যত দোষ নন্দ ঘোষ

মামুন আল মাহতাব
Published : 15 June 2017, 05:11 PM
Updated : 15 June 2017, 05:11 PM

সিঙ্গাপুর হেপাটোলজি কনফারেন্সে যোগ দিতে রাতের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর রওনা হয়েছি আর বিমান যখন ঢাকার আকাশে ডানা মেলছে আকাশে তখন ভালোই মেঘ। সিঙ্গাপুরের সুন্দরী বিমানবালা সাবধান করে দিলেন, যাত্রা খুব একটা সুখকর হবে না। যাত্রাপথের প্রায় পুরোটাতেই আকাশজুড়ে মেঘ, অতএব অকস্মাৎ টার্বুলেন্সের জন্য মানসিকভাবে তৈরি হয়ে বেল্ট বেঁধে সিটে বসে থাকার পরামর্শ বিমানবালার।

বিমানবন্দরে আসার পথে টিভির খবরে জেনে এসেছি ঘূর্ণিঝড় 'মোরা' দুর্বল হয়ে নিম্মচাপে পরিণত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ২৭,০০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হলেও মানুষ আর গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি সেই তুলনায় অনেক কম।

মানুষের জীবন মানেই মানুষের জীবন আর প্রতিটি জীবনই অমূল্য আর তা কুখ্যাত অপরাধীর জীবন হলেও। যুদ্বাপরাধীদের ফাঁসির আগে 'অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল', 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ'-এর মায়াকান্না দেখে অন্তত তা-ই মনে হয়। এবারে মোরায় মৃত্যুবরণ করেছেন সাত-আটজন মানুষ; ক্ষয় হয়েছে সাত-আটটি অমূল্য মানবজীবন। তবু কোথায় যেন একটু স্বস্তি!

ছোটবেলায় দেখা উড়ির চরের ঘূর্ণিঝড়ের টিভি আর পত্রিকার ছবিগুলো এখনও চোখে ভাসে। হাজারো মানুষ আর পশুর লাশে একাকার চারদিক। একদিকে শকুনের মহোৎসব, আর অন্যদিকে উড়ে আসছেন একের পর এক ভিনদেশি সরকার আর রাষ্ট্রপ্রধান। আসছেন রাজীব গান্ধী, জয়াবর্ধনে, এমন আরও অনেকে। সঙ্গে টন টন ত্রাণসামগ্রী। দেশের রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী আর প্রসাশন যন্ত্রের সে কী ছোটাছুটি আর আকাশে হেলিকপ্টারের ওড়াওড়ি।

সে সময়টায় আমাদের ছিল না গর্বের আর কোনো কিছু। আমাদের ক্রিকেট টিম তখন জিততে শিখেনি, আমাদের ছিল না নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির গর্বও। আমাদের একমাত্র গর্বের জায়গা যে 'মুক্তিযুদ্ধ', তা-ও তখন বিস্মৃতি আর বিকৃতির অতল তলে, বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারের রক্তের দাগে কলঙ্কিত।

আমাদের প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানেই ছিল হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনীর টুকটাক গোলাগুলি আর একজন অর্বাচীন 'মেজরের যাদুর ঘোষণায়' স্বাধীনতার সহসা প্রাপ্তি। তেমনি এক অদ্ভুতুরে সময়ে ঘটেছিল উড়ির চরের বিপর্যয়। দেশ-বিদেশের মিডিয়া বলতে তখন সম্বল 'বিটিভি', 'বিবিসি' আর 'ভোয়া'। সেসব জায়গায় তখন শুধুই উড়ির চর, শুধুই বাংলাদেশ।

কেন যেন নিজেদের খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হত। হোক না আমার দেশের মানুষ আর গবাদি পশুর লাশের গন্ধে বিবর্ণ আমার উপকূল, কী আসে যায় তাতে? দেশটাতো অন্তত আলোচনায়। লাশের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে নিজ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে বিদেশি রাষ্ট্র আর সরকারপ্রধানদের কাছ থেকে হাসিমুখে দাক্ষিণ্য গ্রহণ করতে দেখে আমরা গুনগুনিয়ে গাইতাম: '…নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা, নতুন করে আজ শপথ নিলাম…।'

মনে আছে নব্বইয়ের কথাও। আরেকটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে আবারও বিশ্বমিডিয়ায় বাংলাদেশ। তখন আরেকটু বড় হয়েছি, বুঝিও আরেকটু বেশি। আমাদের চট্টগ্রাম বিমানঘাঁটির বেশ কিছু স্যবর জেট যুদ্ববিমান সেসময় কর্ণফুলিতে ভেসে গিয়েছিল, যার অনেকগুলোই আজ ঢাকা আর চট্টগ্রামের মোড়ে মোড়ে শোভাবর্ধন করে।

যা হোক কর্ণফুলিতে সাম্পানের বদলে যুদ্ধবিমান তখন সবার মুখে মুখে। তখন আমাদের ছিল না 'মিগ ২৯' যুদ্ধবিমান কিংবা সাবমেরিনের গর্ব। কর্ণফুলিতে বিমান ভাসিয়েই আমরা তখন খুব পুলকিত। যাক কোনো একটা ছুতোয় আমরাতো আলোচনায় আছি। সঙ্গে তো আছেই ত্রাণোৎসব! চারিদিকে শুধুই বাংলাদেশ, শুধুই আমরা আর মিডিয়ায় বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীদের ঘন ঘন প্রদর্শনী।

মনে আছে '৯৮-এর কথা। আবারও ঘূর্ণিঝড়। আমি তখন কর্মসূত্রে লন্ডনে। অবাক হয়ে একদিন 'বিবিসি'র খবরে শুনলাম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিনয়ের সঙ্গে আর্ন্তজাতিক ত্রাণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাংলাদেশ নাকি নিজেরাই পারে! আজ এই খবর তখন গরম করছে ব্রিটিশ মিডিয়াতে। হাসপাতালে গেছি একই আলোচনা, একই আলোচনা শপিং সেন্টারেও।

রয়েল লন্ডন হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগে আমার দুই বস প্রফেসর ফারদিং আর প্রফেসর পারভিন কুমার ডেকে জানালেন বাংলাদেশ নিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা। ভাবছেন হাসপাতালে ডাক্তার, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের কাছ থেকে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের প্রিয় মুখ ডাক্তার মামুনের দেশের জন্য কিছু চাঁদা তুলবেন কি না। আবার সংশয়ে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তো ত্রাণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। জানতে চাইলেন আমি কী বলি। কী করবেন তারা?

সাত-পাঁচ না ভেবেই বলে দিলাম প্রধানমন্ত্রী যখন মানা করেছেন, নিশ্চই প্রয়োজন নেই। কী বলেছি তখনও বুঝিনি। বুঝেছি পরে। এরপর যে কটা দিন লন্ডনে ছিলাম দেখেছি আমার প্রতি পুরো হাসপাতালের বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গি। কোথায় যেন আরেকটু ঘনিষ্টতা, একটু যেন শ্রদ্ধাও।

১৯৯৯ সালে প্রফেসার পারভিন কুমারের দেওয়া লোকাম কনসালটেন্টের চাকরির প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়ে দেশে এসে যোগ দিয়েছিলাম ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৮তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন গর্বিত সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে। একই সুযোগ প্রফেসর কুমার দিয়েছিলেন আমার দুই লিবীয় ও সিরীয় সহকর্মীকেও। তারা সেটা গ্রহণও করেছিলেন।

আমিই কেন যেন কিছুটা বুঝে আর কিছুটা না বুঝে ত্রিশালের পথে হিথরো বিমানে চেপেছিলাম। হয়তো বাবা-দাদা আর মামা-নানার সরকারির চাকরির করার পরম্পরা অস্বীকার করতে পারিনি। আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলে সেদিনের লিবিয়া, সিরিয়া আর বাংলাদেশের অবস্থানগত বৈষম্য বিবেচনায় বেশিরভাগ লোকের কাছেই আমার সিদ্ধান্তটা ছিল বোকামি। আমি চলে আসব শুনে প্রফেসর পারভিন কুমার কষ্ট পেলেও অবাক হননি। যে দেশের শেখ হাসিনা অতবড় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সে দেশের ডাক্তার মামুন যে অমনটা করতেই পারে– এটা যেন তাঁর কাছে প্রত্যাশিতই ছিল।

আজকের লন্ডন-ত্রিপলি-দামেস্ক আর ঢাকার তুলনামূলক চিত্র বিবেচনায় সেদিনের সেই 'বোকা আমি' নিজেকে কেন জানি নিজের বোকামির জন্য ধন্যবাদ না দিয়ে পারি না। নিঃসন্দেহে আমার এই বোকামির পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত অনেকখানি ইন্ধন যুগিয়েছিল। অতএব ধন্যবাদ তাঁকেও।

লিখছি আর ভাবছি, এই যে শেখ হাসিনার এত বড় এক একটা অর্জন, যে অর্জনে বদলে যায় দেশের ভাবমূর্তি আর এমনকি দেশের একেকটি সাধারণ নাগরিকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রজ্ঞাও, তার স্বীকৃতি কি তাঁকে আমরা দিয়েছি আমাদের লেখনিতে, আমাদের মিডিয়ায়? কোন এক কর্তার ইচ্ছায় একটি ভাস্কর্য এল, বিকৃত হলেন গ্রিসের দেবী, সাজলেন শাড়িতে, বির্তক হল বিস্তর– ভাস্কর্য না মূর্তি, আর তার পর একসময় কর্তার ইচ্ছায়ই তিনি হলেন স্থানন্তরিত। অথচ দোষ সব শেখ হাসিনার!

