পচা শামুকে পা কাটবেন না

সাইফুর রহমান তপন
Published : 21 June 2017, 03:52 PM
Updated : 21 June 2017, 03:52 PM

অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত অবশেষে ব্যাংক হিসাবের ওপর বিতর্কিত আবগারি শুল্ক বিষয়ে তাঁর সিদ্বান্ত পরিবর্তনের কথা জানিয়েছেন। ১৮ জুন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে তিনি বলেছেন, এ সংক্রান্ত একটা ঘোষণা বাজেট পাসের সময়ে দেওয়া হবে।

কিন্তু বাজেট পাস হবে ঈদের পর, সবাই যাতে এখনই 'স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে', তাই তিনি বিষয়টা আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, গত ৮ জুন সিলেটে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আবগারি শুল্ক কমানোর বা প্রত্যাহারের কোনো পরিকল্পনা তাঁর নেই।

তিনি এমন সময়ে এ কথা বলেছিলেন, যখন বিষয়টা নিয়ে সরকার সমর্থক-সরকারবিরোধী সবার মধ্যেই নেতিবাচক আলোচনা চলছিল। সংসদেও বিরোধী দলতো বটেই সরকারি দলের সদস্যরাও এর সমালোচনায় মুখর ছিলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও জাতীয় প্রেসক্লাবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সাংবাদিকদের এক ইফতার মাহিফলে বলেছিলেন, বাজেটে কোনো সমস্যা থাকলে তা সংশোধন করে নেওয়া হবে।

এ ধারণা করা অসঙ্গত হবে না যে, জনমতের প্রতি অর্থমন্ত্রীর ওই 'থোড়াই কেয়ার' ভাব সরকারের নীতিনির্ধারকদের ক্ষুব্ধ করে থাকতে পারে, যার ফলে অর্থমন্ত্রী ১৮ জুনের ঘোষণাটি দিতে বাধ্য হয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি সংসদে দেওয়া সরকারের অন্যতম প্রভাবশালী মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর ভাষণটি স্মরণ করা যেতে পারে। সেখানে তিনি ব্যাংক হিসাবের ওপর আবগারি শুল্ক চাপানোর বিরুদ্ধে খুব কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। অর্থ প্রতিমন্ত্রীও (বাজেট প্রণয়নে যাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থাকার কথা) এ ধরনের শুল্ক চাপানোর সিদ্ধান্তকে অসময়োচিত বলে বর্ণনা করেছেন।

এ ঘটনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, বাজেটে ব্যাংক হিসাবের আবগারি শুল্ক সম্পর্কিত প্রস্তাবটি অর্থমন্ত্রীর একার, এবং সংসদে পেশের জন্য অনুমোদন দেওয়ার আগে মন্ত্রিসভার সদস্যরা বাজেট প্রস্তাবগুলো খুব একটা তলিয়ে দেখেননি। বিষয়টা এমনও হতে পারে যে, বাজেট প্রণয়নের ব্যাপারটা তাঁরা পুরোপুরি অতি অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন, অথবা অর্থমন্ত্রী নাখোশ হতে পারেন ভেবে অন্তত মন্ত্রিসভায় তাঁর কোনো প্রস্তাবের তাঁরা বিরোধিতা করেন না। কারণ যা-ই হোক, অর্থমন্ত্রীকে এভাবে 'ব্ল্যাংক চেক' দেওয়ার ফলে জনমত তোয়াক্কা না করার ব্যাপারে তাঁর মানসিকতা দিন দিন বেড়েই চলেছে, যা প্রায়ই সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে।

এ প্রসঙ্গে গত বছর তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর অযৌক্তিক ভ্যাট বসিয়ে ঢাকা শহরে যে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন সেই ঘটনার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। একই মানসিকতা থেকেই তিনি কিছুদিন আগে হুট করে ঘোষণা দেন যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেতন পাঁচগুণ বাড়ানো হবে, যা বাস্তবায়িত হলে সত্যিই গোটা দেশেই দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যাবে।

