বিএনপির পরবর্তী নেতা কে?

স্বদেশ রায়
Published : 10 May 2017, 04:10 AM
Updated : 10 May 2017, 04:10 AM

হাওড়ে বিপুল পরিমান ফসলহানির পর বিএনপির তরফ থেকে দাবি তোলা হয়: ওই এলাকাকে 'দুর্গত এলাকা' ঘোষণা করা হোক। বিএনপির এ দাবি আওয়ামী লীগ মেনে নেয়নি। তবে বিএনপি এ দাবি তোলার পরে একজন সাংবাদিক হিসেবে অতীতের বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাজ পর্যালোচনা করে এমনটি ভেবেছিলাম, বেগম জিয়া শিগগিরই ওই এলাকায় যাবেন এবং ওই এলাকায় কয়েকটি জনসভা করে তাঁর দাবি আরও জোরদার পর্যায়ে নিয়ে আসবেন।

বিএনপির এ দাবির পরপরই মিডিয়ার মাধ্যমে জানা গেল, প্রধানমন্ত্রী হাওড় এলাকায় যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর স্বাভাবিকভাবে অপেক্ষা করতে থাকি বেগম জিয়ার হাওড়ে যাওয়ার দিনও শিগগিরই ঘোষণা দেওয়া হবে; যেহেতু এ দেশের রাজনীতির একটা বড় ইস্যুই হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরা।

১৯৯১ সালে শেখ হাসিনাকে যেভাবে চট্টগ্রামে ঘূর্ণি-দুর্গত এলাকায় ঘুরতে দেখেছি তা ছিল অবিশ্বাস্য। যে ছোট নৌকায় তিনি চড়ে ছিলেন, রির্পোটার হয়েও সে নৌকায় উঠতে সাহস করিনি, প্রকৃত অর্থে সাঁতার জানি না বলে। পরে ট্রলারে তাঁর পিছে পিছে যাই। সরকারপ্রধান হিসেবে বেগম জিয়া গিয়েছিলেন অনেক পরে। তারপরও তিনি বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা যেসব দুর্গম এলাকায় গিয়েছিলেন, সেসব জায়গায় যাননি।

বিরোধী রাজনীতিকদের যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ একটি বাড়তি সুবিধা। এ কারণেই মনে করেছিলাম অনেকটা বিরোধী রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়া বিএনপি ও তার নেত্রী বেগম জিয়া হাওড়ের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে। শেষ অবধি দেখা গেল শেখ হাসিনা নেত্রকোনা হাওড় এলাকায় যাওয়ার দিন ঘোষণা করেছেন, অন্যদিকে মীর্জা ফখরুল জানিয়ে দিয়েছেন, বিএনপি থেকে একটি টিম গিয়েছিল, অতত্রব বেগম জিয়ার আর যাওয়ার দরকার নেই।

সংবাদ সম্মেলনে মীর্জা ফখরুলের এ বক্তব্যর পরে মনের ভেতর প্রশ্ন জাগে: কী এমন ঘটল যে বেগম জিয়া হাওড় এলাকায় যাচ্ছেন না। সাংবাদিক হিসেবে অনেকগুলো কারণ এ ক্ষেত্রে মাথায় আসবে। সে কারণগুলোর একটার পর একটা খোঁজ নিতে থাকি। শেষ যে তথ্যটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, তা হল বেগম জিয়ার শারীরিক অক্ষমতা।

বেগম জিয়ার এক ফিজিওথেরাপিস্টের কাছ থেকে জানতে পারি, তিনি এখন রাতে ঘুমালে সকালে কারো সাহায্য ছাড়া উঠতে পারেন না। সকালে ওঠার পরে তাঁকে দীর্ঘসময় ফিজিওথেরাপি নিতে হয়, তারপরে তিনি পা টেনে টেনে সামান্য হাটতে পারেন। খুব বেশি হাঁটতে পারেন না। তখন বুঝতে পারি বেগম জিয়া কেন হাওড় এলাকায় যেতে পারলেন না। বুঝতে পারি অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বেগম জিয়া হাওড় এলাকায় যাওয়া থেকে বিরত থাকেননি। বরং তিনি ও তাঁর দলের নেতারা শারীরিক বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন। তারা হয়তো মনে করেছেন, বেগম জিয়ার শরীরের প্রকৃত অবস্থা জেনে গেলে তাদের প্রতিপক্ষ এর সুযোগ নেবে।

জিন্নার ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ নেতারা এমনভাবে গোপন করেছিলেন। তবে বাস্তবে বিএনপি নেতারা এমন ভেবেছেন কি না তার কোনো তথ্য নেই, ধারণা মাত্র।

তবে বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থাটি বাস্তবতা। বার্ধক্য, জরা কোনো একটা পর্যায়ে মানুষকে এমনি করেই থামিয়ে দেয়। আমাদের প্রত্যেকের জন্যে একই নিয়তি কোনো না কোনোভাবে অপেক্ষা করছে। এটা যে শুধুমাত্র বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে ঘটছে তা-ও তো নয়, এই তো এখনও বর্তমান আছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। তাঁরও বেগম জিয়ার মতো বার্ধক্যের সঙ্গে একই ধরনের শারীরিক জটিলতা হয়। তিনিও চলাফেরার ক্ষমতা দিন দিন হারিয়ে ফেলেন। যার ফলে নেতৃত্ব সংকটে পড়ে যায় বিজেপি। তাদের দশ বছর অপেক্ষা করতে হয় একজন নরেন্দ্র মোদির জন্যে।

এখন প্রশ্ন হল অটল বিহারী বাজপেয়ীর শারীরিক অক্ষমতার ফলে বিজেপিকে দশ বছর অপেক্ষা করতে হয় একজন নরেন্দ্র মোদির জন্যে, বিএনপির ক্ষেত্রে কী হবে? বিএনপির অবস্থা কি ভারতের বিজেপির মতো হবে, তাদের কি আরও দশ বছর কারো না কারো জন্যে অপেক্ষা করতে হবে, না অন্য কিছু ঘটবে?

বিজেপি ও বিএনপির পার্টি-কাঠামোগত চরিত্র এক নয়। বিজেপি একটি ক্যাডারভিত্তিক পার্টি। অন্যদিকে বিএনপি পরিবারতন্ত্রে আটকা পড়া একটি দল। যেহেতু পরিবারতন্ত্রের মাধ্যমে তাদের নেতৃত্ব আসবে তাই অনেকে বলতে পারেন– বেগম জিয়ার এই শারীরিক অক্ষমতার পরেও বিএনপির কোনো অসুবিধা নেই। বেগম জিয়ার অবর্তমানে তাঁর ছেলে তারেক রহমান বিএনপির নেতা হবেন। বেগম জিয়া তেমনটিই ভেবেছিলেন। তিনি সেভাবে তারেক রহমানকে সামনে এনেছিলেন। সেখানে তিনি সফল হননি।

বিএনপির ভক্তরাও বলেন, বিএনপি ডুবেছে তারেক রহমানের জন্যে। তারেক রহমান বিএনপির কিছু অসৎ কর্মীর কাছে জনপ্রিয়, তবে বিএনপির সিনিয়র ও শিক্ষিতজনের কাছে মোটেই জনপ্রিয় নন। তাছাড়া চট্টগ্রাম অস্ত্র চোরাচালান ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ওই দুই মামলার আসামীদের জবানবন্দিতে বেরিয়ে এসেছে।

মুফতি হান্নান তার জবানবন্দিতে স্পষ্ট বলেছে, তারেক রহমান হাওয়া ভবনে তাকে ডেকে নিয়ে কীভাবে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে নির্দেশনা দেন। এসব কারণে আঞ্চলিক পর্যায়ে ও পশ্চিমা বিশ্বে তারেক রহমানকে দেখা হয় ভিন্নভাবে। মোটেই রাজনীতিক হিসেবে নয়। যদিও তিনি লন্ডনে আছেন, তারপরেও পশ্চিমা দুনিয়া তারেক রহমানকে অস্ত্র চোরাচালান ও জঙ্গি হামলার মদদদাতা হিসেবেই জানে।

পশ্চিমা দুনিয়ার এক প্রভাবশালী প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, আর যাই হোক তারেক রহমান কোনোদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন না। কারণ, আর্ন্তজাতিক বিশ্ব তা মেনে নেবে না।

সত্যিকার অর্থে বর্তমানের এই জঙ্গিকবলিত বিশ্বে ১৫ কোটি মুসলিমের একটি দেশে কোনো বড় দলের নেতা হিসেবে তারেক রহমানকে অভিষিক্ত করার অর্থই হল ওই দলটিকে 'পটাশিয়াম সায়ানাইড' খাইয়ে আত্মহত্যা করানো। তাই বর্তমানের আর্ন্তজাতিক প্রেক্ষাপটে ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে কোনো দলই সুস্থ মাথায় তারেক রহমানকে তাদের নেতা হিসেবে অভিষিক্ত করবে না।

