ফ্রান্সের নির্বাচন ও বিশ্বায়নের অতুষ্টি

সাব্বির আহমেদ
Published : 11 May 2017, 12:19 PM
Updated : 11 May 2017, 12:19 PM

ইউরোপ-আমেরিকার খেটে-খাওয়া মানুষ 'বিশ্বায়ন' এবং সেই সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করা শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে দিনকে দিন তাদের মনোভাব জোরালোভাবে প্রকাশ করছে। যার প্রকাশ দেখা গেল ব্রিটেন, আমেরিকা, ইতালি, গ্রিস, স্পেন, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্সে। আগামী সেপ্টেম্বরে দেখা যাবে জার্মানির জাতীয় নির্বাচনে।

সর্বশেষ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম পর্বে এতকাল ধরে পালাবদল করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনাকারী সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের হারিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় পর্বে মুখোমুখি হয়েছেন রাজনীতিতে একেবারে নতুন, প্রাক্তন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার, ৩৯ বছর বয়সী ইমানুয়েল মাক্রোঁ এবং বিশ্বায়ন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অভিবাসন ও ইসলামভিত্তিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার মেরিন লি পেন। মাক্রোঁ প্রেসিডেন্ট ওঁলাদের পরামর্শক এবং জুনিয়র অর্থনীতি মন্ত্রী হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্বাচনী রেস থেকে ফ্রান্সের জনগণ প্রথমেই বাদ দিয়ে দিয়েছে মূলধারার রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন সোশ্যালিস্ট দলের বেনট হ্যামন্ড, ডানপন্থী লা রিপাবলিকান দলের ফ্রাঁসোয়া ফিলন এবং কড়া বাম, লা ফ্রান্স ইনসৌমাইজ দলের জঁ লুক মেলেনশনকে।

অভিজ্ঞ সব রাজনৈতিক নেতাদের বাদ দিয়ে ফ্রান্স কেন আনকোরা মাক্রোঁ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী লি পেনকে বেছে নিয়েছে তা বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। মাক্রোঁ রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে মধ্যপন্থী, অর্থনীতিতে উদারপন্থী, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তথা বিশ্বায়নের পক্ষের, অভিবাসনের বিরুদ্ধে নন।

অন্যদিকে লি পেন রাজনীতিতে চরম ডানপন্থী, অর্থনীতিতে রক্ষণশীল পুঁজিবাদী, খেটে-খাওয়া মানুষের স্বার্থের পক্ষে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে, ইসলামবিদ্বেষী এবং অভিবাসনের ঘোরতর বিরোধী। বামপন্থীরা দ্বিতীয় পর্বে সুযোগ না পাওয়ায় ভোট দিয়েছে মধ্যপন্থী মাক্রোঁকে।

মাক্রোঁ বামপন্থীদের সঙ্গে সঙ্গে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছেন ডানপন্থীদের। মূলধারার সব ফ্রেঞ্চ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া, ইউরোপ-আমেরিকার সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো আদাজল খেয়ে নেমেছিল লি পেনকে হারিয়ে দিতে; অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে মাক্রোঁকে। খোদ ইউরোপিয়ান কাউন্সিল প্রধান জঁ-ক্লদ জাংকার প্রথা ভেঙে তাঁকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন। পশ্চিমা দুনিয়ার কায়েমি স্বার্থবাদীরা যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে চেয়েছে লোকরঞ্জনবাদী (পপুলিস্ট) লি পেনের পরাজয়।

পপুলিজমের (লোকরঞ্জনবাদ) উৎস খুঁজতে গিয়ে ব্রিটিশ সাপ্তাহিক 'দ্য ইকোনমিস্ট' ১৮৯০ দশকের আমেরিকায় শহুরে এলিটদের বিরুদ্ধে গ্রামীণ জনগণের আন্দোলন এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের রাশান কৃষকদের নারোদনিশেস্তভ আন্দোলনকে শনাক্ত করেছে। ১৯৫০এর দশকে ফ্যাসিজম ও কমিউনিজমকে 'লোকরঞ্জনবাদী' বলে আখ্যায়িত করেছে পশ্চিমের সাংবাদিকরা। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত লোকরঞ্জনবাদীদের মধ্যে রয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, অস্ট্রিয়ার গিরট ওয়াইল্ডার, ইতালির গ্রিল্লো বেপ্পে, পোল্যান্ডের জারস্লাও কাচয্যন্সকি, ফ্রান্সের মেরিন লি পেন, বলিভিয়ার ইভো মোরালেস ও ফিলিপাইনের রড্রিগো দুতার্তে।

