জীয়নকাঠির ছোঁয়ায়

আবেদ খান
Published : 11 July 2017, 04:54 AM
Updated : 11 July 2017, 04:54 AM

একটি ছোট্ট সংবাদ আমার দীর্ঘ বিষণ্নতা অপসারিত করেছে; সংবাদটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়ক।

সেটির সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে: আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভার আলোচ্যসূচিতে একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছেন। আলোচ্য বিষয়টি ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতির জন্মদিন পালন প্রসঙ্গ। তিনি বলেছেন:

"কেন এটা দলের আলোচ্যসূচির মধ্যে থাকবে? আমার জন্মদিন এভাবে পালিত হবে কেন? আওয়ামী লীগ কেন আমার জন্মদিবস পালন করবে? আমি অনেকবার নিষেধ করেছি এসব করতে, কিন্তু কেন সেটা শোনা হচ্ছে না?"

তাঁর এই ভর্ৎসনার পর সবাই চুপসে গিয়েছিলেন এবং প্রসঙ্গটি আর উত্থাপিত হয়নি। সংবাদটি এটুকুই।

পাঠক নিঃসন্দেহে ভাবতে পারেন এই ছোট ঘটনায় আমার দীর্ঘ বিষণ্ন নীরবতা অকস্মাৎ অপসৃত হল কেন। কেউ কেউ ভাবতে পারেন এটাও যে একটা অজুহাতে কৌশলে 'হাসিনাবন্দনা' করে নিলাম। এটা বোধ হয় আমার ফরহাদ মজহার স্টাইলে নিজেকে আলোচিত করার প্রয়াস!

সুপ্রিয় পাঠক, তেমন বাসনা আমার নেই এবং কখনও ছিল না। আমি আপন মনে নিজের কাজ করেছি এবং আমার বিশ্বাসের সঙ্গে কখনও প্রতারণা করিনি।

পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ থেকে বঙ্গবন্ধুর নিঃশব্দ উপাসক থেকেছি এবং এই পড়ন্ত কালেও সেখান থেকে বিচ্যুতি ঘটেনি। আমি আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলাম না কখনও এবং আওয়ামী লীগের অনেক চিন্তার সঙ্গে আমি একমত হইনি। কখনও নিজে ভেবে নিজের ভাবনা সংশোধন করেছি আবার কখনও দেখেছি আমার ভাবনা সঠিক এবং আওয়ামী লীগ সেটা রাজনৈতিকভাবেই সংশোধন করে নিয়েছে।

তবে আমার– পঞ্চাশ দশকের লিডার, ষাটের দশকের মুজিব ভাই, ষাটের শেষাংশের নেতা ও বঙ্গবন্ধু, সত্তরের দশকের জাতির পিতা– বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে প্রগাঢ় শ্রদ্ধার তিলমাত্র ব্যত্যয় ঘটেনি কিংবা তাঁর নিকটতম পরিবারের সদস্যদের প্রতি আমার স্নেহ কিংবা শ্রদ্ধায় এতটুকু অন্যথা হয়নি।

আমি আমার পেশাগত জীবনে বঙ্গবন্ধুর পথপরিক্রমণ অত্যন্ত গভীরভাবে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি। কীভাবে তিনি দলনায়ক থেকে জননায়ক, জননায়ক থেকে দেশনায়ক, দেশনায়ক থেকে রাষ্ট্রনায়ক এবং রাষ্ট্রনায়ক থেকে বিশ্বনায়ক হলেন– সেটাও দেখার চেষ্টা করেছি গভীরভাবে। দেখেছি কীভাবে মানুষের ঢল নামে তাঁর যাত্রাপথে, দেখেছি তাঁর বার বার কারারুদ্ধ হওয়ার পর কীভাবে বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে, সেসবের বিভিন্ন সময়ের সংবাদ এবং চিত্রাবলী।

