খুশির ‘ঈদ’ বনাম অস্বস্তির ‘ইদ’!

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 27 June 2017, 04:51 AM
Updated : 27 June 2017, 04:51 AM

ঈদ আসার আগেই এ বছর 'ঈদ' শব্দের বানান নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির 'ঈদ' নয়, অস্বস্তি ও বিরক্তি-জাগানিয়া বানানে লেখা হচ্ছে 'ইদ'। বলা হচ্ছে, 'ঈদ' বানান অশুদ্ধ। কারণ, বাংলা একাডেমির বানানের নিয়মানুসারে যাবতীয় বিদেশি শব্দে দীর্ঘ ঈ বা দীর্ঘ ঈ-কার নিষিদ্ধ।

ঈদের উপর হস্তক্ষেপ করার আগে প্রতিষ্ঠানটি অবশ্য নিজের নামটিও সংস্কার করে নিয়েছিল। বহুদিন নামের সঙ্গে 'একাডেমী' থাকার পর এখন 'বাংলা একাডেমি'।

বানান সংস্কারে কী কী সমস্যা হয়? শব্দের উচ্চারণ যেমন আমাদের ভাষাবোধের অংশ, তেমনি শব্দের বানানও শিক্ষিত বাঙালির ভাষাবোধের অংশ। 'ঈদ'-এর পরিবর্তে 'ইদ' লিখলে সেই ভাষাবোধ বা ভাষাব্যবহারের অভ্যাস কমবেশি ধাক্কা খায় বৈকি। শব্দকোষে শব্দ সম্ভবত একা থাকে না, যেমন 'ঈদ' শব্দের সঙ্গে ('আঙ্গুর'-এর থোকার মতো) জড়িয়ে থাকে 'ঈদুল ফিতর', 'ঈদি' বা 'ঈদী', 'ঈদোত্তর', 'ঈদপূর্ব' ইত্যাদি শব্দ।

পুকুরে একটিমাত্র ঢিল ছুঁড়লেও জলতরঙ্গ যেমন জলপৃষ্ঠের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তেমনি একটি শব্দে ধাক্কা দিলে ধাক্কা গিয়ে লাগে 'ঈদ' থেকে গঠিত বা 'ঈদ'-এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য শব্দগুলোতেও।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধাক্কা, বিশেষ করে 'ঈদ' বানানের উপর এই ধাক্কাটা অপরিহার্য ছিল কি না। প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণে 'বিদেশি বা কৃতঋণ শব্দ' নামে একটি অধ্যায় আছে বটে, কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো ভাষার শব্দকোষে বিদেশি কোনো শব্দ থাকতেই পারে না। ইংরেজিতে 'Chair' শব্দের যে উচ্চারণ সেই উচ্চারণ কি বাংলা ভাষায় বহাল আছে? সংস্কৃতে 'ধর্ম' শব্দের যে উচ্চারণ, সেটি কি বাংলায় আদৌ করা হয়? কোনো একটি শব্দ এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় প্রবেশ করতে হলে প্রান্ত-ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের নিয়ম মেনে শব্দটির খোল-নলচে পাল্টে যায়। শব্দটি আর উৎস-ভাষার শব্দ থাকে না, প্রান্ত-ভাষার শব্দ হয়ে যায়। আরবি বা ইংরেজি ভাষা থেকে আসা শব্দগুলো বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের নিয়ম মেনে বাংলা শব্দে পরিণত হয়ে তারপর বাংলা শব্দকোষে প্রবেশাধিকার পেয়েছে।

ঋণ খেলাপিতে যদিও বাঙালিদের জুড়ি নেই, তবু কারো কাছ থেকে অর্থ ঋণ নিলে সেই অর্থ ফেরৎ দেওয়ার একটা বাধ্যবাধকতা থেকেই যায়। আরবি বা ইংরেজি ভাষার শব্দকোষ থেকে বাংলা ভাষায় যেসব শব্দ 'ঋণ' নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কি ভবিষ্যতে কখনও ফেরত দেওয়া হবে? বাংলা উচ্চারণরীতি অনুসারে সেই শব্দগুলো এমনভাবে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে যে ইংরেজি বা আরবিতে সেগুলো আর ব্যবহারযোগ্য নেই। সুতরাং ফেরত দিতে চাইলেও ইংরেজি বা আরবিভাষী লোকেরা সেই শব্দগুলো আর ফেরত নেবে না। যে ঋণ কেউ ফেরত চায় না, কেউ ফেরত দেয় না, সেটাকে ঋণ বলে কী লাভ?

ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের সঙ্গে দইপাতার মিল আছে। পুরনো দইয়ের সঙ্গে নতুন দুধ মিশিয়ে যেমন নতুন দই পাতা হয়, তেমনি প্রান্ত ভাষার কাঠামোতে বিভিন্ন উৎস ভাষার শব্দ এসে জমে প্রান্ত-ভাষার পুষ্টি ও বিকাশ সাধিত হয়। দই খাওয়ার সময় কেউ জানতেও চায় না দুধের স্বাদ কেমন ছিল। সুতরাং ব্যক্তির কৌতূহল মেটানো ছাড়া একটি শব্দ কোন ভাষা থেকে এসেছে– সেটা জানার অন্য কোনো উপযোগিতা নেই, অন্তত ব্যাকরণের দিক থেকে নেই। সুতরাং বিদেশি শব্দের উচ্চারণ বা বানানের জন্যে আলাদা নিয়ম রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। বাংলা ব্যাকরণ থেকে কৃতঋণ বা বিদেশি শব্দের অধ্যায়টাই অবিলম্বে বাদ দেওয়া উচিত।

বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ যদি না-ই থাকে, তবে সব বাংলা শব্দের বানানে একধরনের নিয়ম প্রয়োগ করা হোক। মূর্ধন্য-ণ, মূর্ধন্য-ষ, দীর্ঘ ঈ, দীর্ঘ ঈ-কার, (খ–ত) ৎ ইত্যাদি বর্ণকে 'উজিরে খামাখা' বলে এক পাশে ঠেলে না রেখে পুরোদমে ব্যবহার করা হোক।

অনেকে বর্ণমালা থেকে একাধিক বর্ণ বাদ দিয়ে ভাষাকে সহজ করতে চান অথবা শিশুদের শিক্ষাভার লাঘব করতে চান। 'ঈদ', 'ইতিপূর্বে', 'ফলশ্রুতি', 'লক্ষ্য', 'উপরোক্ত' ইত্যাদি বানানকে যারা ইতিপূর্বে ভুল বলেছেন বা এখনও বলেন, অথবা বাংলা বর্ণমালা থেকে একাধিক বর্ণ বাদ দিতে পারলে যারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের কারোরই আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নেই। বর্ণমালায় একটা নতুন বর্ণ যোগ করার মুরোদ নেই, বর্ণ বাদ দিতে এক পায়ে খাড়া! একেই বুঝি বলে: 'ভাত দেবার ভাতার নয়, কিল দেবার গোঁসাই!'

এই অর্ধশিক্ষিত, অতি উৎসাহী গোঁসাইদের মুখের উপর সাফ সাফ বলে দিতে হবে: 'আমার ভাষা, আমার বর্ণমালায় হাত দিও না বাপু! তোমার হাফ-পণ্ডিতি অন্য জায়গায় গিয়ে দেখাও!'

ভাষা কখনও সহজ হয় না, ভাষা ভাষাই। ভাষাশিক্ষণের পদ্ধতি সহজ বা কঠিন মনে হতে পারে। যারা প্রমিত বাংলাকে সহজ করতে চায়, তাদের আমি চট্টগ্রামি বা ফরাসি ভাষা শিখতে আহ্বান জানাব। তখন তারা বুঝতে পারবে, কঠিন ভাষা কাকে বলে।

আরবি ভাষায় বানানে ও উচ্চারণে হ্রস্ব ও দীর্ঘ দুই ধরনের 'ই' আছে। 'ঈদ' শব্দটি প্রমিত আরবিতে দীর্ঘ 'ই' দিয়ে লেখা হয়। উচ্চারিত হয় 'আঈত'। এখানে ঈ-এর আগে যে 'আ' রয়েছে সেটির আগে একটি কণ্ঠমূলীয় রুদ্ধস্বর (গ্লোটাল স্টপ) থাকাতে (চট্টগ্রামি ভাষায় 'হাত' উচ্চারণে যেমনটা থাকে) দীর্ঘ ঈ-এর দৈর্ঘ আরও খানিক বেড়ে যায়।

