হেফাজতিদের প্রশ্রয় বিভ্রম সৃষ্টি করছে মাত্র

মুনতাসীর মামুন
Published : 3 June 2017, 05:01 AM
Updated : 3 June 2017, 05:01 AM

'থেমিস কমেডি' রাজনৈতিক দল, ধর্মব্যবসায়ীদের দল, ব্যক্তি, সমষ্টির দৃষ্টিভঙ্গি, বিভ্রম অনেককিছু স্পষ্ট করেছে। ধরা যাক, থেমিস না হয়ে যদি অন্য কোনোকিছুর ভাস্কর্য হত, ধারা যাক, উটেরই হত, তা হলে কি এ ঘটনা ঘটত? হ্যাঁ, ঘটত। কেননা, ধর্মব্যবসায়ীরা একটি সুযোগ খুঁজছিল। তারা দেখাতে চাইছিল শেখ হাসিনার মতো নেত্রীও মুজাহিদ জনাব শফির কথায় ওঠেন, বসেন।

এর দুটি দিক আছে, শেখ হাসিনার দুর্বলতা তাঁর অনুসারী ও সমর্থকদের মধ্যে সমষ্টিগত বিষন্নতার সৃষ্টি করত, হজরত শফিরা আরও যা যা চান তা কার্যকর করতে পারতেন। ভোট দেবেন কি দেবেন না, সে তো পরের ব্যাপার।

আওয়ামী লীগের পুরনো সেই সলিড জেনারেশন নেই, যাদের উদাহরণ আমরা দিই। এখন মিশ্র এক জেনারেশন, যেখানে আদর্শ নয়, পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। এ পাওয়ার বিষয়টাও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের তৈরি। অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু সত্য তো। ওবায়দুল কাদেরের অতিকথন অপছন্দ করতে পারেন, কিন্তু 'কাউয়া' নিয়ে যা বলেছেন ও নির্বাচনে না জিতলে কী হতে পারে তার বিষয়ে যা বলেছিলেন, তা মিথ্যা নয়। আওয়ামী লীগ যখনই জেতে তখনই 'কাউয়া'রা অগ্রাধিকার পায়।

সুতরাং, হে-জা-বি এবং যারা ধর্মের ব্যবসা পুঁজি করে 'টু পাইস' কামান তারা অজুহাত দিতেনই। তাদের কাছে যুক্তি অসার। পৃথিবীর সব ইসলামী রাষ্ট্রে ভাস্কর্য আছে তাহলে বাংলাদেশে ইসলামের কী সমস্যা? সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশে ইসলামের প্রতিভূ এখন পাকিস্তানিমনারা। জনাব শফি মুজাহিদ বাহিনীর নেতা ছিলেন ১৯৭১ সালে, সে কথা তো পত্রিকায়ই এসেছে। হেফাজতের নেতৃত্বে এখন জামায়াতিরা আছেন তা-ও তো পত্রিকায় এসেছে। পাকিস্তানীরা ১৯৭১-এর পরাজয় ভোলেনি। সে কারণে, বাংলাদেশ অনেক মহব্বত দেখানোর পরও তারা বিষ উগরে দিচ্ছে। হেফাজতরা ৫ মে ঢাকা আক্রমণের পরাজয়ের স্মৃতি ভোলেনি। তারা সুযোগের অপেক্ষায়। রাউজান, হাটহাজারী, সাতকানিয়ার যারা শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা ছাড়া বাকি সবাই অজ্ঞ, পলিটিকস বোঝে না, এই ধারণা অজ্ঞানতার সামিল।

সুতরাং ইস্যু তৈরিতে সক্ষম হয়েছে হেফাজত, এটা তাদের কৃতিত্ব। এই ইস্যু তৈরিতে সরাসরি সহায়তা করেছেন বর্তমান প্রধান বিচারক। বাংলাদেশের জুডিশিয়াল ইতিহাসে এমন 'কথক' বিচারপতি আগে আবির্ভূত হননি। আর বাংলাদেশেও কোনো প্রধান বিচারপতি এত বশীভূত বার, আইনব্যবসায়ী, বিচারক পাননি। জনাব শফি ইস্যু খোঁজেন, প্রধান বিচারপতি প্রতিদিন তার বক্তব্যের মাধ্যমে ইস্যু তৈরি করছেন। দুজনকেই অভিনন্দন!

