অর্থমন্ত্রীর অসময়ে ভুল স্বীকার

সাইফুর রহমান তপন
Published : 13 Nov 2011, 04:10 AM
Updated : 17 July 2017, 05:06 AM

অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত বলেছেন, নতুন ভ্যাট আইনে ১৫% ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। গত ৯ জুলাই একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেছেন, এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) তাঁকে এ বিষয়ে মাঠের বাস্তবতা সম্পর্কে 'ভুল তথ্য' দিয়েছিল, আবার তিনি নিজেও এ বিষয়ে খোঁজখবর করেননি।

অর্থমন্ত্রীর এ ভুল স্বীকারের জন্য আমরা তাঁকে ধন্যবাদ দিতে পারি, বিশেষ করে যেখানে আমাদের রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে ভুল স্বীকারের প্রবণতা একেবারে নেই বললেই চলে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এমন সময়ে ভুল স্বীকার করলেন যখন তা সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই।

অর্থমন্ত্রী চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময়ে খুব জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হবে। কিন্তু সংসদের ভেতরে-বাইরে, বিশেষ করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে তীব্র বিরোধিতার প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর 'পরামর্শে' তাঁকে বাজেট পাসের সময় আইনটির বাস্তবায়ন স্থগিত করতে হয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল যে, ঢালাওভাবে ১৫% ভ্যাট আরোপ করা হলে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সেবার দাম বেড়ে যাবে, এতে সাধারণ ভোক্তাদের খুব কষ্ট হবে। বিষয়টা সরকারের কর্তাব্যক্তিদেরও ভাবিয়ে তোলে। কারণ এর নেতিবাচক প্রভাব সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে– যা খুব বেশি দূরে নয়– পড়তে পারে।

কিন্তু অর্থমন্ত্রী চাইলে বিষয়টি খুব সহজেই সুরাহা করতে পারতেন। নতুন ভ্যাট আইনটি পাস হয়েছে ২০১২ সালে। এই সময়ের মধ্যে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে তাঁর ও এনবিআরের কর্তাব্যক্তিদের বহু বৈঠক হয়েছে। উভয় পক্ষের মধ্যে এ নিয়ে একটা সমঝোতার কথাও শোনা গিয়েছিল। বাজেট পেশের আগে তো অর্থমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে এমন খবরও বেরিয়েছিল যে, ভ্যাটের হার ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হতে পারে। তখন ব্যবসায়ী নেতাদের পক্ষ থেকে ভ্যাটের এ সম্ভাব্য হারকে স্বাগত জানাতেও দেখা যায়। কিন্তু কী সব হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশের সময়ে বলে দিলেন যে, ভ্যাটের হার ১৫% না হলে তাঁর চলবে না।

বাজেট পেশের পর অনেকেই নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেসব আলোচনায় যাঁরা বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কমিটিতেও আছেন, তাদেরও অনেকে ভ্যাটের হার ১২% করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী তাদের কথাও শুনতে পারতেন। আসলে এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর 'আমলা-সত্তা' প্রবলভাবে জেগে উঠেছিল, যে কারণে তিনি মাঠে থেকেও মাঠের বাস্তবতা বুঝতে পারেননি।

আরেকটা কারণও এর পেছনে থাকতে পারে। তা হল 'যদি লাইগা যায়' মনোভাব, যা আমলাতন্ত্রের একটা সাধারণ প্রবণতা। অর্থাৎ যদি ১৫% ভ্যাট হার একবার চালু করে দেওয়া যায়, তাহলে অল্প পরিশ্রমে অনেক রাজস্ব আদায় করা যাবে। কিন্তু এ ধরনের পলিসি যে সব সময় সফল হয় না, এমনকি আম ও ছালা দুটোই হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত করার সিদ্ধান্তে তা-ই বোঝা গেল।

ভ্যাট হার ১২% হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যই মূল্যবৃদ্ধির খড়্গ থেকে রক্ষা পেত। শুধু তা-ই নয়, এর ফলে অনেক সেবা ও পণ্যের খুচরা মূল্য কমে যেত, ভ্যাট আদায়ও অনেক বেড়ে যেত। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরাও নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে আপত্তি করার সুযোগ পেতেন না। তাছাড়া, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন স্থগিত করার পরে পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে কোনো কোনো ব্যবসায়ী নেতা এমনও বলেছেন যে, সরকারের কাছ থেকে তাঁরা 'এতটা' প্রত্যাশা করেননি।

উল্লেখ্য, দেশে এখন অনেক পণ্য ও সেবা আছে যা জনগণকে কিনতে হয় ১৫% ভ্যাট দিয়ে। কিন্তু সেই ভ্যাটের একটা বড় অংশ সরকারি কোষাগারে জমা হয় না বলে অভিযোগ আছে। কারণ, প্রচলিত পদ্ধতিতে একজন ব্যবসায়ী তাঁর ক্রেতার কাছ থেকে যে ভ্যাট আদায় করছেন সে হিসাব রাখার কোনো উপায় সরকারের কাছে নেই। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের জন্য ভ্যাট নিয়ে ফাঁকিবাজির প্রচুর সুযোগ থেকে যায়। তাছাড়া এ ব্যবস্থায় অসৎ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অসৎ কর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গোপন লেনদেনের সম্পর্ক চর্চারও বিস্তর সুযোগ থাকে।

