমাদের পুলিশ সম্পর্কে এখনই এমন ঢালাও মন্তব্য করব না। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ যে বাড়াবাড়ি আচরণ করে সেটাও অস্বীকার করব না। এখানে পুলিশ বলতে আমি অবশ্যই পুরো বাহিনীকে বোঝাচ্ছি না, বাহিনীর কতিপয় সদস্যের কথা বলছি। এই কতিপয় সদস্যই আবার পুরো বাহিনীর সুনামহানি করেন। সরকারও এদের জন্য বিব্রত হয়।

দোষ বা দুষ্কর্ম করে পুলিশের জনাকয়েক সদস্য আর বদনাম হয় সরকারের। তাই সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থেই সরকারের উচিত পুলিশের লাগাম টেনে ধরা। আবার পুলিশ কর্তৃপক্ষেরও উচিত হবে নিজেদের সদস্যদের সদাচার শিক্ষা দেওয়া। বিপদে-আপদে মানুষকে পুলিশের কাছেই যেতে হয়। অথচ পুলিশ নিয়ে মানুষের রয়েছে ভীতির মনোভাব। একটু সচেষ্ট হলেই এই অবস্থা দূর করা সম্ভব।

আজকাল সভা-সমাবেশ দেখলেই মনে হয় পুলিশের হাত নিশপিশ করে। এটা কি সরকারের নির্দেশে? সরকার কি পুলিশকে এই নির্দেশ দিয়েছে যে বাংলাদেশে আর কোনো সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করা যাবে না?

যারা সমাবেশ বা মিছিল করবে তারাই সরকারের শত্রু– এই মনোভাব তো ভয়ংকর। সরকারকে যারা অগণতান্ত্রিক উপায়ে উৎখাত বা হটাতে চায় তাদের প্রতি যে আচরণ করা হবে, শিক্ষাজীবনের কোনো ন্যায়সঙ্গত সমস্যা সমাধানের জন্য ছাত্ররা যদি কোনো কর্মসূচি পালন করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধেও যদি একই আচরণ করা হয়, তাহলে সেটা কি কোনোভাবে সমর্থন করা যেতে পারে?

রাজধানীর সাতটি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা শাহবাগে জমায়েত হয়ছিল, সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর জন্য নয়। তারপরও পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠল কেন? ছাত্ররা কি এমন কোনো কিছু করেছিল যা শান্তিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল? ছাত্ররা জান-মালের জন্য হুমকির মতো কিছু করেছিল কি? তারা কি পুলিশের আঁকা লক্ষ্মণব্যুহ ভেঙে সীতা হরণের মতো কিছু করেছিল?

যদি এসব প্রশ্নের উত্তর 'না' হয়, তাহলে পুলিশ ২০ জুলাই শাহবাগে নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি করেছে। টেয়ার শেল ছোড়ার মতো ঘটনা সেখানে ঘটেছিল বলে গণমাধ্যমে খবর ছাপা হয়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে এখন বলা হচ্ছে, পুলিশের টিয়ার শেল নাকি ছাত্রদের নিক্ষিপ্ত ঢিলে সিদ্দিকুরের চোখে আঘাত লেগেছে, সেটা তদন্ত করে দেখা হবে।

এসব তদন্তের ফলাফল কী হয় তা আমাদের অজানা নয়। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ঘটনাটি যেভাবে 'রহস্যজনক' বলেছেন, তা থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না, কেমন তদন্ত হবে। আমরা আশা করব, আত্মরক্ষার জন্য যেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কোনো অপচেষ্টা না হয়। সিসিটিভি ফুটেজে অভিযুক্ত পুলিশকে শনাক্ত করা সম্ভব। একজন অপরাধীকে বাঁচাতে গিয়ে সমগ্র বাহিনীকে যেন কাঠগড়ায় দাঁড় করানো না হয়।

আমাদের পুলিশকে আরও দক্ষ এবং আরও সংবেদনশীল করে গড়ে তুলতে হবে। কোন সমাবেশে কী আচরণ করতে হবে, কাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে, কাদের প্রতি নমনীয়তা দেখাতে হবে– সেসব বিষয়ে পুলিশকে জানতে হবে, জানাতে হবে। দেশবিরোধী, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আর সাধারণ শিক্ষার্থী অথবা নিরীহ ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে এক ধরনের অ্যাকশন প্রত্যাশিত নয়।

সর্বশেষ খবর: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্দিকুরের আহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, সরকারি খরচে সিদ্দিকুরের চোখের চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাই পাঠানো হবে। এটা ভালো সিদ্ধান্ত। এতে মানুষের ক্ষোভ কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে। সরকারকে সিদ্দিকুরের পরিবারের পাশেও দাঁড়াতে হবে।

সিদ্দিকুরের দুই চোখে আলো ফিরবে কি না, আমরা জানি না। তবে তাঁর হয়ে দেশের ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি চোখ তীক্ষ্ণ নজর রাখবে সরকারের প্রতি, পুলিশ প্রশাসনের প্রতি। এটা মনে না রাখলে বিপদের পর বিপদ আসবে।