সেই তিন ঘণ্টা

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 27 June 2017, 03:47 PM
Updated : 27 June 2017, 03:47 PM

নানান ধুমধাড়াক্কার মধ্যে নিভৃতে নিস্পন্দে, নিঃশব্দে নীরবে এসে চলে গেল সেই দিনটা যেদিনে বদলে গিয়েছিল পাক-ভারত উপমহাদেশের অগণিত মানুষের ভবিষ্যৎ, বদলে গিয়েছিল চিরকালের জন্য। কী হয়েছিল সেদিন? সেই তিনটা মর্মান্তিক ঘণ্টা কীভাবে বদলে দিল আমাদের ও প্রজন্মের ভবিষ্যৎ?

আজ হয়তো এটা গল্প ছাড়া আর কিছু নয়। একদিন যা ছিল জীবন, উন্মত্ত ঘটনার ঘনঘটায় আমাদের স্বাধীনতা-পরাধীনতা, উন্নতি-অবনতির নিয়ামক, আজ তা গল্প হয়ে গেছে।

পলাশী, ২৩ জুন ১৭৫৭
মস্ত বড় ময়দান পলাশী, মাঝখানে আমবাগান। নাম 'লক্ষবাগ'। লক্ষবাগ আমবাগানের দক্ষিণ ধারে ছাউনি ফেলেছেন লর্ড ক্লাইভ তার মোট তিন হাজার (মতান্তরে একত্রিশ শ) সৈন্য নিয়ে যার ৮০০ জন ইংরেজ ও পর্তুগিজ, বাকি সবাই মাদ্রাজি, পাঠান, রাজপুত, আফগান, রোহিলা, জাঠ এবং কিছু বাঙালি। বিশাল পুরুষ লর্ড ক্লাইভ, তীক্ষ্ম ধীশক্তিবলে যিনি কেরানি থেকে হয়ে উঠেছেন একটি জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা। তার জীবনে আজ, ১৭৫৭ সালের ২২ জুন, এই সন্ধ্যার মতো অস্থির সময় আর আসেনি। কাল যুদ্ধ হবে।

বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহর পঞ্চাশ হাজার (মতান্তরে ত্রিশ হাজার) সৈন্যের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন মাত্র তিন হাজার সৈন্য নিয়ে। ওদের ৩২, ২৪ আর ১৮ পাউন্ডের ৫৩টি কামানের বিরুদ্ধে তার আছে ছোট্ট ছয় পাউন্ডের মাত্র আটটি কামান। পারবেন কি তিনি? নিশ্চয়ই পারবেন। তার আসল শক্তি তো সেনাবাহিনী নয়। তার আসল শক্তি মীরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগম, নন্দকুমার, ইয়ার লাতিফ, মানিকচাঁদ, কৃষ্ণবল্লভ।

২৩ জুন সকাল আটটায় যুদ্ধ শুরু হল। মীরমদন এবং কাশ্মিরি মোহনলালের ১২ হাজার সৈন্য ও গোলাবর্ষণের মুখে ইংরেজ বাহিনী আমবাগানে লুকিয়ে পড়ল। অবিরাম গোলাবর্ষণ এবং অগ্রসরমান মীরমদন ও মোহনলালকে বাধা দেওয়ার শক্তি লর্ড ক্লাইভ আর অ্যাডমিরাল ওয়াট্সনের তখন নেই। আর ঠিক সেই মুহূর্তে এল সেই বৃষ্টি। সব গোলাবারুদ গেল ভিজে।

সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল মীরমদন, মোহনলাল এবং ফরাসি সৈনাধ্যক্ষ সিনফ্রে। কিন্তু এই আধঘণ্টার যুদ্ধেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে ইংরেজের পরাজয় আসন্ন। পরমুহূর্তে এল আঘাত। মীরমদন মরণাহত হলেন। তাঁকে নবাবের তাঁবুতে আনা হল। মারা যাওয়ার মুহূর্তে তিনি নবাবকে জানিয়ে গেলেন যদিও বাকি সব সেনাপতি এবং তাদের সৈন্যদল দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে, তবু শুধু মোহনলালই ইংরেজদের জন্য যথেষ্ট।

ওদিকে মোহনলাল আমবাগানে ইংরেজদের ঘিরে এনেছেন। মাত্র সময় আধঘণ্টা, তাহলেই ইংরেজদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটবে। কিন্তু এই আধঘণ্টা সময় তিনি পেলেন না। নবাবের আদেশ এল যুদ্ধ বন্ধ করতে। দিশেহারা মোহনলাল ছুটে গেলেন নবাবের কাছে। কিন্তু ততক্ষণে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ-রাজবল্লভের দল নবাবকে বুঝিয়েছে বিজয় তো সুনিশ্চিতই, সৈন্যরা ক্লান্ত হয়েছে, কাল আবার যুদ্ধ হবে।