এদিকে পুরনো ভ্যাট আইনে ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন করেছে প্রায় সাড়ে আট লাখ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। যদিও এ সংখ্যা বাস্তবে আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা, কারণ, দোকান মালিক সমিতির দেওয়া তথ্যানুসারে, দোকান আছে প্রায় ২৫ লাখ। এর বাইরে আছে বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ বহু ধরনের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান।

ওই নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ৩২ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান। নতুন ভ্যাট আইন চালু হলে একদিকে যারা বর্তমানে ভ্যাট দিচ্ছে তাদের ভ্যাট আদায়ের প্রকৃত চিত্র বোঝা যেত, আরেকদিকে যারা কম টার্নওভার দেখিয়ে ভ্যাট দিচ্ছে না (যদিও তারা ভোক্তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা ভ্যাট আদায় করছে) তাদের প্রকৃত অবস্থাটাও বোঝা যেত।

এটা সম্ভব হত, কারণ নতুন ভ্যাট আইনের অধীনে বার্ষিক ৩০ লাখ টাকার বেশি লেনদেনকারী সব ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে ইএফডি (ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস) ব্যবহার করতে হত; এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সব লেনদেনের হিসাব এনবিআরের সার্ভারে ধরা পড়ত।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, নতুন ভ্যাট আইন চালু হলে এ বছরেই ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনায়াসে অন্তত এক লাখে উন্নীত করা যেত। বলা বাহুল্য, বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এনবিআরের অভিযান পরিচালনার কারণে রাজস্ব আদায় ৩৭% থেকে বেড়ে ৩২৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। আবার নতুন ভ্যাট আইনের কারণে ভ্যাট প্রশাসনেও স্বচ্ছতা ও জবাবাদিহি নিশ্চিত করা যেত; ব্যবসায়ীরাও এনবিআরের অসৎ কর্মকর্তাদের হয়রানি থেকে নিষ্কৃতি পেতেন।

নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে দেশে দেশে বিশ্বায়নের সুফল ঘরে তোলার লক্ষ্যে করব্যবস্থার যৌক্তিককরণের যে ঢেউ লেগেছে, বাংলাদেশও সেই কাতারে সামিল হতে পারত। পাশের দেশ ভারতে বেশ ঘটা করে সম্প্রতি জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) কার্যকর করা হল। বলা হচ্ছে, এর ফলে বহু বিদেশি বিনিয়োগকারী এখন ভারতমুখী হবে, দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধির পালেও হাওয়া লাগবে।

আমাদের নতুন ভ্যাট আইনটি কিন্তু অনেকটা ওই জিএসটির মতো। ফলে এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, এটি অন্তত আরও দুবছরের জন্য স্থগিত করে আমরা বিশ্বায়নের সুবিধা আদায়ের প্রতিযোগিতাতেও পিছিয়ে গেলাম।

অনেকে বলছেন, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কথাটা বার বার বলা হচ্ছে, যে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের জন্য এনবিআর বা ব্যবসায়ী সমাজ কেউই প্রস্তুত নয়। তারা ভুলে যাচ্ছেন যে আইনটি পাস হওয়ার পর ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ বছর চলে গেছে। তাছাড়া এটাও মনে রাখা দরকার যে, কী ব্যক্তিজীবন কী জাতীয় জীবন কোনো ক্ষেত্রেই একেবারে সব ঠিকঠাক করে কাজে নামার অভ্যাস আমাদের নেই; এমনকি বিপর্যয় মোকাবেলায়ও আমরা শেষ মুহূর্তে তৎপর হই; পরীক্ষার আগের রাতে পড়াটাই আমাদের অভ্যাস। অর্থাৎ কোনো কিছু চাপিয়ে দিলেই কেবল তা বাস্তবায়নে আমরা তৎপর হই।

এ ধরনের অভ্যাস জীবনে যারা বেশিদূর যেতে চায় তাদের জন্য নিশ্চয়ই ভালো নয়, কিন্তু এটা আমাদের অভ্যাস, রাতারাতি এর পরিবর্তন সম্ভব নয়। সুতরাং নতুন ভ্যাট আইন চালু হলে এনবিআর, ব্যবসায়ী সমাজ সবার মধ্যে এ নিয়ে একটা তৎপরতা শুরু হত, দু-তিনবছর পর যার সুফল জাতি ভোগ করতে পারত বলেই মনে হয়।

অর্থমন্ত্রী যখন টিভিতে ভুল স্বীকার করছিলেন তখন তাঁর কণ্ঠে বিনয় ঝরে পড়ছিল। কিছুটা উদ্বেগও মিশে ছিল তাতে। উদ্বেগটা তিনি অন্যত্রও প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, নতুন ভ্যাট আইন স্থগিত হওয়ার কারণে বছর শেষে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতিতে দেশ পড়তে পারে। এর ফলে চলতি অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে টার্গেট তিনি ঠিক করেছেন তা অর্জন ব্যাহত হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, প্রবৃদ্ধিকে খুব দ্রুত ডাবল ডিজিটে নিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন তিনি নিজেই জাতিকে দেখিয়েছেন তা পূরণও পিছিয়ে যেতে পারে।

এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, আমদের কর-জিডিপি অনুপাত এখনও দশের নিচে, যা গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন; এ দিয়ে আর যা-ই হোক অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানো সম্ভব নয়। তবে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে শুধু ভুল স্বীকার নয়, যে ভ্রান্ত প্রবণতার কারণে এ ধরনের ভুল হয় তা থেকে অর্থমন্ত্রী ও তাঁর সহযোগীদের খুব দ্রুত বের হয়ে আসতে হবে।