আমি মৃণাল হককেও অভিনন্দন জানাতে চাই। তিনি যখন আবেগাপ্লুত হয়ে বলছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও এখন সরাতে বলা হবে। তখন আমরা কয়েকজন বয়সী যারা টিভি দেখছিলাম তারা হেসে ফেললাম। মৃণাল ছিলেন, তার সহপাঠীদের মতে, ছাত্রদলের দুর্ধর্ষ ক্যাডার। তার বাবা-দুলাভাই দুজনই ছিলেন বিএনপির নীতিনির্ধারক। তিনিই প্রথম অস্ত্র হাতে 'বাকশালিরা কই' শ্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের ক্যাডার ও সমর্থকদের চারুকলা ছাড়া করেন। ওই প্রথম চারুকলায়, যাবতীয় কারুকর্মের বিরোধী বিএনপি-জামায়াত জায়গা করে নেয়। বিশ্বাস না হয়, চারুকলার বর্তমান ডিন মৃণালের সিনিয়র নিসার হোসেন, মৃণালের শিক্ষক হাশেম খান বা রফিকুননবীকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

ঢাকা শহরকে ভাস্কর্য-বর্জ্যে রূপান্তর করেছেন দুজন– শামীম শিকদার ও মৃণাল হক। দুজনই আওয়ামীবিরোধী। ভাস্করদের মধ্যে এ দুজনই আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন বেশি। শামীম 'একুশে পদক' পেয়েছেন একটি-দুটি ভাস্কর্য করে, আওয়ামী লীগ আমলে। আজ ৮৫ বছরে মুর্তজা বশীরের মতো শিল্পী 'স্বাধীনতা পদক' পান না। শামীম বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য করেছেন। এস এম হলের সামনে বঙ্গবন্ধুর যে ভাস্কর্য সেটি বঙ্গবন্ধুর একটি ক্যারিকেচার, ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে। আমার তো দাবি সেটি অপসারণ করা হোক এবং সেখানে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য স্থাপন করা হোক।

মৃণাল বিএনপি আমল থেকেই কমিশন পাচ্ছেন। ঢাকার সব চৌরাস্তায় তার ভাস্কর্যের নিদর্শন দেখা যাবে। এ ভাগ্য বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর হয়নি। তার শিল্পকর্মকে কেউ কখনও 'ভাস্কর্য' আখ্যা দেয় না। যেমন: শামীমের শিল্পকর্মও কেউ 'ভাস্কর্য' বলে না। আওয়ামী লীগ আমলে চমৎকার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন মৃণাল, প্রধান বিচারপতির কমিশন করা ভাস্কর্য এর সর্বশেষ উদাহরণ। ঢাকার মেয়র বা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি মুক্তিবুদ্ধির ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক কোনো শিল্পীকে এরকম পৃষ্ঠপোষকতা দেয়নি। আজ স্বাধীনতা নিয়ে যার সন্দেহ আছে, বঙ্গবন্ধুর কথা যার মুখে প্রথম শুনলাম, তিনি প্রগতিশীলতার প্রতীকে পরিণত হলেন। কে বলে, বাংলাদেশ 'সব সম্ভবের দেশ' নয়?

ভাস্কর্য স্থানান্তরের বিষয়ে ওবায়দুল কাদের আর মওদুদ আহমদের বক্তব্য এক। দুজনই নোয়াখালির এক কনসটিটিউন্সির। বস্তুত অর্থনীতি বা ব্যবসার ক্ষেত্রে বিএনপি-আওয়ামী লীগ পার্থক্য কম। পার্থক্য এখন শুধু বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানে। আওয়ামী নেতাদের বিএনপির বিরুদ্ধে যত কথা বলতে দেখি, জামায়াতের বিরুদ্ধে তত বলতে শুনি না। এমনকী জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিও তারা মানেননি। সুতরাং আওয়ামী লীগ এখন পুরনো আদর্শের একমাত্র দাবিদার সে কথা বলা ভুল হবে। মূল আদর্শ থেকে আওয়ামী লীগ পিছু হটছে এটি কেউ বুঝছে না ভাবলে ভুল হবে। আমি সাম্প্রতিক কয়েকটি উদাহরণ দিলে অবাক হবেন। কিন্তু উদাহরণ দিয়ে কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না।

যুক্তিবুদ্ধির চর্চাকারিরা শেখ হাসিনার ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। কিন্তু যিনি ইস্যুটি তৈরি করলেন তার সম্পর্কে কোনো বক্তব্য রাখেননি। আজ বঙ্গবন্ধুর যে কদাকার শিল্পকর্ম সরাবার প্রস্তাব করলাম তখন এরা তাতে আপত্তি করবেন না; কিন্তু ছাত্রলীগ করবে। সুতরাং শিল্পকর্ম এখন আর নিছক শিল্পকর্মের দৃষ্টি থেকে দেখা হচ্ছে না।

প্রধান বিচারপতি ভাস্কর্য আবার পুনস্থাপন করছেন। সেটি থাকবে, না মৌলবাদীদের দাবি মানা হবে– সেটি প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার। তবে সেটি এখন মৌলবাদীদের চোখে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রথমে হেফাজতিরা এই ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে যে দাবি করেছিল আর এখন যে দাবি করছে তার সঙ্গে কিন্তু মিল নেই। রমজান মাসে এটি নিয়ে যথেষ্ট জল ঘোলা হবে। তবে এ ইস্যু বেশিদিন চালানো যাবে না। ১৫ ভাগ ভ্যাট প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমর্থকদের মুখে একটু কষটে স্বাদ থেকে যাবে।