জাতীয় বেতন স্কেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান নিয়েও তিনি প্রায় এককভাবেই ভীষণ একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিলেন। সম্প্রতি তিনি নাকি এমনও বলেছেন যে, তাঁর স্বপ্ন হল কৃষকদেরও ভ্যাটের আওতায় নিয়ে আসা। যদি সত্যি সত্যিই তিনি অদূর ভবিষ্যতে তাঁর এ উদ্ভট স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে যান তাহলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা বুঝতে কাউকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতে হবে না।

অর্থমন্ত্রী একজন ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। বহুবছর ধরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখনও তিনি মূলত তা-ই রয়ে গেছেন। জন্মগতভাবে তিনি 'এলিট'। আমজনতার সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ তাঁর জীবনে কমই ঘটেছে, তাই তাদের অনুভূতির মূল্য তাঁর কাছে খুব একটা নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। আবার জীবনের একটা বড় অংশ তিনি কাটিয়েছেন পাশ্চাত্যে। সেখানে যা যা দেখেছেন, অন্য আধুকিতাবাদীদের মতো, তার সবই তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে অন্ধভাবে এখানে প্রয়োগ করতে চাইছেন।

এ কথা ঠিক যে, অর্থমন্ত্রী শুধু ইংরেজি সাহিত্যের কৃতি ছাত্র ছিলেন না, অর্থনীতিও তিনি কারও চেয়ে কম বোঝেন না। এ মন্ত্রণালয়ে তিনি আমলা হিসেবে বহুবছর কাটিয়েছেন, আবার মন্ত্রী হিসেবেও এ মন্ত্রণালয়ে আছেন অন্য যে কারও চেয়ে বেশি সময় ধরে। তিনিই বাজেটের আকার ৯৯ হাজার কোটি টাকা থেকে চার লাখ কোটি টাকায় তুলেছেন।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি শুধু সাতের ঘরেই তোলেননি, তিনি এ প্রবৃদ্ধির উন্নতিতে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন, যা সহজ কোনো বিষয় নয়; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেখানে ইউরোপ, আমেরিকার অর্থনীতিতে টানা মন্দাবস্থা চলছে। ব্যাংকিং খাতে অনেক বড় বড় কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও এ সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতি টালমাটাল হয়নি। বাজেট ঘাটতি কখনও জিডিপির পাঁচ শতাংশ ছাড়ায়নি, মূল্যস্ফীতিও গত কয়েক বছর ধরে সহনীয় পর্যায়ে আছে। মোদ্দা কথা, অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুহিত সাহেব অসফল, এমনটা দাবি করা খুব কঠিন। বাংলাদেশের অতীতের যে কোনো অর্থমন্ত্রীর চেয়ে সম্পদ আহরণ, ব্যয় ও ব্যবস্থাপনায় তাঁর সাফল্য অনেক বেশি।

কিন্তু এটাও ঠিক যে, এসব সাফল্য নিয়ে আলোচনা খুব একটা হয় না। এ জন্য সরকারের সমালোচকদের নেতিবাচক প্রবণতা যতটা দায়ী, ঠিক ততটাই দায়ী অর্থমন্ত্রীর মুখের উটকো বুলি আর তপ্ত মেজাজ। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যে কোনো সমালোচনাকেই তিনি 'রাবিশ' বলে উড়িয়ে দেন, আর এ নিয়ে গণমাধ্যমে চলে বছরব্যাপী আলোচনা।

২০১০ সালে শেযার কেলেঙ্কারি নিয়ে যখন তুমুল আলোচনা চলছে তখন তিনি বলে দিলেন, এটা একটা 'ফাটকা বাজার', এ নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল এ নিয়ে বিরূপ আলোচনা। হল মার্ক কর্তৃক মেরে দেওয়া সোনালী ব্যাংকের ৪,০০০ কোটি টাকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ২০১২ সালে তিনি বললেন, এ অংকটা তেমন কিছুই না, তখনও এ নিয়ে বেশ হৈ চৈ হল। এবারও যখন সবাই ব্যাংক হিসাবে গচ্ছিত অর্থের ওপর চাপানো আবগারি শুল্কের বিরোধিতা করছিল তখন তিনি বলে দিলেন এক লাখ টাকার আমানতকারীরা নাকি 'স্বচ্ছল' লোক। আর এ নিয়ে প্রায় সব গণমাধ্যমে নানা মুখরোচক আলোচনা এখনও চলছে।

এদিকে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, তিনি শুধু ব্যাংক হিসাবের ওপর বর্ধিত আবগারি শুল্কটুকু পরিবর্তন করতে চান। কিন্তু পরিস্থিতি যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে কি এটুকুতে 'স্বস্তি' মিলবে?

