উচিত শিক্ষা-২ : কেমন শিক্ষক চাই?

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 21 May 2017, 05:08 AM
Updated : 21 May 2017, 05:08 AM

'শিক্ষার সাফল্য শতভাগ নির্ভর করে শিক্ষকের দক্ষতার উপর', লিখেছেন ফরাসি দার্শনিক মোঁতেঈন (১৫৩৩-১৫৯২)। শিক্ষক যদি চৌকষ হন এবং শিক্ষার্থীর যদি জ্ঞানার্জনে আগ্রহ থাকে, তবে বিদ্যালয় ভবন, শ্রেণিকক্ষ, ব্ল্যাকবোর্ড– কোনো কিছুর অভাবই উচিত শিক্ষা ব্যহত করতে পারার কথা নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমনটা লিখেছেন: "নিচের ক্লাসে যে-সকল মাস্টার পড়ায়… তাহারা না জানে ভালো বাংলা, না জানে ভালো ইংরেজি। কেবল তাহাদের একটা সুবিধা এই যে, শিশুদিককে শিখানো অপেক্ষা ভুলানো ঢের সহজ কাজ, এবং তাহাতে তাহারা সম্পূর্ণ কৃতকার্যতা লাভ করে।"

শখানেক বছর আগে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বক্তব্য বর্তমান যুগে একেবারে বাতিল হয়ে গেছে, সে দাবি করা যাবে না।

মোঁতেঈন লিখেছেন, মানবিক বিজ্ঞানের মহত্তম কিন্তু কঠিনতম সমস্যা হচ্ছে শিশুশিক্ষা। শিক্ষার সঙ্গে তিনি চাষবাসের তুলনা করেছেন। বীজতলা তৈরি করে চারা গজানো এমন কিছু কঠিন কাজ নয়; চারা রোপন করাও সহজ; কিন্তু চারা যখন একবার বেড়ে উঠতে শুরু করে, তখন তাকে ঠিকঠাকমতো বড় করে তোলাটাই প্রধান সমস্যা। এই সমস্যা যেমন বিচিত্র তেমনি এর সমাধানের উপায়ও বিচিত্র।

'বাচ্চা নেওয়াতে পরিশ্রম কমই', বলেছেন মোঁতেঈন, কিন্তু 'একবার যখন তারা জন্ম নিল, তার পর থেকেই তাদের বহু রকম যত্ন নিতে হয়। সঠিকভাবে তাদের খাইয়ে-পড়িয়ে, সুঅভ্যাস, নীতিবোধসম্পন্ন করে মানুষ করা যাবে কি যাবে না, এই নিয়ে বাবামায়ের কত আশঙ্কা, কত ভয়!'

'ভালুক বা কুকুরের বাচ্চা তো প্রকৃতির ধারা অনুসরণ করে ভালুক বা কুকুর হয়েই যায়। কিন্তু মানুষের বাচ্চাকে জন্মের পর পরই হাজারো অভ্যাস, মতামত, রীতিনীতি এবং আইনের সাগরে ঝাঁপ দিতে হয় বলে তাদের প্রকতিদত্ত সত্তা সহজেই বদলে যায়, অথবা এই সত্তা এমন সব ছদ্মবেশ ধারণ করে যে সহজে তাকে চেনাই যায় না।'

শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব কী? ধরা যাক, কোনো শ্রেণিকক্ষে তিন ধরনের শিক্ষার্থী আছে: উত্তম, মধ্যম এবং অধম। উত্তম নিজে থেকেই অনেক কিছু বুঝে যাবে। মধ্যমকে উৎসাহ দিয়ে উত্তমে পরিণত করার চেষ্টা করতে হবে। অধমের কাছে লেখাপড়াটা আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সম্ভবত এর উল্টোটাই করা হয়। উত্তমকে মধ্যমে এবং মধ্যমকে অধমে পরিণত করা হয়। বেচারা অধমকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে স্রেফ স্কুল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সুতরাং শিক্ষার নীতিনির্ধারক, শিক্ষক, অভিভাবক কেউই A student is not a vessel to be filled, but rather a lamp to be lit– এই প্রবাদবাক্যে বিশ্বাস রাখেন বলে মনে হয় না।

