হায় শ্যামল কান্তি! ধিক্‌ রাজনীতি!

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 26 May 2017, 04:40 AM
Updated : 26 May 2017, 04:40 AM

শ্যামল কান্তিকে নিয়ে লেখার কি আদৌ কোনো কারণ আছে? তিনি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে যেদিন জেলে গেলেন, তার আগের দিন জামিন পেলেন সেলিম ওসমান। ঘটনাটা এমন: এক আসবে তো, আরেক যাবে! যে কথাটা বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই, কান ধরার ঘটনাটা না ঘটলে কি এই ঘুষ নেওয়ার কাহিনি বা বাস্তবতা সামনে আসত?

একটা বিষয় পরিষ্কার: চাইলে যে কেউ যে কাউকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে! আর আইনও এখন 'আন্ধা কানুন'। অথচ যখন এই ঘটনা সামাজিক মিডিয়ায় তোলপাড় করছে দেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও অ্যাটর্নি জেনারেলের বচসায় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, দেশের মানুষ নাকি বিচার ও আইনের প্রতি গভীরভাবে আস্থাশীল।

সময় সবকিছু বদলে দেয়। রাজনীতি তার বাইরে কিছু নয়। একসময় আওয়ামী লীগ ছিল এ দেশের সংখ্যালঘু নামে পরিচিত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও ভরসার দল। মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিরোধী দলে থাকা পর্যন্ত নৌকার একতরফা ভোটার নামে পরিচিত এই হিন্দুরা ছিল জাতীয়তাবাদী রাজনীতির চরম দুশমন। যতবার তারা নৌকাকে পরাজিত করে দেশের গদিতে এসেছিল ততবার এদের কপালে জুটেছিল চরম নির্যাতন ও লাঞ্ছনা। এমন সময়ও গেছে যখন মা-বোনদের ইজ্জত, জমিজমা হারিয়ে ভারতে পালিয়ে বেঁচেছিল তারা। মনে করা হত আওয়ামী লীগ দেশশাসনে আসলে এমন পরিবেশ থাকবে না। মোটামুটি শান্তি ও সম্প্রীতির ভেতর বসবাস করতে পারবে তারা। কিন্তু ওই যে বললাম– সময়, তার হাত ধরে আরও অনেককিছুর মতো রাজনীতিও বদলে গেছে।

আসলে দেশের আনাচে-কানাচে এখন 'সাম্প্রদায়িকতা'। মানুষের পোশাক-খাবার-আচরণ কোথাও এর ব্যতিক্রম দেখি না। আওয়ামী লীগের নেতারা নিশ্চয়ই চোখে ঠুলি লাগিয়ে ঘোরেন না। তারা স্পষ্ট দেখতে পান, এ দেশে এখন মুখে সম্প্রীতির কথা বললেও করতে হবে সংখ্যাগুরু তোষণের রাজনীতি।

জামায়াত দৃশ্যপট থেকে সরে গেলেও ধর্মের রাজনীতি কি আসলেই মুছে গেছে? এই যে হেফাজত, এ তো তারই আরেক সংস্করণ। জামায়াত ও বিএনপিকে আলাদা করার জন্য মরিয়া আওয়ামী লীগের কাছে হেফাজতও ইস্যু। তারা ভালো জানে, এদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের ঐক্য হতেই পারে। আর তা হলে নির্বাচনে শিকে ছেঁড়ার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। মূলত এই আবর্তে রাজনীতি হিতাহিত ভুলে মেতে উঠেছে মারাত্মক আত্মঘাতী খেলায়।

সেলিম ওসমান সরাসরি লীগের রাজনীতি করেন না বটে, তিনি তাদের শরিক জাতীয় পার্টির এমপি। নারায়ণগঞ্জে এই পরিবারের অতীত যত বর্ণাঢ্য আর উজ্জ্বল হোক না কেন, এখন তারা নানা ধরনের অপবাদের মুখে। শামীম ওসমান থেকে সেলিম ওসমান কেউই এর বাইরে নেই। সেলিম ওসমানের 'মাতবরি' এমন একপর্যায়ে যা সরকারি দলতো বটেই, আইন-বিচারও এখন হুমকির মুখে!

