আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য, ধকলে ঈদযাত্রা ও বিপন্ন অর্থনীতি

রণেশ মৈত্র
Published : 10 Nov 2011, 06:38 AM
Updated : 24 June 2017, 04:46 AM

বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটি দৈনন্দিন ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আর এই বৃদ্ধির অজুহাত হাজারো; বন্যায় ফসল হানি, হাওরে বিপর্যয়, পাহাড়ে ধস, পরিবহন ধর্মঘট, খরাজনিত কারণে ফসলহানি, সরকারি গুদামে শস্য ঘাটতি, রমজান, ঈদ প্রভৃতি। চোখ বুজে যদি একটু ভাবা যায় দেখা যাবে যে, এসব কারণ বা অজুহাতগুলি ঘুরে ফিরে সারা বছরই থেকে যায়।

উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, এ বছর মে মাসে রমজান মাস শুরু হল। কিন্তু একে সামনে রেখে এক-দেড় মাস আগে থেকেই সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটতে শুরু হল। কিন্তু হাজারে কোনো পণ্যেরই স্বল্পতা আদৌ দেখা যায়নি।

সংবাদপত্রগুলিতে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির খবর প্রকাশিত হতেই বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বরাবরের মতোই বলে উঠলেন, বাজার কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে। এবার রমজানে কোনো প্রকার মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে না, কারণ সরকারের গুদামে বিস্তর পণ্য মজুদ আছে। কিন্তু তিনি বললেন না রমজানের এক-দেড় মাস আগে থেকেই যে পণ্যমূল্য হু হু করে বাড়তে থাকল, তা কেন? সরকারের পর্যবেক্ষণই বা কোথায়?

যদি তা থেকেই থাকে তবে তাতে মূল্য বৃদ্ধি ধরা পড়ল না কেন? সরকারি গুদামে 'যথেষ্ট' পণ্য মজুদ থাকা সত্ত্বেও যারা দ্রব্যমূল্য বাড়াল তাদের আইনের আওতায় আনা হল না কেন? নাকি রমজানের আগে বাড়ালে কোনো অপরাধ হয় না? অপরাধ হয় শুধুমাত্র রমজান শুরু হওয়ার পরে বাড়ালে?

মে মাসে রমজান শুরু হলেও ঈদ কিন্তু জুন মাসে। তাই এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি রমজান ও ঈদের দোহাই দিয়েই ঘটে চলেছে। সরকারের হুঁশিয়ারি? ব্যবসায়ীরা একে থোড়াই পরোয়া করে। কারণ, শতকরা ৭০ ভাগ সাংসদ-মন্ত্রীই তো ব্যবসায়ী পরিবার থেকে আসা।

রাজনৈতিক পরিবার থেকে বা রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য থেকে সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসার সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ ভাগ মাত্র। বাকিরা আমলা পরিবার থেকে আসা। তাই সঙ্গত কারণেই ব্যবসায়ীরা নিত্যনিয়ত সাধারণ মানুষের পকেট কাটা অব্যাহত রাখলেও বিষয়টি কদাপি সংসদের আলোচনায় আসে না। যেন কোথাও কিছু ঘটেনি বা ঘটছে না। মাননীয় সাংসদরা দিব্যি খোশ মেজাজে আছেন, মন্ত্রিসভাও তা-ই।

এর আগে ঘটে গেল হাওরে প্রবল বর্ষণজনিত ভয়াবহ বিপর্যয়। সেখানে লাখ লাখ মানুষের জীবনে হঠাৎ মারাত্মক বিপদ নেমে এল। ফসলহানি ঘটল বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জসহ চার-পাঁচটি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। আর যায় কোথায়? সেই ফেব্রুয়ারির মধ্যেই হাওরের ঘটনার অজুহাতে ঘটে গেল আরেক দফা বিপর্যয়। মোট কথা বছরের প্রথম ছয় মাস ধরেই দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটে গেল ওই অজুহাতগুলিকে কেন্দ্র করে। সরকার বরাবরের মতো নির্বিকার।

