স্বাস্থ্য বিষয়ক অস্বাস্থ্যকর আলাপ

ফিরোজ আহমেদ
Published : 22 March 2012, 03:42 PM
Updated : 22 March 2012, 03:42 PM

না, চিকিৎসককে খলনায়ক বানানোর চলতি হাওয়ায় ভেসে যাওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়। শুধু চিকিৎসক কেন, সাম্প্রতিক কালে তাদের পেশাগত সংস্কৃতি নিয়ে খলনায়কের তকমা পেয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা, খলনায়কের প্রায় স্থায়ী ভূমিকা কালে কালে পেয়ে এসেছেন আইনজীবীরা, কখনো কখনো গণমাধ্যম কর্মীরাও। পেশার পরিস্থিতি বিষয়ক সার্বিক আলোচনা ছাড়া এই ধরনের আলাপ সন্দেহাতীত ভাবেই পেশাগত সংস্কৃতির বিষয়ে ভুল বিশ্লেষণ হাজির করে ব্যক্তিকেই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করে।

বিপরীত দিক দিয়ে কোন নির্দিষ্ট পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ বা সকলে যদি মনে করেন তাদের বাইরে কারোরই ওই পেশাসংক্রান্ত মূল্যায়নের অধিকার নেই, সেটাও চরম এক অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিচয় হবে। নাগরিকদের যেমন অধিকার রয়েছে পরিবহন ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি আর মাফিয়া রাজত্ব কায়েম রয়েছে, যেভাবে একজন শ্রমিককে সেখানে প্রায় উদয়াস্ত পরিশ্রম করানো হয়, যেভাবে তাদেরকে পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে দেয়া হয়, এবং এই সব কিছু মিলে যে একের পর এক দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয় তা নিয়ে কথা বলার; পরিবহন শ্রমিকদেরও অধিকার রয়েছে বাস্তব এই শর্তগুলো আদৌ বিবেচনায় না নিয়ে কেবল তাদের পেশাগত আচরণের নিন্দা করে তাদেরকে একতরফা খলনায়ক বানানোর সংস্কৃতির প্রতিবাদ করার। এই কথাটি সকল পেশার জন্যই সত্য, একটা গণতান্ত্রিক সমাজে সকল নাগরিকই যে বৃত্তিগুলো তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তার সম্যক পরিস্থিতি নিয়ে এবং মূল্যায়নের অধিকার সংরক্ষণ করেন।

একটা সহজ প্রশ্ন দিয়েই চিকিৎসা বিষয়ক পরিস্থিতিটা নিয়ে আলাপটা শুরু করা যাক: পেশাগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, অসদাচরণ কিংবা অন্য যে কোন কারণে এখন পর্যন্ত কতজন চিকিৎসকের শাস্তি হয়েছে? উত্তরটা অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে না জানা থাকলে, এবং সেটা লেখার শেষ পর্যন্ত জমা থাকুক।

বরং আমরা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত কয়েকটি দৃষ্টান্তের দিকে তাকাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী গুরুতর অসুস্থ হয়ে রাজধানীর ল্যাব এইডে আসেন চিকিৎসা নেয়ার জন্য, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী হাসপাতালটির কর্তব্যরত ব্যক্তিগণ চিকিৎসা শুরু হবার আগেই ভর্তির সমস্ত টাকা পরিশোধ করার দাবি জানান, সেটা আনতে আনতেই দেশের এই কৃতী সন্তান মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোন চিকিৎসক তাকে ছুঁয়ে দেখেননি বলে অভিযোগ পাওয়া যায়, কারণ তখনও সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করে ভর্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়নি, সব কাগজপত্র মুমূর্ষু রোগীর হাতে আসেনি, কর্তব্যরত চিকিৎসক খুব সামান্য ব্যবস্থা নিলেও (এক বন্ধু চিকিৎসক বললেন একটা স্যালাইন দিয়ে রাখলেও) তিনি হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন! মৃদুলকান্তির মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামখ্যাত শিক্ষককে যে দেশে আপদমুহূর্তে পকেটে ঘাটতি পড়া কয়েক হাজার টাকার জন্য সামান্য অসুখে মৃত্যুবরণ করতে হয়, আমজনতার চিকিৎসার সেখানে কী দশা তা সহজেই অনুমেয়। এর অল্প কিছুদিন পরই দেশের একজন প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের শিকার হয়ে ওই একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন গভীর রাতে, ভর্তির সম্পূর্ণ অর্থ সাথে ছিল না বলে হাসপাতালটি তাঁর চিকিৎসা শুরু করতে অস্বীকার করে। একই হাসপাতাল সদ্যই আবারও সংবাদ হয়েছে, চিকিৎসায় গাফিলতির ফলে রোগীর মৃত্যুর জন্য তো বটেই, ক্ষুদ্ধ আত্মীয়স্বজনকে রড দিয়ে পিটিয়ে আহত অবস্থায় পুলিশের কাছে সোপর্দ করার কাণ্ড ঘটিয়ে। রোগীর চার জন আত্মীয়, যাদের মাঝে নারীও ছিলেন, ভাঙচুর করে হাসপাতালের ৫০ লক্ষ টাকার ক্ষতিসাধন করেছেন, এই অবিশ্বাস্যপ্রায় 'ক্রসফায়ারীয়' গপ্পোও তারা দিয়েছেন—লক্ষ্য খুব পরিস্কার, রোগীর আত্মীয়রা যাতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে না যান, তার জামানত হিসেবে এই অভিযোগটিকে ব্যবহার করা যাবে।

কিন্তু অভিযোগ শুধু তো এই একটি নির্দিষ্ট ক্লিনিকের বিরুদ্ধে না। রাজধানীর প্রায় তিন-তারকা অতিথিনিবাস সমতুল্য হাসপাতালগুলোতে সাধারণ মানুষের ভেড়ার উপায় নেই, সেটা সকলেই মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু এর বাইরে চিকিৎসা নিতে সাধারণত তারা যেখানে যেখানে এবং যাদের যাদের কাছে যেতে বাধ্য হন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। ভুক্তভোগীরা সাধারণত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পরস্পরের সাথে মিলিয়েই একটা সাধারণীকৃত ধারণা তৈরি করেন, আর তা থেকে গোটা দেশের যে কমবেশি চিত্র পাওয়া যায়, চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িতদের কেউ কেউ তা অস্বীকার করার চেষ্টা করলেও চিত্রটি মোটের ওপর বিশ্বাস্য এবং অসহনীয়।

সম্প্রতি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান চিকিৎসকদের প্রতি নানান 'কটুক্তি' করেছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে চিকিৎসকদের তরফ থেকে প্রতিবাদের ঢেউ বয়ে যায়। ফেসবুক, ব্লগ এবং পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে তারা এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন, এই প্রতিবাদগুলোতে তারা যেমন কটুক্তি নিয়ে কথা বলেছেন, তেমনি পেশাগত পরিস্থিতি বিষয়ক বহু অভিযোগের জবাবও দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলে ড. মিজানুর রহমান তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা কটুক্তির পর্যালোচনাতেই থেমে থাকেনি। বহু ধরনের যুক্তি- পাল্টা যুক্তি এসেছে, এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে ভাববার, এই বিষয়ে অসংখ্য পরিসংখ্যানভিত্তিক গবেষণা চালাবার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে উপলদ্ধ হয়েছে।

এ বিষয়ে গবেষণা একদম যে নেই, তা নয়। কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল এবং অনুদাননির্ভর। "বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ রিপোর্ট ২০০৯" নামের যে প্রতিবেদনটিকে হালনাগাদ বলে মনে হয়েছে, সেটি থেকে যে চিত্র বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার পাচ্ছি তা এক কথায় বিপর্যয়কর। Bangladesh Health Watch Report 2009 : How Healthy is Health Sector Governance? অনুযায়ী ১৯৯৪ সালের তুলনায় ২০০৯ সালের মধ্যে ব্যবস্থাপত্র প্রতি প্রদত্ত ওষুধের পরিমাণ ১.৪ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২.২ টিতে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে তিন বা ততোধিক ওষুধ একত্রে সেবন "increases the risk of drug interactions, errors in dispensing and intake with adverse health consequences and unnecessary household expenditure."

ব্যবস্থাপত্র প্রতি ওষুধের অতিব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? ওই একই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে ওষুধ কোম্পানিগুলোর সক্রিয় বিক্রয় প্রতিনিধির সংখ্যা ২০ হাজার! প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের তথ্যভাণ্ডার তৈরি করে এবং ডাক্তারদের ব্যবস্থাপত্র রীতিমত তদারিক করে। নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওষুধ বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলে চিকিৎসকদের জন্য রয়েছে বিদেশ ভ্রমণসহ আকর্ষণীয় সব 'পুরস্কার'। ওষুধ বাজারজাতকরণের ধান্ধায় ওষুধ কোম্পানিগুলো পল্লীচিকিৎসকদেরও তাদের প্রভাবাধীনে নিয়ে এসেছে।

পরিসংখ্যানভিত্তিক এই সম্ভাব্য বাস্তবতার বিপরীতে গত ১৪-০৩-২০১২ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত 'মানুষ অমানুষ নামানুষ' নামের রচনায় হেলাল আহমেদ নামক জনৈক চিকিৎসক দাবি করেছেন ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের ব্যবহার বৃদ্ধি ওষুধ উৎপাদকদের সাথে চিকিৎসকদের সম্পর্কের কারণে নয়, তার বক্তব্য অনুযায়ী "১৯৯৪ থেকে ২০১০— এই ১৬ বছরে চার গুণ বেশি ওষুধ বিক্রির সঙ্গে ডাক্তারদের লাভকে মিলিয়ে দেখার মতো একটি কাঁচা কাজ করেছেন জনাব মশিউল আলম। এই ১৬ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে কত, মানুষের আয় বা কর্মক্ষমতা বেড়েছে কত, নতুন ওষুধ এসেছে কতগুলো— সেসবও বিবেচনায় রাখতে হবে। তার ওপর অপচিকিৎসা কমে গিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার প্রসার বেড়েছে। ১৬ বছরে অর্থনীতির অবকাঠামোর বিরাট পরিবর্তন হয়েছে, সবকিছুর বিক্রি বেড়েছে। অন্য সবকিছুর মতো ওষুধের বিক্রি বেড়েছে, দেশে ওষুধ শিল্পের প্রসার ঘটেছে, দেশের বাজার ছাড়িয়ে বিশ্বের বহু দেশে আমাদের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। এই অগ্রসর শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ডাক্তারদের 'অমানুষ' বানানোর চেষ্টা যেন গরুর রচনা লিখতে গিয়ে গরুটিকে জোর করে নদীর কিনারে নিয়ে গিয়ে নদীর রচনা লেখার মতো হয়ে গেছে।" অর্থাৎ ওষুধ বিক্রি বৃদ্ধির সাথে কোন অনৈতিক যোগসাজসের সম্পর্ক নেই, এমনটিই হেলাল সাহেবের দাবি।

যা হোক, ওই একই গবেষণাপত্রে বলা হচ্ছে: "সকল চিকিৎসকই একমত হয়েছেন যে এক বা একাধিক ওষুধ কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়াটা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের ধরনকে প্রভাবিত করে এবং চুক্তির লক্ষ্য পূরণের জন্য বা উপহার গ্রহণের ফলে যে দায় তৈরি হয়, তা মেটানোর জন্য তারা রোগীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় ওষুধ চাপিয়ে দেন। একজন চিকিৎসক জানান, "কোন কোম্পানি চিকিৎসকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলে তাকে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য দেয়। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য চিকিৎসকেরা কখনো কখনো এমন ওষুধ দেন যা অপ্রয়োজনীয়। আমি আমার সহকর্মীদের প্যারাসিটামলই যথেষ্ট ছিল এমন ক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিক দিতে দেখি।"

বিএসএমএমইউ থেকে বের হওয়া রোগীদের রীতিমত ঘিরে ধরে ব্যবস্থাপত্র পরীক্ষা করে নিজের কোম্পানির ওষুধের নাম লেখা হয়েছে কি না তার তদারকি করছেন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ নামধারী বিক্রয় প্রতিনিধিরা, এমন ছবি হরহামেশা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এই চিত্রটি বাকি সব মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারী হাসপাতালের জন্য প্রযোজ্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আশেপাশে রীতিমতো উপগ্রহের মত আবর্তন করছেন বিক্রয় প্রতিনিধিরা, কার ওষুধ কত গেল তার হিসেব রাখছেন এমন দৃশ্যও বহু বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকে পাওয়া যাবে। সরকারী কর্মস্থলে রোগীদের বাইরে বসিয়ে রেখে বেআইনীভাবে চিকিৎসকরা সময় দিচ্ছেন এই বিক্রয় প্রতিনিধিদের, এমন ঘটনার কথাও পত্রিকাতে এসেছে। ১১ জুন ২০১১ তারিখে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এমন একটি ছবির সাথে সংযুক্ত সংবাদে এই পরিস্থিতির স্বীকৃতি পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ ই মাহবুব এর মন্তব্যেও: "এটা একটা অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা, স্রেফ উপহার প্রদানকারী ওষুধ উৎপাদকদের খুশী করার জন্য অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সুপারিশ করতে চিকিৎসকদের উৎসাহিত করে এটা । চিকিৎসক ছাড়া আর কারও রোগীর ব্যবস্থাপত্র দেখার অধিকার নেই।" আমরা আনন্দিত হতাম ড. রশীদ ই মাহবুব এর মত সম্মানিত অধ্যাপকের বক্তব্যও যদি ড. হেলাল '‌কাঁচা কাজ' ইত্যাদি তকমায় উড়িয়ে দিতে কিংবা গোটা খবরটিকেই মিডিয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রমাণ করতে পারতেন, জানি না তা করে তিনি আপামর জনসাধারণকে ভরসা দিতে পারবেন কিনা।

ড. হেলালের ধারণার সাথে গবেষণালদ্ধ উপাত্ত এবং রশীদ ই মাহবুব এর উপরোক্ত মন্তব্যের এত গুরুতর বিরোধ রয়েছে যে তিনি যখন ওই রচনায় আরও দাবি করেন যে কেউ "যদি মাত্র দু-তিনজন ডাক্তারকে হাজির করতে পারেন যে তাঁরা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন গ্রহণ করেন, তবে তার বিপরীতে কমপক্ষে ৯৫ জন ডাক্তারকে হাজির করা যাবে; যাঁরা এই কমিশন গ্রহণ করেন না" তখন অবাক না হয়ে পারি না। আমাদের জন্য ভারী দুঃখের যে আমরা এই ৯৫ ভাগ চিকিৎসকে চিনি না। নিশ্চয়ই তারা অস্তিত্বশীল। কিন্তু আমাদের সরল মন তখন চিকিৎসার কাজে ভিটেবাড়ি বিক্রি করা অসংখ্য যে মানুষকে আমরা চিনি, এই সব কমিশন বাদ দিলে একেকটা পরীক্ষা কত কম টাকায় তারা সারতে পারতেন, পরীক্ষা বাবদ কমিশনের প্রণোদনা না থাকলে কত কম সংখ্যক পরীক্ষা রোগীকে চিকিৎসকরা দিতেন এই সব আঁক কষতে বসে।

ডা. হেলাল যেভাবে দাবি করলেন দেশে মোট ওষুধ বিক্রি বেড়েছে চিকিৎসাসেবা বেশি মানুষ গ্রহণ করার কারণে, মাথাপিছু ওষুধ বিক্রি বৃদ্ধির কারণে না, তার সেই দাবি এই গবেষণার ফলাফল এবং ভুক্তভোগীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা কোনটিকেই সমর্থন করে না, আমরা বরং অবাক হয়ে ভাবি তিনি জেনেশুনে সত্য গোপন করছেন নাকি আসলেই তিনি বাস্তব অবস্থাটা সম্পর্কে অবহিত নন। বিভিন্ন মুক্তগণমাধ্যমে চিকিৎসকদের আরও যে সব প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়, তার একটা বড় অংশেই নগরের চিকিৎসকদের একাংশের সাথে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ইত্যাদির যোগসাজশ স্বীকার করে নিয়ে বাকি চিকিৎসকদের এ থেকে মুক্ত বলে দাবি করা হয়। কিন্তু ওই একই প্রতিবেদনে দেখা যাবে "ওষুধের দোকানগুলোতে বসা ডাক্তারদের দেয়া ব্যবস্থাপত্রগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সর্বোচ্চ (৬০% ক্ষেত্রে), এরপর রয়েছে শহরের ক্লিনিকগুলো (৪৫%), তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো, তাদের দেয়া শতকরা ৪৩টি ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক সুপারিশ করা হয়ে থাকে। …উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ব্যাবস্থাপত্রপ্রতি অ্যান্টিবায়োটিক সুপারিশ করার হার ৯৪ সালে ছিল ২৫ ভাগ, ২০০৯ সালে তা ৫০ ভাগ।" এই পর্যালোচনাটি রোগীদের ব্যবস্থাপত্রভিত্তিক, ফলে এই হিসেবে মোট ওষুধ ক্রেতা জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধির সাথে ব্যবস্থাপত্রপ্রতি অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বেশি হবার কোন সম্পর্ক নেই এবং এ থেকে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রের হাসপাতাল থেকে শুরু করে মফস্বলের হাসপাতাল পর্যন্ত কোন ব্যতিক্রমই আদতে নেই। বরং মফস্বলে আর একটি ভীতিকর বিষয় দেখা যায়, এমন অচেনা সব ওষুধ কোম্পানির ওষুধ সেখানকার ব্যবস্থাপত্রগুলোতে সুপারিশ করা হয় এবং ওষুধের দোকানগুলোতে ভর্তি থাকে, যাদের মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন আছে, যেগুলো নগরের দোকানগুলোতেও বিক্রি হয় কম। ফলে নিন্দুকেরা যদি প্রশ্ন করেন, চিকিৎসকদের নিজেদের মধ্যেকার ক্ষমতা কাঠামোতে যারা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন তারা দুধের সরটুকু চুমুকেই খেয়ে নিলেও ওষুধ কোম্পানিগুলোর কল্যাণে এমনকি পল্লী চিকিৎসক পর্যন্ত অন্তত ঘোলটুকু কমবেশি প্রায় সকলেই নিচ্ছেন—কি উত্তর পাওয়া যাবে?

ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে অনুমান করি চিকিৎসকদের উপস্থিতির বেলায় (সম্ভবত খুব অল্পসংখ্যক কিছু ক্ষেত্রে, মাত্র দুয়েক দিন আগেও পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী একটি উপজেলায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতি বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়ায় এক কর্মকর্তাকে নাজেহাল করেছেন তিন চিকিৎসক) উন্নতি হলেও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সুপারিশ করার বেলায় পরিস্থিতির অনেক বেশি অবনতি হয়েছে।

অ্যান্টি বায়োটিকের ব্যবহার কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোন কোন ক্ষেত্রে কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে (সামান্য কিছু ক্ষেত্রে বাড়লেও সর্বমোট ব্যবহারে কমেছে), সকল ক্ষেত্রেই এই ব্যবহারের হার বাংলাদেশের চাইতে আবশ্যিকভাবেই কম। এমনকি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বহু হিসাবে বলা হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীকে সচেতন করা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত ওষুধের ব্যবহার কমানো সম্ভব। গবেষণাটির তথ্য অনুযায়ী একই ওষুধের দামের ভিন্নতাও উদ্বেগজনক, এক বোতল ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এর দামের বেলায় দেখা গেছে তা উৎপাদক ভেদে শতকরা ৬৫০ ভাগ পর্যন্ত ওঠানামা করে, মেবেনডাজল ট্যাবলেটের দামের বেলায় তা শতকরা ৯০০ ভাগ। হাসপাতালের বিছানা আরামের ভেদে তিন তারকা থেকে ময়লা চাদর পর্যন্ত মেনে নেয়া হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়; কিন্তু যে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হবে, তার দামের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য নিয়ে চিকিৎসকরা কি ভাবছেন, তা আমরা জানি না। এই পার্থক্য কি ন্যূনতম মান বিসর্জন দিয়ে করা হয় না কি এর আর কোন রহস্য আছে, সে বিষয়ে জনগণের পূর্ণ অবগত হবার অধিকার রয়েছে। ওষুধের দামও যে ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, সে প্রসঙ্গেও স্বাস্থ্যখাতের অভিভাবক হিসেবে চিকিৎসকদের কঠোর বক্তব্য জনগণ আশা করেছিল।

এর বাইরে আরও কিছু প্রসঙ্গ আলোচনায় আসা জরুরি। বলা হয়ে থাকে স্বাচিপ আর ড্যাব নিজ নিজ দলের আমলে চিকিৎসকদের লাভজনক পদগুলোতে বদলি, উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ প্রদান ইত্যাদির নির্ধারক ক্ষমতার অধিকারী। বিশাল অঙ্কের অর্থের লেনদেনর 'গুজব' শোনা যায়, শোনা কথা বারবার শুনতে পাওয়া গেলে তাতে কান দেয়া অবশ্যই উচিত, চিকিৎসকরা প্রকাশ্যে ছুরিচাকু হাতে নিজেদের ভেতর মারামারি করে সংবাদ হলে এই ভাগবাটোয়ারা বিষয়ক সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।

শেষ করি চিকিৎসা পেশার জবাবদিহিতার পরিস্থিতি নিয়ে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমঅ্যান্ডডিসি), যাদের এই তদারকিটা করার কথা, আক্ষরিক অর্থেই একটি ঠুঁটো জগন্নাথ। যে কোড অব মেডিকেল এথিক্স তাদের ওয়েবসাইটে ঝুলিয়ে রেখেছে, তার কতটুকু পালনের উদ্যোগ তারা নিয়েছে, সেটা বোঝা যাবে একটি মাত্র ধারার দিকে যদি আমরা তাকাই। তাদের অষ্টম অনুচ্ছেদে Canvassing, advertising and using false title etc শীর্ষক ধারায় বলা হয়েছে "Canvassing and advertising for the purpose or obtaining patient and advancing the professional interest of a Medical/ Dental practitioner, whether done directly or indirectly through an agent, association or other persons and organizations is professional misconduct and may make the Medical/ Dental Practitioner liable to disciplinary action.
The publication of mater or comments calculated to advertise the qualifications, professional skill, knowledge or services of any Medical/ Dental practitioner for the purpose of advancing his Professional interests, when procured or instigated by the Medical/ Dental practitioner, or by individuals or associations or other organizations friendly to or associated with the Medical / Dental practitioner knowingly connived at by the Medical/ Dental practitioner liable to disciplinary action."

দেশী এবং বিদেশী বড় বড় হাসপাতালগুলো প্রকাশ্যেই তাদের চিকিৎসকদের যোগ্যতার বিবরণ দিয়ে পত্রিকায় যে সব বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, তা স্পষ্টত বিএমডিসির কোড অব এথিকস এর সরাসরি বিরুদ্ধে। ক্যানভাসারের ভূমিকায় লিপ্ত এই হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিতে সক্ষম বিএমডিসি? এবং গণমাধ্যমসমূহও নিশ্চিতভাবেই দেশী-বিদেশী এই সব প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র দশ মাসে চিকিৎসায় অবহেলা জনিত ৭০টি মৃত্যুর অভিযোগ এসেছে। চিকিৎসকদের কেউ কেউ বলবেন এটা রোগীর শোকাহত আত্মীয়দের বাড়াবাড়ি, কিন্তু বাংলাদেশের ভুক্তভোগী মানুষেরা জানেন, দেশের চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কের যা পরিস্থিতি তাতে মিনিট তিনেক ডাক্তার ভালভাবে কথা বললেই রোগীরা কৃতার্থ হন, পঞ্চমুখে ডাক্তারের প্রশংসা করেন। অবহেলা এমন একটি আচরণ যা বুঝতে চিকিৎসা পেশায় বিরাট বিশেষজ্ঞ হতে হয় না; ডাক্তার আদৌ রোগীর কথা শুনছেন কি না, তার সমস্যাটা দরদ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কি না, তা থেকেই বোঝা যায়। এটা গড়ে ওঠে সামগ্রিক পেশাগত সংস্কৃতির আবহাওয়ায়। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ বাংলাদেশব্যাপী প্রচলিত, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে চিকিৎসকরা রোগীর সাথে সদব্যবহার করেন না। যে অল্প কয়েকজন এই দরদটুকু প্রদর্শন করেন, রোগীরাও শতমুখে তাদের গুনগান করেন।

যাহোক, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মোটামুটি প্রায় ২ হাজার ৩০০ অভিযোগ দাখিল হয়েছে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। একটি মাত্র ক্ষেত্রে, অরুন্ধতী চাকমা নামের একজন চিকিৎসক এবং অসিত বরণ চক্রবর্তী নামের একজন প্যারামেডিক এর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পায় বিএমডিসি, তদন্ত শেষে তাদের পেশাগত অনুমতিপত্র বাতিল করা হয় ১৯৯৩ সালে। যতদূর জানা যায়, এটিই সর্বশেষ ঘটনা।

"কত রোগী দেখতে হয় জানেন?" চিকিৎসকরা সাফ সাফ জবাব দেন। ডা. হেলাল যেমন বলেছেন "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশে প্রতি এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ মানুষের জন্য একজন চিকিৎসক থাকা প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে প্রতি ৩৯০ জনের জন্য একজন চিকিৎসক। আর আমাদের দেশে প্রতি চার হাজার জনের জন্য একজন। ১৬ কোটি মানুষের জন্য প্রায় ৫০ হাজার জন। এই ৫০ হাজার জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেক সরকারি চাকরি পান না, তাই সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তারপ্রতি রোগীর অনুপাত দ্বিগুণ হয়ে যায়।" পরিস্থিতি গুরুতর, সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারই হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে চিকিৎসকদের প্রায় ৩৫ ভাগই নগরকেন্দ্রিক, যেখানে জনগণের মাত্র ১৪ বা ১৫ ভাগ থাকেন। ফলে দেশে শুধু যে চিকিৎসকদের সংখ্যা জনগণের অনুপাতে কম, সেইটাই একমাত্র বাস্তবতা নয়, এই কমকে আরো মন্দীভূত করেছে অন্য আর সব পেশার মতই চিকিৎসকদেরও মফস্বলে থাকতে অনীহা। স্বেচ্ছায় না যান সেটা নিয়ে আমার-আপনার আপত্তি করার কোন কারণ নেই, কিন্তু নিয়োগ গ্রহণ করে, চাকরির শর্ত মেনে নিয়ে উপস্থিত না থাকাটা বিরাট অন্যায়, এটাকে কোন অজুহাতেই জায়েজ করা যায় না।

কিন্তু সামগ্রিক এই পরিস্থিতির অবসানের যে দাবি দাওয়া চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হবার দরকার ছিল, যে প্রচারণার দরকার ছিল, সরকারকে চাপ প্রয়োগ করার দরকার ছিল, তা কি আদৌ কখনো দেখেছি? বরং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা বহু ক্ষেত্রে পরিস্থিতির সুযোগই নিচ্ছেন। এরশাদ এর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলে বিএমএ চিকিৎসাসেবায় জনগণের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় যে ভূমিকা পালন করেছিল, তা বস্তুত উধাও হয়েছে।

হেলাল সাহেবের বক্তব্য বিশ্বাস করলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি, বাংলাদেশের চিকিৎসকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে এতটাই মনোযোগী যে আর কাউকে শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। কিংবা শত্রুপক্ষের কথাতেও একমত হতে পারি এই ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার ব্যবস্থারই অস্তিত্ব নেই, এটা স্রেফ পেশাজীবীদের ব্যক্তিগত মর্জিমাফিক চলছে। দুই চরম দাবির কোনটিরই নিশ্চয়ই সত্যতা নেই, কিন্তু "যুদ্ধ এতই গুরুতর বিষয় যে তা কেবল সেনাপতিদের ওপর ভরসা করলে চলবে না" এই প্রবচনটির মতই, কিংবা আরও বেশি গুরুতর বিষয় চিকিৎসাক্ষেত্রটিকেও কেবল চিকিৎসকদের জন্য ফেলে রেখে তাকে গণতদারকির আওতামুক্ত রাখাটাকে নিরাপদ মনে করি না। সমাজে গণতন্ত্র তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন ব্যবহারিক পেশাগত আচরণগুলো সামাজিক তদারকির আওতায় আসবে। হতে পারে আজকে চিকিৎসক, পরিবহন শ্রমিক, সংবাদকর্মী প্রত্যেকেই এমন পরিস্থিতির শিকার যে ব্যক্তিগতভাবে তাদের খুব বেশি কিছু করার নেই। সে ক্ষেত্রেও আমরা দাবি তো করতেই পারি পেশাগত সংকীণর্তা ডিঙিয়ে তাদের কেউ কেউ অন্তত নীরবতা ভাঙবেন, কী কী ঘাটতির কারণে তারা দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করতে পারছেন না, কিভাবে সরকার এই খাতটিতে দায়িত্ব এড়িয়ে একে মুনাফাখোরদের হাতে তুলে দিচ্ছে, চিকিৎসক এবং নাগরিক উভয়কেই জিম্মি করছে, সেই সত্যগুলো জনগণের সামনে উদ্ঘাটন করবেন এবং পরিবর্তনের একটি শক্তি গড়ে তুলবেন। আমি নিশ্চিত, চিকিৎসকরা জনগণের দিকে এক পা এগুলে জনগণ তাদের দিকে তিন পা এগুবেন।

ফিরোজ আহমেদ:রাজনৈতিক কর্মী, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।