আবার এই মানুষকে দেখেছি গভীর মমতায় সাধারণ মানুষ থেকে বরেণ্য মানুষকে জয় করতে। আবার এই মানুষটিই বাঙালির স্বাধীন সত্তার স্বার্থে সামরিক শাসকের ফাঁসির রজ্জুর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করছেন, দেশ ও জাতিকে তৈরি করেছেন স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে, তাও দেখেছি। দেখেছি সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে, নির্বাচনে, দেখেছি একাত্তরের ৭ মার্চের ইতিহাস তৈরি করতে, ২৫ মার্চের নারকীয় গণহত্যার মুহূর্তে নিজেকে নির্দ্বিধায় অনিবার্য প্রাণদণ্ডের হাতে সঁপে দিতে। দেখেছি বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারিতে মহানায়কের আগমনের দৃশ্য।

এবং দেখেছি ষড়যন্ত্রের বিচিত্র রূপ, চেনা মানুষের অচেনা হতে থাকার দৃশ্য। দেখেছি অনেক মুখ কীভাবে ধীরে ধীরে মুখোশের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। দেখেছি অপপ্রচারণার স্রোত, শুনেছি প্রশস্তির কারাগারে বন্দি নায়কের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ, শুনেছি তাঁর অসহায় আর্তনাদ– 'আমার চারদিকে শুধু চাটার দল', দেখেছি কীভাবে ধীরে ধীরে তিনি মুখোশ পরিবেষ্টিত হয়ে চলেছেন, দেখেছি কীভাবে স্বাধীনতার দুশমনরা তলে তলে মহারাষ্ট্রীয় বিপর্যয় সংঘটনের জন্য জাল বিছাচ্ছে, সেই দৃশ্যও।

তারপর তো বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির অন্ধকার যুগের সূচনা। স্বাধীনতার মর্মবাণী পাল্টে দিয়ে পাকিস্তানের পুনর্বাসনের ক্লেদাক্ত প্রয়াস; পুতপবিত্র দেবচরিত্রকে দানব প্রমাণের নির্লজ্জ আয়োজন, স্বাধীনতার শত্রুদের প্রেতনৃত্য– সেসবও তো দেখতে হল আমার পেশাগত জীবনে। দেখেছি আমাদের সোনালি স্বপ্ন লুট করার বীভৎস মহোৎসব। দেখেছি মুখোশগুলো খসিয়ে দিয়ে কদাকার মুখাবয়বের দানবীয় উল্লাস। তখন এ দেশ আমার ছিল না, এই সবুজ বনাঞ্চল, এই নদী মেঘলা জনপদ বৃক্ষরাজি, এই পক্ষীকুলের কলকাকলি কিছুই আমার ছিল না।

মসিলিপ্ত অন্ধকার রজনীরও তো অবসান ঘটে, ঘটলও তাই। আবার উচ্চারিত হতে পারল জনকের নাম। আবার জাগল বাংলাদেশ জাগল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবার আমরা আত্মশক্তিকে শাণিত করে প্রস্তুত হলাম। শেখ হাসিনা দলীয় রাজনীতিকে সাজালেন হারিয়ে যাওয়া চেতনায়। আমরা আবার জাগলাম। আবার একুশ, নববর্ষ, লাল-সবুজ পতাকা, মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু জেগে উঠতে থাকল। কিন্তু এটাই তো শেষ নয়। ঈশান কোণে আবার জমল মেঘ। আবার গর্ত থেকে বেরিয়ে এল ধূর্ত শৃগাল। হিংস্র প্রাণীরা বেরিয়ে এল জনারণ্যে। উন্মত্ত দাপাদাপিতে বিপন্ন মানবতা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালের দ্বিতীয় রাক্ষুসী কাল। কিন্তু তা-ও তো দেখলাম এবং মুখোমুখিও হলাম।

