উচিত শিক্ষা-৫: সিলেবাসে কী থাকা উচিত?

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 21 July 2017, 04:59 AM
Updated : 21 July 2017, 04:59 AM

নিউটন নাকি বলেছিলেন, তিনি সারা জীবন জ্ঞানসমুদ্রের উপকূলে নুড়িপাথর কুড়িয়েছেন। সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা যদি করতেই হয়, তবে সেই সমুদ্রটি হবে অজ্ঞানতার, যার উপকূলে জ্ঞানের দুয়েকটি নুড়িপাথর কুড়ানো অসম্ভব নাও হতে পারে। গড় বাঙালি যে এই নুড়িপাথর কুড়াতে খুব বেশি আগ্রহী নয়, তার প্রমাণ: 'জানতে জানতে জানোয়ার' অথবা 'জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই' ইত্যাদি অর্বাচীন ও জনপ্রিয় বাংলা প্রবাদ।

অজ্ঞান সমুদ্রের উপকূলে আছড়ে পড়া জ্ঞানের ক্রমবর্ধমান নুড়িগুলোর মধ্যে কোন নুড়িগুলো নেহায়েত না কুড়ালেই নয়? মধ্যযুগ থেকে নুড়ি কুড়ানোর ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক।

মধ্যযুগে ইউরোপের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সিংহভাগ জুড়ে থাকত ধর্মীয় শিক্ষা। একমাত্র পাঠ্যবই ছিল বাইবেল। ফরাসি দার্শনিক রাবলে (১৪৮৩-১৫৫৩) একান্তভাবে ধর্মভিত্তিক এই 'মধ্যযুগীয়' শিক্ষার সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, গ্রিক, লাতিন, হিব্রু, (ব্যাবিলনের ভাষা) কালডিয়ান, আরবি এবং সমসাময়িক ভাষাগুলোসহ কমপক্ষে সাতটি ভাষা শিখতেই হবে।

'গ্রিক যে জানে না সে কিসের জ্ঞানী?' মুক্তকলা, জ্যামিতি, অংক, সংগীত, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যামিতি, আইন ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ছাড়াও শেখাতে হবে অস্ত্রবিদ্যা, অশ্বচালনা, ব্যায়াম ইত্যাদি। শিক্ষার্থীর শরীর ও মনন দুই-ই যেন সুগঠিত হয়। তবে জ্যোতিষশাস্ত্র এবং আলকেমির মতো 'ভুয়া বিষয়' শিখতে রাবলে শিক্ষার্থীদের নিষেধ করেছেন।

শিক্ষার্থীকে প্রচণ্ড কৌতূহলী হতে হবে, বলেছেন রাবলে। এমন কোনো সাগর বা নদী থাকবে না, যার মাছের নাম সে জানবে না। পৃথিবীর সব পাখি, সব গাছ, ঝোপঝাড়, বন, ঘাস-লতা-পাতা, প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের যাবতীয় খনিজ ইত্যাদি সবকিছুই শিক্ষার্থীর নখদর্পণে থাকবে। এমন কোনো ইতিহাস, কাহিনি যেন না থাকে যা শিক্ষার্থীর অজানা। গ্রিক, আরব, রোমান, ইহুদি সব ঘরানার চিকিৎসাবিদ্যার পুস্তক তাকে পড়তে হবে, এমনকি মানবদেহ ব্যবচ্ছেদ করে শিক্ষার্থীকে অ্যানাটমিও শিখতে হবে। পাশে যে আছে, সে যেই হোক না কেন, তার প্রতি সেবার মনোভাব থাকতে হবে এবং তাকে নিজের মতো করে ভালোবাসতে হবে। যে সম্পদ ও ক্ষমতা ঈশ্বর আমাদের দান করেছেন তার বিন্দুমাত্র অপচয় করা চলবে না।

বোঝাই যাচ্ছে, রাবলের দৃষ্টিকোণ থেকে একেকজন শিক্ষার্থী হবে একেকটি চলমান বিশ্বকোষ। রাবলের প্রায় সমসাময়িক ফরাসি দার্শনিক মোঁতেইন (১৫৩৩-১৫৯২) শিশুদের এত কিছু শেখানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি লিখেছেন:

"বহু কষ্টে, বহু সময় ব্যয় করে শিশুদের আমরা এমন সব জিনিস শেখাতে যাই, যেগুলো শেখা বা প্রয়োগ করার জন্যে প্রাকৃতিকভাবেই তারা উপযুক্ত নয়। সুতরাং সেইসব জ্ঞান ও দক্ষতার দিকে শিক্ষার্থীদের ধাবিত করতে হবে, যেগুলো তাদের জন্যে সর্বোত্তম এবং সর্বাধিক লাভজনক।"