না, সরকার পুরোপুরি নির্বিকার থাকলেন ঢালাওভাবে এমন অভিযোগ আনতে চাই না। কারণ, অন্তত ১০ ভাগ ব্যবস্থা তো সরকার নিয়েছে তা স্বীকার করা উচিত।

রমজানের কারণে টিসিবি তাদের নির্ধারিত মূল্যে সীমিত পরিমাণ পণ্য বিক্রি করল বাজার নিয়ন্ত্রনের কথিত উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্য কি পূরণ হল তাতে? দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির গতি কি হ্রাস পেল? না, পায়নি। বরং টিসিবির ওই পণ্যের একাংশ ঘুরেফিরে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের দোকানেই বর্ধিত মূল্যে দিব্যি বিক্রি হল। কারণ, যে দরিদ্রদের জন্য এগুলি টিসিবি বিক্রি করল কম দামে, তা প্রকৃত গরিবদের ঘরে খুব একটা যায়নি শুধুমাত্র পণ্যের পরিমাণ অত্যাধিক সীমিত হওয়ায় এবং বিতরণ পদ্ধতির ত্রুটিগত কারণে।

এছাড়াও দুর্গত এলাকাগুলিতে সরকার স্বল্পমূল্যে ও বিনামূল্যে কিছু ত্রাণ বিতরণ করলেও মজুতদারদের বিরুদ্ধে কিছু হুঁশিয়ারি কর্তাব্যক্তিরা বিতরণ করতে ভোলেননি। এতে যা হওয়ার তা-ই হল। নগদ যে ত্রাণ ক্ষতিগ্রস্তরা পেলেন সেটুকুই লাভ। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি? তা ঘটতেই থাকল বেপরোয়াভাবে।

এভাবে গেল বছরের প্রথম ছয় মাস।

আসছে জুলাই-আগস্ট বর্ষাকাল। হয়তো তা আরও দু-একমাস চলতে পারে। অন্তত আবহাওয়াবিদদের ইঙ্গিত তেমনই। বর্ষায় মূল্যবৃদ্ধি যে পুনরায় ঘটবে তা আর অস্বাভাবিক কী? সে তো প্রতি বছরই ঘটে থাকে। তদুপরি আগস্টের শেষে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে পুনরায় আর আরেকটি ঈদ উৎসব চলে আসবে। আবার সৃষ্টি হবে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধির চমৎকার অজুহাত। তাহলে এভাবেই কাটবে সেপ্টেম্বর অবধি।

বাকি থাকে বছরের শেষ প্রান্তের দু-তিনটি মাস। কৃষকের ঘরে তখন বিস্তর ফসল থাকার কথা। তাই ওই সময়টা দ্রব্যমূল্য নিজ তাগিদেই কম থাকে। ফলে কৃষকের কপাল নতুন করে পুড়তে থাকে। 'নতুন' বলছি এ জন্য যে, দ্রব্যমূল্য নয় মাস ধরে যে বাড়ল তাতে কৃষক নয়, মজুদদারেরা লাভবান হয়েছে। কৃষকের হাত ছাড়া হয়ে গেছে তাদের উৎপাদিত ফসল অনেক আগেই, ফলে তারা উৎপাদন ব্যয়টাও ফসল বিক্রি করে পায় না।

এভাবেই বছরজুড়ে আমাদের দেশে ঘটতে থাকে মূল্যবৃদ্ধি, এবং তার তাপ-উত্তাপ গিয়ে লাগে শুধু স্বল্পবিত্ত-নিম্নবিত্ত-বিত্তহীন ৮০ ভাগ মানুষের জীবনে।

কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর বাকি দেশগুলিতে কী দেখা যায়? ভারতে উৎসব উপলক্ষে মূল্য হ্রাস ঘটে, এমনকি সোনা-রূপার গহনার ক্ষেত্রেও। সর্বত্র ব্যাপক প্রচারণা মূল্যছাড়ের। অস্ট্রেলিয়ায় তো অবিশ্বাস্য ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ে। যেমন নববর্ষ উপলক্ষে ব্যাপক মূল্যহ্রাস এক মাস ধরে, তার আগে বর্ষশেষের মূল্যহ্রাস মাসব্যাপী চলে। 'ফাদার্স ডে', 'মাদার্স ডে', 'ভ্যালেনটাইনস ডে'-তেও তা-ই।

না, সরকারি চাপে নয়। ব্যবসায়ীরা নিজে থেকেই এই মূল্য হ্রাস ঘটায়। ফলে ব্যাপক বিক্রির সুফলও পায় তারা। আর আমাদের দেশে উৎসব উপলক্ষে ফাঁদা হয় দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধির ফাঁদ। আর মূল্য একবার বাড়লে তা আর কোনোদিন কমে না। যেমন: আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে দিব্যি সরকার সেগুলির দাম বাড়িয়ে দেয়, যার 'চেইন ইফেক্ট' হিসেবে কৃষি, শিল্পপণ্য ও পরিবহনে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। দরিদ্ররা হয়ে থাকে তার শিকার। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাস ঘটে তখন কিন্তু বাংলাদেশে তেল-গ্যাসের মূল্য একটুও কমানো হয় না।

কিন্তু এর প্রতিবাদ নেই। সরকারি দল তো করবেই না। বিএনপি-জামায়াত, হেফাজত মার্কারাও চুপ। কিন্তু প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি? তারাও দিব্যি চুপচাপ। অথচ কৈশোরে দেখেছি কোলকাতায় সরকার ট্রামভাড়া মাত্র এক পয়সা বাড়ানোর ফলে হরতাল-অবরোধ, মিটিং-মিছিলে প্রকম্পিত হল গোটা কোলকাতা শহর। আর তা ঘটালো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তাৎক্ষণিকভাবে। পুলিশের গুলিতে একজন মৃত্যুবরণও করলেন। প্রত্যাহৃত হল ওই এক পয়সার বর্ধিত ট্রামভাড়া। জনতার বিজয় হল, কমিউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয়তা ও প্রভাব বাড়ল। আর এখানে? এখানকার বাম-প্রগতিশীল শক্তি দিব্যি ঘুমিয়ে, যদিও চালের দাম আজও হু হু করে বাড়ছে, বাড়ছে অন্যান্য জিনিসের দামও।

ঈদের অবশ্যম্ভাবী দিক হল যার যার বাড়ি ফেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে। দুটি ঈদেই এমনটি ঘটে। এক্ষেত্রেও নির্ঝঞ্ঝাট ঈদযাত্রার হাকডাক শোনা যায় মন্ত্রীদের মুখে, এর মধ্যে অগ্রণন্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। অথচ পথে নামা মানুষ মাত্রেই জানেন, আসল পরিস্থিতি কী। টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলে দেখা যাচ্ছে, কী অসহনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করছে মহাসড়কগুলোতে। এর মধ্যে দুর্ঘটনা তো আছেই।

অন্যান্য বার যেমন রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা থাকায় যানবাহনের দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণ যায়, প্রাণ যায় ঈদযাত্রী বহনের বাড়তি প্রয়োজনে লক্কর-ঝক্কর, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি পথে নামানোর ফলে অথবা অনভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণহীন ভুয়া বা ঘুষ দিয়ে কেনা ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়া ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি চালানোর ফলে অথবা বিশ্রামহীন-ঘুমহীন, ক্লান্ত ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি চালানো কিংবা এক হাতে স্টিয়ারিং অপর হাতে মোবাইলের কথোপকথনের ফলে দুর্ঘটনার প্রাণ যায়। কিন্তু যতই প্রাণ যাক এ ব্যাপারে কারো কোনো শাস্তি হওয়ার খবর পাওয়া যায় না।