এই ইস্যু যেহেতু প্রধান বিচারপতি তৈরির সুযোগ দিয়েছেন তাকে নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক। কেন মৃণালকে তিনি দিলেন? পুরনো কোনো আদর্শিক মিল? সুপ্রিম কোর্টের মতো জায়াগায় একটি ভাস্কর্য হবে, আনন্দের কথা। তিনি দেশজুড়ে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারতেন। কারো কোনো কিছু বলার থাকত না।

২.
পৃথিবীর কোনো দেশে প্রধান বিচারপতি কদাচিৎ খবরের বিষয় হন। শিরোনাম তো নয়ই। আমাদের দেশেটি ব্যতিক্রম। এখানে প্রধান বিচারপতি বক্তব্য দেন। বিতর্কিত বক্তব্য দেন। শিরোনাম হন। বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ বলেই হয়তো এরকম হচ্ছে। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ একদিন এজলাসেই ঘোষণা করলেন, তিনি শান্তি কমিটির [১৯৭১] সদস্য ছিলেন। ভাবুন একবার!

সেই থেকে বিচারপতি সিনহা থামছেন না। হ্যাঁ, তিনি খবরের বিষয় হচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি নেত্রীকে এখন খবরের স্পেসের জন্য তার সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। এতে তিনি সন্তোষ লাভ করতে পারেন, কিন্তু সমাজ রাজনীতিতে তার বক্তব্য, বিভিন্ন বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, যা কাম্য নয়। শুধু তাই নয়, সুপ্রিম কোর্ট এখন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে রাষ্ট্রের দুটি অঙ্গের। এটি আগে কখনও ছিল না। রাষ্ট্রপতিকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে, যিনি বিচারক থেকে প্রধান বিচারপতি সবাইকে নিয়োগ দেন। শুধু তা-ই নয়, প্রতিভাত হচ্ছে, নিজেদের ক্ষেত্রে স্বার্থ সংরক্ষার্থে তারা যতটা যত্নবান অন্যদের ক্ষেত্রে ততটা নন।

এখন সুপ্রিম কোর্টের সামনে এক ভাস্কর্য নিয়ে অস্থিরতা, বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এটিও তার অবিবেচনামূলক সিদ্ধান্ত। প্রধান বিচারপতি বা বিচারপতিরা যাকে যা খুশি বলতে বা মন্তব্য করতে পারবেন, অন্যরা পারবেন না, সে দিন বোধ হয় ফুরিয়ে এসেছে। মনে রাখা দরকার, সুপ্রিম কোর্টের বা যে কোনো আদালতের ক্ষমতার ভিত্তি তাত্ত্বিক, বাস্তব নয়। বাস্তব ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের কাছে। তারা অন্য কোনো বিভাগের নির্দেশ/আদেশ/অনুরোধ না মানলে কারো কিছু বলার নেই। সে জন্য সবাইকে সমঝোতার মাধ্যমে এগোনোই ভালো– যেটি এ ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আরেকটি বিষয়, আদালতও দায়বদ্ধ সাধারণ মানুষের কাছে। কারণ, বাংলাদেশ একটি প্রজাতন্ত্র, রাজতন্ত্র নয়।

কিছুদিন আগে প্রধান বিচারপতি বলেছেন:

"দেশে আইনের শাসন নেই।"

না থাকলে তিনি প্রধান বিচারপতি থাকছেন কীভাবে? বলেছেন, তাঁর আমলেই ৯০ ভাগ বিচার সম্পন্ন হয়েছে। তাঁর পূর্বের প্রধান বিচারকরা এর প্রতিবাদ করেননি। অর্থাৎ মিস্টার সিনহা যা বলছেন তা ঠিক।

সাঈদীর রিভিউ খারিজ করেছেন তাঁর বেঞ্চ, অথচ এ বিষয়ে তাঁর রায়েই পরস্পর বিরোধিতা আছে। প্রকাশ্যে এ কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী। কয়েকদিন আগে এই রিভিউ শুনানির সময় আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন:

"কিছু নন-প্র্যাকটিসিং ল'ইয়ার প্রসিকিউটর হয়েছেন। কিছু প্রসিকিউটর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভায়ও যান। যাদের (নির্মূল কমিটি) পলিটিকাল এজেন্ডা রয়েছে। তারা (প্রসিকিউটর) কিন্তু মিসকন্ডাকট (অসদাচরণ) করছেন। তারা পাবলিক প্রসিকিউটরের বোঝেন না।"

('বাংলাদেশ প্রতিদিন', ১৩ মে ২০১৭)

এ বক্তব্য অত্যন্ত আপত্তিকর। কিন্তু মিস্টার সিনহার ক্ষেত্রে তা স্বাভাবিক। যখন নির্মূল কমিটি হয় তখন স্বাধীনতাবিরোধীরা তার নামকরণ করেছিল 'ঘাদানিক'। আলবদরদের মুখপত্র 'ইনকিলাব' এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। সেই 'ইনকিলাব' এখন কোথায়? আলবদর মান্নানের কথা উঠলে তো সবাই আগে একদলা থুতু ফেলে। নির্মূল কমিটি নয়, মিস্টার সিনহার ক্ষোভ আছে ট্রাইব্যুনাল নিয়ে, ট্রাইব্যুনালের জায়গা নিয়ে, ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে। এ নিয়ে মানহানির মামলায় 'জনকণ্ঠ' পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় জরিমানা গুনেছেন।

নিজে অভিযোগ করেছেন, নিজে বিচার করেছেন, বিশ্বে কোনো আদালতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে শুনিনি। ধরা যাক, একজন বিচারক এমন একটি কাণ্ড ঘটিয়েছেন। তখন সেই অভাগা যাকে গায়ের জোরে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে তিনি যাবেন কোথায়? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিচারকদের স্বার্থই রক্ষা করবে। সংসদ থাকলে হয়তো জনপ্রিতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে।

নির্মূল কমিটি রাজনৈতিক সংগঠন নয়। যে কারণে গত ২৫ বছর বাংলাদেশে নির্মূল কমিটির সহস্রাধিক সভায়, রাজনীতিবিদ, ধর্মজ্ঞ, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিচারক সবাই এসেছেন। বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেলও অনেকবার এসেছেন। কেউ কখনও বলেনি নির্মূল কমিটির 'পলিটিকাল এজেন্ডা' রয়েছে। এ কথা বলে বিএনপি-জামায়াত ও পাকিস্তান। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এ কথা বলতে পারেন না, কারণ এটি রাজনৈতিক বক্তব্য।

হাইকোর্ট সম্প্রতি এক রায়ে বলেছে:

"মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কেউ বিচারক হতে পারবেন না।"

এটি কি পলিটিকাল রায় হিসেবে গণ্য হবে? কারণ আমরা তো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিশেষ করে '৭১-এর ঘাতকদের বিচারের জন্য আন্দোলন করছি। ঘাতকদের বিচার চাওয়া যদি পলিটিকাল এজেন্ডা হয় তাহলে প্রধান বিচারপতি গত এক মাসে যা বলেছেন তা-ও পলিটিকাল এজেন্ডার অন্তর্গত। এবং দেশের অধিকাংশ মানুষ তা-ই মনে করছে। প্রসিকিউটররা 'মিসকন্ডাকট' করছেন কি না, তার জবাব তাঁরা দেবেন যদি মেরুদণ্ড থাকে।

আমরা শুধু বলব, আমাদের আন্দোলনের কারণে ৪৫ বছর পর শহীদরা সুবিচার পেয়েছেন। ট্রাইবুনালের রায় বিশ্বে নন্দিত হচ্ছে যা অনেকের গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠছে। এই একটি বিচারকাজ শুরু করে শেখ হাসিনা বিশ্বে ন্যায়বান রাজনীতিবিদ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং এ কারণে তিনি ইতিহাসে থাকবেন। যারা এসবে পলিটিকাল এজেন্ডা খোঁজেন তাদের অধস্তনরাও তাদের একসময় চিনবে কি না, সন্দেহ।

প্রধান বিচারপতি সর্বশেষ বিতর্কিত কাজটি করেছেন, কাউকে না জানিয়ে, আলোচনা না করে সুপ্রিম কোর্টের সামনে একটি অখাদ্য ভাস্কর্য বসিয়ে। এর ফলে সরকার, চরমপন্থী দল, মুক্তিবুদ্ধির সমর্থক সবাই সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। বিএনপি আমলে কয়েকজন প্রধান বিচারপতি পলিটিকাল এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিতাড়িত হয়েছিলেন অসম্মানজনকভাবে। এখনও তা হয় কি না, কে জানে!

৩.
সুপ্রিম কোর্টের সামনে ভাস্কর্য স্থাপন ও স্থানান্তর সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। এর কয়েকটি দিক আছে, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নান্দনিক। কিন্তু যিনি যে পক্ষের সমর্থক তিনি সে পক্ষকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন।

রাজনৈতিক দলগুলি যে ভবিষ্যৎ ভিশনের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে তাতে সংস্কৃতির কোনো স্থান নেই। অথচ বাংলাদেশের সৃষ্টি মূলত সাংস্কৃতিক। ভিশনে বাস্তবে রাজনৈতিক দলগুলি গুরুত্ব আরোপ করছে ধর্মের ওপর। এর কারণ ধর্মব্যবহারকারী দলগুলি ভাঙচুর করতে পারে, ইসলামি জোশ জাগিয়ে তুলতে পারে। শুক্রবার জুমার পর এবং তাদের সমাবেশে হাজার দশেক লোক নামানো কিছুই নয়। সংস্কৃতিকর্মীরা রাজপথে এক হাজার লোক নামাতে পারেন না, ভাঙচুর করতে পারেন না। রাজনৈতিক শাসকরা শক্তি বোঝেন। সে কারণেই বর্তমান সরকারে গুরুত্ব পায় নিরাপত্তা বাহিনী ও ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলি।

ভাস্কর্য নিয়ে বর্তমান অস্থিরতা সৃষ্টি হত না যদি প্রধান বিচারপতি বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিতেন। দুটির জায়গায় তিনটি গাড়ি ব্যবহার বিবেচনাপ্রসূত হোক না হোক সাধারণের কাছে তা বিবেচ্য নয়, কিন্তু ভাস্কর্য এখন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য হয় এবং ভুলভাবে তুলে ধরা হয়, তখন তা সবার কাছে বিবেচ্য হয়ে ওঠে।

এ ধরনের একটি ভাস্কর্য এখানে বসানো হোক এটির সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর নয়, প্রধান বিচারপতির। বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী বলেছেন:

"প্রধান বিচারপতি এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন 'অটোক্র্যাটে'র মতো। ফুল বেঞ্চে তিনি এ সিদ্ধান্ত নেননি।"

বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্যের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত নই। অন্যান্য বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনা করলে ভালো হত, কিন্তু না নিলে তিনি 'অটোক্র্যাট' হয়ে যান না। তবে তখন সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব তাঁর ওপরই বর্তায়।

হেজাবি বা হেফাজতিরা এই 'মূর্তি' বা 'ভাস্কর্য' সরানোর জন্য 'আন্দোলন' শুরু করে। আমরা অনেকে বিষয়টি দেখেছি নান্দনিক দিক থেকে। এটি ভাস্কর্য বা মূর্তি হতে পারে, কিন্তু এর সঙ্গে নন্দনতত্ত্বর কোনো সম্পর্ক নেই। এখন মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ডেভিডকে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরিয়ে যদি যুব ও ক্রীড়া দফতরের সম্মুখে রাখা হয় তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? এটি ভাস্কর্য নিয়ে এক ধরনের ফাজলামো।

একইরকমভাবে শামীম শিকদারের নানাজনের ভাস্কর্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ভরে গেছে। এগুলি ভাস্কর্য কে বলবে! বলা যেতে পারে শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর হয়ে গেছে। এভাবে ঢাকা শহরে রাস্তাঘাটে ভাস্কর্যের নামে যা গড়া হয়েছে তার কোনো নান্দনিক মূল্য নেই। সিটি করপোরেশনের উচিত ছিল একটি কমিটি করা এবং কোথায় কী হবে তা কমিটি কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে মেয়ররা সবসময় উৎসাহী নির্মাণে। ঢাকা শহর থেকে এসব ভাস্কর্য উৎপাটন করে শহরকে পরিচ্ছন্ন করা উচিত। এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যা ভাস্কর্য তা স্থাপন করা উচিত।

হেজাবিরা সব সময় সুযোগ খোঁজে ঝগড়া-ফ্যাসাদ বাঁধাবার জন্য। তারাও নান্দনিক প্রশ্ন তুলেছে এর সঙ্গে আধুনিক মননের পরিচয় দেওয়ার জন্য ঔপনিবেশিক মনোজগতের কথা বলেছে এবং সর্বশেষ ধর্মীয় তূণ ব্যবহার করেছে: ঈদের নামাজ পড়ার সময় এটি দৃষ্টিগোচর হয়। শেষোক্তটি সাধারণকে উত্তেজিত করেছে, যদিও এটি কোনো যুক্তি নয়।

হেজাবিরা শক্তি পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে। প্রধানমন্ত্রী যদি কওমিদের সনদ দেওয়ার সমাবেশে আবেগভরে এর নান্দনিকতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলতেন এবং তা না থাকার প্রতি ইঙ্গিত করতেন তাহলে হেজাবিরা আর এগোতো না। এখন তারা এটি একটি ইস্যু করে তুলতে পেরেছেন। রমজানের আগে এটি সরানো না হলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হতে পারত– এ ভয় সরকারের ছিল। বিষয়টি দাঁড়াত, প্রধান বিচারপতি যেহেতু মুসলমান নয় সেহেতু তিনি মুসলমানদের সেন্টিমেন্ট বুঝছেন না– এ ধরনের যুক্তির সামনে কোর্ট কী করতেন?

আমার মনে আছে, যখন মি. সিনহাকে প্রধান বিচারপতি করা হয় তখন ধর্মাশ্রয়ী দলগুলি এর বিরোধিতা করেছিল। নির্মূল কমিটির আমরা তখন এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেছিলাম, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ধর্ম দিয়ে পদ নির্ধারিত হতে পারে না। বরং বিচারপতি সিনহাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের জন্য আমরা শুধু অনুরোধ নয় লবিও করেছি। তখন কিন্তু তিনি বলেননি, নির্মূল কমিটির 'পলিটিকাল এজেন্ডা' রয়েছে।
সংবাদপত্র-টিভি দেখে আমাদের এখন ধারণা হয়েছে, তিনি বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তিনি তাঁর নিয়োগকর্তা থেকে সবাইকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছেন, পারলেন না খালি হেজাবিদের সঙ্গে।

ইন ফ্যাক্ট, ধর্মের প্রশ্ন এলে আদালত কখনও দৃঢ় ভূমিকা নেয়নি। দুয়েকজন বিচারপতি এর ব্যতিক্রম, যেমন: প্রাক্তন বিচারপতি গোলাম রাব্বানী, যিনি ফতোয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। আপনাদের মনে আছে কি না অষ্টম সংশোধনীর দুটি দিক ছিল। একটি আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ, অন্যটি রাষ্ট্রধর্ম। বিচারপতি শাহাবুদ্দীন ও অন্যান্যরা বিকেন্দ্রীকরণ বাতিল করলেন যা ছিল জনস্বার্থের পক্ষে। কারণ, এতে আইনব্যবসায়ী ও বিচারপতিদের স্বার্থ জড়িত ছিল। তারা রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কে শুনলেন না যা ছিল জনস্বার্থের পক্ষে ও সংবিধানবিরোধী। কয়েক মাস আগে আবার রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কিত আবেদনটি শুনানির আবেদন করলে তা খারিজ হয়ে যায়। যে যুক্তিতে তা খারিজ হয়ে যায় তা উল্লেখ করে আর নিজেদের খাটো করতে চাই না।

থেমিসের 'ভাস্কর্য' অপসারণের সিদ্ধান্তও প্রধান বিচারপতির একার। শাহদীন মালিক তাঁর এক বক্তব্যে প্রধান বিচারপতির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে বলছেন, জুডিশিয়ারির ওপর নির্বাহী বিভাগের আধিপত্য আবার প্রমাণিত হল।

নির্বাহী বিভাগের আধিপত্য থাকলে গত কয়েক মাস প্রধান বিচারপতি যে সব মন্তব্য করেছেন তা করতে পারতেন না। এমনকি ষোড়শ সংশোধনী শুনানিকালেও যে সব মন্তব্য করছেন তা করতেন না। সুতরাং, এটি ঠিক মন্তব্য নয়। আর নির্বাহীর আদেশই যদি তিনি মানেন তা হলে ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে শুনানির প্রয়োজন কী।

বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ ও আওয়ামী নেতা ওবায়দুল কাদেরও একই সুরে বলেছেন, এটি প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত এবং এ ভাস্কর্য অপসারণের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি এবং জুডিশিয়ারির সঙ্গে যুক্ত অনেকের মতামত নিয়েছিলেন। কিন্তু আন্দোলন হচ্ছে সরকারের বিপক্ষে। কোনো আন্দোলনকারী এটি বললেন না, কেন প্রধান বিচারপতি এটি বসালেন আবার সরালেনও বা কেন? প্রধান বিচারপতি একটি কুশ্রী ভাস্কর্য বসিয়েছিলেন, সেটি আবার স্থানান্তর করলেন (উৎপাটিত হয়নি)। আদালত মানলে আমাদের এত হইহল্লার কী আছে?

৪.
সামগ্রিকভাবে কোনো বিষয় দেখতে আমরা অভ্যস্ত নই এবং অধিকাংশই ধান্ধাবাজিকে গুরুত্ব দিই। ধর্মাশ্রয়ী দল ও রাজনৈতিক দলগুলি ধান্দাবাজ– সেটি দ্বিধা না রেখেও বলা যায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবাই আচ্ছন্ন– এ ধারণাটি এখনও কেউ সহজে বাদ দিতে চায় না; যে কারণে সবাই মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে শুরু করে।

'থেমিস'কে নিয়ে আন্দোলন করছে তরুণরা তাতে আমাদের অসমর্থন নেই। কিন্তু কিছুদিন আগে আরেকটি খারাপ কাজ হয়েছে, করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সরকার। হেজাবিরা দাবি করেছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সিলেবাস বিশেষ করে বাংলার সিলেবাস বদলানোর। সরকার তা মেনে নিয়েছিল নির্দ্বিধায়। সিলেবাস বদলানো যাবে না– এ কথা কখনও আমরা বলব না। কিন্তু, হিন্দুদের লেখা থাকবে না, বোর্ডের চেয়ারম্যান হিন্দু হতে পারবে না– এ ধরনের অনেকগুলি দাবি ছিল।

এই সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে পাকিস্তান আমলে ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এখন এর বিরুদ্ধে অধিকাংশ তরুণ রাস্তায় নামেনি। আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা ছিল নিশ্চুপ। গণজাগরণ মঞ্চের ইমরান পক্ষ এখন বিপ্লবী বক্তব্য দিচ্ছে, কিন্তু তখন একটি কথাও বলেনি। ভাস্কর্য রক্ষা থেকে সিলেবাস রক্ষা ছিল তখন এবং এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই নির্মূল কমিটির বৃদ্ধরা ও তাদের পুরনো সহযাত্রীরাই এর প্রতিবাদ শুধু নয় একটি কমিশন গঠন করে রিপোর্টও প্রকাশ করেছিল।