রাবলের উপদেশ মতো কোনো ব্যক্তি তার ক্ষমতায় কুলালে সবকিছুই শিখুক, কিন্তু রাষ্ট্রকে (মোঁতেইনের উপদেশ অনুসারে) সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সর্বসাধারণের উচিত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে সিলেবাস বা পাঠক্রমে কোন বিষয়গুলো না থাকলেই নয়। সিলেবাস রচনার সময় খেয়াল রাখতে হবে–

১. সর্বজনীন, ২. স্বদেশীয়, ৩. আঞ্চলিক এবং ৪. আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে যেন শিক্ষার্থীর মানসিক সংযোগ ঘটে।

আমরা এমন চারটি বৃত্ত কল্পনা করি যাতে ক্ষুদ্রতর একটি বৃত্ত বৃহত্তর একটি বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত হবে। ক্ষুদ্রতম বৃত্তটিতে প্রথমেই থাকবে সহমর্মীতা ও সহযোগিতা, অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া (বৌদ্ধধর্মে এর নাম 'করুণা')। আমি শুধু শিখব, অন্যেরা কেউ কিছু না শিখুক– এটা যে একটি অসুস্থ মানসিকতা সেই বোধটা শিক্ষার্থীর মনন ও আচরণের অংশ করে তুলতে হবে।

এই ডিজিটাল যুগে ক্লাসের ছাত্রেরা সবাই নিজের নিজের ল্যাপটপ, মোবাইল বা ট্যাবলেটে নোট নিতে পারে এবং সেই নোট প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অন্যদের স্ক্রিনে চলে আসতে পারে। সবাই একসঙ্গে নোট নিলে শিক্ষকের বক্তব্যের সবটুকু শিক্ষার্থীদের চোখের সামনে চলে আসবে। হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না। কেউ হয়তো একটু ধীরে বোঝে, কেউ বোঝে একটু তাড়াতাড়ি। সহপাঠীদের সহায়তা করে সবাই একসঙ্গে শিখতে হবে।

জ্ঞান লুকিয়ে রাখার জিনিস নয়। শিক্ষার্থীদের মনে করিয়ে দিতে হবে: শিক্ষা জিনিসটা 'যতই করিবে দান, তত যাবে বেড়ে!' পরীক্ষায় কে কেমন করবে, কার কতটা মনে থাকবে, সেটা অবশ্য ভিন্ন ব্যাপার। কেউ একবারে পাস করবে, কেউ একাধিকবারে। একাধিকবার পরীক্ষা নিয়ে সবাইকে ভালো নম্বর পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে।

প্রথম বৃত্তে এছাড়া থাকবে কার্যকর যোগাযোগের পদ্ধতি (বলা এবং লেখা), বিজ্ঞান, অংক ও জ্যামিতির মতো সর্বজনীন বিষয়।

দ্বিতীয় বৃহত্তর বৃত্তে থাকবে স্বদেশের ভাষা সাহিত্য, দর্শন, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস ইত্যাদি।

তৃতীয় ও চতুর্থ বৃহত্তর বৃত্তদুটিতে থাকবে যথাক্রমে আঞ্চলিক (অর্থাৎ প্রতিবেশী দেশগুলোর) ও আন্তর্জাতিক ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস ইত্যাদি। ইতিহাসের জ্ঞান যেন খণ্ডিত বা একপেশে না হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পাঠ্যবইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একভাবে উপস্থাপিত হয় না। চীন বা কোরিয়ার উপর জাপানের অত্যাচারের উল্লেখমাত্র নেই জাপানের পাঠ্যবইয়ে। পাঠ্যপুস্তকে জাতীয় ইতিহাস খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে একেকজন অতি জাতীয়তাবাদী 'জন্তু'তে পরিণত করা।

বার্ট্রান্ড রাসেল মনে করেন, দেশ ও বিদেশ– এই উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে বিচার করতে শেখাতে হবে শিক্ষার্থীদের।

পেশাদার ব্যক্তিদের সহায়তায় চতুর্বৃত্তের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিলেবাস তৈরি করে দেবেন এবং সেই সিলেবাস অনুসারে পাঠ্যপুস্তক রচনা করবে আগ্রহী এক বা একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। পণ্ডিতেরা পাঠ্যপুস্তকের রিভিউ লিখবেন। সেই রিভিউ পড়ে এবং নিজেদের বিবেচনায় যে পাঠ্যপুস্তক বিষয়বস্তু, মুদ্রণ, বাঁধাই ইত্যাদি দিক থেকে সর্বোচ্চমানের মনে হবে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা সেই পাঠ্যপুস্তকটিই সংগ্রহ করবে।

