বাঙালির দখল সংস্কৃতি ও ব্যতিক্রমী একটি পরিবার

মামুন আল মাহতাব
Published : 23 July 2017, 05:42 AM
Updated : 23 July 2017, 05:42 AM

আওয়ামী লীগ তখন সবেমাত্র দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায়। ইন্টার্নশিপ শেষ করে ঢাকায় এসে বিএমএ নির্বাচনে সেন্ট্রাল কাউন্সিলর হিসেবে মনোনয়ন এবং জয়ের পর আমরা তখন বিএমএর 'তরুণ তুর্কি'। মাঝে মাঝেই ঢাকা শহরের এই হাসপাতাল, সেই হাসপাতালে ঢুঁ দিই; উদ্দেশ্য জনসংযোগ।

এমন ঘোরাঘুরির সুবাদে একদিন হাজির বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলাম। যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন তরতাজা এক যুবক। বক্ষ বিদীর্ণ করে বেরিয়ে গেছে ত্রিশুল সদৃশ একটি ধারালো অস্ত্র্র। কাতরাচ্ছেন যুবক আর ত্রিশুলের হাতল ধরে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন এক বৃদ্ধা, সম্ভবত যুবকের মা।

বক্ষব্যাধি হাসপাতালের এক সহকর্মী জানালেন, এ নতুন কিছু নয়। মাঝে মাঝেই তাঁরা এমন রোগী পান।

চর দখলকে কেন্দ্র করে দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষের শিকার এই যুবক। আর অস্ত্রটিও নতুন কিছু নয়। স্থানীয়রা একে বলে 'টেটা', আর ভদ্রলোকের কাছে এর নাম 'টোটা'। এটি মূলত মাছ শিকারের অস্ত্র। তবে চর দখলকে কেন্দ্র করে মাঝে মাঝেই ডাঙাতেও এর ব্যবহার রয়েছে।

সুদুর চীন দেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ঘরের কাছেই মহাখালীতে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের বারান্দাতে ছড়িয়ে আছে অসাধারণ শিক্ষণীয় কত কী!

লিভার বিশেষজ্ঞ হওয়ায় আমার চেম্বারে মাঝে মাঝেই মান্যগণ্যদের আগমন ঘটে। প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিল ভাই তাঁর চিকিৎসক হিসেবে আমার 'ব্র্যানডিং' করে নিজের প্রতি কতটা সুবিচার করেছিলেন জানি না, তবে আমার পসার নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে গেছেন।

বলছিলাম চেম্বারে মাঝে মাঝেই মান্যগণ্যরা আসেন। আসেন আমলা, আসেন ছোট-বড় রাজনৈতিক নেতাও। চিকিৎসার ফাঁকে ফাঁকে তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে দেশ-দশের সম্বন্ধে আমার জ্ঞান বাড়ে, আর আমি আবার নানা আড্ডায় সেই চেম্বারলব্ধ জ্ঞান জাহির করে বাহবা কুড়াই।

একদিন চেম্বারে বসে একজন আমলার কাছ থেকে জানলাম এক অদ্ভুত তথ্য। বাংলাদেশে যে পরিমান জমি দলিলে রেজিস্ট্রি করা আছে তার পরিমান বাংলাদেশের মূল আয়তনের চেয়ে নাকি বেশি।

এই হচ্ছে আমাদের দখল সংস্কৃতি। কী দখল করি না আমরা? আমাদের দখলে চট্টগ্রামের চাকতাই খাল আর ঢাকার বুড়িগঙ্গা। দখলের সুবাদে তুরাগ এখন আর নদী নয়, খাল। বিদেশ-বিভুঁইয়েও যে আমরা আমাদের দখলের চর্চা অব্যাহত রাখব তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে?