মনুষ্যনির্মিত যে ইমারত হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে, সেটি হচেছ মিশরের পিরামিড। অগ্রভাগের তুলনায় ভিত্তিমূল বহুগুণ বড় হওয়াটা পিরামিডের দীর্ঘস্থায়িত্বের অন্যতম কারণ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষাও বিদ্যালয়ের সংখ্যা ও মান, শিক্ষকদের জ্ঞান, দক্ষতা, বেতন ও সম্মান, রাষ্ট্রের মনোযোগ ও বিনিয়োগের দিক থেকে শিক্ষার অন্য স্তরগুলোর তুলনায় বহু গুণ সমৃদ্ধ হতে হবে। গুরুত্বের দিক থেকে প্রাথমিক শিক্ষার পরে আসবে মাধ্যমিক শিক্ষা এবং সবার শেষে আসবে উচ্চশিক্ষা। গুরুত্ব, শক্তি ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ধাপে ধাপে উপরের দিকে কমে আসবে, পিরামিডের মতো।

বাংলাদেশে ভালো ছাত্রেরা ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আর মধ্যম মানের ছাত্রেরা বাধ্য হয়ে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক হয়। ফিনল্যান্ড বা নরওয়ের মতো নরডিক দেশগুলোতে শিক্ষক হতে হলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক। ভালো ছাত্রদের সেখানে সর্বোচ্চ বেতন দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। 'অন্নচিন্তা যার চমৎকার, জ্ঞানচর্চা তার দ্বারা হয়ে ওঠে না', বলেছেন মোঁতেঈন– সেই ষোড়শ শতকে।

শুধু শ্রদ্ধায় চিড়া ভিজে না। শিক্ষককে, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে সর্বোচ্চ বেতন দিতে হবে। বেতন যদি আকর্ষণীয় হয়, তবে পিএইচডিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলেই-বা সমস্যা কী? ডিগ্রি তো থাকতেই হবে, কিন্তু দেখতে হবে শিক্ষাদানে আগ্রহী, চৌকষ এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরাই যেন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এ ধরনের শিক্ষক খুঁজে বের করতে হলে আমাদের নিয়োগকর্তাদেরও সমভাবে চৌকষ হতে হবে।

বজ্রকঠিন ভর্তিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে প্রস্তত নয়– কী বাংলাদেশে, কী বিদেশে। এর কারণ আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা দুর্বল। 'আগা মোটা ও গোড়া চিকন' হলে কোনো ব্যবস্থাই ঠিকঠাকমতো কাজ করে না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: "ছেলে যদি মানুষ করিতে চাই, তবে ছেলেবেলা হইতেই তাহাকে মানুষ করিতে আরম্ভ করিতে হইবে, নতুবা সে ছেলেই থাকিবে, মানুষ হইবে না।"

জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করার বিকল্প নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত ভালো ছাত্রদেরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ভালো ছাত্র হলেই কেউ ভালো শিক্ষক হয় না। যে কোনো বিষয় মুহূর্তে আত্মস্থ হয়ে যায় বলে ভালো ছাত্রেরা বুঝতেই পারে না কেন মধ্যম মানের এবং অঘা ছাত্রেরা এত 'সহজ' বিষয়টি বুঝতে পারছে না। জ্ঞান অর্জনে ইচ্ছুক কোনো মধ্যম মানের ছাত্রেরই বরং ভালো শিক্ষক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে।

শিক্ষকের ব্যক্তিত্বেরও রকমফের আছে। অনেক শিক্ষকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করে ভালো শেখা যায়, কিন্তু সেই একই শিক্ষক হয়তো শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতার ক্ষেত্রে তেমন চৌকষ নন। কবি জীবনানন্দ দাশের মতো লাজুক লোকের পক্ষে ভালো শিক্ষক হওয়া কঠিন। যদিও এর মানে এই নয় যে, সজনীকান্ত দাশের মতো সব ঠোঁটকাটা লোকেরাই চমৎকার শিক্ষক হবেন। মানুষ হিসেবে চমৎকার এমন খারাপ শিক্ষক যেমন রয়েছেন, তেমনি নোংরা মনের ভালো শিক্ষকও যে নেই তা-ও নয়।