বাংলার মতোই আরবিতে 'ঈদ' একাক্ষর বা মনোসিলাবিক শব্দ। এই শব্দে অক্ষরের অন্তে ঘোষ 'দ' ধ্বনি অঘোষ 'ত' ধ্বনিতে পরিণত হয়। যারা অতীতে 'ঈদ' বানান লিখেছিলেন, তারা আরবি ভাষায় 'ঈদ' শব্দের উচ্চারণে দীর্ঘ 'ই' আছে বলেই সেটা করেছিলেন। তাঁরা 'ত' এর পরিবর্তে 'দ' ব্যবহার করেননি। কারণ, তাঁরা লক্ষ করেছিলেন, বাংলাভাষীরা অক্ষরের শেষে ঘোষধ্বনি উচ্চারণে সক্ষম (যেমন 'বদ', বা 'রদ')।

তবে আমরা উপরে যেমনটা বলেছি, আরবিতে কোনো শব্দের কী উচ্চারণ বা বানান হয় সেটা বাংলা বানান বা উচ্চারণ নির্ধারণের সময় ধর্তব্যের মধ্যে না নিলেও চলবে। কারণ, আরবি আর বাংলার ধ্বনিতত্ত্ব আলাদা। মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীর যে কোনো ভাষায় বানানের দুটি নিয়ামক: ১. ধ্বনিতত্ত্ব এবং ২. ঐতিহ্য।

উচ্চারণ অনুসারে বানান নির্ধারিত হতে পারে, আবার ঐতিহ্যগতভাবেও (একাধিক কারণে) বানান নির্ধারিত হতে পারে। 'ঈদ' বানানটি ইতিমধ্যে আমাদের ভাষিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গিয়েছে বলে এই বানান ব্যবহার করলে কোনো ক্ষতি নেই। সংস্কৃত ব্যাকরণেও এ ধরনের প্রচলিত কিন্তু ব্যাকরণ-অসম্মত বানানকে গ্রহণযোগ্য করার প্রয়োজনে নিপাতনে সিদ্ধ, আর্ষ প্রয়োগ (বা গণপ্রয়োগ) ইত্যাদি নিয়ম ছিল।

প্রমিত বাংলায় দীর্ঘ স্বরধ্বনি নেই– এই অজুহাতে কি আমরা তথাকথিত কৃতঋণ শব্দ থেকে দীর্ঘ ঈ বা দীর্ঘ ঈ-কার তুলে দেব?

বাংলা ভাষায় দীর্ঘ স্বরধ্বনি নেই– কথাটা ঠিক নয়। প্রমিত বাংলায় দীর্ঘ স্বরধ্বনি অবশ্যই আছে, কিন্তু স্বরধ্বনির দৈর্ঘ ফোনেমিক নয়, অর্থাৎ স্বরধ্বনির দৈর্ঘের ভিত্তিতে দুই শব্দের মধ্যে অর্থগত পার্থক্য সৃষ্টি হয় না। তবে এটা শুধু বাংলার অন্যতম উপভাষা প্রমিত বাংলার ধ্বনিতাত্ত্বিক নিয়ম। অন্য উপভাষাগুলোতে এই নিয়ম খাটবে না, যেমন চট্টগ্রামিতে স্বরধ্বনির দৈর্ঘ ফোনেমিক বলে 'খাই' (আমি খাই) এবং 'খাআই' (আমি খেয়েছি) আলাদা শব্দ। এর মানে হচ্ছে, ই-এর দৈর্ঘ কম বা বেশি হলে প্রমিত বাংলার কিছু যায় আসে না।

