ভূমিকম্প: দুর্যোগে যা করনীয়

এ.কে.এম ওয়াহিদুজ্জামান
Published : 18 March 2012, 03:00 PM
Updated : 18 March 2012, 03:00 PM

আজ ১৮ মার্চ বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টা ৫৬ মিনিটে একটি ভূমিকম্প হয়ে গেল। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে যে ভূমিকম্পগুলো অনুভূত হয়েছে তার সবগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিলো বাংলাদেশের বাইরে। তবে এবারকার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিলো দেশেরই ভেতরে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে- এর উপকেন্দ্র ছিলো ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার বহরা ইউনিয়নের শুভারিয়া মৌজায় ইছামতি নদীর উত্তর তীরে। অক্ষাংশ: ২৩.৬৫৬২°, দ্রাঘিমাংশ: ৯০.১৮০৬° (প্রায়) । কেন্দ্র ছিলো ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৭.৬ কি.মি. গভীরে (প্রায়)। রিখটার স্কেলে ৪.৬ মাত্রার এই ভূমিকম্প স্থানীয় চ্যুতির (Fault) কারণে ঘটেছে। এই মাত্রার ভূমিকম্পে তেমন কোন ক্ষয় ক্ষতি হবার কথা নয়। তবুও ভূমিকম্প বিষয়ে সতর্ক হবার এবং ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।


আমরা জানি যে, ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটটি প্রতি বছর ৫ সেন্টিমিটার হারে ইউরেশিয়া প্লেটের নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এই সরনের ফলে দু'টি প্লেটের সংযোগস্থলে যে শক্তি জমা হচ্ছে তা ইলাস্টিক রিবাউণ্ড তত্ত্ব অনুযায়ী ভূমিকম্পের মাধ্যমে নির্গত হচ্ছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছোট-বড় চ্যুতিগুলো (Fault) একইভাবে চাপ মোকাবেলা করছে এবং একই পদ্ধতিতে শক্তি নির্গত করছে। যার ফলাফল আজকের এই ভূমিকম্প।

ইলাস্টিক রিবাউণ্ড তত্ত্ব
একটি শিলাস্তর যখন দু'টি ভিন্নমুখী চাপের সম্মুখীন হয় তখন এর কেন্দ্রবিন্দুতে পরস্পর বিপরীতমূখী চাপের এক দ্বৈত শক্তি জমা হতে থাকে। চাপ যখন শিলাস্তরের স্থিতিস্থাপকতা অতিক্রম করে তখন সেখানে ফাটল (Fault) সৃষ্টি হয়ে প্রচণ্ড বেগে শক্তি নির্গত হয়। এই শক্তিই বিভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে।

আমরা কতটুকু প্রস্তুত?
যে কোন সময় একটি বড় ভূমিকম্প আঘাত হানলে আমাদের কী হবে? আমরা কতটুকু প্রস্তুত? অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমাদের দেশে ভূমিকম্পের বিষয়টি দেখাশোনা করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ওই প্রতিষ্ঠানটির কাজ করার কথা বায়ুমণ্ডল নিয়ে অথচ তাঁরা শিলামণ্ডল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে। এখনো আমাদের দেশে ভূমিকম্প পূর্বভাষ কেন্দ্র স্থাপন করা হয় নি। আধুনিক সিসমোগ্রাফ নেটওয়ার্ক নেই। ফলে ভূমিকম্প হবার পর আমেরিকার USGS এর ওয়েব সাইটে গিয়ে নিজ দেশের ভূমিকম্পের খবর নিতে হয়। ভূগোল-ভূতত্ত্ব বিষয়ের লোকের বদলে পদার্থবিজ্ঞানী বা পরিসংখ্যানবিদ দিয়ে ভূমিকম্প মাপমাপি করলে এমনটাই হবার কথা। কাজেই ভূমিকম্পের মত প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে জাতীয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে বিষয় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের এর দায়িত্বে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া এই মূহূর্তে সবচেয়ে জরুরী কাজ।

ভূমিকম্প হবার আগে বেশ কিছু ছোটছোট ফোরশক হয়। যেসব প্রাণী মাটির নীচে থাকে তারা তাদের অত্যন্ত সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সেগুলো টের পেয়ে মাটির উপরে চলে আসে। ২০০৯ সালে চীনে ভূমিকম্পের আগে অনেক ব্যাঙ রাস্তায় উঠে এসেছিলো। এসব দেখে আমরা সতর্ক হতে পারি। আগামীকালের পত্রিকা খুলে বাংলাদেশের কতগুলো ভবনের ফাটলের কথা শুনবো জানি না, তবে এখনো সময় আছে, আমাদের ভবন নির্মাণ নীতিমালায় ভূমিকম্পরোধ ব্যবস্থা বাধ্যতামূক করার এটাই বোধ হয় শেষ সময়।

ভূমিকম্পের সময় উপদ্রুত এলাকাবাসীর করনীয়
সরকারী পদক্ষেপের বাইরে সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কিছু বিষয় জানা থাকা প্রয়োজন। ভূমিকম্পের সময় মোটেই আতঙ্কিত হবেন না। এই দূর্যোগে রক্ষা পেতে সাধারণভাবে কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিন।

১: নিজেকে এবং পরিবারকে রক্ষা করুন
ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব কয়েক সেকেণ্ড হতে সর্বোচ্চ মিনিটখানেক। এই সময়ে ঘরে অবস্থান করলে টেবিল বা ডেস্কের নিচে সপরিবারে অবস্থান নিন। আপনার মাথায় কোনকিছুর আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা পাবেন।

২: গ্যাস, তেল বা ইলেক্ট্রিক চুলা দ্রুত বন্ধ করুন
ভূমিকম্পের সময় আগুন লেগে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান অনেক বেড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে যত দ্রুত সম্ভব রান্না ঘরের গ্যাস, তেল বা ইলেক্ট্রিক চুলা বন্ধ করুন। মনে রাখবেন যত ছোট ভূমিকম্পই হোক না কেন চুলা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

৩: তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেড় হবেন না
ভূমিকম্পের সময় তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেড় হতে গেলে ভীড়ে চাপা পড়ে বা উপর হতে মাথায় কিছু পড়ে আহত হতে পারেন। এই জন্য তাড়াহুড়ো না করে ধীর স্থিরভাবে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করে তারপর বাইরে বেড় হবার চেষ্টা করুন।

৪: দরজা খোলার ব্যবস্থা করুন
দালানে বসবাসকারীদের প্রধান সমস্যা হয় ভূমিকম্পের সময় দরজা আটকে বন্দী হয়ে যাওয়া। এইজন্য বাইরে যাবার দরজাটি খোলার ব্যবস্থা করুন।

৫: মাথা রক্ষা করুন
ভূমিকম্পের সময় বহুতল ভবন হতে বাইরে বেড় হবার সময় অনেকেই উপর হতে কোন কিছু পড়ে মাথায় আঘাত পেয়ে থাকেন। এটা এড়াতে বাইরে বেড় হবার সময় মাথার উপর শক্ত বোর্ড বা ট্রে জাতীয় কিছু ধরে রাখুন। এতে করে উপর থেকে কিছু পড়লেও আপনার মাথায় আঘাত লাগবে না। বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় ভূমিকম্প হলে বালিশটি মাথার নীচ হতে মাথার ওপরে আনুন।

৬: সিনেমা হল বা ডিপার্টমেণ্টাল স্টোরের মত পাবলিক প্লেসে করনীয়
সিনেমা হল, অডিটোরিয়াম, ডিপার্টমেণ্টাল স্টোর, রেল স্টেশন বা এয়ারপোর্টের মত পাবলিক প্লেসে থাকলে সেখানে কর্তব্যরত নিরাপত্তা কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের পরামর্শ অনুসরন করুন।

৭: গাড়ি বামদিকে পার্ক করুন
ভূমিকম্পের সময় আপনি যদি গাড়ি চালানো অবস্থায় থাকেন তাহলে ধীরে ধীরে আপনার গাড়িটি রাস্তার বামপাশে পার্ক করুন। কোন অবস্থাতেই ভূমিকম্পের সময় গাড়ি চালাবেন না।

৮: পাহাড়ী রাস্তায় ভূমিধ্বস এবং গড়িয়ে পড়া পাথর খেয়াল করুন
ভূমিকম্পের সময় আপনার গাড়িটি পাহাড়ী এলাকায় থাকলে ভূমিধ্বস এবং গড়িয়ে পড়া পাথরের আঘাত এড়াতে নিরাপদ স্থানে গাড়িটি পার্ক করুন।

৯: উপদ্রুত এলাকা ত্যাগ করতে হাটুন
ভূমিকম্প উপদ্রুত এলাকা হতে নিরাপদ এলাকায় সরে যাবার জন্য গাড়ি ব্যবহার করার চেয়ে পায়ে হাটা অনেক নিরাপদ।

১০: গুজবে বিভ্রান্ত হবেন না
ভূমিকম্পের সময় গুজব বা ভুল তথ্যের কারনে অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকে বিপদ ডেকে আনেন। এজন্য সঠিক তথ্য পেতে রেডিও/টিভির বুলেটিন শুনুন।

ভূমিকম্পের সময় করনীয় বিষয়ক একটি আত্মরক্ষমূলক গাইডের লিংক নীচে দেয়া হলো এটি ডাউনলোড করে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন।

http://www.seikatubunka.metro.tokyo.jp/index3files/survivalmanual.pdf

(১৮, মার্চ, ২০১২)
এ.কে.এম. ওয়াহিদুজ্জামান: গবেষক ও কলামিস্ট। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশের শিক্ষক।