বীরেরা ফিরে আসেন

মামুন আল মাহতাব
Published : 24 May 2017, 04:15 PM
Updated : 24 May 2017, 04:15 PM

'বিদায়-বিধুর'– কবে কোথায় যেন শুনেছি, লিখতে বসে কানে বাজছে বারবার। বিদায় বরাবরই বেদনা-বিধুর, হোক তা সাময়িক কিংবা দীর্ঘতর। বিমানবন্দরে গেলেই চোখে পরে কাঁদছেন প্রবাসী শ্রমজীবীর মা, ছেলে হয়তো ফিরবে না পাঁচ-ছয় বছরেও; কাঁদছেন কানাডায় ইমিগ্রেশনধারীদের পরিবারও,  দেখা আবার হবে কবে? এমনকি সাত দিনের জন্য কনফারেন্সে যাচ্ছেন যে তরুণ প্রকৌশলী বা চিকিৎসক, কাঁদছেন তার নববিবাহিতা স্ত্রীও। 'বিদায়' বোধ করি এমনই।

আর সেই বিদায় যদি হয় একেবারেই অপ্রত্যাশিত, আকস্মিক; ভাবুন তাহলে একবার। যে নেতার হওয়ার কথা রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী তার সহসা গন্তব্য যদি হয় হাজার মাইল দূরের কোনো কুখ্যাত কারাগার আর পরিণতিও হয় অনিশ্চিত, কতই না বেদনায় নীল সেই বিদায়!

মাত্র কয়েক বছর পরের কথা, ঘাতকের বুলেটে বিদীর্ণ জাতির পিতার বুক, ক্ষত-বিক্ষত তাঁর পরিবার আর সেই সঙ্গে জাতির বিবেক। আর তারপর? আবারও বিদায়– বড়ই বিধুর। গিয়েছিলেন ইউরোপে পিএইচডি গবেষণারত স্বামীর সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটাতে, সঙ্গে আদরের ছোট বোন। সেই কয়েকটা দিন শেষ হল অনেক কয়েকটা বছরে।

জাতির জনকের কন্যা, অথচ হঠাৎই কেউ নন তিনি। আর তাঁকে এই 'কেউ নন' বানানোর ষড়যন্ত্রে উন্মত্ত পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র। আর সে রাষ্ট্রযন্ত্র শুধু দেশেরই নয়, সঙ্গে আছে ভিনদেশিরাও। ভাবা যায়? কতই না নীল সে বিদায়ের বেদনা!

বেদনায় বিধুর বিদায় আবারও। গতবার ছিল রাষ্ট্রনায়কের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে, আর কয়েক বছরের ব্যবধানে এবার সাবেক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। প্রথমে একাকী জেলযাত্রা আর তারপর বিদায়। প্রেক্ষাপটটাও ভিন্ন। গতবারের বিদায় ঘটনা প্রবাহে হঠাৎ সংগঠন, আর এবার 'মাইনাস ফর্মুলা' বাস্তবায়নের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে।

বীরেরা ফিরে আসেন। ফিরে আসেন রাজনীতিবিদরাও। বিদায়ের পর ফিরে আসা মধুরও বটে। কিন্তু সে ফিরে আসা সবসময় মধুর নয়, বিশেষকরে রাজনীতিবিদদের বেলায় এটি আরও বেশি সত্য। এইচএসসিতে ইংরেজি সাহিত্যে 'দ্য প্যাট্রিয়ট' কবিতায় জেনেছি বীরের অসম্মানজনক ফিরে আসার গাথা। সেই ফিরে আসা মোটেও মধুর নয়, বরং তা বিদায়ের বেদনার চেয়েও অনেক বেশি নীল, অনেক বেশি বেদনা-বিধুর। ইতিহাসের পাতায় পাতায় বিধৃত এমন অনেক উদাহরণ।

আর যারা ফিরে আসেন এবং টিকেও যান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ফিরে আসা পরবর্তী উপাখ্যান পূর্ববর্তীর তুলনায় অনেক বেশি ম্রিয়মান। আর অস্বাভাবিকও নয় এটি মোটেও। কারণ প্রকৃতি শূন্যস্থান পূরণ করে। পাশাপাশি বেদনায় নীল যে কোনো প্রস্থানই বৈরী শক্তির জন্য খুলে দেয় খালি মাঠ। একারণেই ফিরে আসা গৌরবের নয় অনেকের বেলাতেই। ব্যতিক্রমও আছে, তবে তা হাতেগোনা। ব্যতিক্রমী বাংলাদেশে কেন যেন এই ব্যতিক্রমের উদাহরণ বেশি। আর তা-ও আবার একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই। এটি সেই পরিবার, এ দেশ যাদের অবদান, এ জাতি যাদের কাছে কৃতজ্ঞতাবনত।