একান্ত করতে বাধ্য হলে তার ভবিষ্যত কী কী হতে পারে তা নিয়ে লিখতে গেলে অনেক বড় হয়ে যাবে এ লেখা। তবে ফল কী হবে তা আগেই বলেছি, দল হিসেবে সেটা হবে তাদের হারিকিরি করা। তাছাড়া তারেক রহমানকে নেতা হিসেবে অভিষিক্ত করতে গেলে বিএনপি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ক্ষেত্র থেকে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হবে। আর্ন্তজাতিক বিশ্ব বিএনপিকে আরও বেশি জঙ্গি, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের সমর্থক দল হিসেবে চিহ্নিত করবে।

তারেক রহমানকে বাদ দিলে উত্তরাধিকার হিসেবে বিএনপির নেতা থাকেন তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়াদা রহমান। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ এই নারী এ মুহূর্তে আর যাই হোক, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে সরকারপ্রধান হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবেন না। এ মুহূর্তে জোবায়াদা রহমানকে নিয়ে যদি বিএনপিকে এগুতে হয়, আর জোবায়দা যদি জঙ্গি-পছন্দ এই বিএনপির হাল ধরতে চান তাহলে সে বিএনপির রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। তাদের নির্বাচনে যেতে হবে শুধুমাত্র দলটিকে টিকিয়ে রাখার জন্যে।

বাংলাদেশ ভূ -রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ও মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে এখন একটি জটিল সময় পার করছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে এখন আঞ্চলিক দুই পরাশক্তি চীন ও ভারতের সঙ্গে সমানভাবে সম্পর্ক রক্ষা করতে হচ্ছে। যে কারণে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এমন একজন ব্যক্তির দরকার যার চমৎকার দুটি দক্ষ হাত আছে। যে হাত দুটি দিয়ে তিনি নিজে পানি হয়ে এক হাতে অক্সিজেন অপর হাতে হাইড্রোজেন ধরে রাখার মতো এক হাতে চীন ও অপর হাতে ভারতকে ধরে রাখার যোগ্যতা রাখেন। এই পানির মতো নেতৃত্বের কোয়ালিটি এ মুহূর্তে শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশে আর কারো নেই। তা শুধু চীন ও ভারত স্বীকার করে না পশ্চিমা বিশ্বও স্বীকার করে।

অন্যদিকে এ মুহূর্তে পশ্চিমা বিশ্বের এমন একটি বাংলাদেশ দরকার, যে বাংলাদেশ কোনোদিকে হেলে না পড়ে চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে। তার ওপরে রয়েছে বর্তমানের মুসলিম জঙ্গিকবলিত বিশ্বে ১৫ কোটি মুসলিমের এই দেশকে শান্তিপূর্ণ ও জঙ্গিমুক্ত রাখা। এ যে কত বড় চ্যালেঞ্জ তা যাদের ধর্মীয় জঙ্গি নিয়ন্ত্রনের ওপর ন্যূনতম পড়াশোনা আছে বা ধর্মীয় জঙ্গিদের মানসিকতা সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন তারা বোঝেন।

তাছাড়া এটাও মনে রাখা দরকার, সারা বিশ্বের জঙ্গির মদদদাতা পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর একটা 'লিগ্যাসি' এখানে আছে; একটা যোগসূত্রও সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। তাই সবার কাছে স্পষ্ট; এ মুহূর্তে আর্ন্তজাতিক অঙ্গন কখনও চাইবে না বাংলাদেশের নেতৃত্ব এক অনভিজ্ঞ নারীর হাতে তুলে দিতে। এ বিষয়টি নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিএনপিকে অবশ্যই মাথায় নিতে হবে।

এ কারণে সব সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও এ মুহূর্তে যদি বিএনপির দিকে তাকানো হয়, তাহলে যে কোনো বাস্তববাদী মন ও চোখ বলবে: বেগম জিয়ার শারীরিক অক্ষমতার কারণে এ মূহূর্তে বিএনপির মূল নেতা হতে পারেন একমাত্র মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনিই কেবলমাত্র দেশে ও আর্ন্তজাতিক বিশ্বে গ্রহণযোগ্য হবেন। বিএনপি কি পারবে পারিবারিক বলয় থেকে বেরিয়ে এসে মীর্জা ফখরুলকে তাদের মূল নেতা হিসেবে গ্রহণ করতে?