মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি

সাজ্জাদুল হাসান
Published : 18 June 2017, 04:25 AM
Updated : 18 June 2017, 04:25 AM

মনে পড়ে ছোটবেলায় পড়া নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখা প্রিয় সেই ছড়া 'কাজের লোক':

"মৌমাছি, মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই।
ওই ফুল ফোটে বনে
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় তো নাই।"

কবির মতো মৌমাছি বললেই অবধারিতভাবে আমাদের ভাবনায় প্রথমেই চলে আসে মধু! অথচ ছোট্ট এই পতঙ্গটি বিশ্বসংসার তথা মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত যে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে মধু তার কাছে নস্যি! একটু ব্যাখ্যা করা যাক।

পৃথিবী নামক এই গ্রহে ৮৭% ফসলই পতঙ্গ পরাগী। আর এই ৮৭% এর মধ্যে ৮০% ফসলের পরাগায়ন সংঘটিত হয় মৌমাছি দ্বারা।

পরাগায়ন হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে উদ্ভিদ তার বংশ বিস্তার করে। এই প্রক্রিয়ায় ফুলের পরাগরেণু পরাগধানী থেকে স্থানান্তরিত হয়ে গর্ভমুণ্ডে পড়ে। পরাগরেণুর নিজস্ব কোনো চলনশক্তি নেই, তাই চলাচলের জন্যে তার প্রয়োজন হয় বিভিন্ন বাহকের, যেমন: বাতাস, পানি, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ। অন্যান্য কীটপতঙ্গের তুলনায় মৌমাছি অধিক প্রজাতির এবং সংখ্যায় অনেক বেশি ফুলে বিচরণ করে।

সে কারণে মৌমাছি কর্তৃক সংঘটিত পরাগায়ন বিভিন্ন দিক থেকে বহুমাত্রিক, ব্যাপক ও অধিক কার্যকরী। পরাগায়ন প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ধাপে ফুল থেকে ফল (বীজ) হয় যা দিয়ে উদ্ভিদ তার বংশ রক্ষা করে। এ কথাতো বলাই বাহুল্য যে, উদ্ভিদ যদি তার বংশ বিস্তার করতে না পারে তা হলে প্রিয় এই পৃথিবীর অস্তিত্ব হবে বিপন্ন। (সূত্র: ইন্টারনেট)

বিশ্বের মোট খাদ্য উৎপাদনের প্রায় ৩০% সরাসরি নির্ভর করে মৌমাছির উপরে যার অার্থিক মূল্য আনুমানিক ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মৌমাছি কর্তৃক উৎপাদিত মধু এবং মোমের মূল্যের তুলনায়, তাদের দ্বারা সংঘটিত পরাগায়নের কারণে উৎপাদিত বাড়তি ফসলের মূল্য প্রায় ১৫ গুণ বেশি!

পৃথিবীর অনেক দেশে ফসলের উৎপাদন এবং একইসঙ্গে তার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৌমাছির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। পরাগায়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য কৃষি জমির পাশে সাময়িক সময়ের জন্যে 'মৌ কলোনি' স্থাপন করা হয়। এতে একদিকে যেমন ফলন বৃদ্ধি পায়, সেই সঙ্গে অধিক পরিমাণে মধুও উৎপাদিত হয়। যেটি কৃষকের জন্য বাড়তি আয়ের উৎস।

তেলবীজ জাতীয় ফসল, যেমন: সরিষা, সূর্যমুখী, তিল ইত্যাদির বেলায় মৌমাছি মূখ্য পরাগায়নকারীর ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় প্রমাণিত: সরিষা ক্ষেতে যেখানে মৌমাছির অবাধ বিচরণ সেসব ক্ষেত্রে দানা ভালো হয়। পক্ষান্তরে সূর্যমুখীর বেলায় দেখা গেছে মৌমাছির কারণে বীজের উৎপাদন, ওজন, বীজের প্রাণশক্তি এবং তেলের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। তিল চাষেও একই ধরনের ফলাফল পরিলক্ষিত হয়।