লন্ডনের কথাই ধরুন। সদ্য সেখানে সিরিজ বোমা হামলা হয়েছে। হামলাকারীদের অন্তত দুজন পূর্ব লন্ডনের বাঙালি অধ্যুষিত ইষ্ট লন্ডন মসজিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট– এমন দাবি ব্রিটিশ মিডিয়ার। আর এই যে ইষ্ট লন্ডন মসজিদ, কদিন আগেও এটির পরিচালনায় সামনের দিকে ছিলেন চৌধুরী মইনুদ্দিন, একাত্তরে এ দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত 'কসাই'।

এখন তিনি সে দেশের বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার। ইষ্ট লন্ডন মসজিদের নিয়ন্ত্রনাধীন প্রপার্টি আর 'মুসলিম এইড' নামের একটি ব্রিটিশ এনজিওর মাধ্যমে প্রতিমাসে তার লক্ষাধিক পাউন্ডের আমদানি। আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত হওয়ার পর তিনি এখন কিছুটা নিভৃতে। কিন্তু এখনও নেপথ্যে সক্রিয় নাটের গুরু।

তার বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারকে দফায় দফায় অবহিত করা হয়েছে; এ কাজ করেছে আমাদের সরকার, করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিও।

২০১৫ সালে নির্মূল কমিটির সভাপতি সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির আর সহধর্মিনী ডা. নুজহাত চৌধুরীর অনুগামী হয়ে লন্ডনে গিয়ে সরকার ও বিরোধী দলীয় একাধিক ব্রিটিশ এমপির সঙ্গে দেখা করে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদর দপ্তরে কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করে আর লন্ডনে একাধিক প্রেস কনফারেন্সে আমরা নিজেরাও এ সব কথা তুলে ধরেছিলাম। প্রশ্ন করেছিলাম, 'শুনতে কি পাও?'

সম্ভবত শোনেনি। তবে এবার শুনলেও শুনতে পারে। একটু দেরিতে যদিও, ওদের দিগন্তেও যে এখন দুর্যোগের ঘনঘটা।

এ তো গেল সেকালের কথা। একালের কথা শুনুন। হোলি আর্টিজানে যখন সন্ত্রাসী হামলা, ওই লন্ডন শহরে বসেই আদালত পালিয়ে বেড়ানো আমাদের এক স্বনির্বাসিত রাজনৈতিক নেতা সারা রাত মোবাইলে মধ্যপ্রাচ্য আর পাকিস্তানে যোগাযোগ করে তা কোঅর্ডিনেট করেছেন– এই তথ্য এখন পুরাতন। লন্ডনে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আন্ডারগ্রাউন্ডের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তার একাধিক সহযোগীর বিরুদ্ধে মার্কিন আদালতের রায় কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থেকেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়।

দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও এখন কেউ কেউ দখলের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটাচ্ছে। সে দেশের মৌলবাদের উত্থানে আর সে দেশে বসে সাত সাগর পাড়ের বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রসারে আজ আমাদের দেশের লোকের যে সাফল্য, এই ধারা অব্যাহত থাকলে একদিন তারা আরও বড় কিছু করে দেখাতে পারবে– এ কথা হলফ করে বলা যেতে পারে। এমনও হতে পারে তাদের কেউ না কেউ একদিন হবে সেসব দেশের 'গড ফাদার'।

অনেকের মনে হতেই পারে যে, আমি বোধ করি বাঙালির চরিত্রহননে ব্যস্ত। ব্যাপারটি বরং একেবারেই উল্টো। আমি মনে করি এই যে দখলের সংস্কৃতি, তার জনক ও ধারক অল্প কিছু প্রতিক্রিয়াশীল লোক। এরাই একাত্তরে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ঘাতক, এদের হাতই পঁচাত্তরে রঞ্জিত হয়েছে আমাদের জনকের রক্তে। অথচ আমরা আমাদের লেখায়-বলায়, বারবার জেনে না-জেনে কিংবা বুঝে না-বুঝে তাদের কথাই বলি। তাদের পাপে আমলনামা ভরে যায় পুরো জাতির আর কলঙ্কিত হয় গোটা বাংলাদেশ।

