‘নেত্রীত্ব’ বনাম নেতৃত্ব

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 17 May 2017, 04:48 AM
Updated : 17 May 2017, 04:48 AM

হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সাম্প্রতিক 'মায়াময়' বৈঠকের পর ইসলামের এক হেফাজতকারী নাকি বলেছেন: ইসলামে নারী 'নেত্রীত্ব'(নেতৃত্ব) নিষিদ্ধ। কথাটা নুতন নয়। দেশের অনেক আলেম-ইমাম নারী নেতৃত্বের বিরোধী এবং তারা গ্রামগঞ্জের কোটি মানুষকে প্রভাবিত করেন।

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে এক ইসলামি দল লিখিত স্মারকলিপি দিয়েছিল যেন সাংবিধানিকভাবে নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয় — ১৩ জুলাই ২০০৮।

১৮ জানুয়ারি ২০০৬ 'ভয়েস অব আমেরিকা' রেডিওর আলোচনায় আমার বিপক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতের সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট জেনারেল সেক্রেটারি জনাব মরহুম কামরুজ্জামান মিয়া অংশ নিয়েছিলেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল জামায়াত বহু বছর ধরে নারী নেতৃত্ব 'হারাম' বলার পরেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রীত্ব মেনে নিল কী করে? জবাবে তিনি বলেছিলেন:

"পরিস্থিতির কারণে জামায়াত নারী নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে।"

অর্থাৎ 'পরিস্থিতির কারণে' যাঁরা এতকালের 'হারাম'কে 'হালাল' করেছেন, ভবিষ্যতে তারা ওই 'পরিস্থিতির কারণে'ই সে হালালকে হারাম করতে পারেন এবং সেই পরিস্থিতি কখন কোথায় কীভাবে ঘটবে, সেটাও তারাই ঠিক করবেন। এটা অবশ্য নুতন কিছু নয়; এরকম উদ্ভট ও স্বার্থকেন্দ্রিক কিছু দাবি চিরকাল হয়েছে মুসলিম ইতিহাসে। যেমন, সুবিশাল ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ ইসলামি প্রকাশনা কেন্দ্রের 'দ্য ডকট্রিন অব ইজমা ইন ইসলাম — এ স্টাডি অব দ্য জুরিডিক্যাল প্রিন্সিপল অব কনসেন্সাস' বইয়ে (পৃষ্ঠা ১৬ – আহমেদ হাসান – কিতাব ভবন, নিউ দিল্লি ১১০০০২) দাবি করা হয়েছে:

"কোরানের কোনো আয়াত যদি আমাদের ইমামদের মতের বিরুদ্ধে যায় তাহা হইলে ধরিয়া লইতে হইবে যে ওই আয়াতটি বাতিল হইয়া গিয়াছে… ইহাই ভালো যে ওই আয়াতটি এমনভাবে ব্যাখ্যা করিতে হইবে যাহা ইমামদের মতের সাথে মিলে।"

কেউ চাইলে পৃষ্ঠাটার ফটোকপি পাঠানো যেতে পারে। ইসলাম নিয়ে এ কালখেলার অনেক মূল্য দিয়েছে ও দিচ্ছে বিশ্ব-মুসলিম। আমরা এখন দেখব নারী নেতৃত্বের ব্যাপারে (১) শরিয়া আইন কী বলে, (২) ইতিহাসের বাস্তবতা কী, (৩) রাসুল (সা.) কী বলেন এবং (৪) কোরান কী বলে।

(১) শরিয়া আইন:

শরিয়া আইনে নারী নেতৃত্ব সরাসরি নিষিদ্ধ যা কোরান, রাসুল (সা.) ও ইসলামি ইতিহাসের বাস্তবতার বিরুদ্ধে যায়, সূত্র-প্রমাণ নিচে দেওয়া হল। শরিয়া আইনটা বাংলাদেশের পাঠক যাতে মিলিয়ে দেখতে পারেন সেজন্য দেখাচ্ছি বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত 'বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন' বইয়ের ৩য় খণ্ডের ১৯৭ পৃষ্ঠায় ধারা ৯০০। 'রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা' আইনে আছে:

"রাষ্ট্রপ্রধানের পুরুষ হওয়াও অপরিহার্য শর্ত।"

