ডলি বেঁচে থাকবেন তাঁর অসামান্য অভিনয়ের জন্য

দিল মনোয়ারা মনু
Published : 3 July 2017, 04:39 AM
Updated : 3 July 2017, 04:39 AM

৩ জুলাই অনন্য অভিনেত্রী ডলি ইব্রাহীমের মৃত্যুদিন। ১৯৯১ সালের এই দিনে ছোট ও বড় পর্দার এই প্রতিভাবান শিল্পী মাত্র ৪২ বছর বয়সে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান। এটা তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যু কি না তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু আসল সত্য কী? তা আজও জানা যায়নি। এই গুণী শিল্পীর মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা পুরোপুরি কাজে লাগানোর আগেই তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে।

স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ডলি অভিনয় চর্চা শুরু করেন। এই সময়েই তিনি বেশকিছু নাটকে অভিনয় করে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। মুক্ত চিন্তা ও অসম্ভব প্রগতিশীল এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় নাট্যচর্চায় দ্বার তাঁর জন্য অবারিত ছিল।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ লেখক গবেষক মা নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন তাঁর শিল্পচর্চার প্রকৃত বন্ধু। আমরা জানি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী হিসেবে তিনি মহিলা সমিতির মিলনায়তনকে এদেশের প্রগতিশীল নাট্য চর্চার জন্য ব্যবহারের অবাধ সুযোগ করে দিয়েছিলেন। যাতে মিলনায়নের অভাবে এদেশের নাট্যচর্চা ব্যহত না হয়।

মাত্র ১০ বছর বয়সে মায়ের নাট্যরূপ দেওয়া 'চরিত্রহীন'-এ অভিনয় করেন ডলি। চরিত্রহীন ছিল 'রঙ্গম' নাট্যগোষ্ঠীর একটি জনপ্রিয় নাটক। সেই থেকে অভিনয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা সুদৃঢ় হয়।

স্কুল-কলেজের পাশাপাশি নাটকের বৃহত্তর পরিসরে অংশগ্রহণের সুযোগও তৈরি হয়। ১৯৬৩-৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নাটক মঞ্চায়নের জন্য আবদুল্লাহ আল মামুন, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদাররা যে সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী না হওয়া সত্ত্বেও নিষ্ঠা ও অভিনয় গুণের জন্য তাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ডলি। যেমন সুযোগ পেয়েছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম নাটক 'একতলা দোতলা'তে অভিনয় করার এবং এই নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে টেলিভিশন নাটকে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি।

সেই সময়ের টেলিভিশনের স্বনামধন্য নাট্য প্রযোজক আতিকুল হক চৌধুরী, মুস্তফা মনোয়ার, মোমিন চৌধুরী, মোহাম্মদ জাকারিয়া, আবদুল্লাহ আল মামুনসহ অনেকে ডলিকে তাদের প্রযোজিত নাটকে অভিনয় করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ডলির এই প্রবল জনপ্রিয়তার পেছনে যে কারণগুলো ছিল তার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়: ডলি নিজগুণে অভিনয়ের ক্ষেত্রে একটি নিজস্ব ধারা তৈরি করতে পেরেছিলেন।

নাটকে তাঁর উচ্চারিত সংলাপ হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হত যা বহির্মুখী নয়, উচ্চকিত নয়; একেবারেই অন্তর্মুখী ও সংবেদনশীল। তাঁর আর একটা বড় গুণ ছিল, তিনি অভিনয় ক্ষেত্রে চরিত্রকে নিজের মধ্যে ধারণ করে অভিনয় করতেন না। ডলি চেষ্টা করতেন চরিত্রের মধ্যে নিজেকে প্রবিষ্ট করানোর। তিনি সিরিয়াস চরিত্রগুলো বোঝার জন্য প্রচুর পড়াশোনা, গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণ করতেন। তাই 'সূর্য দীঘল বাড়ী'  চলচ্চিত্রের জয়গুণ চরিত্র এখনও এত জনপ্রিয়।

'সূর্য দীঘল বাড়ী'  চলচ্চিত্রের জয়গুন চরিত্রটি ডলির ভালোবাসা ও ভালোলাগার প্রতীক। শিল্পে নিবিষ্ট প্রাণ ডলি জয়গুন চরিত্র নিয়ে অনেক ভেবেছেন, পড়াশোনা করেছেন। সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে জয়গুনের প্রতি তাঁর অন্যরকম আগ্রহ, ভালোবাসা ছিল। যেমন ছিল তাঁর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'যোগাযোগ' উপন্যাসের কুমুদিনীর প্রতি। জয়গুন চরিত্রের বহুমাত্রিক সংগ্রাম ও চ্যালেঞ্জ ডলিকে আকৃষ্ট করেছিল। তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে জয়গুনকে তিনি বিবেচনায় এনেছিলেন। তাই জয়গুন চরিত্রে অভিনয়কারী ডলি আজও অনন্য এবং কিংবদন্তি হয়ে আছেন। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নন্দিত এই চরিত্রটি তাই কখনও হারিয়ে যাবে না।