মন্ত্রী মহোদয় এ সময় মাঠ-ঘাট ঘুরে বেড়ালেও না হয় রাস্তার উন্নতি, না হয় লক্কর-ঝক্কর মার্কা গাড়ি চালানো বন্ধ, না হয় অবৈধ পন্থায় অর্জিত লাইসেন্স নিয়ে অনভিজ্ঞ অপ্রশিক্ষিত ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ।

এহেন সমস্যাজর্জরিত দেশে এসেছে বাজেট অধিবেশন। অর্থমন্ত্রী তাঁর খসড়া বাজেট সংসদে কয়েক সপ্তাহ আগেই পেশ করেছেন। তিনি এই বাজেট করেছেন বিশাল অংকের যা অতীতে কোনোদিন হয়নি। যত আশাবাদ তিনি দেখিয়েছেন, বোধকরি, তিনিও জানেন তা পূর্ণাঙ্গভাবে বা অর্ধেকের বেশি বাস্তবায়ন হবে না। হয়নি কোনোদিন। কেন হয় না তা-ও খতিয়ে দেখা হয় না কখনও। ফলে প্রকল্প ব্যয় বাড়ে, তার মেয়াদও বাড়ে দফায় দফায়। হয়তোবা ওই বাড়তি ব্যয় মেটানো হয় বাজেটের অব্যবহৃত অর্ধাংশের মাধ্যমে। ক্ষতি হয় জনগণের, কারণ বাজেটের টাকা তো তাদেরই টাকা।

এর ওপর এবার ভ্যাটের আওতা ব্যাপক বৃদ্ধির প্রস্তাবে সংবাদপত্র শিল্প পড়েছে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। এ শিল্পকে বাঁচাতে হবে। অনুকূল পরিস্থিতি তৈরির জন্য ভ্যাটে সংস্কার আনা হোক।

তদুপরি আবগারি শুল্কসহ ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর অমানবিক প্রস্তাবও তিনি দিয়েছেন মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত কোটি কোটি মানুষের প্রতিকূলে গিয়ে। কিন্তু ব্যাংক ডাকাতি করে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিল তা উদ্ধারের কোনো কথাই শোনা গেল না অর্থমন্ত্রীর সুদীর্ঘ বাজেট বক্তৃতায়। ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার সুদের হার কমতে কমতে যে শূন্যের কোটায় প্রায় পৌঁছেছে তা থেকে তিনি আরও কমানোর প্রস্তাব রেখে প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছেন মন্ত্রী-এমপি ও জনগণের দ্বারা।

তাঁর নজর পড়েছে সঞ্চয়পত্রের প্রতিও। যাঁরা বয়স্ক ও রিটায়ার করে বসে আছেন তাদের সংসার চালাতে হয় ওই সঞ্চয়পত্রে ও ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদে গচ্ছিত টাকার বিনিময়ে প্রাপ্ত সুদের টাকায়। এগুলি বন্ধ করে কার স্বার্থ রক্ষা করা হবে? সরকারের? সরকার কতইবা পাবে এখান থেকে?

এই বাজেট আরও নানাদিক থেকে গণবিরোধী। ঈদের আগে থেকে দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া উল্লম্ফনের মুখে এই গণবিরোধী বাজেটের দ্রুত মৌলিক সংস্কার করে তাকে গণমুখী করা হোক। বর্ধিত প্রস্তাবগুলি প্রত্যাহার ও ব্যাংক সুদের হার কমানো নয়, তা বরং বাড়ানো হোক। নইলে মানুষ ব্যাংকমুখী হবে না এবং আরেক বিপদে পড়বে অর্থনীতি। বরং অলস টাকা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে ব্যাংকের আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হোক, সঞ্চয়পত্রের সুদের বর্তমান হারও অব্যাহত রাখা হোক।