'অপরিহার্য' মানে যাকে পরিহার করা বা বাদ দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু তার পরপরই কোনো এক রহস্যময় কারণে 'অপরিহার্য শর্ত' আর ততটা 'অপরিহার্য' থাকেনি। বলা হয়েছে:

"ইসলামি রাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ ফকীহগণ কোনো বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জাতির সার্বিক কল্যাণ বিবেচনা করিয়া উক্ত সর্বোচ্চ পদ নারীর জন্য অনুমোদন করিতে পারেন।"

অর্থাৎ তাদের অনুমোদন ছাড়া যোগ্য নারীও রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবেন না। এই সুবিশাল সিদ্ধান্ত কে বা কারা, কবে, কোথায়, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই কোন অধিকারে ও কিসের ভিত্তিতে ঠিক করল এবং এটা বিশ্ব-মুসলিম মানবেই বা কেন তা অবশ্য বলা হয়নি।

(২) ইতিহাসের বাস্তবতা:

আমাদের সময়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ইন্দোনেশিয়ায় রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন বেগম শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া, বেগম বেনজির ভুট্টো ও বেগম সুকর্ণপুত্রী। আর ইতিহাসে আছে মুসলিমপ্রধান দেশ মিসর, ইয়েমেন, ইরান, মধ্য এশিয়া, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ায় সার্বভৌম মুসলিম রানিরা শাসন করেছিলেন। তারা কোনো রাজাদের অলঙ্কার-মার্কা রানি ছিলেন না, তারা ছিলেন রাজদণ্ডধারী সার্বভৌম শাসনক্ষমতার অধিকারী মুসলিম রানি। তাদের কারো কারো নিজের নামে মুদ্রা ছিল, তাদের অনেকের নামে মওলানারা দোয়া (খুতবা) করতেন মসজিদে। ১৭ জন সার্বভৌম মুসলিম রানির উদাহরণ দিচ্ছি বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি বিশেষজ্ঞ ডক্টর ফাতিমা মার্নিসির বই 'ইসলামের বিস্মৃত রানিগণ' (দ্য ফরগটেন কুইনস অফ ইসলাম) পৃষ্ঠা ৯০-৯১ থেকে–

• ১২৩৬ সাল দিল্লি, মানুষের ইতিহাসে একমাত্র কুমারী রানি সুলতানা রাজিয়া। তখনকার খলিফা আমিরুল মুমেনিনের সমর্থনও পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর মুদ্রায় খোদাই করা আছে:

"সুলতান ইলতুৎমিসের কন্যা মালিকা ইলতুৎমিস, যিনি আমিরুল মুমেনিনের সম্মান বাড়ান।" মুদ্রাটা এখনও থাকার কথা কোলকাতার মিউজিয়ামে।

• ইরানের তুরকান অঞ্চলের রানি তুরকান খাতুন, ১২৫৭ থেকে ১২৮২ পর্যন্ত একটানা ২৫ বছর। মসজিদে তাঁর নামে খুতবা পড়া হত।

• তুরকান খাতুনের কন্যা পাদিশা খাতুন। নামাঙ্কিত মুদ্রা।

• ইরানের সিরাজ অঞ্চলে আবশ খাতুন। ১২৫৩ থেকে ১২৮৭, একটানা ৩৪ বছর। খুতবা ও নামাঙ্কিত মুদ্রা, দুটোই ছিল।

• ইরানের লুরিস্থান অঞ্চলের ১৩৩৯ সালের মুসলিম রানি (নাম জানা নেই)।

• রানি তিন্দু, ১৪২২ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত (জায়গা সম্বন্ধে মতভেদ আছে)।

• মালদ্বীপের সুলতানারা খাদিজা, মরিয়ম ও ফাতিমা। ১৩৪৭ থেকে ১৩৮৮, একটানা ৪১ বছর। এক সময়ে ইবনে বতুতা সেখানকার সরকারি কাজি ছিলেন।

• ইয়েমেনের সুলায়হি (শিয়া-খেলাফত?) বংশের দুই রানি আসমা ও আরোয়া, প্রায় ৫০ বছর রাজত্ব করেছেন। মসজিদে তাদের নামে খুতবা হত।

• ১২৫০ সালে মিসরের রানি সাজারাত আল দুর, ১২৫৭ থেকে ১২৫৯, মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত দুবছর। তাঁর নামে মুদ্রা ও মসজিদে খুতবা দুটোই। মামলুক খেলাফতের সমর্থনও পেয়েছিলেন তিনি।

• সুলতানা ফাতিমা, মধ্য এশিয়ায় কাসেমি খেলাফতের শেষ সার্বভৌম সুলতানা, শাসন করেছেন ১৬৭৯ থেকে ১৬৮১ দুবছর।

• ইন্দোনেশিয়ায় ১৬৪১ থেকে ১৬৯৯ পর্যন্ত ৫৮ বছর ধরে একটানা শাসন করেছেন সুলতানা শাফিয়া, সুলতানা নুর নাকিয়া, সুলতানা জাকিয়া, ও সুলতানা কামালাত শাহ। ওখানকার মওলানারা মক্কা থেকে ফতোয়া এনে সুলতানাদের উৎখাত করার চেষ্টা করেও পারেননি রানিদের জনপ্রিয়তার জন্য।

(৩) রাসুল (সা.):

নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কিছু হাদিস আছে কিন্তু সেগুলোতে নাম-ধাম জায়গা ও ঘটনার বিস্তারিত কোনো বিবরণ নেই। যেমন, মওলানা মুহিউদ্দীনের অনুদিত বাংলা কোরানের ব্যাখ্যার অংশ, পৃষ্ঠা ১২২০। নবীজি (সা.) নাকি বলেছেন:

"যখন তোমাদের শাসকবর্গ তোমাদের মন্দ ব্যক্তি হইবে, তোমাদের বিত্তশালীরা কৃপণ হইবে এবং তোমাদের কাজকর্ম নারীদের হাতে ন্যস্ত হইবে, তারা যেভাবে ইচ্ছা কাজ করিবে, তখন তোমাদের বসবাসের জন্য ভূপৃষ্ঠ অপেক্ষা ভূগর্ভই শ্রেয় হইবে।"

এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সবাই জানেন আমাদের সহি হাদিসের কিতাবগুলোতে অনেক পরস্পরবিরোধী হাদিস আছে। নাম-ধাম ঘটনার বিবরণহীন কোনো হাদিসের বিপক্ষে যদি নাম-ধাম ঘটনার বিবরণসহ কোনো হাদিস থাকে তবে পরেরটা গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, যদি তা থেকে সমাজের উপকার হয়।

'শারিয়া কী বলে, আমরা কী করি' বইতে আমি এরকম দুপক্ষেরই পরস্পরবিরোধী হাদিসের অজস্র উদাহরণ-উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছি। আরেকটা কথা না বললেই নয়। হাদিসের অনুবাদগুলোতে নম্বরের পার্থক্য আছে। আমি ব্যবহার করি মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহসিন খানের সহি বুখারির ৯ খণ্ডের অনুবাদ, দুনিয়ায় ওটাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বলে আমার ধারণা।

নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নাম-ধাম ঘটনার বিবরণসহ হাদিস পেয়েছি মাত্র একটি, তাও আবার মাত্র একজন সাহাবির বলা, এবং রাসুলের (সা.) মৃত্যুর সুদীর্ঘ ২৪ বছর পরে। এবারে সেই হাদিসটার ব্যবচ্ছেদ করা যাক।

নবীজির (সা.) তায়েফ আক্রমণের সময় কিছুতেই তায়েফের দুর্গ ভাঙা যাচ্ছিল না। তখন তিনি ঘোষণা করলেন দুর্গের ভেতর থেকে যে সব ক্রীতদাস পালিয়ে আসবে তারা সবাই মুক্ত হবে। শুনে অনেক ক্রীতদাস পালিয়ে আসে, ফলে দুর্গের পতন হয়। বালক আবু বাকরা [হজরত আবু বকর (রা.) নন] ছিলেন তাদের একজন।

এরপর ২৪ বছর চলে গেছে, নবীজি (সা.) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, আবু বাকরা তখন বসরা নগরের গণ্যমান্য নাগরিক। ঘটে গেল রক্তাক্ত 'জামাল যুদ্ধ' হজরত আলীর (রা.) বিরুদ্ধে হজরত আয়েশা-তালহা-যুবায়ের (রা.) দলের। যুদ্ধে হজরত আলী (রা.) জয়লাভ করে বিবি আয়েশাকে (রা.) সসম্মানে মদিনায় পাঠিয়ে দেওয়ার পর বসরায় প্রবেশ করে শহরের গণ্যমান্য লোকদের ডেকে পাঠান। আবু বাকরা তখন হজরত আলীকে (রা.) এই হাদিস শোনান–