শিক্ষকতা একটি কলা এবং যে কোনো কলাই একটি বিরল জন্মগত প্রতিভা। যে কেউ সাক্ষ্য দেবেন, মনে রাখার মতো শিক্ষক হাতেগোনা। এর একটি প্রমাণ, ১১০০ থেকে ১৫০০ মধ্যযুগের এই পাঁচশ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে পাঁচ জনের বেশি বিখ্যাত শিক্ষকের কথা জানা যায় না। যদিও একই সময়ে বহু জ্ঞানী ব্যক্তির কথা জানা যায়।

আমার নিজের প্রায় ত্রিশ বছরের ছাত্রজীবনে এশিয়া-ইওরোপ-আমেরিকা মিলিয়ে খুব বেশি হলে দশ জন শিক্ষক পেয়েছি মনে রাখার মতো। অন্য অনেকের মতো আমারও বেশিরভাগ শিক্ষক ছিলেন মধ্যম মানের। এঁদের কাছ থেকেও যে কম কিছু শিখেছি, তা নয়। তবে সাড়ে চার দশক পরেও উত্তম শিক্ষকেরা স্মৃতির আকাশে জ্বলজ্বল করেন। তাঁরা কী পড়িয়েছিলেন, কীভাবে পড়িয়েছিলেন, সব মনে আছে। মধ্যম মানের শিক্ষকদের চেহারাটাও মনে নেই, নাম পর্যন্ত ভুলে গেছি।

বলা হয়ে থাকে যে 'প্রতিভা হচ্ছে একভাগ প্রেরণা এবং নিরানব্বইভাগ কঠোর পরিশ্রম'। শিক্ষক হবার কোনো প্রকার প্রেরণা বা আগ্রহ যার নেই তাকে হাজার প্রশিক্ষণ দিয়েও লাভ হবে না। ইস্পাত দিয়ে ভালো ছুরি হয়, কাঁচা লোহাকে পেটানো পণ্ডশ্রম। অভিজ্ঞতা দিয়েও প্রেরণা বা প্রতিভার ঘাটতি মেটাতে যায় না, অন্ততপক্ষে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে।

প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার ছাত্রজীবনে দেখেছি, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকদের চেয়ে এমন কিছু ভালো পড়াতেন না। এর মানে অবশ্য এই নয় যে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। যার মধ্যে শিক্ষকতার প্রেরণা রয়েছে প্রশিক্ষণ শুধু তার ক্ষেত্রেই ফলপ্রসূ হবে। শিক্ষক-নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শিক্ষকতার প্রেরণাসম্পন্ন প্রার্থীদের খুঁজে বের করার ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়।

কয়েক বছর পড়ানোর পর শিক্ষার্থীদের গোপন মতামতের ভিত্তিতে শিক্ষকের নিয়োগ স্থায়ী করার কথা ভেবে দেখা যেতে পারে। আমাদের দেখতে হবে, শিক্ষার ক্ষেত্রে দর্শনীয় অগ্রগতি করেছে এমন সব দেশে, বিশেষত ফিনল্যান্ডে, কীভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সে সব দেশে ছাত্রদের কোনো ভূমিকা আছে কিনা।