শ্যামল কান্তি একজন স্কুল শিক্ষক। এমন শিক্ষক দেশে ভূরি ভূরি। কই তাদের নিয়ে তো এমন দেশ মাথায় তোলার ঘটনা ঘটে না। আসল রহস্য বা ঘটনার মূলে যায় না কেউই।

সবাই জানে কেন কী ঘটেছিল। সমাজে সব পাপ, সব অপরাধ চুরি-ডাকাতি-খুন-রাহাজানি জায়েজ হলেও ধর্মের নামে একটা কথা এমনকি একটা শব্দও মাটিতে পড়তে পারে না। সেটা আসলে সত্য না, মিথ্যা– কেউ বিচার করে না। তার আগেই 'মুণ্ডু চাই', 'ফাঁসি চাই' বা গণধোলাইয়ের নীতি চালু হয়ে গেছে।

শ্যামল কান্তি কান ধরে সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন বটে, সেলিম ওসমান তার অপমান ভোলেননি। অপমান সরকার বা রাজনীতি করেনি, করেছিল জনগণ। তারা সামাজিক মিডিয়ায় এমন দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে যে সেলিম ওসমানকে হার মেনে পিছু হঠতে হয়। সাময়িকভাবে রাজনীতিও তা মেনে নেয়। কিন্তু আমরা জানতাম এটাই শেষ কথা না; এটা শেষ হতে পারে না।

তার জের এখন পোহাতে হচ্ছে শ্যামল কান্তিকে। ইনি ভুলে গেছেন, এ দেশে মুখে যতই এক আইন এক বিচারের কথা হোক না কেন, বাস্তবে তার প্রয়োগ সম্প্রদায় বা মানুষ ভেদে একেক ধরনের। গরিব মুসলমান, উদার সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু নামে পরিচিতদের বেলায় সরকার অন্ধ! আইন চোখে কম দেখে! বিচার কান বন্ধ করে চোখ মুদে ঘুমায়! তা-ই যদি না হবে তো ঘুষ দেওয়ার অপরাধটা বিবেচনায় আনা হল না কেন? ঘুষ যদি অপরাধই হয় তো যিনি দেন তিনি কি নিরাপরাধ? ধরলাম, বাধ্য হয়ে দিতে হয়েছিল, তাই বলে এটাও মানতে হবে স্কুল বন্ধের দিন এমন ঘটনা ঘটে?

শ্যামল কান্তি ভুলে গিয়েছিলেন আমাদের বদলে যাওয়া সমাজে মানুষ আর মানুষ নেই! বাঙালি কাগজে-কলমে লেখা একটা নাম হলেও আসলে আমরা হয় হিন্দু, নয় মুসলমান। আমাদের অন্য পরিচয়গুলো এখন অবলুপ্তির পথে। এই সমাজে উন্নয়ন আর ডিজিটালের ঢাক পিটিয়ে রাজনীতি নিজের পাতে ঝোল টানলেও মানুষ কিন্তু জানে– ভেতরে আসলে ফাঁকা।

এই আমলেও কাউকে নিরুদ্দেশী হতে হয়। পালাতে হয়, দেশ ছেড়ে। শ্যামল কান্তি মুক্তিযুদ্ধের দেশে এখন আসলেই অচেনা কেউ। জনগণের বিরাট অংশ তাদের সঙ্গে থাকলেও যে যখন গদিতে এরা তাদের হাতের 'গিনিপিগ'। আমি বিষয়টা এমনভাবে দেখি, 'শ্যামল কান্তি'র নাম 'নূরুল ইসলাম' হলেও বিষয়টা এমনই হত।

কবে এসব নাটকের অবসান হবে? আমরা কি একবারও ভাবছি সমাজ আসলে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? কোথায় নেমে গেছে মানবতা? যে সমাজে একজন শিক্ষক ছিলেন মাথার মুকুটের মতো, যারা আমাদের পরিবার, সমাজ ও দেশকে আলোকিত করতেন, তাদের নিয়ে এমন ছেলেখেলা, এমন নোংরামির পরিণাম কী হবে, কেউ কি ভাবছেন একবারও?

সমাজ প্রায় নষ্টের শেষপ্রান্তে। চারদিকে শুধু খারাপ খবরের ছড়াছড়ি। এরপরও শ্যামল কান্তিকে নিয়ে এসব ঘটনায় লীগের সরকার ও তার ইমেজ কোথায় যাচ্ছে ভাবার মতো সময় আছে তাদের? নারায়ণগঞ্জ একটি শহর, একটি জায়গা হতে পারে তবে তার প্রভাব পুরো দেশকে নাড়িয়ে তুলছে। সেটা বিদেশে বসেও টের পাই আমরা। দুর্ভাগ্য সরকারি দলের লোকেরা তা দেখতে পান না।

অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? সেই প্রলয়ের নাম কি 'শ্যামল কান্তি' বা ঘটে যাওয়া সব অপঘটনা? এর জবাব সময়ই দেবে হয়তো একদিন।