নবীজির (সা.) সময় রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের আক্রমণে ইরানে খুব বিশৃঙ্খলা হয়েছিল। তখন সেখানে দুজন নেত্রীর আবির্ভাব হয়েছিল, সেকথা শুনে নবীজি (সা.) নাকি আবু বাকরাকে বলেছিলেন:

"আবু বাকরা বলিয়াছেন, জামাল যুদ্ধের সময় আমি সাহাবিদের সহিত যোগ দিয়া (বিবি আয়েশার পক্ষে) যুদ্ধে প্রায় নামিয়া পড়িয়াছিলাম, কিন্তু নবীর (সা.) একটি কথায় আল্লাহ আমাকে বড়ই উপকৃত করিয়াছেন। যখন নবীজিকে (সা.) বলা হইল যে (পারস্য সম্রাট) খসরুর মৃত্যুর পরে পারস্যের লোকেরা তাহার কন্যার উপর নেতৃত্ব অর্পণ করিয়াছে, তখন তিনি বলিলেন, 'কখনও উন্নতি করিবে না সেই জাতি যে জাতি তাহাদের নেতৃত্ব অর্পণ করে নারীর উপরে'।"

(সহি বুখারির ইংরেজী অনুবাদ, ড. মুহসিন খান, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় – পঞ্চম খণ্ড, হাদিস ৭০৯)

তাহলে আমরা পেলাম:

১। এ হাদিস জানার পরেও আবু বাকরা বিবি আয়েশার (রা.) পক্ষে যুদ্ধে "যুদ্ধে প্রায় নামিয়া পড়িয়াছিলাম", অর্থাৎ তিনি বিবি আয়েশার (রা.) পক্ষে যুদ্ধ করেননি;

২। এ হাদিস তিনি প্রকাশ করেছেন হজরত আয়েশা (রা.)পরাজিত হওয়ার পরে, আগে নয়;

৩। বলেছেন নবীজির (সা.) মৃত্যুর সুদীর্ঘ ২৪ বছর পর, তার আগে নয়;

৪। এ হাদিসে তিনি "বড়ই উপকৃত হয়েছেন";

৫। তিনি হজরত আলীকে (রা.) বলেছেন, অন্য কাউকে না জানালেও তিনি নাকি শুধু হজরত আয়েশাকে (রা.) জামাল যুদ্ধের আগে চিঠি লিখে এ হাদিসের কথা জানিয়েছিলেন;

৬। অনেক গুরুত্বপূর্ণ হাদিস নবীজি (সা.) বর্ণনা করেছেন অনেক সাহাবিকে, কিন্তু যে হাদিসের সঙ্গে কেয়ামত পর্যন্ত বিশ্বের সব মুসলিম নারীর সম্মান ও অধিকার বাঁধা, সেই অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ হাদিস নবীজি (সা.) বলেছেন শুধু তাকেই, আর কাউকেই নয় কিংবা বিদায় হজের খুতবাতেও নয়।

এবার হিসাবের কড়ি:

• আবু বাকরা বলেছেন, "আমি বড়ই উপকৃত হইয়াছি।" কীভাবে? তিনি কোনো নেতা বা রাজা-বাদশা ছিলেন না, কীভাবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বড়ই উপকৃত হলেন? তিনি তো বিবি আয়েশার (রা.)বিরুদ্ধে হজরত আলীর (রা.)পক্ষে যুদ্ধও করেননি।

• জামাল যুদ্ধে যদি আয়েশা (রা.) জিতে যেতেন, তবে কি তিনি এ হাদিস প্রকাশ করতেন? নিশ্চয়ই না, তিনি তো ২৪ বছরে কাউকেই এ হাদিস বলেননি।
• জামাল যুদ্ধ যদি না হত তবে তিনি এ হাদিস বলতেন কি? নিশ্চয়ই না, কারণ তিনি ২৪ বছরে কাউকেই এ হাদিস বলেননি।

এবারে প্রমাণ:

• চিঠিতে হাদিসের কথা জানানোর পরেও বিবি আয়েশা (রা.) যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি এ হাদিস বিশ্বাস করেননি;

