‘আমার ভয়’

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 4 July 2017, 04:42 AM
Updated : 4 July 2017, 04:42 AM

লিখতে বসে আজকাল অনেককিছু ভাবতে হয়। এটা লেখা ঠিক হবে তো? কোন লেখায় কার মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয় তা নিয়ে কিছুটা ভয়ে ভয়ে থাকি। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে তো রীতিমতো বুক কাঁপে। এমনিতেই আমি একটু ভীতু প্রকৃতির মানুষ।

ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে দেশে কম অশান্তি হয়নি। কক্সবাজারের রামুর ঘটনা নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে। বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের ওপর আদিম আক্রোশে হামলে পড়েছিল একদল মানুষ। বৌদ্ধদের উপাসনালয়, বুদ্ধমূর্তি, ধর্মগ্রন্থ কোনোকিছুই বাদ যায়নি; সবকিছু তছনছ করে দেওয়া হয়েছিল।

ভাবা যায়, কে একজন ফেসবুকে কী স্ট্যাটাস দিলে, সেটা সত্য না মিথ্যা, তা যাচাই না করেই একদল ধর্মরক্ষক অথবা ধর্মভীরু মানুষ যা করেছে তা বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এরপর নাসিরনগরের ঘটনা। ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চলল তাণ্ডব।

আবার নিছক গুজব ছড়িয়েও কম হাঙ্গামা হয়নি। চাঁদে সাঈদী নামের এক যুদ্ধাপরাধীর ছবি দেখা গেছে– এই গুজব ছড়িয়ে বগুড়ার বিভিন্ন জায়গায় কী নারকীয়তা চলেছিল, তা-ও ভুলতে পারি না।

সারা ক্ষণ ভয়, কী না কী হয়। নির্বাচনের কথা শুনলেই ভয় হয়। আবার বুঝি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর জুলুম-নির্যাতন শুরু হয়। গত কয়েকটি নির্বাচনের আগে-পরে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন হয়েছে তার ভয়াবহতা ভুলতে পারি না। আবার নির্বাচনর কথাবার্তা শুনে বক্ষ দুরু দুরু করতে শুরু করেছে।

ভারতে মুসলমানদের ওপর কোনো সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হয় কি না, তা নিয়েও শঙ্কায় থাকি। ভারতে হিন্দুরা মুসলিম-নিগ্রহ করছে, বাংলাদেশে তার বদলা নাও। এই যে গরু রক্ষার নামে উগ্রবাদী হিন্দুরা কোথাও কোথাও মুসলিম-নিধন শুরু করেছে তার বিরূপ হাওয়া এ দেশে বয়ে যাবে না তো– শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সবাই সজাগ থাকতে? এই যে পাকিস্তানে মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর আরেকদল মুসলমান হামলা করছে, হত্যা করছে তার জন্য এ দেশে কেউ তো কারো ওপর হামলা করছে না।

খুব ভয়ে থাকি 'ধর্মীয় অনুভূতি' নিয়ে। একশ্রেণির মধ্যে আজকাল এটা প্রকট হয়ে উঠেছে। হিন্দুদের আর এই অনুভূতি থাকতে নেই! হিন্দুদের মন্দির ভাঙা যাবে। তাদের আরাধ্য দেবদেবীর প্রতিমা ভাঙা যাবে। কিন্তু হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগা চলবে না। কিন্তু কোনোভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে ছোঁয়া দেওয়া যাবে না। কারণ, তারা সংখ্যাগুরু।

আমার এই ভয় যাদের দূর করার কথা তারাও হয় ভয়ে নয়তো অন্য কোনো কারণে সংখ্যালঘুদের নিয়ে মাথা ঘামায় না। দেশের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি আগে সম্প্রীতি রক্ষায় সোচ্চার থাকত এখন তারা নিজেরাই অতি দুর্দশাগ্রস্ত। কারো বিপদে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা তাদের নেই।

দেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার যেভাবে বাড়ছে তাতেও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। আগে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরোধী ছিল। ইদানীং এখানেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগও 'ধর্মের কার্ড' হাতে নিয়েছে।

হেফাজতে ইসলামের পরামর্শে পাঠ্যবইয়ে যেভাবে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা খুব ছোট ঘটনা নয়। সমাজে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। হিন্দু-মুসলমান বিষয়টি পাকিস্তানি শাসকরা যেভাবে দেখত আবার সেই অবস্থা ফিরে আসছে কি?

বাংলা ভাষার ইসলামিকরণের যে অপচেষ্টা চলছিল আবার তা শুরু হবে না তো? পাকিস্তানি শাসকরা বাংলা ভাষার মুসলমানিকরণের উদ্দেশে শব্দ বদলের উদ্যোগ নিয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা থেকেও কিছু শব্দ বদলানো হয়েছিল। 'মহাশ্মশান' হয়েছিল 'গোরস্থান', 'সকাল' হয়েছিল 'ফজর', 'মন'-কে বানানো হয়েছিল 'দিল'। পাকিস্তানি চেতনা ফিরে এলে বাংলা ভাষার ওপর আবার আক্রমণ শুরু হবে না তো?

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা একটি বিশেষ কালপর্বে।। বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনের পর পর আমার জন্ম। ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির মনোজগতে বিরাট নাড়া দিয়েছিল; অনেককিছু থেকেই তা বোঝা।

ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি ছিলেন। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন 'একুশে ফেব্রুয়ারী'র প্রকাশকও ছিলেন তিনি। তাঁর বাড়িও আমাদের পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার মাঝগ্রামে। ভাষা আন্দোলনের প্রভাবেই সম্ভবত ছেলের নাম রেখেছিলেন 'সুব্রত চয়ন' আর মেয়ের নাম 'সুস্মিতা শম্পা'। ঠাকুরগাঁয়ের আরেক ভাষা-সংগ্রামী এফ এ মোহাম্মদ হোসেনের ছেলের নাম 'প্রভাত সমির'। এখন এমন ভাবা যায়?