বিভিন্ন ধরণের ফল যেমন: আম, লিচু, আপেল, নাশপাতি ইত্যাদি ফলের গঠন, গুণগত মান এবং ফলনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে মৌমাছি। বাদাম জাতীয় ফসল, বিভিন্ন ধরনের সবজি যেমন লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া ,শসা, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, পটল, কাঁকরোল, ধুন্দুলের প্রধান পরাগায়নকারী হল মৌমাছি। এরকম আরও বহু ফসল যেমন লেবু, তরমুজ, বাঙ্গি কিংবা বিভিন্ন ধরনের ডাল এমনকি তুলার মতো অৰ্থকরী ফসল উৎপাদনে মৌমাছির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

পরাগায়নের পাশাপাশি মৌমাছির আরেকটি অবদান মধু। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মধু চাষ হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৬ সালে যে পরিমাণ মধু রপ্তানি হয়েছে তার বাজার মূল্য প্রায় ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। খাদ্য হিসেবে মধু বিশ্বব্যাপী ভীষণ জনপ্রিয়। গত পাঁচ বছরে গড়ে মধু রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৭% হারে। মধু রপ্তানির শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারক দেশ:

১. চীন – ২৭৭ মিলিয়ন ডলার (বিশ্বের মোট রপ্তানির ১২.৩%)
২. নিউজিল্যান্ড – ২০৭ মিলিয়ন (৯.২%)
৩. আর্জেন্টিনা – ১৬৯ মিলিয়ন (৭.৫%)
৪. জার্মানি – ১৪৫ মিলিয়ন (৬.৫%)
৫. সিয়েরা লিওন – ১৪২ মিলিয়ন (৬.৪%)

এশিয়া মহাদেশে ভিয়েতনাম মধু রপ্তানিতে শীর্ষে। ২০১৬ সালে তাদের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত গত বছর মধু রপ্তানি করে আয় করে ৭১ মিলিয়ন ডলার।

মধু চাষে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। দেশে যে পরিমাণ জমিতে সরিষা, লিচু, আম, তিল ইত্যাদি ফসলের আবাদ হয় তার মাত্র ১০% জমিতে মৌ চাষ হয়। শতভাগ জমি যদি মৌ চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন যেমন উল্লেখজনকভাবে বৃদ্ধি পাবে, মধু উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ব্যাপকভাবে। দেশে এখন প্রায় দুই লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মধু চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে সংশ্লিষ্ট। মধু উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৫,০০০ টন। দেশীয় বাজারে সরবরাহের পাশাপাশি বাংলাদেশ এখন ভারত, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাত ইত্যাদি দেশে মধু রপ্তানি করছে। গত অর্থ বছরে মধু রপ্তানি করে ৫০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

শঙ্কার বিষয়: অত্যন্ত উপকারী এই পতঙ্গটির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ শিল্পায়ন, নগরায়ন ইত্যাদি। বিভিন্ন কারণে ব্যাপকভাবে উজাড় হচ্ছে বনভূমি, ফলে মৌমাছি হারাচ্ছে বাসস্থান। গ্রীস্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে মধু আহরণের জন্যে মৌচাকগুলো থেকে মৌমাছিকে বিতাড়িত করার কারণে অনেক মৌমাছির মৃত্যু ঘটে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তরের সহযোগীতায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, বিগত নয় বছরে ১২% মৌমাছি হারিয়েছে তাদের বাসস্থান।

বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী অন্যান্য যেসব কারণে মৌমাছির সংখ্যা লোপ পাচ্ছে সেগুলো হল:

– মাইটস বা মাকড় জাতীয় একধরনের পরজীবীর আক্রমণ;
– ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা ভাইরাসজনিত বিভিন্ন রোগ;
– মোবাইল টাওয়ার থেকে নির্গত ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন;
– নিম্নমানের কীটনাশকের অসতর্ক ব্যবহার;
– যানবাহন ও বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত বাতাস এবং
– মৌচাষিদের সচেতনতার অভাব।

উপকারী এই পতঙ্গটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে দরকার আমাদের সচেতনতা। অচিরেই যদি আমরা এ ব্যাপারে সচেতন না হই তাহলে বিপন্ন হবে আমাদের অস্তিত্বও। মৌমাছি অবাধে বিচরণ করুক ফুলে, বাধাহীনভাবে উদ্ভিদ বিস্তার করুক তার বংশ, প্রিয় এই পৃথিবী হোক আরও সবুজ, আরও বাসযোগ্য।