ধর্ষণের দায় নারীর নয়, পুরুষের!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 22 May 2017, 04:01 AM
Updated : 22 May 2017, 04:01 AM

এ কথা দিব্যি দিয়ে বলা যায় যে, মানুষমাত্রেরই (আপনি ছাড়া!) অন্যের ঘাড় ভীষণ প্রিয়। কারণ দোষ চাপানোর এমন প্রকৃষ্ট জায়গা আকাশ-পাতাল এক করলেও মিলবে না! নিজের দায় থাকলেও আমরা চটপট তা অন্যের দিকে দ্রুত 'পাস' করে দিই। আর মেয়ে হলে তো কথাই নেই।

আমাদের সমাজে মেয়েরা হচ্ছে 'নন্দ ঘোষ'। সব দোষ তাদের ঘাড়ে না চাপালে আমরা শান্তি-স্বস্তি পাই না। দেশ ঠিকঠাক মতো চলছে না, দায়ী হচ্ছে নারী নেতৃত্ব, (যেন ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা ইত্যাদি দেশ পুরুষ নেতৃত্বের হাত ধরে খুব ভালো চলছে।)

একটি নাবালিকাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, ধর্ষণ করল পুরুষ, কিন্তু বলা হবে, সব হচ্ছে মেয়েদের দোষ! কোনো পুরুষ অবদমিত যৌন ইচ্ছের বিকৃত প্রকাশ ঘটাবে, দায় চাপানো হবে নারীর ওপর, ওদের পোশাক ও আচরণের ওপর!

আসলে আমরা অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজে 'ভিকটিম' সেজে স্বস্তি পাই।

বনানীর ধর্ষণের ঘটনাটি নিয়েও যথারীতি দোষারোপ অব্যাহত রয়েছে। বেশির ভাগ পুরুষই মেয়ে দুটিকে দায়ী করছেন। কোনো কোনো নারীও ওই মেয়েদের দিকেই আঙুল তুলছেন। মেয়েদের উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহারের কারণেই ধর্ষণ হয়ে থাকে– এটা আমাদের দেশে খুব 'কমন' একটি মন্তব্য। বনানীর ঘটনাটির ক্ষেত্রে সবাই একযোগে এই ধরনের মন্তব্যই করছেন।

একজন তো বেশ জোরের সঙ্গে বলেছেন, মেয়েরা চোখের ইশারা না করলে কোনো পুরুষ অশালীন আচরণ করে না। বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, পিতৃতন্ত্রের ধারক-বাহকরা এমন ধরনের কথাই বলে থাকেন। এ ধরনের মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করা নিশ্চয়ই উচিত কাজ।

নিরন্তর ধর্ষণ হয়ে চলছে, নিরন্তর মেয়েদের ওপরেই দোষারোপ চলছে– এটি কোনো সভ্য সমাজের রীতি হতে পারে না। কিন্তু মর্মান্তিক সত্য এটাই যে, এ দেশের বহু নাগরিক, মুখে উচ্চারণ না করলেও, মনে মনে এই মতই পোষণ করেন যে, মেয়েরা নিজেদের দোষেই লাঞ্ছিত হয়ে থাকে। উচ্চারণ করলে তবেই ব্যাধি ধরা পড়ে। এই ব্যাধি কিন্তু সুগভীর, পরিব্যাপ্ত, 'প্রজন্ম হইতে প্রজন্মে বাহিত'।

কেন এমন ঘটে? কেন বহু পুরুষ এবং সম্ভবত বহু নারীও মেয়েদের লাঞ্ছনার জন্য মেয়েদেরই দায়ী করেন? কেন পুরুষতন্ত্র এমন ধারণা লালন করে? সম্ভবত তার একটি কারণ, পুরুষতন্ত্রের তান্ত্রিকদের নিজেদের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি নিজেকে সংযত রাখতে পারবে, এমন ভরসাটুকুও নেই। অতএব পুরুষতন্ত্র ধর্ষণের দায় চাপিয়ে দেয় মেয়েদের উপর। এভাবে সে নিজের কৃতকর্মের পাপস্খালনের চেষ্টা করে থাকে।