আরও আছে, কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না। পুরো সমাজে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বেড়েছে, ধান্দাবাজি বেড়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখেই এসব কাজ হচ্ছে। আসলে এখন মুক্তিযুদ্ধটা হচ্ছে ক্ষমতা ও ক্ষমতাবান হওয়ার যুদ্ধ। এবং প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখন ক্ষীণ বা না থাকার মতো। তবে সেটি নিয়ে আমি আক্ষেপ করব না। আক্ষেপ করছি পুরো সমাজটা ধান্দাবাজ হয়ে গেলে জাতির ভবিষ্যত কী?

সংসদ দিয়ে শুরু করুন। পত্রিকায় বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিষয় নিয়ে যা লেখা হচ্ছে তার অর্ধেক সত্য হলে বলতে হবে গণতান্ত্রিক সমাজ বিপদাপন্ন। জুডিশিয়ারি হঠাৎ সবার ওপরে নিজের স্থান চাইছে, বিচারবিভাগের 'স্বাধীনতা'র ব্যাপারে অ্যামিকাস কিউরি থেকে বিচারপতিরা একমত।

প্রশ্ন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় এসব আইনজীবীদের ভূমিকা আমরা দেখেছি। এগুলি নিয়ে লেখালেখি হলে কারো ইজ্জত থাকবে না। সে সময় তাদের কোনো হুংকার আমরা শুনিনি, যা শুনি শেখ হাসিনার আমলে। নিম্ন আদালত, বিশেষ আদালত এবং হাইকোর্টে তখন মেজর ও বিচারকরা কী ভূমিকা রেখেছিলেন তা সেই সময়কার খবরের কাগজ দেখলে বোঝা যাবে। একমাত্র ব্যরিস্টার রফিকুল হকই তখন সাহস দেখিয়েছিলেন যথার্থ আইনজীবীর মতো। কই কোনো প্রধান বিচারপতি তো একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের কথা বলেননি ওই সময় বিচারকদের আচরণ তদন্ত করার জন্য বা ওই রায়গুলি আদালতে বিবেচিত হতে পারে কি না, তা দেখার জন্য।

সামরিক আইন যথার্থ আইন– সেই রায় কি এই হাইকোর্ট দেয়নি? তারা কি নিজেদের যথার্থ স্বাধীন করতে পেরেছেন? কোনো প্রধান বিচারপতি এর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন? তোলেননি। ৩০ বছর পর একজন বিচারপতি খায়রুল হক যখন তা বাতিল করলেন তখন তা হয়ে গেল 'রাজনৈতিক রায়'। সব বিভাগের স্বাধীনতা অনেকটা নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর।

ব্লগার হত্যা যখন থেকে শুরু হয়েছে তখন থেকে নিরাপত্তা বাহিনী, সরকার শুধু পরামর্শ দিয়েছে মুক্তিচিন্তার মানুষদের আর প্রশ্রয় দিয়েছে হেজাবিদের। তখনও কয়জন তরুণ, সুধীজন নেমেছেন তাদের জন্য রাস্তায়? আজও দেখি গুটিকয় প্রতিবাদী তরুণকে রাবার বুলেট ও গরম পানিতে পর্যদুস্ত করা হয়, কিন্তু হেজাবিদের কেউ কিছু বলে না। তাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছিল সেগুলির কথা সবাই ভুলে যায়। তাদের গ্রেপ্তার করা হয়, অজ্ঞাত ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

নির্বাহী বিভাগে দেখি তারাই পুরস্কৃত হয় বা প্রশাসনে তারাই ক্ষমতাশালী যারা শেখ হাসিনার বিপদের সময় পাশে ছিলেন না। ছিলেন বিদেশে, আয়েশে, মাঝে মাঝে হয়তো ফোনে খবর নিতেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও যারা মার খেয়েছেন তারাই মার খাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধ ব্যবহারকারী ও হাসিনাবিরোধীরা শক্তিশালী হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে এখন একটি ডানপন্থী দলে তৈরি করা হচ্ছে।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে এগোন, আমলা-কামলা-রাজনীতিবিদদের (ব্যতিক্রম আছে) থেকে সাড়া পাবেন না, প্রতিবন্ধকতা পাবেন। কিন্তু যদি পৌঁছুতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে নিদান পাবেন। কিন্তু এখন চারদিকে যা দেখছি, তার কাছেও এখন নিদান পাব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ জাগছে।

সব রকমের যুক্তি তর্কের পরও বলব, সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য সরানো মুক্তমনাদের মনে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। এখন যে বক্তৃতা-বিবৃতি দেখছেন কাগজে বা রাজপথে কিছু তরুণের পদচারণা তা একেবারে উপেক্ষা করা ঠিক নয়। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সংস্কৃতি কর্মীরা ক্ষুব্ধ। একটির পর একটি হেজাজিদের দাবি মেনে নেওয়াকে তারা দেখছেন রাষ্ট্রের ইসলামীকরণের পক্ষে। এটি আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের পক্ষে যাবে না।