লোকরঞ্জনবাদীরা একেক দেশে একেক কালে একেক বিষয় নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। কখনও তারা ক্যাথলিক, কখনও-বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, বর্ণবাদী। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি, সরকারি ব্যয়, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তারা বিভিন্ন সময়ে সোচ্চার হয়েছেন; জনসমর্থন অর্জন করেছেন।

লোকরঞ্জনবাদ যখন যেখানে যেমন থাকুক না কেন একটি বিষয় সবসময় ঠিক থেকেছে; তা হল, এরা সবসময় অভিজাতদের কাছ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। লি পেন তাই করতে চেয়েছেন বলে কায়েমি স্বার্থবাদীরা তাঁর উত্থান ঠেকাতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিলেন। লোকরঞ্জনবাদে সবকিছু খেটে-খাওয়া মানুষের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য হলেও সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি সবসময় উপেক্ষিত থেকেছে। অনেক লোকরঞ্জনবাদী কালের বিবর্তনে কায়েমি স্বার্থবাদীতে রূপান্তরিত হয়েছে যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমেরিকার ডেমোক্রেটিক পার্টি।

লোকরঞ্জনবাদকে কায়েমি স্বার্থবাদীরা (যাকে ইংরেজিতে 'এস্টাবলিস্টমেন্ট' বলা হয়) সবসময় ভয় পায়। কারণ লোকরঞ্জনবাদ জেগে উঠলে পুঁজিবাদী অর্থনীতিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক অভিজাত, মূলধারার গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকেন্দ্রিক যে ক্ষমতা বলয় তা ধসে গিয়ে ক্ষমতা চলে যায় সাধারণ মানুষের হাতে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কে হারাতে চায়! তাই তো দেখা যায় বিশ্বজুড়ে লোকরঞ্জনবাদীদের বিরুদ্ধে কায়েমি স্বার্থবাদীরা বা অভিজাতরা একাট্টা।

লোকরঞ্জনবাদ পশ্চিমা অভিজাতদের কাছে একটা 'গালি'। যেমন তারা গালি বানিয়ে ফেলেছিল কমিউনিজমকে। অভিজাতরা একাট্টা হয়ে ব্রেক্সিট ঠেকাতে কিংবা ট্রাম্পকে ও রড্রিগো দুতার্তেকে হারাতে না পারলেও হারিয়ে দিয়েছে গিরট ওয়াইল্ডার, জারস্লাও কাচয্যন্সকি ও মেরিন লি পেনকে। লি পেনের ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং ভারতের বিজেপির মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য না থাকলেও পশ্চিমা দুনিয়া দুই ক্ষেত্রে দুই ভূমিকা নিয়েছে– লি পেনকে হারিয়েছে, মোদীকে জিততে সাহায্য করেছে।

পশ্চিমের কায়েমি স্বার্থবাদীরা একাট্টা না হলে লি পেনকে হারানো যেত না। লি পেনের পেছনে রয়েছেন পিছিয়ে-পড়া, খেটে-খাওয়া জনসাধারণ ও চরম বেকারত্বের শিকার তরুণ ভোটাররা। ব্রেক্সিট ও ট্রাম্পের জয়ের পর লি পেন জিতে গেলে বড়সর রাজনৈতিক ধাক্কা খেত পশ্চিমা দুনিয়া পরিচালিত চলমান বিশ্বব্যবস্থা।

পশ্চিমের লোকরঞ্জনবাদীরা বেশ কয়েকটি কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিশ্বায়ন, ইসলামভিত্তিক সন্ত্রাস ও অভিবাসন। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যাপী উদারনৈতিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন। সে সময় থেকেই বর্তমান বিশ্বায়ন পর্বের শুরু।

রিগ্যান ক্ষমতা ছাড়েন ১৯৮৯ সালে, থ্যাচার ১৯৯০ সালে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায় ১৯৯১ সালে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর পশ্চিম-প্রবর্তিত মুক্তবাজার অর্থনীতি কোনো বাধা ছাড়া প্রাক্তন সোভিয়েত দেশগুলোসহ বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করে। মুক্তবাজার অর্থনীতিকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা রেখেছে আন্তর্জাতিক সংগঠন জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)।

পশ্চিমা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বায়ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেছে। এদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়েছে দরিদ্র দেশগুলোতে। না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর জন্য বিশ্বায়নের নিয়ম মেনে চলার শর্তে খাদ্য সাহায্য দিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। অন্যত্র পশ্চিমাদের পণ্য বিক্রয়ের সুবিধা করে দিতে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ঋণ দিয়েছে বিশ্বায়নের শর্তে।

পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বিশ্বায়নের নামে গুটিকয়েক বিলিয়নিয়ারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সুরক্ষা করে তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছে। সার্বিক অর্থে বিশ্বায়ন ঘটানোর প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রধান অর্থনীতি উপদেষ্টা, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎস ২০০২ সালে প্রকাশিত 'Globalization and Its Discontent' বইয়ে লিখেছেন:

"অল্পকিছু কায়েমি স্বার্থবাদী যারা গরিব দেশের উৎপাদিত পণ্য দ্বারা লাভবান হয়েছে, নিজেদের অর্থনীতি রুদ্ধ রেখে ভণ্ডামি করে উন্নয়নশীল দেশকে সাহায্য করার নামে তাদের অর্থনীতিকে উন্নত বিশ্বের জন্য মুক্ত করতে বাধ্য করেছে। এর ফলাফল হয়েছে: ধনী আরও ধনী হয়েছে; দরিদ্র আরও দরিদ্র এবং দিনদিন বাক্রুদ্ধ হচ্ছে।"

স্টিগলিৎস তাঁর উপরোল্লিখিত বইয়ের ভূমিকায় বিশ্ব ব্যাংক ও হোয়াইট হাউসের নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় ত্বত্তের সঙ্গে কীভাবে রাজনীতি এবং কায়েমি স্বার্থ যুক্ত হয়ে তত্ত্বকে আমূলে বদলে দিয়ে নীতি নির্ধারণ করা হয় তার বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। আজ থেকে ১৫ বছর আগে স্টিগলিজের বইটি প্রকাশ হলেও তা থেকে শিক্ষা নেননি সারাজাহানের মোড়লগণ; বাস্তবায়ন করেননি তাঁর পরামর্শগুলো।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপিয়ে দেওয়া বিশ্বায়নের নীতি আমাদের এখানে কীভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে তার দুয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

সত্তরের দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সরকারের আগে পর্যন্ত কোনো বিনিয়োগ হয়নি রেল লাইনে কিংবা প্রকৃতিপ্রদত্ত নৌপথে। আমাদের নদীতে বাঁধ দিয়ে, কৃষিজমি ভরাট করে রাস্তা বানানো হয়েছে জাপান, ইউরোপের গাড়ি আর মধ্যপ্রাচ্যের তেল বিক্রির জন্য। বিশ্বায়নের ফলে এখানে পোশাক শিল্পের প্রসার ঘটেছে এ কথা যেমন ঠিক তেমনি এ কথাও ঠিক যে, আমাদের কাছ থেকে পাঁচ ডলারে জামা কিনে ৩০ ডলারে তা কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে পশ্চিমের খেটে-খাওয়া মানুষদের। মাঝখানের ২৫ ডলার গুটিকয়েক কায়েমি স্বার্থবাদীদের পকেটে।

পোশাক শিল্পের অগ্রগতির মাধ্যমে আমরা বছরে ২৪-২৫ বিলিয়ন ডলার পাই। যার বেশিরভাগ খরচ হয় উন্নত দেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল কিনতে; নিট পাওয়া সামান্যই। অন্যদিকে বিশ্বায়নের নামে আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রগুলোর ইজারা নিয়ে লুটেপুটে খাচ্ছে বিশ্বায়নের মালিকরা। গরিব দেশে কৃষিপণ্য কম খরচে উৎপাদন হয়; রয়েছে অসংখ্য বেকার শ্রমিক। উন্নত দেশে কৃষিপণ্য রপ্তানির পথে রয়েছে হাজার প্রতিবন্ধকতা, মাত্র অল্পকিছু উচ্চশিক্ষিত তরুণের রয়েছে সেখানের শ্রমবাজারে প্রবেশাধিকার।

বিশ্বায়নের নামে শুধুই গরিব দেশগুলোর সম্পদের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে উন্নত বিশ্বের গুটিকয়েক ধনী লোক; রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করেছে তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র।

বিশ্বায়নের প্রভাব শুধু গরিব দেশগুলোর গরিব মানুষগুলোর উপরই পড়েনি, পড়েছে উন্নত দেশের গরীব মানুষগুলোর উপরেও। শ্রম এবং কাঁচামাল যেখানে সহজলভ্য সেখানেই ছুটে গেছে বিশ্বায়নের মালিকেরা। নিজেদের দেশের কারখানা বন্ধ করে তারা কারখানা বানিয়েছে সস্তা শ্রমিকের এবং কাঁচামালের দেশে। ফলে উন্নত দেশগুলোতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কোটি কোটি মানুষ। নিজেদের দেশে শ্রমের মূল্য আরও কমাতে অন্যদেশ থেকে অভিবাসনের মাধ্যমে তারা আমদানি করেছে সস্তা শ্রমিক। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে জনসেবামূলক কাজ থেকে বিরত রেখেছে রাষ্ট্রকে; বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে স্বাস্থ্যসেবারও। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়তে বাড়তে চরমে পৌঁছেছে; বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। পশ্চিমে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমেছে। সারা দুনিয়ার ৯০ শতাংশ সম্পদ জমা হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে।