সুতরাং 'গ্রীক', 'চীন' ইত্যাদি শব্দ দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে লেখা যেতেই পারে ঐতিহ্যের অজুহাতে। আবার এই শব্দগুলোতে ই-উচ্চারণ দীর্ঘ নয়– এই অজুহাতে যদি কেউ শব্দগুলোকে হ্রস্ব ই-কার দিয়ে 'গ্রিক', 'চিন' লেখে তাতেও কোনো ক্ষতি হবে না।

বানান সংস্কার করার সময় বড়দের সঙ্গে যুক্তিতে এঁটে না উঠতে পেরে সংস্কারকেরা সব সময় শিশুদের ভঙ্গুর কচিমনের দোহাই দেন। তাদের এই আচরণ দেখে মহাভারতের কথা মনে পড়ে যায়। মহাভারতের যুদ্ধে অন্যতম যোদ্ধা-নায়ক অর্জুন নিজের বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধে কোনোমতেই টিকতে না পেরে শিখণ্ডি নামক এক তৃতীয় লিঙ্গের যোদ্ধাকে রথের সম্মুখভাগে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা ছিল, পুরুষ ব্যতীত আর কারও শরীরে তিনি অস্ত্রাঘাত করবেন না। অবিলম্বে অর্জুনের শত শত তীরে বিদ্ধ হয়ে ভীষ্ম ভূমিতে পতিত হয়েছিলেন।

বানান সংস্কারকদের কুযুক্তি: বড়রা ভুল-শুদ্ধ যা খুশি লিখুক না, কিন্তু শিশুদের যেন একটাই বানান শেখানো হয়, কারণ তা না হলে তাদের কচি মনের উপর নাকি অনর্থক চাপ পড়বে।

জীবনের প্রতি পদে শিশুরা বিকল্পের সম্মুখীন হচ্ছে, বানান ছাড়া ভাষার অন্য সব ক্ষেত্রে বিকল্প লক্ষ করে করে প্রতিটি শিশু বড় হচ্ছে। কয়েকটি বানানে বিকল্প দেখলেই যদি 'ভেঙে যায় শিশুমন কাচেরি মতন', তবে হাজার পাঁচেক চিত্রলিপি এবং দুই-তিন সেট বর্ণমালা শিখতে গিয়ে জাপানি শিশুদের তো ধুলায় মিশে যাওয়ার কথা? তা তো হয় না। বছর দশেক বয়সের আগেই হাজার দুয়েক চিত্রলিপিসহ 'হিরাগানা' ও 'কাতাকানা'– এ দুই বর্ণমালা শিখে ফেলে বেশির ভাগ জাপানি শিশু-কিশোর। শিশুদের বেকুব ভাবা ঠিক নয়। তাদের ভাষা শেখার ক্ষমতা বড়দের চেয়ে বহুগুণ বেশি।

বানান সংস্কার মূল সমস্যা নয়, মূল সমস্যা বিকল্প বানান রহিত করা। সংস্কার কেউ করতে চাইলে করুন, কিন্তু বিকল্প বানানও বহাল থাকুক। কালের প্রবাহে যে কোনো একটি টিকে যাবে, 'বউ', 'বৌ', 'বাংলা', 'বাঙলা' বা 'বাঙ্গালা'-এর ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে।

কিন্তু বানান সংস্কার যারা করেন, তারা কখনই বিকল্পে বিশ্বাসী নন: "আমরা যে বানান ঠিক করে দেব, শুধু সেটিই শুদ্ধ, বাকি সব অশুদ্ধ। অশুদ্ধ বানান লিখলে নম্বর কেটে ফেল করিয়ে দেওয়া হবে। বিসিএস পরীক্ষায় যখন গোল্লা পাবে, তখন বুঝবে 'কত গমে কত আটা'।"

সংস্কারকদের তুঘলকি, অপেশাদার খামখেয়ালের শিকার হয় অসহায় শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী, ভাষাব্যবহারকারী। 'তুমি যে বানান শিখেছিলে সেটা ভুল ছিল!' বানান সংস্কার করে শিক্ষিত মানুষকে রাতারাতি অশিক্ষিত করে দেওয়া যায়।