এই পরিবারে প্রধান একদিন এই জাতিকে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন, সামনে থেকেছেন জাতির প্রত্যাশা পূরণের প্রতিটি ধাপে। নেতা থেকে হয়েছেন জাতির পিতা। পাকিস্তানি জান্তার চোখরাঙানি আর নির্বিচার নির্যাতনকে শাসিয়েছেন উদ্ধত তর্জনীতে। কিছুই তাঁকে 'দাবায়ে রাখতে' পারেনি। না আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, না একযুগেরও বেশি কারাবাস, না ফাঁসির দড়ি– কোনো কিছুই না।

১৯৭১এর ২৬ মার্চ এ দেশ থেকে তাঁর বেদনা-বিধুর বিদায়। বিজয়ীর বেশে তার দেশে ফেরা ১৯৭২এর ১০ জানুয়ারি। যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে জাতির পিতা হিসেবে সামনে থেকে দিয়েছেন সফল নেতৃত্ব। দেশ যখন হাটি হাটি পা পা করে এগোচ্ছে, তখনই পাকিস্তানি বাংলাদেশিদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লণ্ডভণ্ড সবকিছু। দেশে আবার অমানিশা আঁধারের আর পরিণতিতে বেদনায় বিধুর বিদায় তাঁর জীবিত দুই সন্তানের।

মাঝে বেশ কয়েকটি বছর। ফিরে এলেন তিনি। সিক্ত হলেন লাখো জনতার ভালোবাসায়। শুরু হল তাঁর সংগ্রামী জীবনের আরেক অধ্যায়ের। নিজ হাতে একাকী সাফ করেছেন প্রিয় পিত্রালয়ের রক্তাক্ত, ধুলায় ধূসরিত অঙ্গন। আর দীর্ঘ লড়াই করে সামরিক শাসককে পরাজিত করে ফিরিয়ে এনেছেন বেসামরিক শাসন। চেয়েছিলেন ফিরিয়ে দিতে গণতন্ত্র; পারেননি– নব্বইয়ে সামরিক জান্তা হেরে গেলেও, জিতেছে 'পাকিস্তানি-বাংলাদেশিরা'। অন্য লেবাসে আর গণতন্ত্রের ভূয়া আবেশে তাদের লক্ষ ছিল একটাই– 'প্রজেক্ট পাকিস্তান' বাস্তবায়ন। যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে তাই তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে উড়েছে জাতির পতাকা। সঙ্গত কারণেই তিনি এর বিরোধিতায় নেমেছেন। পরিণতি আবারও বিদায়, আবারও বেদনায় নীল জাতির বিবেক।

তিনি জাতির জনকের কন্যা, তাঁকেই বা 'দাবায়ে রাখবে' কে? ফিরে এসেছেন আবারও এবং অবশ্যই বিজয়ীর বেশে। জিতেছেনও দফায় দফায়। তাঁর নেতৃত্ব আজ দেশ-দশের জন্য উদাহরণ। সরব উপস্থিতি তাঁর জি-৮ সামিটে। সাত শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনে সফলকাম পৃথিবীতে দুটি মাত্র দেশের একটি তাঁর নেতৃত্বে, বাংলাদেশ।

চাল-গম-ভুট্টা-মাংস-ডিম-ফল উৎপাদনেও পৃথিবীতে শীর্ষ দশে আমরাই। আমরা যেমন বাংলাদেশ-ভূটান-ইন্ডিয়া কিংবা বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া-নেপাল আঞ্চলিক সহযোগিতায় যেমন আমরা অপরিহার্য, তেমনি আমাদের ছাড়া চলে না 'সিল্ক রোড' সহযোগিতাও। তাঁর সুশাসনে দেশের কোষাগার আজ বৈদেশিক মুদ্রায় ফুলে-ফেঁপে একাকার আর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু এখন অমোঘ বাস্তবতা।

তিনি ক্ষমতায় থাকা মানে জাতির পিতার হত্যাকারীদের আস্ফালনে 'ফুলস্টপ' আর যুদ্ধাপরাধীদের জন্য 'ফাঁসির দড়ি', তিনি ক্ষমতায় থাকা মানে রেইনট্রির কেলেংকারির হোতাদের শত কোটিও তাদের কারাগারের বাইরে থাকার নিশ্চয়তা দেয় না।

গত ১৭ মে ছিল তাঁর ৩৭তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।