প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণদের তিনটি কর্তব্য ছিল: যজন, যাজন ও অধ্যাপন। 'যজন' মানে নিজে প্রার্থনা করা, 'যাজন' মানে অন্যকে প্রার্থনায় সহায়তা করা আর অধ্যাপন মানে পাঠদান। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরও তিনটি কর্তব্য: নিজে গবেষণা করা, অন্যকে গবেষণায় সহায়তা করা এবং পাঠদান করা। ভালো গবেষক, এই অজুহাতে অনেক শিক্ষক খারাপ পড়িয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে বহাল তবিয়তে টিকে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু মূলত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেহেতু একজন শিক্ষকের মুখ্য কর্তব্য পাঠদান, গবেষণা তাঁর গৌণ কর্তব্য। ভালো পড়াতে পারেন না কিন্তু ভালো গবেষক, এমন শিক্ষকেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আটকে থেকে স্রেফ নিজের ও শিক্ষার্থীদের সময় নষ্ট করছেন। এ ধরনের শিক্ষক কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ নিলেই সবার জন্যে মঙ্গল।

গবেষণা বা পড়ানো কোনোটাতেই দক্ষতা নেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম 'না ঘরকা, না ঘাটকা' শিক্ষকের সংখ্যাও খুব একটা কম নয়।

শিক্ষকতা একটি সেবা। শিক্ষার্থী, সমাজ, রাষ্ট্র এই সেবার ভোক্তা। শিক্ষকতা সম্ভবত একমাত্র পেশা যেটিতে বিন্দুমাত্র দক্ষতা না থাকলেও ভোক্তার কিছু বলার থাকে না। কোনো মুদি যদি খারাপ চাল বিক্রি করে, তবে তার দোকানে আমরা দ্বিতীয়বার যাই না। কিন্তু একজন শিক্ষক যত খারাপই পড়ান না কেন, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী শিক্ষকেরা (পাশ্চাত্যে যাদের 'টেনিউরড' শিক্ষক বলা হয়), ছাত্ররা সাহস করে তাদের কিছুই বলতে পারে না। কারণ সে ক্ষেত্রে ডিগ্রি আটকে যেতে পারে (যায়ও অনেক সময়)। এই পরিস্থিতি জ্ঞানের আদান-প্রদানের উপযোগী নয়, বলাই বাহুল্য।

ফরাসি দার্শনিক মোঁতেঈন লিখেছেন: '(জ্ঞানে) ভরা মাথা নয়, শিক্ষকের হবে (জ্ঞানে) বিকশিত মাথা'। এর মানে হচ্ছে, জ্ঞান যেন শিক্ষকের ক্ষেত্রে 'গাধার পিঠে চিনির বোঝা' না হয়। জ্ঞান শিক্ষককে আগাপাশতলা বদলে দেবে এবং সেই পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীর উপর। গুরু শ্রী রজনীশ তাঁর এক বক্তৃতায় তিন ধরনের ডাক্তার এবং তিন ধরনের গুরুর কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রথম ধরনের ডাক্তার ঔষধের ব্যবস্থাপত্র দেবেন, কিন্তু রোগী সেই অনুযায়ী ঔষধ খেল কী খেল না তাতে তাঁর কিছু যাবে আসবে না। দ্বিতীয় ধরনের ডাক্তার ঔষধ সেবনের জন্যে রোগীকে বার বার বোঝাবেন। তৃতীয় ধরনের ডাক্তার রোগীকে ঔষধ খেয়ে সুস্থ হতে বাধ্য করবেন।

একইভাবে এক ধরনের শিক্ষক আছেন যাঁরা শুধু পড়িয়ে যান, শিক্ষার্থী আদৌ কিছু শিখল কিনা, সে ব্যাপারে তাদের মাথাব্যথা নেই। দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষক শিক্ষার্থীকে বিদ্যার্জনে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেন। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষক শিক্ষার্থীকে জ্ঞানার্জনে বাধ্য করেন।

আমার ছাত্রজীবনে চট্টগ্রামের কুমিরা উচ্চ বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক, যেমন খোরশেদ আলম, সামসুল আলম এবং অমল বোস ছুটির পরও আমাদের কোচিং করতে বাধ্য করতেন বিনা পারিশ্রমিকে, আমাদের চরম অনিচ্ছাসত্ত্বেও। প্রধান শিক্ষক নজির আহমেদ চৌধুরী অন্য দুই একজন শিক্ষক এবং দফতরিকে সঙ্গে নিয়ে রাতের বেলায় শিক্ষার্থীদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতেন তারা ঠিকমতো লেখাপড়া করছে কিনা। যদি কোনো বেচাল দেখতেন তবে অকুস্থলেই শাস্তি দিতে দ্বিধা করতেন না।

আমার শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে স্বল্প বেতনের কারণে শিক্ষকতা ছেড়ে ব্যাংক বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠানে কাজ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ ধরনের শিক্ষককে জ্ঞানদানে নিয়োজিত না রেখে ব্যাংকে কাজ করানো জাতির জন্যে বিরাট অপচয়।

অ্যাপল কম্পিউটার কোম্পানির জনক স্টিভ জবস মনে করেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে একজন পেশাদার (প্রফেশনাল বা এক্সপার্ট) হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। যিনি ভালো পড়াবেন, শুধু তিনিই শিক্ষকতার পেশায় থাকবেন। আর যিনি তা পারবেন না তিনি গবেষণা বা অন্য কোনো পেশা বেছে নেবেন। যে শিক্ষক যত ভালো পড়াবেন, তাঁকে তত বেশি বেতন দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হবে।

সমাজে বহু ক্ষেত্রে এই নিয়ম চালু রয়েছে, শিক্ষাক্ষেত্রে কেন থাকবে না? কোন শিক্ষক ভালো পড়ান আর কোন শিক্ষক পড়াতে জানেন না, সেটা সবচেয়ে ভালো জানে শিক্ষার্থীরা। অথচ পৃথিবীর প্রায় কোনো দেশেই শিক্ষকের পদায়ন বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় না। কেন এই আচরণ ভোক্তা অধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে না?

মোঁতেঈন লিখেছেন: 'শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে যে রীতিটি সাধারণত অনুসৃত হয় সেটা হচ্ছে, শিক্ষকেরা শিক্ষার্র্থীর কর্ণকুহরে বজ্রপাতের আওয়াজ করে যাবে এবং শিক্ষক যা বলেছেন, শিক্ষার্থীরা তার পুনরাবৃত্তি করবে।' শিক্ষাদানের এই রীতিকে মোঁতেঈন অবশ্য সমর্থন করেননি। তাঁর সুপারিশ হচ্ছে, শিক্ষক কখনও শিক্ষার্থীকে পথের দিশা বলে দেবেন, কখনও-বা শিক্ষার্থীকে নিজেই পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করবেন। শিক্ষার্থীকে তিনি প্রশ্ন করতে দেবেন সক্রেটিসের মতো, প্রশ্ন করতে শেখাবেন। একটি উপযুক্ত প্রশ্ন হাজারো অনুপযুক্ত উত্তরের চেয়ে উত্তম।

আমার শিক্ষক রাজেন্দ্র সিংহ একবার তাঁর সুহৃদ চমস্কি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, অন্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে চমস্কির তফাৎ হচ্ছে এই যে, তিনি সঠিক প্রশ্ন করেছেন কিন্তু সঠিক উত্তর হয়তো খুঁজে পাননি। অন্যরা প্রশ্নই ভুল করেছেন, সুতরাং উত্তর সঠিক হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ বদলে ফেলার সময় এসেছে। শিক্ষক ডায়াসে দাঁড়িয়ে ওয়াজ করে যাবেন, বা পাওয়ার-পয়েন্ট দেখাবেন আর ছাত্রেরা নোট নেবে, এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই প্রস্তাবও অবশ্য স্টিভ জবসের। (মধ্যযুগে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক যখন বক্তৃতা দিতেন তখন নোট নেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কাউকে নোট নিতে দেখলে অধ্যাপক বা তাঁর সহকারী সেই শিক্ষার্থীর দিকে নুড়িপাথর ছুঁড়ে মারতেন!)। শ্রেণিকক্ষ হবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আলোচনার স্থান, যে আলোচনায় পয়েন্ট এবং পাওয়ার দুটোই থাকবে।