• পরবর্তীতে মওলানারা এ হাদিস জানতেন না, এটা হতে পারে না। ইতিহাসে এক ইন্দোনেশিয়া ছাড়া আর কোথাও তারা সুলতানাদের বিরোধীতা তো করেনইনি বরং রানিদের নামে খুতবা পড়িয়েছেন। অর্থাৎ তারা এ হাদিস বিশ্বাস করেননি;

• খলিফাদের সমর্থন ছাড়া সুলতানাদের মুদ্রা ও খুতবা সম্ভব হত না। তাদের দরবারে কোরান-হাদিসের প্রচণ্ড চর্চা হত, খলিফারা ও প্রাসাদ ইমামেরাও এ হাদিস বিশ্বাস করেননি।

অর্থাৎ ইসলামের ইতিহাসে বেশিরভাগ লোক এ হাদিস বিশ্বাস করেনি। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের বিরুদ্ধে নির্বাচনে ফাতিমা জিন্নার সমর্থক মওলানা মওদুদিও বিশ্বাস করেননি। কেন? কারণ তারা জানতেন, এ হাদিস জাল।

এই সূত্রগুলো থেকে জানা যায় কেন এ হাদিস জাল–

• "ইহার বর্ণনাকারী আবু বাকরাকে নারী-ব্যাভিচারের মিথ্যা সাক্ষ্য দেওবার অপরাধে হজরত ওমর (রা.) শাস্তি দিয়াছিলেন"। (উইমেন অ্যান্ড পলিটিক্স ইন ইসলাম – Submission নামক ইসলামি ওয়েবসাইট)

অর্থাৎ আবু বাকরা এক নিরপরাধ শালীন নারীর বিরুদ্ধে ব্যাভিচারের মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। এটা একটা জঘন্য অপরাধ;

"এই হাদিসের অসত্যতা সুপ্রমাণিত শুধু ইতিহাসেই নয়, বরং ইহাও সত্য যে আবু বাকরা সম্বন্ধে মুসলমানের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে যে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অপরাধে তাহাকে জনসমক্ষে শাস্তি দেওয়া হইয়াছিল।"

(উইমেনস রাইট ইন ইসলাম – শরীফ চৌধুরী)

"আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওবার অপরাধে আবু বাকরাকে শাস্তি দেওয়া হইয়াছিল।"

(দ্য ফরগটেন কুইনস অফ ইসলাম – ফাতিমা মার্নিসি)

(৪) কোরান:

সুরা নূর, আয়াত ৪:

"যাহারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর স্বপক্ষে চারজন পুরুষ-সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাহাদিগকে ৮০টি বেত্রাঘাত করিবে এবং কখনও তাহাদের সাক্ষ্য কবুল করিবে না। ইহারাই নাফরমান।"

এই নাফারমান আবু বাকরার কথাতেই শারিয়া আইনে নারী নেতৃত্ব নিষিদ্ধ করা আছে। অথচ কোরানে কোথাও নারী নেতৃত্ব নিষিদ্ধ তো নেইই বরং সমর্থন করা আছে। সুরা নমল আয়াত ২৩:

"আমি এক নারীকে সাবাবাসীদের উপর রাজত্ব করিতে দেখিয়াছি।"

সেই রানি যখন ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হলেন (আয়াত ৪৪) তখন কি কোরান তাকে সিংহাসন থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছে? মোটেই নয়, কোথাও বলেনি! (কোরানে তাঁর নাম নেই, কিন্তু ইসলামি সাহিত্যে তাঁর নাম বিলকিস পাওয়া যায়।)

জীবনের বেশিরভাগ বোঝা মা-বোনেরাই বয়েছেন চিরকাল। কিন্তু তাদের অবদানের প্রতিদান তো দূরের কথা, স্বীকৃতিটুকুও দেওয়া হয়নি। লজ্জাটা কম নয়, কিন্তু সমস্যাটা তার চেয়ে অনেক বড়।

নারী-পুরুষের মিলিত অবদান ছাড়া সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়। নেতা কিংবা মহাপুরুষেরা সেটা বিলক্ষণ জানতেন। তাই তারা নারীদের কখনও অক্ষম করে রাখেননি, বিশ্বনবী (সা.) তো ননই।