ভাস্কর্য না মূর্তি এ নিয়ে বিতর্ক চলমান, তবে দোষ যে শেখ হাসিনার এ নিয়ে বির্তক নেই কোনো পক্ষেরই। একদল শাসায় তো অন্যদল মিছিল করে, আর তিনি সয়ে যান সর্বংসহা হয়ে। যার চোখের ইশারায় উল্টে-পাল্টে যেতে পারে সবকিছুই, কিছুই বলেন না তিনি। তারা 'ছিঃ', 'ছিঃ' স্লোগান দেয় আর তিনি সয়ে যান, যেমন একদিন সয়ে গিয়েছিলন খুনি ফারুক-রশীদ গংদের আস্ফালন। তাঁর অঙ্গুলিহেলনে ফারুক-রশীদের পরিণতি হতে পারত 'ফারারিং স্কোয়াড' অথবা 'ক্রস ফায়ার'। তা না করে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন দীর্ঘস্থায়ী এবং সরকারি হস্তক্ষেপে দীর্ঘতর হওয়া প্রচলিত বিচারের। যারা 'ছিঃ', 'ছিঃ' স্লোগান দেয় তারা এটা জানে। আর জানে বলেই তাদের এতটা ধৃষ্টতা। তারা উড়ে বেড়ায়, বকে যায় নির্ভয়ে।

শুধুই কি শেখ হাসিনা? একই পাল্লায় তারা মাপে বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার অনুসারী প্রতিটি লোককে। প্রেমে প্রত্যখ্যাত হয়ে প্রেমিকার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া পাষণ্ডের ছাত্রলীগ পরিচয় আবিষ্কারে তাই ব্যস্ত হয় মিডিয়া, কিন্তু ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক যখন দুস্থ রোগীনির চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় তখন তা হেডলাইন হয় না। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া অবশ্যই পত্রিকার শিরনাম, কিন্তু শিরনাম হয় না বন্যাকবলিত সুনামগঞ্জের হাওরে অথবা মোরা পরবর্তী কক্সবাজারে তাদের দলবদ্ধ ত্রাণ তৎপরতা।

কোনো একদিন আমিও ছাত্রলীগে সক্রিয় ছিলাম, ছিলাম কেন্দ্রীয় কমিটিতেও। এখনও আমি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য। ছিলাম আওয়ামী লীগের গত কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদকও। নেসভ্যাক নামক 'হেপাটাইটিস বি'-এর একটি নতুন ওষুধ নিয়ে গবেষণা আর লিভার ফেইলিওরে এ দেশে প্রথমবারের মতো 'স্টেম সেল থেরাপি' চালু করায় আমি এখন মাঝে মাঝেই মিডিয়ায়। মিডিয়ার বন্ধুদের বলায়, তাদের লেখায় আর তাদের দেখানো ছবিতে মাঝে মাঝেই ইদানিং নিজেকে আবিষ্কার করি। প্রায়ই বলি, আমাকে নিয়ে লিখলে, বললে আমার ছাত্রলীগের পরিচয়টা একটু টেনে আনবেন। কই? একবারও তো দেখলাম না।

প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিল লিখতেন। আরও অনেক কিছুর মতই স্বল্পায়ু এই ভদ্রলোক লেখালেখিতেও ছিলেন অন্য মার্গের। তাঁর মতো করে লেখার যোগ্যতা আমার নেই। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮৮ সাল থেকে। জানতেন একসময় লিখতাম। বলতেন লিখি না কেন? ধমক দিতেন প্রেসক্রিপশনের পাশাপাশি আবারও লেখালেখির জন্য। গত ৬ তারিখে শাকিল ভাইয়ের চলে যাওয়া অর্ধবার্ষিকী পার করলাম। তিনি বেঁচে থাকতে লিখিনি। আবার শুরু করেছি তাঁর চলে যাওয়ার পর, কিছুটা হয়তো বা তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই। শাকিল লিখেছিলেন:

"তুমি সুশীল, আমি ছাত্রলীগ।"

এখন লেখার চেষ্টা করছি আমরা। শাকিলরা চলে যান। আমরা কেউ কেউ লেখার চেষ্টা করতে থাকি। সয়ে যান শেখ হাসিনা। কাজের কাজ হয় না কিছুই। মেনে নিয়েছেন নেত্রী, মেনে নিয়েছিলেন জাতির পিতা, মেনে নিয়েছি আমরাও।

আমরা শুধু বুঝি "দোষ সব নন্দ ঘোষেরই!"