পাঠদান ও গ্রহণ ব্যাতিহারিক বা পারস্পরিক হতে হবে। 'যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়, তথাপিও মোর গুরু নিত্যানন্দ রায়' এরকম ভাবলে চলবে না। শিক্ষকের কথা প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে– তবে বেহুদা নয়, প্রয়োজনে। শিক্ষক বলবেন, শিক্ষার্থী শুনবে, তারপর শিক্ষার্থী প্রশ্ন করবে, শিক্ষক জবাব দেবেন। অন্য শিক্ষার্থীরাও আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন। শিক্ষাদান হবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনোমুগ্ধকর প্রশ্নোত্তরের যুগলবন্দী।

শিক্ষক আগে থেকে বলে দেবেন, পরের ক্লাসে কী পড়ে আসতে হবে। পাঠ্য বিষয় অন্তর্জালের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে শিক্ষার্থীর কাছে অথবা পাঠাগারের কম্পিউটারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শিক্ষার অন্যতম উৎস পড়ালেখা। শিক্ষার্থীকে পড়তে হবে। জ্ঞানদান শিক্ষকের একার দায়িত্ব নয়। এতে জ্ঞানগ্রহীতা শিক্ষার্থীরও দায়িত্ব রয়েছে। পাশ্চাত্যে শিক্ষার্র্থীদের উপর নিয়মিত পড়ার দায়িত্ব থাকে এবং সেই দায়িত্ব তারা এড়াতে পারে না।

শিক্ষকের কারণেই একটি অবোধ শিশু তার অসংস্কৃত, অশিক্ষিত পর্যায় অতিক্রম করে কালক্রমে একজন সফল পেশাজীবী এবং সার্থক মানুষ হয়ে ওঠে। সমাজের অন্য কোনো পেশাই শিশুর এই উত্তরণ ঘটাতে পারে না। অন্য কোনো পেশাই ব্যক্তিকে শিক্ষকে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে না। সমাজে যত পেশা আছে তার মধ্যে শিক্ষকের পেশাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিক্ষকের মাধ্যমেই এক প্রজন্মের জ্ঞান অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়। আদিম মানুষ আধুনিক মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার পিছনে শিক্ষকদের অবদানই সবচেয়ে বেশি।

শিক্ষকদের এমন চরিত্রের অধিকারী হতে হবে যাতে সঙ্কটকালে সমাজ শিক্ষকের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে পায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'সমাজকে শিক্ষাঋণে ঋণী করিবার গৌরব হইতে' শিক্ষকের নিজেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিজেদের তুচ্ছ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে ক্ষমতার আশেপাশে ঘুরঘুর করেন। সঙ্গত কারণেই সব শিক্ষক সম্পর্কে ভুল ধারণা সৃষ্টি হয় একদিকে ক্ষমতাগর্বী রাজনীতিক এবং অন্যদিকে গুজবপ্রবণ, অক্ষম আমজনতার মনে।

শাসনকর্তা নিজের প্রয়োজনে অধ্যাপকের কাছে এসে বিনয়াবত হয়ে উপদেশভিক্ষা করবেন এটাই উপমহাদেশের শাশ্বত ঐতিহ্য। তুচ্ছাতিতুচ্ছ করণিক পদের জন্যে লালায়িত হয়ে শিক্ষকেরা যখন শ্ব-জাতির মতো শাসনকর্তার কাছে গিয়ে অনুগ্রহভিক্ষা করেন, তখনই স্ব-জাতির সম্মানহানির দায়টাও তাদের উপরই অনেকখানি বর্তায় বৈকি। তবে সমাজের সব পেশার লোকজন যখন আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছে, তখন শুধু শিক্ষককে কেন খালি পেটে আদর্শ আর আপোষহীনতার কঠিন ব্যায়াম করতে হবে? রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন, শিক্ষকদের আদর্শহীনতাকে পুরো সমাজের আদর্শহীনতা থেকে আলাদা করে দেখে লাভ নেই।

'নগরে আগুন লাগিলে দেবালয় কি এড়ায়?'