খালেদা জিয়ার নিরানন্দ ঈদ উৎসব

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 30 June 2017, 04:40 AM
Updated : 30 June 2017, 04:40 AM

ঈদ ও রথযাত্রা পালিত হয়েছে নিরাপদে। ঈদ উৎসবে এবার নিরাপত্তা কেমন ছিল তার চেয়ে বড় কথা, কোথাও এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যাতে মনে হতে পারে: দেশের মানুষের জীবন অনিরাপদ।

এখন সামাজিক মিডিয়ার সোনালী যুগ। দেশে-বিদেশে বাঙালির হাতে হাতে মোবাইল। ঘরে ঘরে ল্যাপটপ কম্পিউটার। এর মানে কেউ আর কারো থেকে দূরে নয়। চাইলেই যোগাযোগ করা যায়, চাইলেই 'কল' করা যায়, ইচ্ছে হলেই চেহারা দেখা যায়।

এমন বাস্তবতায় আমি যদি বলি ঈদ আসলে ভালোভাবে পালিত হয়নি বা ঈদের আনন্দ ছিল না– সেটা কি প্রলাপ বলে মনে হবে না? একজন দায়িত্বশীল নেত্রী, একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যে আসলে ডিজিটাল বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে সেটাই মনে হল তাঁর কথায়। তিনি ঈদের পরদিন 'প্রলাপ বকলেন' যে, মানুষ নাকি নানা কারণে সরকারের আমলে ঈদ-ই করতে পারেনি।

এসব কথা একটা সময় চলত বা বলে পার পাওয়া যেত। কিন্তু এখন তা আর সম্ভব না। এখন খোলা দুনিয়ায় বাংলাদেশও এক চলমান দেশ। তার সঙ্গে নিবিড় যোগ পৃথিবীর। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি, আমরাও বাস্তবতা জানি। আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবেরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় জানান দেন কী হচ্ছে।

এমন বাস্তবতায় খালেদা জিয়া তাঁর ও দলের হতাশা মানুষের কাঁধে চাপাতে পারেন না। তিনি দেখলাম রাগী রাগী চেহারা করে বলছেন: এবার দেশবাসী নাকি ভয়ে-হতাশায় ঈদ করতে পারেননি।

মানলাম, মানুষের কোনো এক অংশের মনে চাপা ভয় থাকতেই পারে। এরা কারা? যারা অপরাধী, যারা দাগী আসামি, যারা সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের দোসর, তারা ছাড়া আর কারো মনে কেন ভয় কাজ করবে? ভয় যদি কাজ করতই মানুষ কি দলেবলে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশের নানা এলাকায় ঘুরে বেড়াত? এমনকি প্রচুর অমুসলিমদেরও দেখলাম দেশে-বিদেশে ঈদ আনন্দভ্রমণে বেড়িয়েছে।

সত্যি বলতে কি, আমার মনে হয়, একটা বয়সের পর শরীরের নানা অঙ্গের চিকিৎসা জরুরি। এগুলোর দেখভাল করাও জরুরি।

ভালো করে তাকালেই দেখতে পাব দেশের মানুষের আনন্দ-বিনোদনের চেহারাও পাল্টে গেছে। তাদের পোশাক ও আচরণে যে পরিবর্তন তার পেছনে আছে স্বচ্ছলতা। দেশের মানুষের হাতে এখন অনেক টাকা। সে টাকায় যে জোয়ারের ঢেউ, তা ছবিতেই স্পষ্ট।

খালেদা জিয়া কেন সেটা দেখলেন না?

যদি এমন হত তিনি হাওর ও পার্বত্য জনপদের মারা যাওয়া, সর্বস্ব হারানো মানুষের জন্য কাঁদতেন, মানতে পারতাম। তিন যা বললেন যেসব অভিযোগ তুললেন তার পেছনে যতটা বেদনা বা কষ্ট তার চেয়ে বেশি ছিল আক্রোশ। খালেদা জিয়ার এই আক্রোশ নতুন কিছু নয়। তিনি যখন মীর্জা ফখরুলের কথা বলছিলেন, তখনও মনে হচ্ছিল, তিনি আসলে আওয়ামী লীগ আমলের কারণে ঈদ উৎসবকেও ছোট করতে ছাড়বেন না।

ফখরুল সাহেব ও তাদের গাড়িবহরের ওপর হামলা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। এমন কোনো ঘটনা মানি না, মানতেও চাই না। কিন্তু বিএনপির এ বিষয়ে ভূমিকা কী? তারা কি এ নিয়ে মিছিল মিটিং করেছে? করতে না পারলে এ নিয়ে জনমনে প্রতিক্রিয়া তৈরির চেষ্টা করেছে? এসব না করে আওয়ামী গুণ্ডারা ঘটনা ঘটিয়েছে বললেই চলবে? তারা ঘটালেও মানুষ কি এভাবে বললেই মেনে নেবে?

