ধিক এই রাজনীতি, ধিক!

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 22 June 2017, 04:45 AM
Updated : 22 June 2017, 04:45 AM

দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল রাঙামাটি যাওয়ার পথে রাঙুনিয়া উপজেলার ইছাখালি বাজারে বাধা দেওয়া হয়েছে। তারা পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছিল। প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড় ধসে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে ১৩ জুন, আর বিএনপির প্রতিনিধি দল সেখানে যাচ্ছিল ১৮ জুন।

মির্জা আলমগীরের গাড়ি বহরে কয়েকজন যুবক লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণ করে। মির্জা আলমগীর এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। কয়েকটি গাড়ির কাঁচ ভেঙে চুরমার হয়েছে। যে বা যারা যে উদ্দেশ্য নিয়েই এই অঘটন ঘটিয়ে থাকুক না কেন, কাজটি মোটেও ভালো হয়নি। এ ধরনের কাজ অবশ্যই নিন্দনীয় এবং কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও বিষাক্ত হওয়ার উপাদান যুক্ত হল।

বিএনপির মহাসচিব তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন:

"কার কী আঘাত লেগেছে সেটা বড় কথা নয়। এই আঘাত গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত। এই আঘাত যারা রাজনীতিতে মুক্তচিন্তা করেন তাদের প্রতি। যারা সরকারের খারাপ কাজের বিরোধিতা করেন, এই আঘাত তাদের প্রতিও।"

কারা এই হামলা করল? বিএনপির প্রতিনিধিদলকে কারা পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে বাধা দেওয়ার কুমতলব আঁটল?

মির্জা আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন:

"ওই এলাকার এমপি আওয়ামী লীগের বড় পদে আছেন। তার ইন্ধন আছে কি না, সেটা আপনারা তদন্ত করুন।"

তিনি সরাসরি না বললেও বিএনপির আরেক সিনিয়র নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অভিযোগ করেছেন, এই হামলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ করেছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন:

"আওয়ামী লীগ তাদের যতটুকু দায়িত্ব তা পালন করেনি। দুর্যোগের যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে বড় দল হিসেবে বিএনপির মহাসচিবের নেতৃত্বে একটি দল সেখানে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। দলটি সেখানে সাহায্য করবে বলে যেতে চেয়েছে। যখনই বিএনপি সেখানে গেছে, তখনই আওয়ামী লীগের লোকজনেরা আক্রমণ করেছে। দেশের এই অবস্থা যে, বিএনপি কোথাও গেলেই আক্রমণ হবে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে আর কোনো নিরাপত্তা নেই।"

বিএনপি মহাসচিবের গাড়িবহরে হামলার জন্য অভিযোগের আঙুল আওয়ামী লীগের যে কেনদ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে উঠেছে, রাঙুনিয়ার সেই সংসদ সদস্য ড. হাছান মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেছেন:

"বিএনপি নেতাদের গাড়িবহর দুইজন পথচারীকে ধাক্কা দেয়। এরপর সেখানে উত্তেজিত লোকজন কিছু একটা করেছে।"

তিনি আরও বলেছেন:

"পাহাড় ধস হলো এক সপ্তাহ আগে। আর বিএনপি নেতারা এখন সেখানে যাচ্ছিলেন। তাও আবার হামলার অজুহাত তুলে রাঙামাটি না গিয়ে ফিরে এসেছেন। বিষয়টি নাটক মনে হচ্ছে।"

হাছান মাহমুদের বক্তব্য থেকে যে কারো কাছেই এটা স্পষ্ট হবে যে, 'নাটক' যদি কিছু হয়েই থাকে তাহলে তার চিত্রনাট্য রচনা করেছেন তিনি নিজেই!

দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, হামলার পর বিএনপি নেতারা গাড়ি ঘুরিয়ে শহরের দিকে রওনা হন। তখন ১৫-২০ জন যুবক 'হাছান ভাই এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে' ও 'জয়বাংলা' বলে স্লোগান দিচ্ছিল। সে সময় পুলিশের একটি গাড়ি মিছিলকারীদের বিপরীত দিক থেকে আসছিল। রাস্তায় কয়েকজন পুলিশ সদস্যকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

বিএনপি নেতাদের গাড়িবহরে হামলাকারীদের পরিচয় বোঝার জন্য পুলিশের আচরণই যথেষ্ট। তারা যদি 'হাছান ভাইয়ের লোক' না হতেন তাহলে পুলিশ এত নির্লিপ্ত ও উদাসীন থাকত না। হামলাকারীদের সঙ্গে ঘটনার পরপরই হাছান মাহমুদ ফটোসেশন করেছেন বলেও একটি জাতীয় দৈনিকে খবর বের হয়েছে। বিএনপির প্রতিনিধি দলকে বাধা দেওয়ার ঘটনাটি সরকারের জন্য লাভজনক হয়নি।

বিএনপি সবসময় 'ইস্যু' খোঁজে। আওয়ামী লীগ তাদের হাতে ইস্যু তুলেও দেয়। কিন্তু বিএনপি তা কাজে লাগাতে পারে না। তবে দেশে সাধারণ মানুষের অবস্থান সবসময় হামলাকারীদের বিরুদ্ধে, আক্রান্তের পক্ষে। রাঙুনিয়ার ঘটনায়ও বিএনপির প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেড়েছে। সবমহল থেকেই এই হামলার নিন্দা জানানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগের মিত্ররাও সমর্থন জানানোর জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না।

আশার কথা এটুকু যে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের 'শাক দিয়ে মাছ ঢাকা'র চেষ্টা না করে হামলার নিন্দা করেছেন। হামলাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনার কথাও বলেছেন। শেষ পর্যন্ত সেটা হয়তো হবে না। হলে ভালো হত। সরকারের ভাবমূর্তিতে একটু চুনকাম করা যেত এই বলে যে, দুর্বৃত্তদের প্রতি সরকারের সমর্থন নেই।

সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের 'মহানুভবতা' আশা করা যায় না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই এমন দাঁড়িয়েছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য 'উচিত-অনুচিত' যে পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন, তার বিরোধিতা কেউ করে না। রাঙুনিয়ায় বিএনপি নেতাদের গাড়িবহরে যারা হামলা করেছে, তাদের যদি খুঁজে পাওয়াও যায়, দেখা যাবে শাস্তির বদলে হয়তো তারা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী হয়ে বসবেন।

বিএনপি নেতারা যাচ্ছিলেন রাঙামাটি। প্রশ্ন উঠেছে, পথে বাধা পেয়ে গন্তব্যে না গিয়ে তারা ফিরে এলেন কেন? তারা তো ভাঙা গাড়ি এবং আহত শরীর নিয়ে দুর্গতজনদের পাশে গিয়ে তাদের দুর্গতির কথা তুলে ধরতে পারতেন।

তারা কি সত্যি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, নাকি সংবাদ শিরোনাম হতে চেয়েছিলেন? তারা কি ত্রাণসামগ্রী বা নগদ অর্থ নিয়ে যাচ্ছিলেন, নাকি সরকারি ব্যর্থতার কথা বয়ান করতে যাচ্ছিলেন?

এমনিতেই বিএনপি প্রতিনিধি দল দুর্ঘটনাস্থলে যাচ্ছিলেন অনেক দেরিতে। পাহাড় ধসে বাঙালি বেশি মারা গেছেন, না পাহাড়ি এটা বুঝে উঠতে না পেরেই নাকি বিএনপির এই বিলম্ব। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে পাহাড় ধস নিয়ে রাজনীতি করাটাই যেন তাদের উদ্দেশ্য ছিল।

বিএনপি এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। রাঙামাটি কিছু ত্রাণ তৎপরতা চালালে এবং সরকারি ব্যর্থতার ঢাক পেটালে যতটুকু পাবলিসিটি পাওয়া যেত, হামলার ঘটনায় তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পাবলিসিটি পাওয়া গেছে। সবাই এখন সরকারের সমালোচনা করছে এবং বিএনপির প্রতি দরদ দেখাচ্ছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ইছাখালিতে বাধা পেয়ে দুই কিলোমিটার দূরে পোমরার একটি মাদ্রাসায় বিএনপি নেতারা আশ্রয় নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। মির্জা আলমগীর তাঁর শার্ট পরিবর্তন করেন। সেখানে রাঙুনিয়া থানার ওসি উপস্থিত হয়ে বিএনপি নেতাদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী তখন ইছাখালিতে পুলিশের নির্লিপ্ত ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন এবং ওসির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর নেতারা চট্টগ্রাম শহরের দিকে রওনা দেন।

বিএনপি নেতাদের এই যাওয়া-আসা আওয়ামী লীগের কারো কারো কাছে 'রহস্যজনক' বলে মনে হচ্ছে। রাঙুনিয়া থানার ওসি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিএনপি নেতাদের যাওয়ার কথা ছিল রাঙামাটির মূল সড়ক দিয়ে। তারা গাড়ির গতিপথ পরিবর্তন করে কাপ্তাই সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন বলে পুলিশ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বিএনপি নেতারা তাদের গতিপথ পরিবর্তন করলেন কেন? তারা কি জানতেন, এই পথ পরিবর্তন করলেই তারা আরও বেশি বড় 'খবর' উপহার দিতে পারবেন?

খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন:

"এটি সরকারের হিংসাশ্রয়ী অসুস্থ রাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ।"

কথাটা অসত্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের হিংসাশ্রয়ী অসুস্থ রাজনীতির বিপরীতে বিএনপি কি প্রেমময় সুস্থ রাজনীতির চর্চা করছেন?

পাহাড় ধসের ঘটনার দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিপক্ষীয় সফরে সুইডেন যাত্রা করেছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসন সে জন্য প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ করে অনেক ব্যঙ্গ- বিদ্রূপ করেছেন। শেষ মুহূর্তে সুইডেন সফর বাতিল করা সম্ভব ছিল কি না, জানি না। তবে প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে গোটা সরকারকেই অনুপস্থিত বলে মনে হয়েছে।

পর্তুগালে অতি সম্প্রতি দাবানলে ৬৫ জনের মৃত্যু হওয়ায় দেশটি তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে। আমাদের দেশে দুজন সামরিক কর্মকর্তাসহ দেড় শতাধিক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও সরকারের ভাবসাব দেখে মনে হয়নি তারা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। সেজন্য সরকারের সমালোচনা করা যেতেই পারে।

প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা না হয় বিদেশ সফরে গিয়ে 'আনন্দ-ফুর্তি' করেছেন। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন ও একাধিকবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশে থেকে কি করেছেন? তিনি কি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে ছুটে গেছেন?

জৌলুসপূর্ণ ও ব্যয়বহুল একটি ইফতার পার্টি বন্ধ রেখে দুর্গতদের সাহায্য করার কথা খালেদা জিয়ার কেন একবারের জন্যও মনে হয়নি? দলের নেতাকর্মীদের দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ কেন দেওয়া হয়নি? শেখ হাসিনা তথা সরকারের সমালোচনা করা বিরাট মওকা পেয়ে খালেদা জিয়া কি তাঁর নিজের কর্তব্য ভুলে গেছেন?

শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে পাহাড়ে গিয়ে খালেদা জিয়া যদি বলতেন, 'এই যে দেখেন, তিনি আপনাদের পাশে নেই কিন্তু আমি আছি' তাহলে তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা কি আরও বাড়ত না?

মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর করা নয়, একে পুঁজি করে রাজনীতি করাই যদি লক্ষ্য হয় তাহলে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়। শেখ হাসিনা দেশে ছিলেন না, আর খালেদা জিয়া দেশে থেকেও দূরে থাকলেন। এ অবস্থায় কার নিন্দা আর কার প্রশংসা করা হবে?

সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে বেসামাল, আর বিএনপি 'লেট লতিফ'। মানুষ যাবে কোথায়?