উন্নত দেশগুলোর সাধারণ মানুষকে বিশ্বায়নের চরম মূল্য দিতে হয়েছে ২০০৮ সালের আর্থিক ব্যবস্থা ধসের পর। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে ব্যাংকগুলোতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমাতে কমাতে এমন পর্যায়ে আনা হয়েছিল যে, তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। ফল হয়েছে অর্থবাজার 'ক্রাশ' এবং দীর্ঘ অর্থনৈতিক মন্দা যা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওইসব অর্থনীতি।

২০১০-১২ সালে দারিদ্র্য নেমে এসেছিল ইউরোপ-আমেরিকার ঘরে ঘরে। আধপেটা খেয়ে, চিকিৎসা না পেয়ে, ঋণ শোধ করতে না পেরে ব্যাংকের কাছে বন্ধকি ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে তাঁবুতে বসবাস করতে হয়েছে সেসব দেশের সাধারণ মানুষদের। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমেছেন প্রতিবাদে। ইউরোপ, আমেরিকার শহরে শহরে হয়েছে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ। হয়েছে 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট মুভমেন্ট'। একই দিনে উন্নত বিশ্বের ৮০টি শহরে হয়েছে প্রতিবাদী মানুষের মিছিল। পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়েছেন, জেল খেটেছেন সাধারণ মানুষ। যাদের জন্য ইউরোপ, আমেরিকায় এসব ঘটেছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন ভোটাররা। ভোট দিচ্ছেন সাধারণ মানুষের পক্ষে যারা কথা বলেছেন তাদের হয়ে।

এ ফাঁকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন বার্নি স্যান্ডার্স, ডোনাল্ড ট্রাম্প, জেরেমি করবিন, মেরিন লি পেন, গিরট ওয়াইল্ডার, গ্রিল্লো বেপ্পে, জারস্লাও কাচয্যন্সকি। যাদের জন্য ঘটেছে অর্থনৈতিক মন্দা তারাই আজ মেরিন লি পেনদের গালি দিচ্ছেন লোকরঞ্জনবাদী বলে; ঠেকাতে চাচ্ছেন খেটে-খাওয়া মানুষের উত্থান।

তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বায়ন খারাপ কিছু নয়– এ কথা সবাই জানে। কিন্তু বিশ্বায়নের ধারণাটা যেভাবে ধনী লোকেদের পকেট আরও ভারী করার জন্য ব্যবহার হয়েছে সেটা খারাপ। পশ্চিমের অভিজাত শ্রেণি জেনে-শুনে-বুঝে এই খারাপ কাজ করে যাচ্ছে। সে কথা বুঝে উঠেছের সেসব দেশের সাধারণ মানুষ। আমাদের মতো দেশে অল্পকিছু মানুষ এ কথা বুঝে থাকলেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের চাপে, লোভে মুখ বুজে আছের। সাধারণ আলোচনায় আসছে না তথাকথিত বিশ্বায়ন।

বর্তমান বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একদিকে যেমন প্রকাশ্যে যুদ্ধ করে চলছে তেমনি অনেক ক্ষেত্রে বৈশ্বিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে সমঝোতা করছে। বিশ্বায়নের নামে সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত চরিত্র সাধারণ আলোচনায় উঠে এলে সরকারের জন্য যুদ্ধটা এগিয়ে নেওয়া সহজ হবে। ঠিক সে কাজই শুরু হয়েছে পশ্চিমের দেশে দেশে। মানুষ জেগে উঠেছেন স্যান্ডার্স, করবিন, লি পেনদের ডাকে।

ট্রাম্প, লি পেন, গিরট ওয়াইল্ডার, জারস্লাও কাচয্যন্সকিদের ডাকের মধ্যে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। দুর্বলতা নেই স্যান্ডার্স আর করবিনের ডাকে। বিশ্বায়নের নামে গরিবের রক্ত শুষে ধনীদের পকেট ভারী করার দিন শেষ হয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত থামবে না লোকরঞ্জনবাদের এগিয়ে চলা। জেগে উঠেছে পশ্চিমের মানুষ। আমাদের ঘুম ভাঙবে কবে?