কথায় কথায় সামাজিক স্থিতি ও পবিত্রতার অজুহাত খাড়া করে মেয়েদের দায়ী করতে তৎপর হয়, সেই দোষারোপে তার সহায় হয় দীর্ঘকালের লালিত সামাজিক ধারণা, যে ধারণা বহুলাংশে পুরুষতন্ত্রেরই সন্তান। দায় অন্যের ঘাড়ে না চাপাতে পারলে সেই কাজের দায়িত্ব নিতে হবে এবং সর্বোপরি নিজের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। যে জবাবদিহি হয়তো পুরুষতন্ত্রের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে।

কারণ, পুরুষতন্ত্র ক্ষমতার তন্ত্র। আর ক্ষমতা নিজেকে প্রশ্ন করতে চায় না। নিজের কাছে জবাবদিহি করতে তো নয়ই। স্বাভাবিক। প্রশ্ন করলে সব কাজের কারণ দর্শাতে হয় এবং ফলের দায়িত্ব নিতে হয়। এ দুটিই অতি বিষম কাজ। অতএব পুরুষতন্ত্র আপন অন্যায়ের দায় ক্রমাগত মেয়েদের উপর চাপিয়ে দিতে প্রবৃত্ত হয়।

এই রীতি কেবল পুরুষের বা পুরুষতন্ত্রের নয়। এটা সামগ্রিকভাবেই ক্ষমতার স্বভাব। যেখানেই ক্ষমতা, সেখানেই এটা দেখা যায়। উচ্চপদস্থ কর্মচারী অধস্তন কর্মচারীর ওপর অন্যায় জুলুম করে থাকেন, চাকরিরত বড় ভাই বেকার ভাইয়ের ওপর অন্যায় রাগ দেখিয়ে থাকেন।

ঘরে বা বাইরে, ক্ষমতা কোনো অবস্থাতেই নিজের দায় স্বীকার করতে চায় না। আবার সেই কারণেই ক্রমাগত ক্ষমতাতন্ত্রকে কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলা দরকার। 'ক্ষমতাকে সত্য বলার' গুরুত্ব এখানেই। মেয়েদের লাঞ্ছনার জন্য মেয়েদেরই দায়ী করার যে কোনো চেষ্টাই তাই প্রবল প্রতিবাদের যোগ্য।

'সামান্য একটু-আধটু অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ' আমাদের দেশে আমলে নেওয়া হয় না। এই 'সামান্য স্পর্শ' একসময় তার নিজস্ব মাত্রা হারায়। এটা জবরদস্তি বা ধর্ষণ পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু পুরুষরা যখন নারীদের শরীরে অন্যায় ও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে স্পর্শ করে, সেটা কেউ আমলে নেয় না। অভিভাবকদের জানালে বলেন, "ওতে কী হয়েছে?"

এদিকে ধীরে ধীরে এই মাত্রা ছাড়িয়ে ঘর থেকে বাইরে, গ্রাম থেকে শহরে, লোক থেকে লোকান্তরে ছড়িয়ে পড়ে!

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক প্রকাশিত 'ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইম্যান সার্ভে ২০১৫' শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিবাহিত নারীদের ৮০ দশমিক ২ শতাংশ স্বামী ও শ্বশুরপক্ষীয়দের দ্বারা কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার। সে নির্যাতন শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক বা যৌন হতে পারে। শহর এলাকায় এ হার ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৭৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ৪১ শতাংশ নারী স্বামীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার।

এটা হচ্ছে ঘরের ভেতরে 'আপন' মানুষ দ্বারা নির্যাতনের চিত্র। ঘরের বাইরে 'পর' মানুষ দ্বারা নির্যাতনের চিত্র এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। কী ঘরে কী বাইরে, নারীর অবস্থান যখন এরকম তখন একজন-দুজন ধর্ষকের বিচার চেয়ে খুব কী লাভ হবে?