ভিন্ন ভিন্ন বিদ্যালয় ভিন্ন ভিন্ন পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করতে পারে। ফ্রান্স ও কানাডায় এমনটাই হতে দেখেছি। সরকার নিজে পাঠপুস্তক না ছাপিয়ে প্রত্যেক ছাত্র বা বিদ্যালয়কে পাঠ্যপুস্তক কেনার অর্থ সরবরাহ করতে পারে। সরকার যত বেশি দায়িত্ব নিজের মাথায় নেবে তত বেশি দুর্নীতি ও অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

আমরা কি কখনও দেখেছি, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান বা ইতিহাসের সিলেবাসে কী থাকে, বা কীভাবে সেখানে এসব বিষয় পড়ানো হয়? আমরা কি জানতে চেয়েছি ফিনল্যান্ড, জাপান, রাশিয়া বা আফ্রিকায় কীভাবে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অংক শেখানো হয়। শিক্ষাদানের একাধিক পদ্ধতির মধ্যে তুলনা করলে আমরা জানতে পারতাম, কোন জাতির বা কোন দেশের শিক্ষণপদ্ধতি অধিকতর কার্যকর। বাংলাদেশে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে চলেছে। পরীক্ষায় নকল হয়েই চলেছে। আমরা কি কখনও জানতে চেষ্টা করেছি, অন্যান্য দেশ এই সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করেছে?

সিলেবাস নিয়ে তারই কথা বলা উচিত, যার কথা বলার মতো জ্ঞান ও যোগ্যতা আছে। জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনে চীনে গিয়ে আমি কীভাবে আশা করতে পারি যে চীনাদের কোনো জ্ঞান আমার রুচি বা ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত করবে না? নিজের বিশ্বাস বা রুচির সঙ্গে মেলে না– এমন কিছু যদি আমি না-ই শিখি, না-ই জানি, তবে চীনে গিয়েই বা কী লাভ? পান থেকে খসে পড়া চুনের আঘাতে ধর্মবিশ্বাসের সরা যদি হরহামেশা ভেঙে যায়, তবে আর যা-ই হোক, জ্ঞানচর্চা হবে না।

রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে যখন অন্ধকার যুগ নেমে এসেছিল তখন সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সিসেরো, ওভিড ইত্যাদি গ্রিক-রোমান লেখকদের কথা সবাই ভুলেই গিয়েছিল। আরবেরা এই মনীষীদের রচনা আরবি ভাষায় অনুবাদ করে, টীকাভাষ্য রচনা করে প্রায় চারশ বছর ধরে ইউরোপের হারিয়ে যাওয়া জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত রেখেছিল। একাদশ-দ্বাদশ শতকে ক্রুসেড যুদ্ধ করতে এসে ইউরোপীয়রা আরব মনীষীদের দ্বারা সযত্নে রক্ষিত গ্রিক-রোমান জ্ঞানশিখাটির সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হয়েছিলেন। এই পরিচয়ের সূত্রে ইউরোপে আবার পুরোদমে গ্রিক-রোমান জ্ঞানচর্চা শুরু হয়েছিল, যার ধারাবাহিকতায় পঞ্চদশ-ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে পুনর্জাগরণ এবং আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সমাজের সূচনা হয়েছে।

আরবেরা যদি বলত, তারা মূর্তিপূজক বা নাস্তিক গ্রিক ও রোমান পণ্ডিতদের লেখা পড়বে না, অথবা ইউরোপীয়রা যদি বলত, তারা বিধর্মী মুসলমানদের রচনা এড়িয়ে চলবে, তাহলে পুনর্জাগরণ কি আদৌ সম্ভব হত? সিলেবাসে কোনো রচনা অন্তর্ভুক্তির সময় লেখক কোন ধর্মের বা কোন তরিকার সেটা না দেখে বরং দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট রচনাটি উপরে উল্লেখিত চতুর্বৃত্তের কোনোটির সঙ্গে যুক্ত কি না।

ভূতের পা নাকি থাকে গোড়ালির উল্টো দিকে এবং সে কারণে এগোতো গেলেই ভূতেরা পিছিয়ে যায়। লেখক হিন্দু বা নাস্তিক, লেখায় মূর্তিপূজা বা নাস্তিক্যবাদের ছোঁয়া আছে– এসব হাস্যকর অজুহাতে যারা কোনো বিশেষ রচনা না পড়ার বা না পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তারা জ্ঞানচর্চার আরব ও ইসলামি ঐতিহ্যের সিরাতুল মুস্তাকিমের দিকে অগ্রসর না হয়ে ভূতের মতো উল্টো দিকে হাঁটছে।