বিশ্বাস করি, বাঙালি যেমন ছিল তেমনই আছে। আমাদের যা কিছু ভালো তা আমরা বলতে ভুলে গেছি, আর তাই খারাপটাই চোখে লাগে বড় হয়ে।

এবারে তাই বাঙালির ব্রিটেন দখলের আরেকটি দৃশ্যপটের কথা বলব যা একেবারেই ব্যতিক্রম। সদ্যসমাপ্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে তিনটি আসন দখল করেছেন আমাদের 'তিন কন্যা'। গতবারেও তাই ছিল, তবে এবারে তাঁদের দখলের মাত্রাটা আরেকটু বেশি। ভোট বেড়েছে প্রত্যেকেরই। বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিকী এমপি গতবারের চেয়ে এবার ১০ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। তাঁর উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত হয়েছি আমরা আর ভেসেছি বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে। টিউলিপ সিদ্দিকী এমপি গর্বিত করেছেন জাতিকে আর জাতির পিতাকে।

কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবেছি টিউলিপ সিদ্দিকীর ব্রিটেনে এমপি হওয়ার প্রেক্ষাপট কী? তিনি তো ব্রিটেনে না হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়ারও এমপি হতে পারতেন। থাকতে পারতেন আমাদের জাতীয় সংসদেও। জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭৫ সালে।

ক্ষমতার জবরদখলের কুৎসিত সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় জাতির পিতার সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর জীবিত দুই উত্তরসূরি দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সহযোগিতা ছিল সামান্যই। বরং ছিল রাষ্ট্রীয় আর আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতায় নিপীড়ন। এমন প্রতিকূল বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা একদিন থিতু হয়েছিলেন লন্ডন শহরে। বিয়েও হয়েছিল তাঁর ওই শহরেই বঙ্গবন্ধুর অকাল প্রয়াণের পর। একমাত্র বোন শেখ হাসিনার সুযোগ হয়নি সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার।

সময়ের স্রোতে একসময় শেখ রেহানার কোলে আসেন টিউলিপ সিদ্দিকী, ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেন লন্ডনে আর একদিন ওয়েস্ট মিনস্টার দখল।

বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা যেমন করে জিতে নিয়েছেন কোটি বাঙালির হৃদয়, টিউলিপ সিদ্দিকী এমপিও একইভাবে জিতে নিয়েছেন তাঁর নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের হৃদয়। তাই তো তিনি প্রথমবার নির্বাচিত হয়েই লেবারের ছায়া মন্ত্রিসভার সদস্য। আবার সেই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যগেও এক মুহূর্ত দ্বিধা করেননি নিজ নির্বাচনী এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। তাই তো মধ্যবর্তী নির্বাচনে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে শতগুণ। এই নির্বাচনে বেড়েছে লেবারের জনপ্রিয়তাও। কিন্তু তা যদি ব্যক্তি টিউলিপ সিদ্দিকী এমপির জনপ্রিয়তার ধারেকাছেও হত তাহলে আমরা অবশ্যই এবার ওয়েস্ট মিনস্টারে টোরি নয়, লেবারের সরকারই পেতাম।

শুধু কি টিউলিপ সিদ্দিকী এমপি? তাঁর ছোট বোন রূপন্তী। ২০১৫ সালে ঈদের দুদিন আগে সন্ধ্যায় অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম শেখ রেহানা আপার লন্ডনের বাসায়। কথায় কথায় ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১১টা। হঠাৎ চিন্তিত আপা, আমরা কীভাবে ফিরে যাব? নুজহাত বলল, "আমরা তো একটা সময় লন্ডনে ছিলাম। ঠিক ঠিক ফিরে যাব।"

আপা রাজি হননি। রূপন্তী অত রাতে গাড়ি চালাচ্ছেন আর পিছনের সিটে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভাবছি: 'বঙ্গবন্ধুর নাতনি আমাদের নিজে গাড়ি চালিয়ে ড্রপ দিচ্ছেন, এ তো স্বপ্নেরও অতীত।'

আর গাড়িটাও অত্যন্ত সাদামাটা, সম্ভবত একটা সুজুকি ইকোনোমি কার। কী বিনয়ী একটি পরিবার!

