আবারও আক্রান্ত চিকিৎসক সমাজ: এর শেষ কোথায়?

আবুল হাসনাৎ মিল্টন
Published : 21 May 2017, 03:49 PM
Updated : 21 May 2017, 03:49 PM

বাংলাদেশে চিকিৎসকরা ক্রমাগত হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন। পত্রিকার পাতায় আজকাল মাঝেমধ্যেই চিকিৎসকদের মারধরের খবর বেরয়। আবার কিছু খবর জানা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। চিকিৎসক নিগ্রহের এই হার ইদানিং উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।

কয়েক দিন আগে বগুড়া মেডিক্যাল কলেজে রোগীর সঙ্গে আগত এক দর্শনার্থী স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এলাকার লোক হওয়ায় আবার ক্ষমতার একটু বাড়তি মহড়াও দেখালেন। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসক নির্যাতনের সমস্যাটা ধীরে ধীরে বাড়লেও সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ নেই। উল্টো চিকিৎসক হয়রানির ষোলকলা পূরণের লক্ষ্যে 'স্বাস্থ্যসেবা আইন ২০১৬' প্রণয়ন প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। শেষমেষ 'বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের' (বিএমএ) হস্তক্ষেপে আপাতত ওই কালো আইনটি ঠেকানো গেছে।

কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এখন পর্যন্ত কোনো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না, বরং কোথাও কোনো সমস্যা হলে এডহক ভিত্তিতে একটা সমাধান করে মূল সমস্যা ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে। আখেরে যা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনছে না।

গত ১৮ জুন গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। ভাঙচুরেই ঘটনা থেমে থাকেনি, দ্রুতগতিতে তা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে এখন মোটামুটি সবাই প্রকৃত ঘটনাটা জানে।

দূর থেকে সংবাদমাধ্যম এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে যতটুকু জানতে পারলাম তাতে মনে হল, এখানে ভুল চিকিৎসা করার কোনো অবকাশই ছিল না। আগের দিন ১৭ জুন সকালে জ্বর, ত্বকে ফুসকুড়ি ও ভ্যাজাইনাল ব্লিডিংয়ের সমস্যা নিয়ে মেয়েটি সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল।

ঢাকায় এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে, স্বভাবতই জ্বর আর ত্বকের ফুসকুড়ি দেখে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসক এটাকে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ বলে ভাবতেই পারেন। পরবর্তীতে নিশ্চিত হওয়ার জন্য রক্তের কিছু পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার ফলাফলে রক্তের শ্বেত কণিকা ও অনুচক্রিকার মাত্রা ভীষণ অস্বাভাবিক দেখে একজন হেমাটোলজিস্টকে জরুরি ভিত্তিতে ডাকা হল।

মেয়েটির শরীরে প্রতি কিউবিক মিটার রক্তে শ্বেত কণিকার পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৭ হাজার, স্বাভাবিকভাবে যা চার থেকে ১১ হাজারের মধ্যে থাকে। রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তাকারী অনুচক্রিকার পরিমাণ প্রতি কিউবিক মিটারে ন্যূনতম যেখানে দেড় লাখ থাকার কথা, সেখানে মেয়েটির রক্তে সেটা কমে মাত্র ১৬ হাজারে নেমে গিয়েছিল। রক্তে ডেঙ্গু-সংক্রান্ত পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ ছিল।

রক্তে আরও কিছুর মাত্রা দেখে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে, মেয়েটি রক্তের এক ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত। হয়তো অসুখটি আগে চিহ্নিত হয়নি এবং রক্তের ক্যানসারের অনেক রোগীই শুরুতে জ্বরের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসে।

তবে হাসপাতালের 'কেস হিস্ট্রি শিট' থেকে জানা যায় যে, গত দু-তিন মাস ধরে মেয়েটির বিভিন্ন হাড়ে খুব ব্যথা হত এবং এই ব্যথা নিরসনে সে প্রায়ই ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করত। রক্তের ক্যানসার ও ধরন নিশ্চিত করার জন্য অস্থিমজ্জার একটি পরীক্ষা করতে হয়, যা সেই মুহূর্তে রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব ছিল না। হাসপাতালের চিকিৎসকরা তখন রোগীর অবস্থানুসারে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রদান করেছেন। রোগীর অবস্থার ক্রমাবনতিতে এক পর্যায়ে তাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে মেয়েটি একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

মাত্র ১৯ বছরের একটি প্রাণবন্ত উচ্ছল মেধাবী তরুণীর মৃত্যু যে কারও পক্ষেই মেনে নেওয়া কষ্টের। ফেসবুকে হাসপাতালের শয্যায় মৃত তরুণীর মুখের ছবিটি দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়েছে। সহপাঠীর মৃত্যুতে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদেরও নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে। মেয়েটির বাবা-মা ও পরিবারের অন্যদের বেদনাও সহজে উপলব্ধি করা যায়।