অথচ বিকল্প আর বৈচিত্র্য ভাষার ধর্ম, জীবনের ধর্ম। উচ্চারণ, শব্দগঠন, বাক্যগঠন থেকে শুরু করে ভাষা বা ব্যাকরণের সব ক্ষেত্রে বিকল্প আছে। একই ভাব প্রকাশের জন্যে যে কোনো ভাষায় একাধিক শব্দ আছে। একই কথা কয়েকভাবে বলা যায়। সব ভাষার বানানে বিকল্প আছে। বাংলা ভাষার লাখ লাখ শব্দের মধ্যে শ দুয়েক শব্দের বানানে বৈচিত্র্য থাকলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।

কিন্তু পৃথিবীর কোনো সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠান বৈচিত্র্য বা বিকল্প পছন্দ করে না। যে কোনো দেশে সরকারের ধামাধরা বুদ্ধিজীবীরা সদা সর্বদা বিকল্প বানানের বিপক্ষে এবং যে কোনো অজুহাতে বানান সংস্কারের পক্ষে থাকে। কারণ, সংস্কার মানেই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কলাটা, মুলোটা 'টু-পাইস' প্রাপ্তিযোগ।

অথচ ভাষা ও ব্যাকরণের ক্ষেত্রে কত কাজই না করার আছে। ভোটচীনা, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষাসহ বাংলার যত প্রতিবেশী ভাষা রয়েছে সেসব ভাষার সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা-আলোচনা হওয়া প্রয়োজন, বাংলা ভাষাকে জানার স্বার্থেই। বাংলা ভাষা এক অনাবিষ্কৃত মহাদেশের মতো আমাদের পায়ের সামনে হেলায় পড়ে আছে, যেমন পড়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষের পায়ের সামনে। নালায়েক আমরা 'বাংলা ভাষা' নামক শাহজাদির নেকাবটি তুলতে সমর্থ হইনি এখনও, মুখ দেখা তো 'দূর কি বাত'।

বাঙালি জাতির উন্নয়নের স্বার্থেই বাংলা ভাষাকে জানা অপরিহার্য। ভবিষ্যতের প্রযুক্তিতে ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করবে। যন্ত্রানুবাসহ ভাষাবিষয়ক হাজারো গবেষণা শুরু হয়েছে পাশ্চাত্যে বহু দশক আগে। শ্রেফ ভাষাব্যবহারকারীদের সংখ্যার বিচারে বাংলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হয়ে উঠবে অদূর ভবিষ্যতে। ইংরেজি, চীনা বা ফরাসির মতো বাংলাকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কি আমাদের আছে? এই সক্ষমতা অর্জনের ন্যূনতম উদ্যোগও কি আমরা নিয়েছি?

অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও কেন আমাদের একাডেমি বা ইনস্টিটিউটগুলো এমন একটি বাংলা ব্যাকরণ জাতিকে উপহার দিতে পারেনি, যেটিতে আসলেই বাংলা ভাষার নিয়মকানুন থাকবে? কয়েক দশক পার হয়ে যাওয়ার পরও কেন আমরা ভাষাবিজ্ঞানসম্মতভাবে বাংলার প্রতিবেশী ভাষাগুলো বর্ণনা করার ব্যবস্থা করতে পারিনি?

একাডেমি বা ইনস্টিটিউটকেই বা দোষ দেব কেমন করে, যখন নিজেই জানি যে ভাষা নিয়ে গবেষণা করার জন্যে শত শত প্রশিক্ষিত ভাষাগবেষক দরকার এবং ভাষা গবেষক তৈরিতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। গত কুড়ি বছরে কুড়িটি গবেষণামূলক প্রবন্ধও লিখতে পারেননি বাংলাদেশের ভাষা গবেষকরা।

অবশ্য ভারত, ফ্রান্স, জাপানসহ অনেক উন্নত দেশের একাডেমিগুলোতেও একই অথর্ব অবস্থা লক্ষ করেছি। 'নেই কাজ তো খই ভাজ!' ভাষা একাডেমিগুলোতে করার মতো কাজ প্রচুর আছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু না করে, সরকারি অনুদান নিয়ে একাডেমির কর্তাব্যক্তিরা শুধু খই-ই ভাজে। সরকারি কাজে যা দস্তুর, কর্তাব্যক্তিরা মিটিংয়ের পর মিটিং করে আর 'সিটিং অ্যালাউন্স' নেয়। মাঝে-মধ্যে 'অলস মস্তিষ্কের শয়তানের কারখানা' থেকে দুই-একটি বিকল্পবিহীন বানান সংস্কারের প্রস্তাবও যদি বেরিয়ে না আসে, তবে গুচ্ছের বেতন-ভাতা কীভাবেই বা হালাল হবে!