আমরা আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নারীদের জন্য মোটেও সহায়ক হিসেবে তৈরি করতে পারিনি। এখানে একটি মেয়ে একবার ধর্ষণের শিকার হলে তাকে প্রতিনিয়ত বৈরিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সহানুভূতি, সহমর্মিতার পরিবর্তে সবখানে সন্দেহ, ভ্রূকুটি নিয়ে এগোতে হয়। ধর্ষণের পর পুরুষ চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করানো, পুরুষ ইনস্পেক্টর দিয়ে তদন্ত বা ট্রাইব্যুনালে পুরুষ আইনজীবী দিয়ে মামলা সহায়তা– এগুলো মোটেও নারী-সহায়ক নয়।

এমনকি কোনো কোনো গণমাধ্যম পর্যন্ত ধর্ষককে অনুসরণ না করে মেয়েটিকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি বার বার ধর্ষিত হয় ঘরে–বাইরে–চিকিৎসালয়ে–আদালতে!

বনানীর ঘটনাটি আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এসবই ইতিবাচক আলামত। সমাজে নারীর প্রতি সংবেদনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। এসব প্রতিক্রিয়া–প্রতিবাদের দরকার আছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, দু-চারজন সাদনান, সাফাত, নাঈমকে শাস্তি দিলেই কিন্তু সমস্যা মিটবে না। যেখানে গোটা সমাজ 'সাদনান-সাফাত-নাঈমে' পরিপূর্ণ, সেখানে একটি-দুটি মেয়ের জন্য আহাজারি করে সমাজে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না।

সমাজে ক্রমবর্ধমান 'সাদনান-সাফাত-নাঈম'দের কীভাবে মানুষ করা যায় কিংবা নির্মূল করা যায়, সেটা ভাবা অধিক জরুরি। এক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে পুরুষদেরই। কারণ নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের অভিযোগের আঙুলটা তাদের দিকেই তাক করা! কিন্তু পুরুষরা কি সেই দায়িত্ব নেবে? ধর্ষক পুরুষদের জব্দ করতে একযোগে এগিয়ে আসবে? কিংবা 'মায়ের কসম' খেয়ে (মুখে তো দেখি সব পুরুষই চরম মাতৃভক্ত!) কোনো শপথ উচ্চারণ করবে?

মনে হয় না! অনেককেই তো দেখি কেবল মজা লুটতে চায়; প্রকাশ্যে, গোপনে, সরাসরি কিংবা পরোক্ষে!

তসলিমা নাসরিন তো মিথ্যে বলেননি:

"ধর্ষণ আর যা কিছুই হোক, যৌনসঙ্গম নয়। ধর্ষণ কেউ যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য করে না। প্রায় সব ধর্ষকেরই স্থায়ী যৌনসঙ্গী আছে। ধর্ষণ নিতান্তই পেশির জোর, পুরুষের জোর, আর পুরুষাঙ্গের জোর। মোদ্দা কথা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পরম পূজনীয় পুরুষাঙ্গের ন্যাড়া মাথায় মুকুট পরানো বা বিজয় নিশান ওড়ানোর আর এক নাম ধর্ষণ।

"ধর্ষণ বন্ধ হবে কবে, অথবা কী করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে? এই প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো উত্তর: 'যে দিন পুরুষ ধর্ষণ করা বন্ধ করবে, সে দিনই বন্ধ হবে ধর্ষণ।'

"কবে, কখন বন্ধ করবে, সে সম্পূর্ণই পুরুষের ব্যাপার। সম্মিলিত ভাবে সিদ্ধান্ত নিক যে এই দিন থেকে বা এই সপ্তাহ থেকে বা এই মাস থেকে বা এই বছর থেকে নিজের প্রজাতির ওপর ভয়াবহ বীভৎস এইসব নির্যাতন তারা আর করবে না।"