ধর্ষণ বন্ধে শরিয়া আইন?

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 29 May 2017, 04:40 AM
Updated : 29 May 2017, 04:40 AM

বাংলাদেশ এখন ধর্ষকের অভয়ারণ্য! ক্রমাগত বিচারহীনতা ও শাস্তিহীনতাই এর জন্য দায়ী। মারাত্মকভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়েছেন আমাদের মা-বোনেরা। একশ্রেণির অর্থলোভী পুলিশ ও শক্তিশালী ধর্ষকদের দাপটে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশ। ধর্ষকের বিচার না পেয়ে ধর্ষিতার বাবা মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছেন। সরকারের এই ব্যর্থতা ক্ষমাহীন। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে নারী ও সুশীল সমাজ, তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে জাতি। এই ফাঁকে আবারও উঠে এসেছে সেই পুরনো দাবি:

"একবার আল্লাহর আইন শরিয়া প্রয়োগ করে দেখুন, দেশ থেকে ধর্ষণ উঠে যাবে।"

তা-ই? হতেও পারে! 'আল্লাহর আইন' বলে কথা! তাহলে দলিলপত্র একটু ঘেঁটেই দেখা যাক–

ক্রুদ্ধ নিরুপায় জাতি শরিয়ার পথ নিলে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। সেজন্য এ ব্যাপারে জাতিকে শিক্ষিত করা দরকার। যারা ওই চিন্তা করছেন তারা ধর্ষণ সম্পর্কিত শরিয়া আইনগুলো পড়ে দেখেছেন মনে হয় না! মিলিয়ে দেখার সুবিধার জন্য আমি বিশেষ করে বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন' ও মওলানা মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত কোরান থেকে দেখাচ্ছি। দরকার হলে শরিয়া কিতাবের পৃষ্ঠার ফটোকপি দেওয়া যেতে পারে।

• "বলপ্রয়োগকারী জেনার শাস্তি ভোগ করিবে যদি বলপ্রয়োগ প্রমাণিত হয়।"

– 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন', ১ম খণ্ড, ধারা ১৩৪খ।

চমৎকার আইন, ন্যায্যও বটে। কিন্তু গেঁড়ো বেঁধে যায় "বলপ্রয়োগ প্রমাণিত হয়" এখানে এসে। কারণ, শরিয়া আইনে ধর্ষণের প্রমাণ হল চারজন পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষী, সেখানে নারী সাক্ষী বা ডিএনএ পরীক্ষা গ্রহণযোগ্য নয়। সেজন্যই ১৫-২০ বছর আগে লাহোর হাইকোর্ট এক পরকীয়া মামলার রায়ে বলেছে, শরিয়ার "বিশেষ" অনুষঙ্গ আছে যেখানে ডিএনএ পরীক্ষা গ্রহণযোগ্য নয়।

কোরানে জেনার উল্লেখ ও শাস্তি রয়েছে কিন্তু আলাদা করে ধর্ষণের উল্লেখ নেই। এদিকে শরিয়া আইনে ধর্ষণকে ধরা হয়েছে জেনার আওতায়। উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

"কোনো পুরুষ বা নারী বলপ্রয়োগ করিয়া পর্যায়ক্রমে কোনো নারী বা পুরুষের সহিত সঙ্গম করিলে তাহা জেনা হিসেবে গণ্য হইবে।"

– 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন', ১ম খণ্ড, ধারা ১৩৪।

অর্থাৎ ধর্ষণের ও জেনার প্রমাণ একই। সেজন্যই আইন বানানো হয়েছে:

"বলপ্রয়োগকারী জেনার শাস্তি ভোগ করিবে যদি বলপ্রয়োগ প্রমাণিত হয়।"

এখন তাহলে দেখা যাক শরিয়া আইনে জেনার প্রমাণ কী। বলা দরকার, শরিয়া আইনে হুদুদ মামলায় পারিপার্শ্বিক বা পরোক্ষ প্রমাণ গ্রহণযোগ্য নয়। উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

"হুদুদ মামলায় পারিপার্শ্বিক প্রমাণ চলিবে না।" (চাক্ষুষ সাক্ষী থাকতে হবে)

– 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন', ২য় খণ্ড, ধারা ৬০০।

• চুরি-ডাকাতি-মদ্যপান-খুন-জখম-মানহানি-জেনা (এগুলো হুদুদ মামলা) প্রমাণ চারজন পুরুষ সাক্ষী, নারী সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।

– 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন', ১ম খণ্ড ধারা ১৩৩; শফি আইন 0.13.1, 0.24.9; মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত বাংলা কোরান – পৃষ্ঠা ২৩৯ আর ৯২৮; 'দ্য পেনাল ল অব ইসলাম', পৃষ্ঠা ৪৪; হানাফি আইন হেদায়া, পৃষ্ঠা ৩৫৩; শফি আইন o.24.9; 'ক্রিমিন্যাল ল ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড', পৃষ্ঠা ২৫১।

এ আইন ইসলামবিরোধী এটা শরিয়াবিদরাও বোঝেন। তাই আইনটাকে একটু মেরামত করার চেষ্টা হয়েছে। যেমন: ১১ শতাব্দীতে স্পেনের ইমাম ইবনে হাজম প্রস্তাব করেছিলেন, জেনা প্রমাণের ক্ষেত্রে চারজন ন্যায়পরায়ণ মুসলমান পুরুষ সাক্ষী অথবা প্রতিজন পুরুষের পরিবর্তে দুজন মুসলিম ন্যায়পরায়ণ মহিলা হলেও চলবে।

– 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন', ৩য় খণ্ড, ৮৮৮ পৃষ্ঠা।

অর্থাৎ সাতজন মেয়ের সামনে যদি জেনা বা ধর্ষণ হয় তবে অপরাধীরা সবার সামনে অট্টহাসি হাসতে হাসতে পগার পার হয়ে যাবে। আর "ন্যায়পরায়ণ মহিলা" কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী, তা নিয়ে উকিলের তর্কবিতর্কের শেষ হবে না। তাছাড়া ইমাম হজমের প্রস্তাবটা কেউ পাত্তা দেয়নি, 'হানাফি'-'শফি'-'পেনাল ল অফ ইসলাম'-'ক্রিমিন্যাল ল ইন ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্লড' ইত্যাদি কেতাবে নারী সাক্ষী নিষিদ্ধই রয়ে গেছে। এর সঙ্গে মিলিয়ে নিন–

• "পরকীয়া এবং ধর্ষণের প্রমাণ অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি অথবা চারজন বয়স্ক পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য।"

– পাকিস্তানের হুদুদ আইন, নং ৭-১৯৭৯, সংশোধনী ২০, ৮ এর খ – ১৯৮০।

২০০৬ সালে সংসদে এ আইন বাতিলের প্রস্তাব উঠলে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ক্ষিপ্ত হয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন ও সংসদ থেকে পদত্যাগের হুমকি দিয়ে বলেছে:

"শরিয়া মোতাবেক এই আইনই সঠিক, এর কোনোরকম পরিবর্তন কোরান ও শরিয়ার খেলাফ। এ পরিবর্তন দেশকে অবাধ যৌনতার স্বর্গ বানাবে।" এই হল ইসলামি নেতৃত্বের বিবেক ও বোধ।

• "হুদুদ মামলায় নারী বিচারক অবৈধ।"

– 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন', ২য় খণ্ড, ধারা ৫৫৪।

• "জেনা ও ধর্ষণ সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ না হইলে জেনাকারীর শাস্তি হইবে না যদি সে অস্বীকার করে।"

– 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন', প্রথম খণ্ড, ৩০১ পৃষ্ঠা।

• "কোনো কারণে শাস্তি মওকুফ হইলে ধর্ষক ধর্ষিতাকে মোহরের সমান টাকা দিবে।"

– 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন', ১ম খণ্ড, ৩০১ পৃষ্ঠা, শফি আইন এম ৮-এর ১০।

• "চাক্ষুষ সাক্ষ্য না থাকলে শুধু আলামতের ভিত্তিতে খুনি-ডাকাতের শাস্তি হবে না।"

– 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন', ধারা ৬০০-এর বিশ্লেষণ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯২।

কী হবে যদি কোনো বোবা পুরুষ বা গায়িকা কিংবা সমাজের নিচু ব্যক্তির সামনে ধর্ষণ হয়? সে ব্যাপারেও শরিয়া আইন খুবই পরিষ্কার। উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

• "বোবার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।"

– 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন', ১ম খণ্ড, ধারা ১৪৯।

• "দাস-দাসী, গায়িকা এবং সমাজের নিচু ব্যক্তির (রাস্তা পরিষ্কারকারী বা শৌচাগারের প্রহরী ইত্যাদি) সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।"

– 'বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন', ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৩; হানাফি আইন পৃষ্ঠা ৩৬১; শফি আইন o.24.3; 'পেনাল ল অব ইসলাম', পৃষ্ঠা ৪৬।

অর্থাৎ আমরা পেলাম এসব মামলায় নারীর বিচারক নিষিদ্ধ এবং নারী, গায়িকা, বোবা (পুরুষ হলেও), ও সমাজের নিচু ব্যক্তির (পুরুষ হলেও) চোখের সামনে পরকীয়া বা ধর্ষণ হলে তথাকথিত "আল্লাহর আইনে" তাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। আমি জানি এসব "আল্লাহর আইন" অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। সুযোগ থাকলে এখানে পৃষ্ঠাগুলো পেস্ট করে দিতাম। আবারও অনুরোধ করছি শরিয়া আইন সমর্থন করার আগে আইনগুলো নিজে দেখে নেবেন।

এবারে বাস্তবে মুসলিম নারীর ওপরে এই আইনের প্রভাব দেখি চলুন। ধর্ষিতা আদালতে ধর্ষণের চারজন পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষী বা আটজন নারী সাক্ষী উপস্থিত করতে পারবেন, এটা কি সম্ভব? এই অবাস্তব আইন মুসলিম নারীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস নয়? এমন অবস্থায় হতভাগিনী ধর্ষিতা আরেকটা হুদুদ শরিয়া আইনে অপরাধী হয়ে পড়ে, সেটা হল মানহানির মামলা। অর্থাৎ চারজন পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষী আনতে পারেননি বলে ধর্ষণ প্রমাণ হয়নি, তাই ধর্ষণের অভিযোগ করে ধর্ষিতা ধর্ষকের সম্মানহানি করেছেন। তাই ধর্ষিতাকে শাস্তি পেতে হয়।

কল্পনা নয়, এটা বহুবার ঘটেছে, হাজার হাজার ধর্ষিতা শরিয়া কোর্টে ন্যায়বিচার চেয়ে শাস্তি পেয়েছে। ওই হতভাগিনীদের জায়গায় নিজের মা বা বোন বা কন্যাকে ভেবে দেখুন ইসলামের নামে ধর্ষিতারা কী দোজখে জ্বলছে!

• সবচেয়ে মর্মান্তিক শাস্তি পেয়েছে ১৩ বছরের গণধর্ষিতা অভাগিনী আয়েশা দুহুলো। ওকে আমি শরিয়ার ওপরে বানানো আমার 'নারী' মুভিটা উৎসর্গ করেছি। সোমালিয়ার ১৩ বছরের ওই বাচ্চাটাকে কয়েকজন পুরুষ গণধর্ষণ করেছিল, ওর বাবা সুবিচারের আশায় মেয়েকে শরিয়া কোর্টে নিয়ে গিয়েছিলেন। শরিয়া কোর্ট আয়েশাকে পাথরের আঘাতে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং সেটা কার্যকর হয় ২৭ অক্টোবর ২০০৮ সালে, সোমালিয়ায়। জাতিসংঘের তখনকার সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন তীব্রভাবে এর নিন্দা করেছিলেন।

• নাইজিরিয়ায় ১২ বছরের ধর্ষিতা বরিরা শাস্তি পেয়েছে।

• বাংলাদেশেও অবৈধ ফতোয়ার আদালতে এ ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার।

• এই আইনের পাল্লায় পড়ে পাকিস্তানে হাজারো মা-বোন ১০-১৫ বছর ধরে জেলখানায় বন্দি ছিলেন। কারণ তাঁরা ধর্ষণের চারজন চাক্ষুষ সাক্ষী আদালতে হাজির করতে পারেননি। পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামির প্রবল প্রতিরোধের জন্য সংসদে আপ্রাণ চেষ্টার পরেও ১৯৭৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এ আইন বাতিল করা যায়নি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে পরের দিকে ধর্ষিতারা থানায় অভিযোগ করতেন না, কারণ সেখানে পুলিশেরা তাদের বন্দি করে আবার গণধর্ষণ করত। দীর্ঘ ২৬ বছরে এ আইনে বলি হয়েছেন হাজার হাজার ধর্ষিতা।

• কল্যাণপুরে মাকে বেঁধে কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের একমাত্র সাক্ষী হল মেয়ের মা, ধর্ষক হল স্থানীয় তিন ব্যক্তি।

('দ্য ডেইলি স্টার', ৭ জুলাই ২০০৩)

এই মামলা যদি শরিয়া কোর্টে ওঠে তবে শরিয়ার আইন অনুযায়ী এক নারীর সাক্ষ্যে ধর্ষকদের শাস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। অথচ–

রাসুল (সা.) শুধুমাত্র নারীর একক সাক্ষ্যে ডাকাতের (জেনার মতো ডাকাতিও হুদুদ মামলার অন্তর্ভুক্ত)মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন এবং তা কার্যকরও করেছেন।

– 'সহি বুখারি', ৭ম খণ্ড হাদিস ২১৬হ; 'সহি ইবনে মাজাহ', ৪র্থ খণ্ড হাদিস ২৬৬৬; 'সহি তিরমিজি', ১৩৯৯।

রাসুলের (সা.) সে নির্দেশ পায়ে দলেছে কেন শরিয়া আইন?

এসব ইসলামবিরোধী আইন প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ওই আল্লাহ-রাসুলের (সা.) নামেই। এ জন্যই বুঝি নবীজি (সা.) উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছেন:

"আমার অনুসারীদের জন্য আমার সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা পথভ্রষ্টকারী ইমামগণ নিয়ে।"

– 'সহি ইবনে মাজাহ', ৫ম খণ্ড, হাদিস ৩৯৫২।

এসব কারণে কোটি কোটি মুসলিম এবং বহু ইসলামি বিশেষজ্ঞ শরিয়া আইনের কঠিন বিরোধিতা করেন। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শরিয়া সমর্থক ও বিশেষজ্ঞ ড. হাশিম কামালি ব্যাকুল হয়ে বলেছেন:

"শরিয়াকে এ যুগে চালাইতে হইলে অবশ্যই যে প্রচণ্ড ঘষামাজা করিতে হইবে সে ব্যাপারে আমি সবাইকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি… সেই যুগে যে উদ্দেশ্যে শরিয়ার উসুল বানানো হইয়াছিল অনেক কারণেই এখন উহা সেই উদ্দেশ্য অর্জন করিতে সক্ষম নহে… শরিয়ার উসুল নিজের পদ্ধতি ও তত্ত্বের ভেতর সমাজের স্থান-কালের ব্যাপার ঠিকমতো অন্তর্ভুক্ত করে নাই।"

– 'প্রিন্সিপালস অব ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স', ড. হাশিম কামালি, পৃষ্ঠা ১৩, ৫০০, ৫০৪।

আরও বলতে হবে? যারা শরিয়া আইনকে সমর্থন করেন তাদের অনুরোধ করি, আইনগুলো একটু পড়ে দেখবেন। ইসলামে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে কোনো দালালের জায়গা নেই। রোজ হাসরে আপনার জবাব শুধুমাত্র আপনাকেই দিতে হবে।