সরকার হয়তো বিষয়টিকে দেখছে এ ভাবে যে, নির্বাচনের আগে আর কোনো ঝামেলা নয়, একধরনের সমঝোতা করে সময়টা পার করে দেওয়া। কিন্তু 'হেজাবিদের কনসটিটিউয়েন্সি' রক্ষা করতে গিয়ে 'ট্রাডিশনাল কনসটিটিউয়েন্সি' থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সরকার। নতুন বাজেট সবাইকে আনন্দিত করবে না। উন্নয়নেও সহায়ক ভূমিকা কতটা রাখবে, সন্দেহ। কারণ ১৫% ভ্যাট সাধারণ মানুষ দেবে, ব্যবসায়ীরা না। ব্যাংক লুটেরা, শেয়ার লুটেরা কেউ গ্রেপ্তার হয় না, গুটিকয় তরুণ গ্রেপ্তার হয় ভাস্কর্য অপসারণরোধ আন্দোলনে– এটি কোন ধরনের ন্যায্য ব্যবস্থা?

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে পারেন, কিন্তু এখন তা পরাজিত। ১৯৭৫-এর শাসকরা দূরদর্শী ও শক্তিশালী শাসক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। আমাদের সবার হৃদয়ে পাকিস্তানের একটি ডাকটিকেট গেঁথে দিয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তচিন্তা, মুক্তিবুদ্ধির চর্চা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে কাজ করে যাওয়া এখন বিপজ্জনক। কেননা সবাই সে জায়গা থেকে সরে আসছেন। নইলে বারবার হেজাবিদের কাছে এ সরকার নতি স্বীকার করবে কেন? কেন এদেশের প্রধান বিরোধী শক্তি, নিজ দেশের প্রতি অনুগত না থেকে পাকিস্তানের অনুগত হবে? কেন প্রধান বিচারপতি বলবেন খোলা এজলাসে যে, "আমিও দিনে শান্তি কমিটি করেছি" এবং তারপরও তিনি প্রধান বিচারপতি থাকবেন এবং আইনজীবীরা যারা এখন সোচ্চার জুডিশিয়ারির স্বাধীনতা নিয়ে তারা নীরব থাকেন?

আমরা বিষয়টি বুঝি না, তা নয়। কেন স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম উৎপাটন করতে চাইলে (স্থানীয়) আওয়ামী লীগ নেতারা একটি বাক্যও বলেন না। অনেক উদাহরণ দিতে পারি, দেব না। সান্ত্বনা দিই এ ভেবে যে, সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যথেষ্ট কাজও তো করেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও ভাতা বৃদ্ধি, 'জাতীয় গণহত্যা দিবস' ঘোষণা, বিদেশি বন্ধুদের সম্মান, বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য– সে তো শেখ হাসিনাই করেছেন বা সমর্থন দিয়েছেন।

কিন্তু দুঃখটা এইখানে যে, নির্বাচনের জন্য বারবার নতি স্বীকার অপরপক্ষকে শক্তিশালী করে মাত্র এবং নিজের দুর্বলতাই প্রকাশিত হয়। তিনি হয়ত আগামীবার আবারও নির্বাচিত হবেন, হয়তো কেন, হবেন। কিন্তু এই ধরনের আদর্শহীন রাষ্ট্র বা সমাজ বা রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে গৌরবের কী কারণ থাকতে পারে?

আমরা এ-ও বলতে চাই, ভাস্কর্য হবে। হেজাবি নেতাদের বলেছিলাম, সাহস থাকলে ক্যান্টনমেন্ট বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সামনে এসে বলেন, ভাস্কর্য সরাতে হবে। দেখি, সেটি সরানো যায় কি না।

শেখ হাসিনা ৫ মে ২০১৩ সালে হেফাজতিদের ঢাকা আক্রমণের সময় বলেছিলেন:

"আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে।"

হেজাবিরা দে দৌড় ঢাকা ছেড়ে পালিয়েছিল। ডান্ডা সবাই ভালোই বোঝে উপর্যুক্ত বিবরণ তার উদাহরণ।

শেখ হাসিনা ধর্ম ব্যবসায়ীদের দৌড়ানি না দেন, প্রশ্রয় দেবেন না– সেটিই সবার কামনা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবি মানছেন, কোনো ক্ষেত্রে হেজাবিদেরও। কিন্তু এই নীতি কোনো পক্ষকে খুশি করে না। এই বিভ্রম নির্বাচনের জন্যও অনুকূল নয়।

হেফাজতিদের আর যে কোনো ধরনের ছাড় সরকারের পক্ষে যাবে না। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পুরোধা সেই অভিধাও যাবে। আমরা সেটি চাই না।

১ জুন ২০১৭