ডলি তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলোতে মেধার সর্বোত্তম বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। সেটি চলচিত্র, টেলিভিশন অথবা মঞ্চ যেখানেই হোক না কেন। তাঁর অভিনীত টেলিভিশন নাটক 'বকুলপুর কতদূর', 'শেষ বিকেলের মেয়ে', 'জোনাকি জ্বলে' এখনও দর্শকের স্মৃতিতে অম্লান এবং তাদের ভালোবাসায় সিক্ত। 'সূর্য দীঘল বাড়ী''দহন'-এর মতো আর্টফিল্ম ডলিকে বাঁচিয়ে রাখবে চিরকাল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অনুবাদ নাটকেও তাঁর দক্ষতা ছিল উল্লেখ করার মতো। মুনীর চৌধুরীর অনুবাদে শেক্সপিয়ারের নাটকে তাঁর অভিনয় ছিল সমানভাবে প্রশংসনীয়।

ডলির অভিনয় জীবনের আয়ু খুবই কম। আমরা হারিয়েছি এক প্রতিভাবান অভিনেত্রীকে যা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। আমাদের দেশের শিল্পস্রষ্টারা তাঁর প্রতিভাকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাতে পারলেন না। এই আমাদের দুর্ভাগ্য। আমরা তাঁর ভক্তরা, শিল্পবোদ্ধা ও শিল্পরসিকরা তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান দেখাতে পারলাম না। আমাদের এই অক্ষমতার ক্ষমা নেই। নিদারুণ সত্য হল আমরা তাঁকে ভুলে যাচ্ছি।

ডলি ইব্রাহীমের মৃত্যুর পর আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মা নীলিমা ইব্রাহীম বলেছিলেন:

"ডলির জন্ম যেদিন সেদিন ছিল শ্রাবণ পূর্ণিমা সন্ধ্যা, আকাশে মেঘের ছোঁয়া ছিল না এতটুকু। রূপালী আলোর বন্যায় ঝলমল করছিল চারদিক। দিনটি ছিল ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই। শ্রাবণ পূর্ণিমার সন্ধ্যায় জন্ম নেওয়া আমার এ মেয়েটি ছিল আশৈশব শিল্পানুরাগী, মাত্র ১৩ বছর বয়সে ডুরে শাড়ি পরে চুলে ঝুটি বেঁধে মুখে পান দিয়ে লিলি চৌধুরীর সামনে এসে যখন দাঁড়াল তখন ইউএসআইএস মিলনায়তন করতালিতে মুখর হয়ে উঠেছিল। ডলি দুহাত ভরে সকলকে ভালোবাসা দিয়েছে, কিন্তু পরিবর্তে পায়নি আপন পুরুষের কাছ থেকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান।

"১ জুলাই ওর জন্মদিন ছিল, ৩ জুলাই তারিখে ওকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হল। জন্মদিন উপলক্ষে ওকে একটি শাড়ি দিয়েছিলাম। সেই নীলাম্বরি শাড়িখানা সে পরতে পারেনি। তার এই স্বেচ্ছামৃত্যু আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। কারণ, যে পৃথিবীকে, তার অভিনয় জগৎকে এত ভালোবাসতো তার সব মায়া ত্যাগ করে এভাবে ও চলে যেতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি শিল্পকলার পুষ্পিত ফুলবাগানের এই প্রস্ফুটিত ফুলটি যদি সত্যিই নিধন করা হয়ে থাকে তবে যিনি সকল পাপ-অন্যায়ের বিচারক সেই স্রষ্টা নিশ্চয়ই বিচার করবেন।

"ডলির চলে যাওয়ার এই মুহূর্তে আমি শুধু বলব, বাংলার মেয়েরা তোমরা জাগো, সচেতন হও। শুধু দিয়ে ধন্য হয়ো না, নিজের অধিকার বুঝে নিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও। সবশেষে বলতে চাই আমার গৃহে ঐশ্বর্য ছিল না, আবার অভাবও ছিল না। কিন্তু ছিল মা, বাবা আর বোনদের ভালোবাসার পরিমণ্ডলে গড়া এক অনাবিল স্বর্গসুখ। আজ থেকে সেই সুখের বিচ্যুতি ঘটল। চলে গেল হাসি, আনন্দে গানে ভরা মুখর পরিবেশ।"

আমার প্রিয় শিক্ষক নীলিমা আপার কথার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমিও বিশ্বাস করি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এই রুচিশীল মানুষটি কখনও হারিয়ে যাবেন না, তাঁর উদার প্রাণের কথা আমাদের চিরকাল মনে থাকবে। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের জন্য, এদেশের সব শিল্পবোদ্ধা, শিল্পপ্রেমী মানুষের মধ্যে।

আনুষ্ঠানিকতায় না থাকুন, তাঁর বহুমাত্রিক অভিনয়ের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন এবং থাকবেন এদেশের মানুষের মনে।