নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপির উপায় কী?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 17 June 2017, 04:22 AM
Updated : 17 June 2017, 04:22 AM

নির্বাচনের আরও বছর দেড়েক বাকি থাকলেও দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক মাস ধরেই প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় দেশবাসীকে নৌকায় ভোট দেওয়ার আগাম আহ্বান জানাচ্ছেন। শেখ হাসিনা আশা করছেন, তাঁর সরকারের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী নির্বাচনেও জনগণ নৌকায় ভোট দেবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বলেছেন, আগামী নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর দল বিজয়ের 'হ্যাট্রিক' উদযাপন করবে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সবাই পরের নির্বাচনের জয়ের খোয়াব দেখছেন। বিতর্কিত বা অগ্রহণযোগ্য কাউকে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী না করার কথা জানিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।

নানা রকম জরিপের কথা বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নাকি মন্ত্রী-এমপিদের আমলনামা রয়েছে। যারা দুর্নীতি-লুটপাটে জড়িত তাদের ভাগ্যে নাকি এবার মনোনয়ন জুটবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে না তো?

টানা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সবাই না হলেও অনেকেই যে বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগের ভেতরে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের সমস্যা। আওয়ামী লীগের মধ্যে তৈরি হয়েছে আরও আওয়ামী লীগ। দলের মধ্যে বিরোধও চরম পর্যায়ে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে চরম গোলযোগ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কেউ জায়গা ছাড়তে চাইছে না। কেউ বঞ্চিত হতে চাইবে না। সবার চাওয়া মেটাতে গিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে নাজেহাল হতে হবে।

দলের মধ্যে শেখ হাসিনার অবস্থান সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে হলেও তাঁর মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধেও বিদ্রোহী প্রার্থী হতে দেখা যাচ্ছে অনেককে। এমনকি এই বিদ্রোহী প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্রার্থীর চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই বেশি জনপ্রিয় বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

আগামী নির্বাচনে বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ নিয়ে আওয়ামী লীগকে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কতটুকু সফল হবে তার ওপর নিবর্বাচনের ফলাফল বড় প্রভাব ফেলবে। প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল করলে কিংবা প্রার্থীর প্রতি দলের সব অংশের সমর্থন না থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যেতে পারে। দলের মধ্যে সংহতি ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে গণমাধ্যমে খবর বের হলেও বাস্তবে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন।

২০১৪ সালের নির্বাচন যেভাবে হয়েছে পরবর্তী নির্বাচন ঠিক একইভাবে হবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনে এবার আওয়ামী লীগ মাঠ খালি পাবে না। শেখ হাসিনা সব প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার দায়িত্ব হয়তো নেবেন না অথবা বাস্তবে সেটা সম্ভব হবে না। আওয়ামী লীগকে বিজয়ের 'হ্যাট্রিক' করতে হলে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে।

নির্বাচনের সময় একটি কথা খুব শোনা যায়, আর তা হল, আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ। দলের পক্ষ থেকে একজনের বেশি প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রত্যেক আসনেই মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকেন একাধিক প্রার্থী। এখন দল যাকে মনোনয়ন দিল তার চেয়ে মনোনয়ন বঞ্চিতজন যে বেশি জনপ্রিয় সেটা প্রমাণের জন্য শুরু হয় 'ঘরের শত্রু বিভীষণে'র খেলা। দলের প্রার্থীকে হারিয়ে প্রমাণ করা যায় যে, দলের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।

এবার কি পরিস্থিতি কোনো ব্যতিক্রম ঘটবে? দলের মধ্যে ঐক্য বজায় থাকবে? নৌকা প্রতীক যাকে দেওয়া হবে তার প্রতি দল এক ও অভিন্ন অবস্থান নিতে পারবে?

বিএনপির নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা এবং না-করার মধ্যে অনেক গুণগত পার্থক্য তৈরি হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি একদিকে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে, অন্যদিকে দলগতভাবেও তারা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

বিএনপি নেতারা স্বীকার না করলেও এটা ঠিক যে, ২০১৪ সালের ভুলের খেশারত ভবিষ্যতে বহুদিনের জন্য বইতে হবে বিএনপিকে। এখন সবার সামনে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হল, আগামী নির্বাচনে বিএনপি কী করে? বিএনপি কি পরের নির্বাচনে অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় ফিরে আসবে, নাকি নির্বাচন থেকে বাইরে থাকার অজুহাত খুঁজতে থাকবে?

বিএনপি কী করবে– সেটা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুবই দুরূহ কাজ। কারণ, বিএনপির নেতাদের কথায় ও কাজে খুব একটা সঙ্গতি লক্ষ করা যায় না। যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা জোর দিয়েই বলছেন যে, বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে দলটি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

বিএনপি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়লে আওয়ামী লীগ তো খুশি হওয়ার কথা। তাহলে তারা এটা বলছেন কেন? কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে– এই কথা বার বার বলে বিএনপিকে একধরনের চাপের মুখে রাখতে চায়। এটা একধরনের কৌশল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি এতে কতটুকু পা দিচ্ছে?

বিএনপি নেতারা একবার বলছেন, আওয়ামী লীগকে এবার খালি মাঠে গোল দিতে দেওয়া হবে না। আবার আর মুহূর্তেই বলছেন, শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। বিএনপি কি আশা করছে যে, তাদের দাবি অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচন সহায়ক সরকারের অধীনে হবে?

বিএনপি যেমন শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না, তেমনি আওয়ামী লীগও কোন দুঃখে বিএনপির জন্য সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেবে?

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্প্রতি এক ইফতার পার্টিতে বলেছেন, ঈদের পর শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করবেন।

বেগম জিয়ার আন্দোলনের কথায় এখন আর কেউ উত্তেজনা বোধ করেন না। বিএনপি সমর্থক গোষ্ঠীও মনে করে যে, বেগম জিয়া আন্দোলনের কথা বলেন মূলত নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই। বিএনপি যে আন্দোলনের দল নয়– এটা এখন সবাই বুঝে গেছেন। যতবার বেগম জিয়া আন্দোলনের কথা বলেছেন ততবারই তা 'ফ্লপ' করেছে। এবারও ঈদের পর আর বিএনপির পক্ষে কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।

আন্দোলন সম্পর্কে দেশের মানুষের মধ্যে একধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে। আন্দোলন মানেই যেন হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ, অগ্নিত্রাস। আর এটা তৈরি হয়েছে বিএনপির কারণেই। মানুষের মন থেকে এই আন্দোলন-ভীতি দূর না হওয়া পর্যন্ত বিএনপির পক্ষে কোনো ধরনের আন্দোলন করা সম্ভব হবে না।

আন্দোলন জোর করে করা যায় না। আন্দোলনের জন্য ইস্যু থাকতে হবে, জনগণের সম্পৃক্তির প্রয়োজন হয়। বিএনপি যেরকম হুকুম দিয়ে আন্দোলন করতে চায় সেভাবে কোনো সময়, কোনো দেশেই আন্দোলন হয় না। আমাদের দেশে অতীতে বহু সফল গণআন্দোলন হয়েছে। রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তনে সেসব আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থন করে, বর্তমান সরকারও ব্যাপক গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বিদায় হবে বলে আশা প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কবে, কোন সফল আন্দোলন সংঘটনে ভূমিকা রেখেছে– সেটা তারা বলতে পারবে না।

বিএনপির এত জনসমর্থন থাকার পরও কেন তারা বছরের পর বছর চেষ্টা করেও কোনো আন্দোলনে সাফল্যের মুখ দেখতে পেল না, সেটা নিয়ে দলীয় পর্যায়ে তাদের কোনো মূল্যায়ন হয়েছে বলে শোনা যায় না।

বিএনপি একটি অদ্ভুত রাজনৈতিক দল। এই দলের যারা কর্মী-সমর্থক তাদের মন-মানসিকতাও ভিন্ন ধরনের। আওয়ামী লীগের কাজের সমালোচনা আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও করে থাকেন। শেখ হাসিনার সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যার বিরোধিতা আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও করেছেন। কিন্তু এমন একটা নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, বিএনপির কোনো সমর্থক বিএনপির কোনো কাজের নিন্দা-সমালোচনা করছে।

শেখ হাসিনার অনেক বক্তব্যের বিরোধিতা অনেকে করলেও খালেদা জিয়ার কোনো বক্তব্যের সমালোচনা বিএনপিপন্থি কোনো বুদ্ধিজীবী করেন না। বেগম জিয়া ভুয়া জন্মদিন পালন করেন, বিএনপি সমর্থকরা তাতেও গদগদ। বেগম জিয়া বলেছেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি হলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কেউ কি ওই ধরনের ফালতু বক্তব্যের সমালোচনা করেছিলেন?

বেগম জিয়া যখন বলেন, "আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মসজিদে আজান শোনা যাবে না, উলুধ্বনি শোনা যাবে", তখনও বিএনপি সমর্থকদের মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে দেখা যায়।

বিএনপির কোনো সাংগঠনিক সক্ষমতা নেই। বছরের পর বছর কোনো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নেই। মনে হয়, বিএনপি বুঝি নেই। কিন্তু ভোট আসলে দেখা যায় মৃত বিএনপি জীবন পায়। মৃত সৈনিকরাই আসলে বিএনপির প্রাণ। বিএনপির উচিত দলের শক্তি ও দুর্বলতার দিকগুলোর পূর্ণাঙ্গ বিচার-বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন-পর্যালোচনা করে দলের রাজনৈতিক অবস্থান ও নীতি কৌশল ঠিক করা। না হলে একেক নেতা একে রকম কথা বলবেন আর কথার তোড়ে হারিয়ে যাবে দলের আসল পরিকল্পনা।

নানা ধরনের কথা না বলে, বার বার আন্দোলনের হুমকি না দিয়ে বিএনপির এখন দেশের মানুষের সামনে স্পষ্ট অস্থান জানানো দরকার। বিএনপির ভাবা দরকার যে, যা-ই হোক না কেন, পরের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবেই বিএনপির দাবি মতো সহায়ক সরকার যদি না-ও হয়, তাহলেও।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন:

"আর কয়েক মাস আছে যত পারেন লুটেপুটে চলে যান। এদেশে থাকার আর সময় পাবেন না, বিএনপিকে বাদ দিয়ে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না। এদেশে নির্বাচন হবে সহায়ক সরকারের অধীনে, হাসিনার অধীনে নয়।"

খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যে তাঁর কর্মী-সমর্থক কতটুকু উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছে, সেটা জানা না গেলেও এটা বলা যায় যে, এটাই যদি বেগম জিয়ার চূড়ান্ত রাজনৈতিক অবস্থান হয় তাহলে আগামী নির্বাচনেও বিএনপিকে দূরেই থাকতে হবে। বিএনপির দাবি অনুযায়ী নির্বাচন সহায়ক কোনো সরকার গঠনের সুযোগ সংবিধানে নেই। শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও অবাধ না-ও হয় তাহলেও সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে কীভাবে?

বিএনপি নেত্রী যদি মনে করে থাকেন যে, আন্দোলন করে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করে সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন, তাহলে সেরকম পরিস্থিতির জন্য আরও দীর্ঘসময় তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে। বেগম জিয়ার এখন একটাই কথা বলা উচিত, বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন হবে না, কারণ বিএনপি নির্বাচনে যাবে।

বিএনপি এমন দৃঢ় অবস্থান ঘোষণা করলে দেশের রাজনৈতিক চালচিত্র দ্রুত বদলাতে শুরু করবে। নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে আপাতত কোনো ভালো বিকল্প খোলা নেই।