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম! এমন একসময় ছিল যখন 'ঈদ', 'খ্রীষ্ট' বানানের কোনো বিকল্প ছিল না। শ সাতেক বছর ধরে 'ঈদ' এবং শ চারেক বছর ধরে 'খ্রীষ্ট' বাংলা শব্দকোষে থাকার পরেও বাংলা শব্দ হতে পারল না? আশ্চর্য! 'লক্ষ্য' এবং 'লক্ষ' আলাদা বানান ছিল। এখন এই দুই শব্দের বানান এক করে দেওয়া হয়েছে। 'উপরোক্ত' 'ইতিপূর্বে' শুদ্ধ বানান ছিল, এখন অশুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এই তিনটি সিদ্ধান্তের একটিও কোনো প্রশিক্ষিত ভাষাবিজ্ঞানী নিতে পারেন না। মানুষের ভোগান্তি বাড়ানো ছাড়া এসব ফালতু বানান সংস্কারের অন্য কোনো উপযোগিতা আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না।

ত্রিশের দশকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবিত বানানরীতি বিনা বাক্যব্যয়ে, চোখ বুজে অনুসরণ করে চলেছে বাংলাদেশের একাধিক ভাষা ও শিক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বানানের নিয়ম নির্ধারণ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়… ভাষাবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে তাঁরা 'সঠিক' বানান নির্ধারণে একাধিক ভুল করেছিলেন (এবং পরে সেসব ভুল স্বীকারও করেছেন)।

গুরুদের ভুল স্বীকার আমলে না নিয়ে উত্তরসূরিরা সেই ভুলগুলো প্রজন্মান্তরে সশ্রদ্ধচিত্তে বহন করছেন। কারণ, ভাষাবিজ্ঞানে তাদেরও না আছে কোনো প্রশিক্ষণ, না আছে ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে গবেষণার কোনো অভিজ্ঞতা।

ভাষা, ব্যাকরণ, বানান ইত্যাদি বিষয় হচ্ছে 'গরিবের বউ, সবার ভাবী'। সবাই বানান নিয়ে কথা বলতে চায়, বানানের গায়ে হাত দিতে চায়, অধিকার ও যোগ্যতা থাক বা না থাক। মেডিকেল সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি নেই, এমন কারও কাছে যদি আপনি চিকিৎসার জন্যে যান, তবে বিভ্রাট তো ঘটতেই পারে। 'ঈদ/ইদ' বানানবিভ্রাটের অন্যতম কারণ যে ভাষাবিজ্ঞানে উপযুক্ত প্রশিক্ষণহীনতা, এতে অন্তত আমার কোনো সন্দেহ নেই। ঈদে বাড়ি ফেরার হাজারো ঝামেলার 'বোঝার উপর' সঙ্গে এই নতুন একটি ঝামেলার 'শাকের আটি' যোগ না করলে কি চলতই না?

আমার কথাটি যখন ফুরাল, আশা করি নটে গাছটিও একদিন না একদিন মুড়াবে। আশা করব, রমজানের ঐ রোজার শেষে অস্বস্তির 'ইদ' নয়, খুশির 'ঈদ' ফিরে আসবে ফিবছর।

ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে 'ঈদ' সম্পূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য একটি বানান। কেউ যদি 'ইদ' লিখতে চান, তিনি লিখতেই পারেন, সেটি তার 'বানানিক' অধিকার। কিন্তু যারা তাতে রাজি নন, তাদেরও যে 'ঈদ' লেখার ষোল আনার উপরে আঠারো আনা অধিকার রয়েছে– এটিও যেন কেউ, কোনো অজুহাতে বিস্মৃত না হয়।