মনে পড়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডানকার্কের কথা। লর্ড গর্টের অধীনে তিন লাখ ব্রিটিশ সৈনিক যখন সর্বহারা হয়ে শুধুমাত্র পরনের কাপড়টি নিয়ে ডিঙ্গি নৌকা, স্পিডবোট, ছোট্ট জাহাজ, মাছধরা জাহাজ, প্রমোদতরী, যুদ্ধজাহাজে শুধু প্রাণটা নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে ব্যস্ত, যখন জার্মান বিমানগুলো অনায়াসে ওপর থেকে বোমা ফেলে তাদের ধ্বংস করতে পারে, ঠিক তখনই হিটলারের আদেশ এসেছিল: "বন্ধ কর"।

দিশেহারা জেনারেল রোমেল, গুটেনবার্গ, গুডেরিয়ান, হিমলার ছুটে গিয়েছিলেন হিটলারের কাছে, লাভ হয়নি। চূড়ান্ত বিজয়ের মুখে লাগাম টেনে ধরা দিশেহারা মোহনলাল ছুটে গিয়েছিলেন নবাবের কাছে। লাভ হয়নি।

'অলক্ষ্যে অট্টহাসি হাসছে নিয়তি'
পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। মোহনলালের সৈন্যরা অস্ত্র সংবরণ করে তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছে। মীরজাফরের ইঙ্গিতে ক্লাইভ, ওয়াট্সন আর মেজর কিলপ্যাট্রিক পালটা আঘাত হানল। রায়দুর্লভ ইয়ার লতিফের সৈন্যরা খামাখা ছুটাছুটি করে নবাবের সৈন্যদের মধ্যে পরাজয়ের আতঙ্ক ছড়িয়ে দিল। রাজবল্লভ নবাবকে নানা কুকথায় আতঙ্কিত ও উদভ্রান্ত করে তুলল, মীরজাফর সসৈন্যে ইংরেজদের পক্ষে যোগ দিল, দিশেহারা নবাব রণাঙ্গন ছেড়ে মুর্শিদাবাদের দিকে পালালেন। নবাবহীন মোহনলাল ও সিনফ্রে হতোদ্যম হয়ে পড়লেন। বিকেল পাঁচটায় নবাবের তাঁবুতে উড়ল ইউনিয়ন জ্যাক। বিলেতের পতাকা।

নবাব মুর্শিদাবাদ মহল থেকে স্ত্রী লুৎফুন্নেছা আর শিশুকন্যা জহুরাকে নিয়ে রওয়ানা হলেন পাটনার উদ্দেশ্যে। ভগবানগোলা পার হয়ে গোদাগাড়ি থেকে নৌকা নিয়ে মহানন্দা নদীতে উজানে চললেন পাটনার দিকে। পাটনা কেন? কারণ, পাটনায় তখন নবাবের অনুগত ৫০ হাজার সৈন্য রাখা ছিল। কেন? কারণ, কিছুদিন আগে পারস্য সম্রাট আহমদ শাহ আবদালি দিল্লি দখল করেন। বাংলার দিকে আসতে পারেন এই ভেবে নির্ভীক নবাব ঘরে বাইরে শত ষড়যন্ত্রের মধ্যেও আহমদ শাহ্ আবদালির মতো শক্তিশালী সম্রাটকে বাধা দেওয়ার জন্য নিজের অর্ধেক সৈন্যকে এগিয়ে রাখেন পাটনায়।

এদিকে পলাশীর ঘটনা চতুর্দিকে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে। শুনে ভাগলপুর (বিহার) থেকে মঁসিয়ে লালি সসৈন্যে এগিয়ে আসছেন মহানন্দার দিকে। নবাবকে উদ্ধার করে পাটনা পৌঁছে দেবেন অনুগত ৫০ হাজার সৈন্যের কাছে। এই সেই ফরাসি মঁসিয়ে লালি, ইংরেজদের কুমন্ত্রণায় ভুলে যাঁকে নবাব কিছুদিন আগে সসৈন্যে নির্বাসিত করেছিলেন ভাগলপুরে। যাওয়ার আগে অশ্রুসজল নেত্রে বলেছিলেন:

"নবাব, আপনি রাজনীতির ভুল পথে পা বাড়ালেন।"

অগ্রসরমান দু'পক্ষের মধ্যে মাত্র তিন ঘণ্টার ব্যবধান। তার পরেই মঁসিয়ে লালির শক্তিশালী আশ্রয়ে পৌঁছুবেন নবাব। পাটনায় গিয়ে মিলিত হবেন অনুগত ৫০ হাজার সৈন্যের সঙ্গে, ফিরে আসবেন উন্মত্ত কালবৈশাখীর তাণ্ডবে। পালটা আঘাতে গুঁড়িয়ে দেবেন মীরজাফর-ক্লাইভের ষড়যন্ত্রের দুর্গ। আর ভুল হবে না। কারণ, ততদিনে শত্রুর মুখ চেনা হয়ে গেছে তাঁর। বাংলার মাটি থেকে মুছে দেবেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাম। বাংলা ইংরেজদের উপনিবেশ হবে না। ভারতবর্ষ হবে না পরাধীন ১৯০ বছরের জন্য। নীলচাষ হবে না। আঙুল কাটা হবে না মসলিন তাঁতীদের।

শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে গেছে।  সেই তিন ঘণ্টা এখনও স্তব্ধ হয়ে মহানন্দার ধারে দাঁড়িয়ে আছে।

[লেখকের 'বাংলার কথা কই' বইয়ের একটি অধ্যায়]