অবশেষে সেটাও গেল। মনে হল শেখ হাসিনার বদৌলতে বাংলাদেশ আবার দেশে ফিরল! উন্নতি হচ্ছে, মানুষের ভাগ্য ফিরছে, ঘরে আলো জ্বলছে, হাঁড়িতে চাল ফুটছে, মাঠে ফসল ফলছে, কিন্তু তারপরেও অনেক কিন্তু কিন্তু কিন্তুর জন্ম হয়ে চলেছে। ফিরে ফিরে আসছে ষড়যন্ত্র সহস্র ফণা তুলে। পঁচাত্তরের মতো শত্রুদের লক্ষ্যমুখ তো একটাই। একটা মানুষ এবং একটা পরিবার। লক্ষ্য থাকে সুনির্দিষ্ট, ঠিক এইভাবে। যে লক্ষ্য ভেদ করলে বিদীর্ণ করা যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক।

যত দিন যাচ্ছিল আমি ততই ধীরে ধীরে বিপন্ন এবং বিষণ্ন হয়ে পড়ছিলাম। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত যেভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের নেপথ্য পদচারণার শ্বাপদ গতি দেখেছি, এখন আবার যেন তারই পূর্বাভাস। সেই একই ধরনের কানে কানে ফিস ফিস, একই ধরনের স্তাবকতার স্তবক। তবে তফাৎ তো আছেই। তখন প্রযুক্তির এত আস্ফালন ছিল না, তখন প্রত্যক্ষ শত্রু ছিল নির্দিষ্ট, মুখোশের সংখ্যাও ছিল সীমিত। তখন বিশ্বাসে সতর্কতা স্বল্প থাকার কারণে ষড়যন্ত্রকারীদের গতিবিধি বেশ অবারিত ছিল।

কিন্তু এখন মুখোশের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ, প্রযুক্তি হয়েছে বিপুলভাবে প্রসারিত। গুঞ্জন গুঞ্জরিত হওয়ার মাত্রাও বেড়েছে বহুগুণ। বিভ্রান্তি বিতরণকারীরা ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে সদাসক্রিয়। আমি বিষণ্ন হয়ে পড়ছিলাম, কারণ, দেখছিলাম মিথ্যাচারের সহস্রবাণ বর্ষণে মানুষের বিশ্বাস স্থাপনের ভিতটি জর্জরিত হচ্ছে, অর্জনের বাস্তব রূপটিকে আড়াল করছে অপপ্রচারের অন্ধকার নেকাব।

ক্রমাগত বিষণ্ন হচ্ছিলাম যখন দেখছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটিতে ছদ্মবেশীদের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। দুর্নীতির বিশালকায় দানবটি যখন স্ফিতদেহী হতে হতে দলের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে রাষ্ট্রকাঠামোর কেন্দ্রে এসে আঘাত করছে। প্রচণ্ড অসহায় বোধ করেছি। একাত্তরে শত্রুর মুখে পড়ে কিংবা পঁচাত্তরের পর, নব্বইয়ের পর, দুই হাজার একের পরও এতখানি বিপন্ন বোধ করিনি। মনে হয়েছে মিথ্যা, স্বার্থবাদিতা আর ভোগবাদিতার পাশাপাশি লোভ ও স্বার্থপরতার অশ্লীল বিস্তারে আমার নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে।

ঠিক এই সময়ে ওই এক টুকরো সংবাদ আমাকে নতুন প্রণোদনা এবং বিশ্বাস স্থাপনের নতুন শক্তি সঞ্চারিত করেছে। বঙ্গবন্ধুতনয়ার ওই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমি অন্তত এই বার্তা আত্মস্থ করেছি: তাঁর চতুষ্পার্শ্বে যে অদৃশ্য প্রাচীর সুকৌশলে গড়ে তোলা হয়েছে সেটা বিচূর্ণ করার জন্য তিনি পা বাড়াচ্ছেন।

এখন তোষামোদপ্রিয় নেতা, ভোগমন্ত্রে দীক্ষিত পাত্র-মিত্র-অমাত্য-উজির-নাজির-সেনাপতি-কোটাল প্রত্যেকেই শঙ্কিত হয়ে ভাববেন, সবার কর্মের হিসাব সংগৃহীত আছে বঙ্গবন্ধুদুহিতার মস্তিষ্কের করোটিতে।

তাই আমি আশ্বস্ত।