এভাবেই বিএনপি নিজেকে সর্বনাশের শেষ সীমায় নিয়ে এসেছে।

একটা বিষয়ের কিছুতেই উত্তর মেলে না। তৃণমূলে বা জনমনে বিএনপির এত সমর্থন বা ভিত থাকলে তারা কাদের ভয়ে গুটিয়ে আছে? নিন্দুকেরা বলে, বিএনপির সমর্থন মূলত দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি ও উগ্র জাতীয়তাবাদের মিলন। এরা অঘটন ঘটাতে পারে, কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রাম করতে পারে না।

আরেকটা বিষয় হল মানুষের বদলে যাওয়া মন। তারা আসলে রাজনীতিবিমুখ। তাদের কাছে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ভেতর বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। বরং তারা এখন যেসব সুযোগ ও উন্নয়নের আওতায় আছেন সেখানেই থাকতে চান। কেন তারা ঝুঁকি নেবেন? বিএনপি কি ধোয়া তুলসিপাতা? না তাদের আমল ছিল সোনায় মোড়ানো? বরং এই আমলেই দেশের উন্নয়ন চোখে পড়ছে সবার।

খালেদা জিয়া কি সেটা জানেন না? জানলে তাঁর উচিত হবে সংযত ভাষায় কথা বলা। তিনি যে বললেন দেশে আসলে উৎসবের পরিবেশ নেই বা মানুষ আনন্দ করতে পারেনি, এটা কি ঠিক?

কোটি কোটি মানুষ কোথায় গেলেন তবে? ঢাকা খালি করে এক কোটির মতো মানুষ কি আনন্দহীন কোনো উৎসবের জন্য যানবাহনে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েছিলেন? দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষের যে আনন্দমুখর চেহারা, উৎসব, খাবারের ঢল সব মিথ্যা?

বেগম জিয়া, আপনারা সরকারে থাকলে আনন্দ থাকবে আর অন্যেরা থাকলে আনন্দ নেই– এ ধারণা বাদ দিন। আপনাদের আমল, আমাদের বয়সী মানুষদের আমল এখন আর নেই। এখন যে প্রজন্ম তাদের চাওয়া-পাওয়া আমরা বুঝি? বুঝলে তো তাদের ভাষায় কথা বলতে হবে। সে ভাষা রপ্ত করুন।

কথায় কথায় রাগ, কথায় কথায় অন্যকে দোষারোপ করা এই প্রজন্মের কাছে অচল। তারা চায় সোজাসাপ্টা রাজনীতি। সেখানে কে কার গাড়ি ভাঙল, কে কাকে ত্রাণ দিল– সেগুলো নিতান্ত তুচ্ছ বিষয়।

খালেদা জিয়া, আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতি। সেটা করে আপনি তো ডুবেছেনই, জামায়াতের শীর্ষ নেতারাও আজ আর দুনিয়ায় নেই। এখনও আপনি যে ধ্যানধারনা আর ক্রোধে আছেন তাতে বিএনপি শেষ হয়ে যাওয়ার বাইরে কিছু দেখি না।

নানা কারণে আপনার দলের যে ইমেজ ও প্রিয়তা সেটা বজায় রাখতে হলে পরিমিত কথায় ফিরে যান। আওয়ামী লীগের বদনাম করতে গিয়ে দেশের মানুষের ঈদ আনন্দ খাটো করার জন্য মানুষ আপনাকে বাহবা দেবে না। তাছাড়া আপনার মহাসচিবসহ বাকিদের প্রশ্ন করুন, তারাই বলবেন, কেমন ঈদ কাটিয়েছেন তারা। নিজেরা ভালোভাবে ঈদ করে দেশের মানুষকে জিম্মি করে 'ঈদ উৎসবের পরিবেশ নেই' বলাটা আপনার দেউলিয়াত্ব।

অাগে ঈদের সঙ্গে কৌতুক ছিল মাস্ট।

টিভির অনুষ্ঠানে হানিফ সংকেত, হিটলু, ফরিদ অালীরা কৌতুক বলে মন ভরাতেন। ছিলেন টেলি সামাদ, রবিউল, খান জয়নুল, অানিসের মতো কৌতুক অভিনেতারা। দু-চারজন মেয়েও অনেক হাসাতে পারত। অাজকাল কেউ অার ঈদে কৌতুক বলে না, এ কথা ভাবতে ভাবতে টিভি খুলে দেখি খালেদা জিয়া স্বয়ং বলছেন: এই সরকারের কারণে দেশে এবার কোনো ঈদ-ই হয়নি।

তাহলে কী করছে মানুষজন এই লম্বা ছুটিতে?

এত বড় নেত্রী, উনি সব জানেন, সব বোঝেন। এটা জাস্ট একটা কৌতুক, ঠিক না? ওয়েলডান ম্যাডাম জিয়া। রাজনীতিতে এমন জোকস এখন বিরল।

কিন্তু এই রাজনীতি আত্মঘাতী, বেগম জিয়া। এটা আপনাকে বুঝতে হবে।