গত নভেম্বরে ছোট আপার হঠাৎ দাওয়াত গণভবনে। উপলক্ষ রেদওয়ান সিদ্দিকী ববির একমাত্র মেয়ের জন্মদিন পালন। একটু ভয় ভয়ই লাগছিল। আমার ছেলে সূর্য অনেকটা 'থোড়াই কেয়ার' ধরনের। কখন কী করে বসে! সূর্যর বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে মিশে যেতে সময় লাগেনি। ওর বরং আড়ষ্ঠতা সাকিব-তামিমদের সঙ্গে সেলফি তোলায়। বড় আপা ওর কাঁধে হাত রেখে ছবি তুলছেন। আর ববি নিজে থেকেই সেলফি তুলতে দাঁড়িয়ে গেলেন, আর সময় নিয়ে দেখলেনও ছবিগুলো ঠিকঠাক উঠেছে কি না।

সূর্য আর রেদওয়ান সিদ্দিকী ববির মেয়ে কাছাকাছি স্কুলে পড়ে। নুজহাত মাঝেমধ্যে সময় পেলে সূর্যকে স্কুলে নামিয়ে যায়। হয়তো বা ববিও তাই। কখনও কখনও ওদের দেখা হয়ে যায়। নুজহাতের কাছে শুনেছি, ববি একাধিকবার নিরাপত্তার বেষ্টনী এড়িয়ে নিজ থেকে এসে ওর সঙ্গে কথা বলেছেন। জাতির পিতার রক্ত যাদের ধমনীতে ধাবমান, যাদের সামান্য ইশারায় সূর্য সানন্দে এই ভূখণ্ডে উত্তর দিকে উদিত হয়ে দক্ষিণ দিকে অস্ত যাবে, তাঁরা এতটা বিনয়ী! ভাবাই যায় না!

আমার পরম সৌভাগ্য আমি শেখ রেহানা আপাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। সুযোগ হয়েছে লন্ডনে তাঁর বাসায় যাওয়ার, তাঁর আটপৌরে বাঙালি জীবন দেখার। সুযোগ হয়েছে ঈদের আগে একজন 'বাঙালি মায়ের' অতিথি আপ্যায়নের ব্যস্ততা দেখার। দেখেছি নাতি-নাতনি নিয়ে তাঁর সে কী উচ্ছ্বাস আর তাঁর সাধাসিধে ড্রইংরুমে বসে নির্বাক হয়ে তাঁর মুখে শুনেছি পঁচাত্তর-পরবর্তী দুঃষহ দিনগুলোর স্মৃতিচারণ।

আমার ফেসবুকে ছোট আপার সঙ্গে আমাদের পরিবারের ছবি দেখে আর্মেনিয়ার লিভার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর হাসমিক উলান বাটারে জানতে চাইছিলেন: উনি আমাদের কী রকম আত্মীয়?

কী করে বলি উনি আমাদের কী হন? রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় নন, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু।

এমন পরিবারের সাহচর্য্য মানুষকে বদলে দিতে বাধ্য। শুধু ভাবি নিরাপত্তার এই অনিবার্যতা যদি না থাকত, সৌভাগ্য হত যদি প্রতিটি বাঙালির এই পরিবারটিকে আরেকটু কাছ থেকে দেখার, এ দেশের ভবিষ্যৎটা বদলে দিতে আমাদের সম্ভবত ২০৪১ সালের অপেক্ষায় থাকতে হত না!

উলান বাটার থেকে ঢাকায় ফেরার পথে বেইজিং বিমানবন্দরে বসে এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন কেন যেন চোখ একটু ভিজে আসছে। ধন্যবাদ ছোট আপা! ধন্যবাদ আপনার সন্তানদের। আপনাদের মাঝেই আমরা দেখি 'আগামীর' বাংলাদেশ।