এত অল্প বয়সের এমন একটা মৃত্যু মেনে নেওয়া কষ্টকর। কিন্তু এখানে ভুল চিকিৎসার অবকাশ কোথায় বুঝলাম না। শুরুতে কি ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল? আচ্ছা, ডেঙ্গু রোগের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা কী? ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে সৃষ্ট ডেঙ্গু জ্বরের কি কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা আছে? না, নেই। বরং রোগের বিভিন্ন লক্ষ্মণ দেখে সাপোর্টিং ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়। যেমন, জ্বর ও ব্যথা কমানোর ওষুধ কিংবা প্রয়োজনে রক্ত দিতে হতে পারে। তবে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ বিশেষ করে ১২ বছরের বাচ্চাদের দেওয়া উচিত নয়।

এবার আসি রক্তের ক্যানসারের চিকিৎসা প্রসঙ্গে। প্রাথমিকভাবে কারও রক্তের ক্যানসার নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে কি মূল চিকিৎসা শুরু করা হয়? রক্তের এই ক্যানসারের মূল চিকিৎসাই-বা কী? কেমোথেরাপি? রেডিওথেরাপি? অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন? অস্থিমজ্জার পরীক্ষাটা কি করা দরকার?

চিকিৎসা শুরু করার জন্য ক্যানসার কোন স্টেজে আছে, সেটা জানা দরকার।

রোগীর যে শারীরিক অবস্থা তাতে রক্তের অনুচক্রিকার সংখ্যা না বাড়িয়ে চাইলেও কি কেমোথেরাপি দেওয়া যায়? রোগীর বাবা-মা বা নিকটাত্মীয়দের আসার একটা ব্যাপার থাকে। আরও অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু আলোচ্য রোগীর শারীরিক অবস্থা এমন পর্যায়ে ছিল যে, জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে তাকে আসলে 'সাপোর্টিং ট্রিটমেন্ট'ই দেওয়া হচ্ছিল। তবু তাকে বাঁচানো যায়নি।

মেয়েটির মৃত্যুতে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা চিকিৎসকদের বিরূদ্ধে ভুল চিকিৎসার অযৌক্তিক ও অসত্য অভিযোগ তুলে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভাঙচুর করেছে।

ক্যানসারাক্রান্ত মেয়েটির মৃত্যু দুঃখজনক। তার চেয়ে হতাশাজনক হল মৃত্যু-পরবর্তী সন্ত্রাসী প্রতিক্রিয়া! এটি মেনে নেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের কাছে এহেন আচরণ আদৌ প্রত্যাশিত নয়।

মৃত ছাত্রীর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঢাকায় তার পরিবারের কেউ না থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক আমজাদ আলী সেন্ট্রাল হাসপাতালের নয়জন চিকিৎসক-সেবিকা-কর্মকর্তার বিরূদ্ধে মামলা করেছেন। মামলা প্রসঙ্গে বাদী অধ্যাপক আমজাদ আলী 'বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম'কে বলেছেন:

"একটা পরিবারের স্বপ্ন যে ধ্বংস হল, স্বপ্নভঙ্গ হল কিছু ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা ও গাফিলতির জন্য, এটার দায়দায়িত্ব তাদের নেওয়া উচিত। এরকম যারা সেবক থাকবে, তারা যদি সেবক না হয়ে ব্যবসায়ীর মতো আচরণ করে, তাহলে তাদের এটার জন্য শাস্তি পাওয়া উচিত।"

মামলার বাদী নিজে একজন অধ্যাপক হয়ে ঘটনার ব্যাপারে সামান্য কিছু না জেনে কীভাবে এমন একটি ভিত্তিহীন, মিথ্যে মামলা করলেন তা আদৌ বোধগম্য নয়। তিনি কী করে নিশ্চিত হলেন যে, ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা ও গাফিলতির জন্য মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে? তাছাড়া, এতই যখন সন্দেহ তখন কেন মেয়েটির লাশের ময়না তদন্ত করা হল না?

তিনি নিজে যেহেতু একজন অধ্যাপক, তাঁর কাছে তো যৌক্তিক আচরণ আমরা প্রত্যাশা করতে পারি।

এই মামলার অন্যতম আসামী অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ, সদ্যপ্রয়াত মেয়েটি যার তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য 'একুশে পদক' পেয়েছেন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসকও। আন্তর্জাতিকভাবেও তাঁর খ্যাতি দেশে দেশে, তাঁর রচিত মেডিসিনের একাধিক বই অনেক দেশেই পড়ানো হয়। সঠিকভাবেই তিনি মেয়েটির চিকিৎসা করেছিলেন। তাঁর মতো এমন দক্ষ, গুণী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন চিকিৎসকেরও আজ রক্ষা নেই।

এই ঘটনায় বোঝা যায়, কর্মক্ষেত্রে ডাক্তারদের নিরাপত্তা আজ কতটা হুমকির মুখে। এর শেষ কোথায়? এভাবে আর কতকাল চলবে? এর মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আসলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি?