ধর্ষণের বিচার: ‘নারীবিরোধী’ আইনের সংশোধন চাই

হুসাইন আহমদ
Published : 3 Nov 2011, 05:56 AM
Updated : 19 May 2017, 05:45 AM

মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলেও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পর্যায়ে অধিকার-সুযোগের বহু ক্ষেত্রে সাড়ে চার দশকেও নারী 'মানুষের' মর্যাদা পায়নি। অনেক অধিকার ও সুযোগের কথা সংবিধানে লেখা থাকলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও শোষণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা তা থেকে নারীকে বঞ্চিত করে রেখেছে।

নারীদের অধিকার ও সুযোগের বিষয়ে সংবিধান বিশেষ জোর দিলেও সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করতে পারেনি।

সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদের (মৌলিক অধিকার) ২৭, ২৮ ও ২৯ ধারা অনুযায়ী 'রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার' নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী হিসেবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য 'বিশেষ বিধান-প্রণয়নের'ও ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দিয়ে রেখেছে সংবিধান। শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও রাজনীতিসহ অনেকক্ষেত্রে নারীর ঊর্ধ্বতন অবস্থান তৈরি হলেও সমাজ ও আইন পুরুষের সঙ্গে সমান চোখে নারীকে দেখে না। সে জন্য আইনের একটা বড় দায় রয়েছে।

আইন যদি ন্যায্য না হয় বা সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি আইন প্রণয়ন করে নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত না করে, তাহলে সংবিধানের সুরক্ষা কোনো কাজে আসে না। ব্যক্তিস্বাধীনতার চরম উন্মেষের যুগেও বাংলাদেশে প্রচলিত অনেক আইনে নারীকে 'পূর্ণ মানুষ' হিসেবে গণ্য করা হয় না; মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে তার অবস্থান পুরুষের নিচে। পুরুষতান্ত্রিক ও সামন্তীয় ব্যবস্থা নারীকে যে চোখে দেখত সেই দৃষ্টিভঙ্গিই ব্রিটিশরা ভারতীয় উপনিবেশের জন্য তৈরি আইনে রেখে দিয়েছিল।

প্রায় সাত দশক হতে হতে চলল ব্রিটিশরা উপনিবেশ ছেড়ে চলে গেছে। এরপর পাকিস্তানের প্রায়-উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এসেছে; আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশরা আমাদের মনন-জগতে যে উপনিবেশ স্থাপন করে গেছে, তা থেকে আমাদের মুক্তি হয়নি। বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু পরাধীনতা ও শৃঙ্খলের অনেক আইন আমরা মেনে চলছি।

সেই রকম একটি আইন হল ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন (Evidence Act, 1872), যার বিশেষ একটি ধারা সংবিধানের পরিপন্থী এবং নারীর জন্য চরম অবমাননাকর। এই আইনের ১৫৫ (৪) ধারায় ধর্ষণের অভিযোগকারী বা ধর্ষিত নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ধর্ষককে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে:

"কোনো ব্যক্তিকে যখন ধর্ষণ বা বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হয়, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারী নারী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।"

(when a man is prosecuted for rape or an attempt to ravish, it may be shown that the prosecutrix was of generally immoral character.)

বাংলাদেশে পুরুষতান্ত্রিক ও সামন্তীয় চিন্তা কাঠামো প্রবলভাবে বিরাজমান থাকায় 'ধর্ষণকে বলপ্রয়োগ ও নারীর শরীরের প্রতি সহিংসতার' বদলে 'পবিত্রতা ও সতীত্বহানি' হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু শরীরকেন্দ্রীক সেই পবিত্রতার ধারণা পুরুষের বেলায় খাটে না।

১৮৬০ সালের সালের দণ্ডবিধি আইনের (Penal Code, 1860) ৩৭৫ ধারায় দেওয়া ধর্ষণের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয় তা সংকীর্ণ, শুধুই নারীকেন্দ্রীক; নারীর উপর পুরুষের যৌন নিপীড়নে সীমাবদ্ধ। ব্রিটিশদের প্রণীত এই আইন বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতও অনুসরণ করে।