সাবেক বংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন ঠিকই বলেছেন, শুল্ক বাড়ানোর নামে অর্থমন্ত্রী একটা সুপ্ত জিনিস জাগিয়ে তুলেছেন; শুধু তা-ই নয়, এটাকে তিনি আগ্নেয়গিরি রূপে জাগিয়ে তুলেছেন। এখন কোনো টোটকায় কাজ হবে না।

অর্থমন্ত্রীর এ কথা সত্য যে, এ ব্যাংক হিসাবের ওপর আবগারি শুল্ক অনেক আগে থেকেই ছিল, তিনি এতে যে পরিবর্তন এনেছেন তাতে খুব বেশি সংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। কারণ, জনসংখার খুব সামান্য অংশ নিয়মিত ব্যাংকে হিসাব পরিচালনা করেন।

আবার ৮০-৮৫ শতাংশ ব্যাংক হিসাবে স্থিতি এক লাখ টাকার নিচে থাকে। কিন্তু অর্থমন্ত্রীকে বুঝতে হবে যে কখনও কখনও অতি তুচ্ছ একটা বিষয়ও রাজনীতিতে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়, উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই জনমানসকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। শুধু তা-ই নয়, কখনও কখনও তা জনগণের মধ্যে একধরনের 'কালেক্টিভ ম্যাডনেস' (কেউ কেউ এর বাংলা করেন 'সম্মিলিত উন্মাদনা') সৃষ্টি করে, যা সরকারের জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এ ধরনের পরিস্থিতিকে অনেকে 'পচা শামুকে পা কাটা'র সঙ্গে তুলনা করেন। হয়তো এমন কোনো পরিস্থিতি আঁচ করেই সরকারি দলের নেতা-সাংসদরাও আবগারি শুল্কের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।

অর্থমন্ত্রীকে এটা মানতে হবে যে, আবগারি শুল্কসম্পর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে সরকারের প্রাপ্তি হবে খুবই সামান্য, টাকার অংকে যা এক হাজার কোটি টাকার চেয়ে কিছু বেশি, দশ লাখ টাকার নিচের আমানতকারীদের বাদ দিলে যা তিনশ বা চারশ কোটি টাকার বেশি হবে না। কিন্তু এর ফলে সরকারের ক্ষতি যা হবে তা এর চেয়ে বহুগুণ টাকা খরচ করেও পূরণ করা যাবে না।

তিনি হয়তো খেয়াল করেছেন যে, যারা প্রতিবারের মতো এবারও বাজেটের বিরোধিতা করছেন তাদের হাতে এই আবগারি শুল্ক ছাড়া আর কোনো ইস্যু নেই। তারা নতুন ভ্যাট আইন (যা একটু ঘষা-মাজা করলে একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে) নিয়ে সমালোচনা করছেন বটে, কিন্তু এ সমালোচনা ভোঁতা হয়ে যাবে যদি বর্ধিত ভ্যাটের কারণে বিদ্যুৎ-গ্যাসের মতো কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় আইটেমের দাম যতটুকু বাড়বে তা অন্যভাবে ম্যানেজ করা হয়।

মাননীয় অর্থমন্ত্রী, ব্যাংক হিসাবের আবগারি শুল্ক নিয়ে গোঁ ধরবেন না; আমলাসুলভ মানসিকতা ছেড়ে একটু রাজনীতিমুখী হোন। এতে আপনার ভালো হবে, সরকারের ভালো হবে, দেশেরও ভালো হবে।