বহু শতকের ধর্মীয় দাঙ্গার পটভূমিতে সংগঠিত ফরাসি বিপ্লবের সূচনা থেকেই রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ফ্রান্স, কানাডা বা অন্য অনেক পাশ্চাত্য দেশে খ্রিস্টান, ইহুদি এবং ইদানীং ইসলামি ভাবধারার স্কুল রয়েছে, কিন্তু এসব স্কুলে সরকার কোনো অর্থসাহায্য দেয় না, স্কুল পরিচালনার ব্যাপারে খুব একটা খবরদারিও করে না। যে স্কুলেই শিক্ষার্থী বিদ্যালাভ করুক না কেন, তাকে রাষ্ট্রের মাধ্যমিক (আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যামিক) পরীক্ষায় পাস করতেই হয়।

বলা বাহুল্য, পরীক্ষা হয় রাষ্ট্রভাষায়: ফরাসি, ইংরেজি, জার্মান, স্পেনিস চেক, ইত্যাদিতে। এছাড়া বাধ্যতামূলক অংক, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ও সবাইকেই পড়তে হয়, যার ফলে সব শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞান ও দক্ষতার সমতা নিশ্চিত করা সম্ভবপর হয়।

বাংলাদেশেও সরকারগুলো ইতোপূর্বে বেসরকারি মাদ্রাসার ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামাত না, যার মানে হচ্ছে, অন্ততপক্ষে শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ধর্ম ও রাষ্ট্রকে আলাদা রাখার আধুনিক ঐতিহ্য অনুসরণ করত। কিছুদিন আগে সরকার এই ঐতিহ্য থেকে সরে এসে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অনেক মনে করেন (রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যা-ই হোক), এটা বর্তমান সরকারের একটা ভালো উদ্যোগ, কারণ, এর ফলে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের নজরদারিতে আসবে। মাদ্রাসার ছাত্ররা এমন কিছু ভিনগ্রহের প্রাণী নয়, তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরই নাগরিক। সুতরাং তাদেরও রাষ্ট্রের মনোযোগ ও সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

আরবি একবচন 'মাদ্রাসা' (বহুবচন 'মাদারিস') শব্দের অর্থ নিছক 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান', 'ইসলাম ধর্মশিক্ষার প্রতিষ্ঠান' নয়। মধ্যপ্রাচ্যে আরবিভাষী খ্রিস্টান ও ইহুদিদেরও মাদ্রাসা ছিল, সাম্প্রদায়িক হামলার ডামাডোলে এখনও হয়তো কয়েকটি অবশিষ্ট আছে। যে কোনো ধর্মের অনুসারীর মাদ্রাসার শিক্ষার্থী হতে বাধা নেই।

শুনেছি, রাজা রামমোহন রায় মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। কওমি মাদ্রাসাগুলো যদি উচিত শিক্ষার অলঙ্ঘনীয় শর্ত: রাষ্ট্রভাষায় লেখা ও পড়া, বিজ্ঞান, অংক, অর্থনীতি, নীতিশিক্ষা, ইংরেজি ভাষা ইত্যাদি শেখানোর শর্ত পূরণ করতে না পারে, তবে নামকা ওয়াস্তে সরকারি স্বীকৃতিতে কোনো ফায়দা হবে না। সিলেবাসের অপরিহার্য অংশে যদি মিল থাকে তবে স্কুল আর মাদ্রাসার মধ্যে তেমন তফাৎ থাকার কথা নয়।

আন্তর্জালে একাধিকবার দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪০% ভাগের কাছাকাছি হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারা অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে আরবি ভাষা শিখছে, ইসলাম সম্পর্কেও কমবেশি জ্ঞান অর্জন করছে। মাদ্রাসা বা সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে বাধা কোথায়? বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন 'মানব-দর্শন', 'নীতিশাস্ত্র' ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয় না, যেখানে সবগুলো ধর্ম, দর্শন, নীতিবোধ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা থাকবে?

প্রতিবেশীকে জানি না, বুঝি না বলেই আমরা সাম্প্রদায়িক এবং কূপমণ্ডূক হই। প্রতিবেশীর ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক জেনে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকেরা একেকজন কাজী নজরুল ইসলামের মতো 'অতিসাম্প্রদায়িক' ব্যক্তি হয়ে উঠুক। একজন অতিসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি দেশের/পৃথিবীর সব সম্প্রদায়কে জানবেন, ভালোবাসবেন এবং নিজের মধ্যে ধারণ করবেন, নজরুল যেমনটা করতেন।

ইসলামের স্বর্ণযুগে বাগদাদ বা কর্ডোভায় আরবরা কি গ্রিক-রোমান ধর্ম ও দর্শনকে 'বেদাত' বিবেচনা করে সজ্ঞানে পরিহার করতেন? সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জ্ঞান বিচার করার অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যে শিক্ষার বদৌলতে মানুষ নিজের ধর্ম মানে, নিজের সংস্কৃতির চর্চা করে, কিন্তু একইসঙ্গে পরের ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও সম্যক ওয়াকিবহাল থাকে তাকেই আমরা বলতে পারি 'উচিত শিক্ষা'।