এক বিশেষ রাজনৈতিক সামাজিক পরিবেশে আমরা বেড়ে উঠেছিলাম। সেটা ছিল শেখ মুজিব এবং একইসঙ্গে বাম প্রগতিশীলদের বিকাশপর্ব। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা-প্রগতিবাদী চেতনা আমাদের মানসজগতে ঝড় তুলেছিল। গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা আমাদের প্রাণিত করেছিল। আজ আমরা কতকিছু মেনে নিচ্ছি, কতকিছুর সঙ্গে মানিয়ে চলছি। কিন্তু আজ আমাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক অর্জন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। আমরা নানা যুক্তিতে তা মেনেও নিচ্ছি।

আমরা কি পাকিস্তানের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলাম পাকিস্তানি চেতনাসমৃদ্ধ আরেকটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য?

বড় ভয় হয়, 'হিন্দুয়ানি' শব্দ বাংলা ভাষা থেকে বাদ দেওয়ার কোনো হুজুগে আমরা কি আবারও বিভ্রান্তির পথে হাঁটব? যদি তেমন হয় তাহলে কেমন হবে বাংলা ভাষার শব্দাবলি? আমরা কি আর 'আকাশ' দেখব না, আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকবে 'আসমান'? আমাদের কি আর কারও সঙ্গে 'দেখা' হবে না, হবে 'মোলাকাত'? আমাদের ফুলের 'গন্ধে'র বদলে শুঁকতে হবে 'খুশবু'? আমরা 'পাপে'র বদলে করব 'গুনাহ', 'পুণ্যে'র বদলে হাসিল করতে হবে 'ছওয়াব'? 'আশীর্বাদ' নয়, 'দোয়া'ই কবুল? 'অভিশাপ' হবে 'বদদোয়া'। 'স্বর্গ-নরক' হিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত রেখে বাংলাদেশিদের জন্য হবে 'বেহেস্ত' আর 'দোজখ'?

কেউ কারো 'সেবক' থাকবে না, হবে 'খেদমতগার'। আমরা 'মাথা'র বদলে 'শির' উঁচু করতে অভ্যস্ত হব। সেই বহু পুরানা প্রশ্ন নতুন করে সামনে আসবে, আমাদের এত পরিচিত 'কাকাতুয়া' পাখির নাম কি হবে 'চাচাতুয়া'?

ফুলকে পবিত্র বলা হয়। এরশাদ আমলে ঢাকার দেওয়ালে দেওয়ালে স্লোগান শোভা পেত: মাহমুদুল হাসানের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র! রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের ফুলের মালা গলায় দিয়ে বরণ করা একটি জনপ্রিয় রীতি। কিন্তু হিন্দুরা যে ফুল দিয়ে পূজাপার্বণ করে থাকে? ফুল যদি হিন্দু-মুসলমান সবার কাছে পবিত্র হতে পারে তাহলে অন্যসব ক্ষেত্রে কেন মিলমিশ হতে পারে না?

তুলসী গাছ হিন্দুদের কাছে পবিত্র। তুলসী তলায় হিন্দুরা পূজাআর্চা করে, তুলসীর আবার ঔষধি গুণ আছে। কাঁশি হলে বা গলা খুসখুস করলে তুলসীপাতার রস তো মুসলমানরা পান করতে দ্বিধা করেন না।

যত সমস্যা হিন্দুর 'মূর্তি' নিয়ে। অথচ হিন্দুরা কিন্তু নিছক মূর্তি পূজা করে না, মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে প্রতিমা পূজা করে।

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার কথা বলা হলেও এ যুগের ধর্মানুসারীরা তা শুনতে ও মানতে নারাজ। ধর্ম নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে উন্মত্ততা শুরু হয়েছে তার পরিণতি সভ্যতাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে– কে বলতে পারে? মানুষের বিচারবুদ্ধিহীন হয়ে ওঠার প্রবণতা আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে?

ভারতে গোরক্ষার নামে মুসলিম হত্যার যে উপলক্ষ তৈরি হচ্ছে তারও পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। গরুভক্তির নামে মানুষ খুন– এ কি ভাবা যায়? ধর্মোন্মাদরা বিবেকহীনতার পরিচয় দিচ্ছে।

অথচ ধর্ম তো মানুষকে ধারণ করেই। তাহলে ধর্ম নিয়ে পৃথিবী হিংসায় উন্মত্ত হয়ে উঠছে কেন? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম, শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম, আধুনিক ধর্মের যারা অনুসারী তাদের কেউ কেউ যখন বিচারবুদ্ধিহীন হয়ে ওঠেন, তখন আর হতাশ না হয়ে উপায় থাকে না।

চলার পথে যে বৃদ্ধা কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন তাকেও করুণা করেছেন পরম দয়ালু নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। অথচ তাঁর কিছু অনুসারী আজ দেশে দেশে নিরপরাধ মানুষ হত্যায় দ্বিধা করছেন না। অন্য ধর্মানুসারীদের মধ্যেও হত্যাকারী-খারাপ মানুষ আছে। সব ধর্মের খারাপ অনুসারীদের নিয়ে আমার ভয়।

তবে মনে রাখতে হবে এটাও যে, অন্যসব ধর্মকে কিন্তু 'শ্রেষ্ঠ' ধর্ম বলা হয় না! তারপরও ধর্মানুসারী নয়, ধর্ম উন্মাদের সংখ্যা দেশে দেশে বেড়ে যাওয়ায় আমার বড় ভয়।