২০১২ সালে ভারতের দিল্লিতে পাবলিক বাসে ২৩ বছরের এক তরুণীকে (যিনি গণমাধ্যমে 'নির্ভয়া' মানে পরিচিত) দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়; ১৫ দিন পর সিঙ্গাপুরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে ভারতে যৌন অপরাধীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং সংশ্লিষ্ট আইনের কিছু ধারা সংশোধন করে ২০১৩ সালে ফৌজদারি আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ Criminal Law (Amendment) Ordinance, 2013 জারি করে, যেটা পরে আইনে পরিণত করা হয়।

ওই আইনের মাধ্যমে দণ্ডবিধি আইনের ধারা সংশোধন করে ধর্ষণের সংজ্ঞার পরিধি বিস্তৃত করে 'এক ব্যক্তির উপর আরেক ব্যক্তির যৌন নিপীড়ন' দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়। এর আগে ব্রিটিশরা ২০০৩ সালে যৌন অপরাধ আইন প্রণয়ণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্র ২০১২ সালে বিধিমালা সংশোধন করে ধর্ষণের নারীকেন্দ্রীক ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছে।

পক্ষান্তরে বাংলাদেশ ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইনের মাধ্যমে ধর্ষণের কিছু শর্তে সংশোধন আনলেও দণ্ডবিধি আইনের ৩৭৫ ধারার প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো সেই সংজ্ঞা বহাল রেখেছে। ফলে আইনগতভাবে শিশু ও নারী ছাড়া বাংলাদেশে কেউ ধর্ষণের শিকার হতে পারে না।

শিশু আইনে ছেলে শিশুর বলাৎকারের বিচারের বিধান থাকলেও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে যৌন নিপীড়নের বিচারে আইন নেই। ধর্ষণের ধারণা শুধু নারীতে সীমাবদ্ধ বলে সমাজ শুধু নারীর দোষ খোঁজে, নারী নিজেও হয়তো একসময় পারিপার্শ্বিকতায় বাধ্য হয়ে ধর্ষণের জন্য নিজের দেহকেই দায়ী করতে শুরু করেন; সঙ্গে আইনের চোখেতো তিনি 'দুশ্চরিত্রা' হয়েই আছেন।

সব মিলিয়ে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতায় ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রেই আদালত হয়ে ওঠে 'ধর্ষিতার' চরিত্রহননের ক্ষেত্র। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারার প্রয়োগ ঘটিয়ে ধর্ষণের মামলায় ভুক্তভোগী নারীর চরিত্র হননে যতটা প্রভাব ফেলা যায়, অন্য ক্ষেত্রগুলোতে তা করা সম্ভব করা হয় না। আর সেই সুযোগ আসামির পক্ষের কৌসুঁলিরা ষোল আনা উসুল করেন।

'সঠিক ঘটনা তুলে ধরা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পরীক্ষার' নাম করে এই ধারার সুযোগ নিয়ে ধর্ষণের ঘটনার বিষয়ে ধর্ষিতাকে বারবার প্রশ্ন করে তাঁর সাক্ষ্যে অসামঞ্জস্যতা দেখানোর চেষ্টা করা হয়। শুধু ধর্ষিতাকে 'দুশ্চরিত্রা' প্রমাণ করাই নয়, ওই নারী সংশ্লিষ্ট ঘটনায় স্বেচ্ছায় সম্মতি দিয়েছে মর্মে আদালতে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তাঁকে 'দুশ্চরিত্রা' প্রমাণ করতে পারলেই ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বেঁচে যেতে পারে– এই ধারণার বশবর্তী হয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সাক্ষ্য আইনের এই ধারার সুযোগ নিয়ে থাকে।

এই ধারায় জেরা করার সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র হননের চেষ্টা হয়। আসামিপক্ষের উকিল অভিযোগকারীর বিগত যৌন অভিজ্ঞতা নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ভরা এজলাসে অভিযোগকারী নারীকে যখন নিজের ধর্ষিত হওয়ার অভিজ্ঞতা খুলে বলতে হয়, তখন চারপাশে হাসি-তামাশা ও ঠাট্টা-বিদ্রূপের রোল ওঠে। আইনের ঢাল সামনে রেখে কোনো বিচারকও কখনও বিবাদী পক্ষের উকিলের সঙ্গে তাল মেলান। এজন্য এমন কথা বলা হয় যে, ধর্ষণের শিকার একজন নারী বিচার চাইতে গিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্বিতীয়বার জনসমক্ষে ধর্ষণের শিকার হন।

এ কারণে ধর্ষণের শিকার সিংহভাগ মেয়ে শিশু-নারী ও তাদের পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হয়। অনেকে মামলা মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক সময় আসামিপক্ষের উকিলের জেরায় ধর্ষিতা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, এমনকি আত্মহননের পথও বেছে নেন।

সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বিলোপ না করলে ধর্ষিতা নারীর ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা বোধগম্য কারণেই একেবারে ক্ষীণ।

তবে যে কোনো মামলায় অভিযোগকারী বা ভুক্তভোগী ও সাক্ষীকে অশোভন, লজ্জাজনক, আক্রমণাত্মক ও বিরক্তিকর প্রশ্ন করা থেকে সাক্ষ্য আইনের ধারা ১৫১ ও ১৫২ সাধারণ সুরক্ষা দিয়েছে। ভয় বা লজ্জামুক্ত সাক্ষ্যের জন্য নির্দিষ্ট কোনো মামলায় আদালত/ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজনে রুদ্ধদ্বার কক্ষে (trial in camera) বিচার কার্যক্রম চালাতে পারেন। এতে ভুক্তভোগী বা সাক্ষী বিরূপ কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন, যা জনাকীর্ণ উন্মুক্ত আদালতে তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে।

ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা কীভাবে অভিযোগকারী বা ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় সে বিষয়ে 'State of Punjab v. Gurmit Singh; (1996) 2 SCC 384' মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে:

"আদালতে জেরার সময় যৌন নিপীড়নের শিকার নারীর সঙ্গে যে আচরণ করা হয় তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা আছে। সাক্ষ্য আইনে ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে বিধান যা-ই থাকুক না কেন, আসামিপক্ষের কিছু কৌসুঁলি রয়েছেন, যারা ধর্ষণের বিস্তারিত বিষয়ে অভিযোগকারী নারীকে অনবরত প্রশ্ন করার কৌশল নিয়ে থাকেন। ধর্ষণ ঘটনার বিষয়ে বাদীকে বারবার বিস্তারিত উত্তর দিতে বাধ্য করা হচ্ছে সঠিক ঘটনা তুলে ধরতে বা তার বিশ্বাসযোগ্যতা পরীক্ষা করতে নয়, বরং ওই নারীর অভিযোগ ও তার সাক্ষ্যের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা খুঁজে বের করার চেষ্টায় তা করা হয়।

তাই আসামিপক্ষ যখন অভিযোগকারীকে জেরা করবে, তখন আদালত নিরব দর্শকের মতো বসে থাকতে পারে না। আদালতকে অবশ্যই সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জেরা করার মাধ্যমে অভিযোগকারীর সত্যনিষ্ঠা ও তার সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করার জন্য অভিযুক্তকে যেমন পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে ভুক্তভোগী নারী যাতে হয়রানি বা অবমাননার শিকার না হন তা-ও আদালতকে নিশ্চিত করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, ধর্ষণের শিকার নারী ইতোমধ্যে মনো-দৈহিক যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা পার করেছেন। আদালতের অচেনা গণ্ডিতে ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যদি তাকে করতে হয়, তাহলে তিনি লজ্জা, স্নায়বিক অস্থিরতা ও দ্বিধায় নির্বাক হয়ে যেতে পারেন। তখন তার নিশ্চুপ থাকা এবং দ্বিধাগ্রস্ত কথার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সেটাকে সাক্ষ্যের 'অমিল ও স্ববিরোধ' হিসেবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ হতে পারে।"

নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বিলুপ্ত করে ভারত ২০০২ সালে সাক্ষ্য আইন [Indian Evidence (Amendment) Act 2002] সংশোধন করেছে। সেই সঙ্গে আইনটির ১৪৬ ধারায় বিশেষ বিধান যুক্ত করে 'অভিযোগকারী নারীকে সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রের' ধরে নিয়ে আদালতে তাকে জেরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা নিয়ে বাংলাদেশেও ব্যাপক সমালোচনার পর সেটি বাদ দিয়ে সাক্ষ্য আইনের সংশোধনীর একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সুপারিশ ও মতামতের জন্য তা ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ আইন কমিশনের ওয়েবসাইটে ঝুলছে। কিন্তু খসড়াটিকে আইনে পরিণত করার পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র 'যৌনক্রিয়ায় নারীর সম্মতির বিষয়টি' বিবেচ্য হলেও সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার কারণেই অভিযোগকারী নারীকে 'নৈতিক চরিত্রের' পরীক্ষা দিতে হয়।

ধর্ষণ মামলায় অভিযোগকারীর অতীত 'চরিত্র, নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার এই বিধান নারীবিদ্বেষী। কারণ সাক্ষ্য আইনের ৫৪ ধারা অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির চরিত্র অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ধর্ষণের মামলায় অভিযোগকারী হয়েও কেন চরিত্রের পরীক্ষা দিতে হবে? কিন্তু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ১৫৫(৪) ধারার কারণে নারীকে চরিত্রের পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হয়।

দেড়শ বছর আগে ব্রিটিশদের তৈরি এই আইনে নারীর প্রতি চরম বিদ্বেষ থাকলেও তারা কিন্তু সেটা বাদ দিয়ে আইন অনেক উন্নত করেছে। উল্টো যুক্তরাজ্যের ফৌজদারি বিচার আইনে (The Criminal Justice Act 2003) ধর্ষণের মামলায় বিশেষ ক্ষেত্রে আসামিকে 'দুশ্চরিত্র' ধরে নিয়ে জেরা করার বিধান রাখা হয়েছে।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে:

"যদি ধরে নেওয়াও হয় যে, মেয়েটি যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত, সেটা কোনো নির্ধারক প্রশ্ন হতে পারে না। পক্ষান্তরে বিবেচনা করতে হবে, যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি বাদীর উপর ধর্ষণ সংঘটিত করেছে কি না। যদি অনুমিতভাবে এটা মেনে নেওয়া হয় যে, বাদী সংশ্লিষ্ট ঘটনার আগেই কৌমার্য হারিয়েছেন, তাতেই তাকে ধর্ষণের লাইসেন্স আইন কাউকে দেয় না বা দিতে পারে না। বিচার হচ্ছে অভিযুক্তকে নিয়ে, অভিযোগকারী বা ভুক্তভোগীকে নিয়ে নয়। যদি এটাও দেখা যায় যে, অভিযোগকারী আগে থেকেই যৌনজীবনে অজাচারী ছিলেন, তাহলেও যে কারোর ও সবার সঙ্গে যৌন সঙ্গমে সম্মত না হওয়ার অধিকার তার আছে।"

(State of U.P. Vs. Pappu @Yunus & anr. AIR 2005 SC 1248)

ঢাকায় আলোচিত বনানীর দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার পর এক তরুণীর ভাষ্যে ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার দুজনসহ আসামিদের সঙ্গে তাদের পরিচয় ও ধর্ষণের ঘটনার যতটুকু বিবরণ গণমাধ্যম ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা ব্যবহার করে আদালতে ঘটনার শিকার দুই তরুণীর চরিত্রের পরীক্ষা যে নেওয়া হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

তাই জরুরি ভিত্তিতে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারাসহ বাতিলসহ কিছু সংশোধন আবশ্যক, যাতে ধর্ষণের শিকার বা ধর্ষণচেষ্টার শিকার কোনো নারীর চরিত্রের বিষয়টি কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক না হয়। পাশাপাশি দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে যৌন নিপীড়নবিরোধী সমন্বিত আধুনিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে।

তথ্যসূত্র: