হা-খা টাকা খেলে কার কি এসে যায়

Published : 28 March 2012, 04:05 PM
Updated : 28 March 2012, 04:05 PM

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ তিনি বা তার দল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ISI এর পয়সা  খেয়েছেন। বলা হচ্ছে যে এই সংস্থার প্রাক্তন প্রধান দুররানি এটা বলেছেন আদালতের কাছে। এই সংস্থা দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে কী কী ধরনের উৎপাত করে তার চিত্র দিচ্ছিলেন দুররানি।

বাংলাদেশে এই খবরটি নিয়ে বেশ মাতামাতি করা হচ্ছে পত্রিকায় ও রাজনৈতিক মঞ্চে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি অভিযোগ করেছেন, গণমাধ্যমেও বিষয়টি এসেছে যদিও তেমন স্থায়ীভাবে নয়। আমাদের জিজ্ঞাসা ছিল এই সংবাদের কারণে খালেদা জিয়া বা বিএনপি'র কি কোন রাজনৈতিক লোকশান হচ্ছে বলে মনে হয়?

দল হিসেবে বিএনপি অবশ্য এই সবই অস্বিকার করেছে। তারা বলছে যে এই প্রাক্তন ISI প্রধানের বক্তব্যে কোথাও খালেদা জিয়ার বা বিএনপির নাম নেওয়া হয়নি। তাদের বক্তব্য খালিজ টইমস ও মিরর অনলাইন পত্রিকায় ভারতীয় সংস্করণে কেবল এই কথা এসেছে। খালিজ টাইমস পত্রিকায় খবরদাতাও একজন ভারতীয়। অতএব ইংগিত পরিস্কার।

গত ২৩ মার্চ বিএনপি তার অবস্থান থেকে জানিয়েছে যে দুররানীর বক্তব্যে তাদের দলের কোন উল্লেখ নেই বা ছিলনা এবং অভিযোগ আনার জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানির  মামলা করার হুমকি দিয়েছেন। তারা বলছেন যে পাকিস্তান সরকার জানিয়েছে যে এই অভিযোগ কেবল ভিত্তিহীনই নয়, ষড়যন্ত্রমূলকও।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন যে বাংলাদেশের দুটি পত্রিকা নয়া দিগন্ত ও সাপ্তাহিক হলিডেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দুররানী নিজেই বলেছেন তিনি এরকম কথা কখনই বলেননি।

বিএনপি বাংলাদেশের প্রথম আলো, ভারতের ইন্ডিয়া টুডে ও দুবাইয়ের খালিজ টাইমসকে এই মিথ্যাচারের জন্য দায়ি করে। অন্যদিক আওয়ামী লীগ সরকার দুররানীর হলফনামার কাগজ চেয়েছে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে যাতে কী বলা হয়েছে জানা যায়।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কয়েক মাস আগে যখন ভারতীয় টাকা নিয়ে নির্বাচন করার অভিযোগ ওঠে Economist পত্রিকায় তখন বেশ মাতামাতি হয়েছিল। সেই খবরের প্রতিবাদ করেছিল সরকারসহ অনেকেই। শেষ পর্যন্ত কোন কট্টর প্রমাণ উপস্থিত  করেনি এই পত্রিকা। তবে ইকনমিস্ট পত্রিকা তাদের কথা ফেরতও নেয়নি।

আমাদের কথা হচ্ছে এতে কি শেখ হাসিনার এমন কোন ক্ষতি হয়েছিল? এই ধরনের অভিযোগের কোন প্রমাণ উপস্থিত করা অসম্ভব কারণ গোয়েন্দা সংস্থারা তো নাম দিয়ে রশিদ চার্জ করে টাকা দেয় না। সেটা ভারত হোক অথবা পাকিস্তান যেই হোক।

টাকা আদান প্রদান হোক আর নাই হোক আওয়ামী লীগ ভারতপন্থী ও বিএনপি পাকিস্তানপন্থী দল। আর বন্ধুর কাছ থেকে মানুষ টাকা নেবে না তো কি শত্রুর কাছ থেকে নেবে?

অন্য কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়াটা কি আমাদের দেশের রাজনৈতিক ভাবনায় অগ্রহনযোগ্য বা অপরাধ? চাঁদাবাজী তো আয়ের একটি প্রতিষ্ঠিত পন্থা যার ভিত্তিতে কেবল দল চলে না, অনেকের সংসারও বলে। অনেকে অবশ্যই দলে কেবল চাঁদাই দেন না, দল ব্যবহার করেন চাঁদা নিতে।

যদি হিসাব নেওয়া হয় তবে দেখা যাবে যে, যে সব অর্থনৈতিক খাত আছে দেশে তার মধ্যে চাঁদা ব্যবসা অন্যতম সফল একটি খাত। এটা মানবসম্পদ রপ্তানী ও গার্মেন্টসের পরেই স্থান করে নিয়েছে।

অতএব চাঁদা তোলার ব্যাপার কোন লজ্জা বা অপরাধবোধ নেই কারও। এরকম ভাবা হয় যে, দেশ ও জনতার জন্য এই চাঁদা চাওয়া হচ্ছে অতএব এটা জায়েজ। এই পরিমন্ডলে চাঁদা কোথা থেকে আসছে সেটা বিষয় নয়, আসছে কিনা সেটাই বিষয়।

এর পাশাপাশি অবস্থান করছে পারস্পরিক ঘৃনা। এই দুই দল একে অন্যকে এতটাই ঘৃণা করে যে অপর দলকে পরাজিত করার জন্য ভিন দেশের কাছ থেকে টাকা নেওয়াটা কোন ব্যাপারই নয় তাদের কাছে। তাছাড়া স্বয়ং শয়তানের কাছ থেকে যারা সাহায্য নিতে প্রস্তুত অপরকে পরাজিত করতে তারা বন্ধুদেশের কাছ থেকে টাকা নিতে লজ্জা পাবে কেন?

ভারত বহুদিন ধরে পাকিস্তানবিরোধী বাংলাদেশীদেরকে সাহায্য করেছে নানা কাজের জন্য। ১৯৭১ সালে সরাসরি অংশগ্রহণ করে দেশ স্বাধীন করার উদ্দেশ্য। এখন সেই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ যদি টাকা খায় পাকিস্তানপন্থী দল হারাতে সেটা হঠাৎ দোষের হতে যাবে কেন?

একই ধারায় বিএনপি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানোকে সম্ভবত: মুক্তিযুদ্ধের কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করে। যেখানে ভারত এত বড় শত্রু বলে তাদের কাছে পরিচিত, সেখানে পাকিস্তানের কাছ থেকে টাকা খেয়ে ভারতপন্থী দলকে হটিয়ে দেওয়া খুবই গ্রহণযোগ্য নিজেদের কাছে  ও সমর্থকদের কাছে। যে ভাবে ভারতের কাছ থেকে  বিএনপি হটাতে টাকা খাওয়া গ্রহণযোগ্য আওয়ামী লীগের জন্য।

এখানে টাকা খাওয়ার ব্যাপারে বা টাকার সূত্রের ব্যাপারে কোন কালিমা  আছে বলে মনে হয় না। অপ্রমানিত টাকা খাওয়ার তথ্যে হাসিনার কোন রাজনৈতিক ক্ষতি হয়নি। পাকিস্তানী টাকা খাওয়ার তথ্যের কারণে খালেদার কোন অসুবিধা হবে না।

বাংলাদেশে বা তার রাজনৈতিক জগতে পাপ-পূণ্যের কোন হিসাব করা হয় না। এমনও হতে পারে যে সামাজিকভাবে পাপ-পূণ্যের বা হারাম-হালাল বোধ এতোটাই দুবর্ল যে কে টাকা খেল আর কে খেল না এতে কারও কিছুই আসে যায় না।

এই সব খবরে দুই দলের নেতৃবৃন্দ একটু আলাপ-আলোচনা করবেন ঠিকই কিন্তু এর রাজনৈতিক লাভ বা লোকশান কোনটাই নেই।

একজন খায়, বাকিরা দেখে। পাপ-পূণ্য বোধ পরবর্তী সময়ে এইসব কথা প্রধানত মুখরোচক আড্ডার বেশী কিছু নয়।

তবে এই মুহূর্তে ভারত ভীষণ অজনপ্রিয় তার পানিনীতি ও বর্ডার পরিচালনার কারণে। সেই কারনে পাকিস্তানের কাছ থেকে টাকা খাওয়াটা ভারতের কাছ থেকে আ্ওয়ামী লীগের টাকা নেওয়ার চেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য অনেকের কাছে।

কিন্তু ভারত আমাদের প্রতিদিনকার পরশি এবং তার সাথে সম্পর্ক তিক্ত। পাকিস্তানের টাকা খেলে অনেক কম এসে যায় কারণ তারা এক কালের শত্রু, এখনকার নয়। ভারত নিত্যদিনের বিরোধী হিসেবে স্থান পেয়েছে অনেক মানুষের মনে।

শেষ কথা তো রাজনৈতিক ফায়দা লোটা এবং সেটা যখন উদ্দেশ্য তখন এই ধরনের অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ হতেই থাকবে। কে কার কাছ থেকে টাকা খেল সেটা বিষয় নয়, কে কার নামে খারাপ বলতে পারলো সেটাই আসল কথা।

একজন মানুষ বেহায়া হতে পারে কিন্তু একটি সমাজ ও রাষ্ট্র বেহায়া হয় না এমনটাই ধারণা ছিল। সেইটি কি পাল্টাবে?

আফসান চৌধুরী: নির্বাহী সম্পাদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।