হাওর অঞ্চলে তরুণ মুভমেন্ট: দুর্নীতির জন্য জিরো টলারেন্স

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার
Published : 27 April 2017, 04:18 AM
Updated : 27 April 2017, 04:18 AM

হাওর অঞ্চলের বিপর্যস্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি সহায়তা ও সম্পদবণ্টনের ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণ জরুরি। এতে যে কোনো স্তরে যে কোনো প্রকার 'দুর্নীতির জন্য 'জিরো টলারেন্স' কার্যকর হবে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন: বন্যাকবলিত এলাকায় একজন মানুষও যাতে না খেয়ে মারা না যায় সেজন্য সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি সুনামগঞ্জ পরিদর্শনে মূল্যবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি সমস্যা বুঝতে পেরেছেন– সর্ষের মধ্যেই ভূত! তিনি বলেন:

"সকল জনপ্রতিনিধি যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সেখানে দুর্নীতি হয় কী করে?"

সুনামগঞ্জের হাওর-বাঁধ দুর্নীতি ইস্যুতে পৃষ্ঠপোষক-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক আরও স্পষ্ট হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বদলির আদেশে। নিজেদের রক্ষা করার জন্যই তারা এ কাজ করেছেন। তরুণ প্রজন্ম কোনো কারণে তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করলে শিগগিরই দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকদের জবাবদিহি করতে হবে। সেটা কিছুটা তাত্ত্বিক মনে হলেও বাস্তবে আর কোনো দুর্নীতির সুযোগ দেওয়া যাবে না।

এমতাবস্তায় দুর্নীতিবিরোধী মুভমেন্ট অব্যাহত রাখতে হবে। যারা দুর্নীতি করেছে আর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে যারা দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে বা জবাবদিহি নিশ্চিত না করে দায়িত্বে অবহেলা করেছে সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী শ্লোগান ও মুভমেন্ট অব্যাহত রাখতে হবে।

সুনামগঞ্জে আর কোনো দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না। এই অঞ্চলের তরুণ মুভমেন্টের মূল প্রতিপাদ্য: 'দুর্নীতির জন্য জিরো টলারেন্স'।

যে অঞ্চলে দেশের সবচেয়ে বেশি সম্পদ সেই অঞ্চলই সবচেয়ে অবহেলিত, অনুন্নত ও সমস্যা জর্জরিত। এটা এই অঞ্চলের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, বিশেষ করে সাংসদদের অদক্ষতা এবং সামাজিক জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার অভাব, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কারো কারো ব্যাপক ভিত্তিক দুর্নীতিসম্পৃক্ততা ও স্বার্থের সংঘাত (যেমন নিজ নির্বাচনী এলাকায় নামে-বেনামে ঠিকাদারি করা, হাওর-বিল, পাথর-বালির দখল) ইত্যাদি বড় কারণ।

দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্ব কখনও জেলার সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরসমূহসহ ঠিকাদারদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে না। তাছাড়া নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, বিশেষ করে সংসদ সদস্য যখন নিজেই হাওর, বিল, বাঁধ ও স্থানীয় অবকাঠামোর ঠিকাদারিতে নিয়োজিত তখন অন্য ঠিকাদারদের সঙ্গে সম্পর্কটা হয় কাজ প্রাপ্তির প্রতিযোগিতা কেন্দ্রিক বিরোধের, মোটেই জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের নয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরসমূহের সঙ্গে সম্পর্কটা তো অনুগত, আজ্ঞাবহ আর দুর্নীতির মেলবন্ধনের। জবাবদিহির তো আর কোনো সুযোগ রইল না।

সংসদীয় রীতি ও আইন অনুযায়ী কোনো সাংসদ তাঁর ফার্ম দ্বারা বা বেনামে বা নিজে নিজ এলাকায় ঠিকাদারি করতে পারেন না। এটি 'কনফ্লিকট অফ ইন্টারেস্ট'। আর করলে তাঁকে মাননীয় বলা যায় না, স্রেফ ঠিকাদার হিসেবেই দেখতে হবে। অবহেলিত এই হাওর এলাকায় সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় যেটুকু কাজ হয়েছে, সেটুকুও ভেস্তে গেছে দুর্নীতির অতল গহ্বরে, কতিপয় নির্বাচিত সাংসদদের ঠিকাদারি, ইট, বালু, পাথর আর হাওর-বিলের দখলদারির কারণে।

যখন দেখা যায় স্থানীয় তরুণ সমাজের ও সাংবাদিকদের একটি অংশ এরূপ নেতৃত্বের সহযোদ্ধা, বুঝতে আর অসুবিধা হয় না সমাজ আর রাজনীতির বাস্তবচিত্র। তারপরও কিছু যুবক স্বপ্ন দেখে মুক্তির। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও জনাব ওবায়দুল কাদেরের মতো নেতৃত্ব যখন বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া পলিটিক্যাল স্কুল আওয়ামী লীগের দায়িত্বে, স্বপ্ন দেখা যুবকদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে বেশি সময় লাগবে না।

প্রধানমন্ত্রী ইট, বালু, পাথর অথবা হাওর-বিলের ব্যবসা করতে আসা দলে ভেরা সাংসদদের অনেক আগেই চিনেছেন এবং বিভিন্ন দলীয় সভায় তাদের সম্পর্কে সতর্ক বার্তা দিয়েছেন। এখন সময় এসেছে এদের হাত থেকে দলকে রক্ষা করার। নতুবা পরিস্থিতি রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। সরকারের টেকসই উন্নয়ন নীতির স্থায়িত্বশীল বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব।

হাওর অঞ্চলের মানুষের মুক্তির প্রশ্ন তো এর সঙ্গেই সম্পর্কিত। সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া কোনো এলাকার মুক্তি সম্ভব নয়। প্রতিদিনই সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় ও জেলা সদরে ছাত্র, যুবক, আইনজীবী ও সংবাদকর্মীদের দাবি আদায়ের শ্লোগান ও প্রতিবাদী মুভমেন্টের প্রতিবেদন দেখা যায়। যেখানে এমন বিপ্লবী সোনার ছেলেরা আছে সেখানে এরূপ অন্যায়-অবিচার, সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের রাজত্ব আর চলতে পারে না। এটা হোক প্রজন্মের প্রতিশ্রুতি ও দায়বদ্ধতা।

যাহোক হাওর অঞ্চলের বাঁধ সমস্যার বিষয়টির স্থায়ী সমাধান জরুরি। যতদূর মনে পড়ে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বাঁধ সম্পর্কিত সমস্যার স্থায়ী সমাধানের নির্দেশ দিয়েছেন। নামে বা বেনামে সাংসদের ঠিকাদারির অভিলাষ এখানে আসলে তো একই বৃত্তে আবর্তিত হতে হবে। যুবকদের সাংবাদিকদের ও শিক্ষিত তরুণদের ভাবার সময় এসেছে।

বাঁধ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি ও পরিবেশবান্ধব সমাধানের জন্য শিগগিরই পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত এবং পরিবেশ ও সুশাসন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমেদ খানের সঙ্গে পরামর্শ করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা যেতে পারে। তাঁরা দুজনই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়নের (International Union for Conservation of Nature) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রধান ছিলেন এবং সেই সূত্রে টাংগুয়ার হাওরের নান্দনিকতা ও এর জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন।

বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে যেসব পর্যবেক্ষণমূলক পরামর্শ পাওয়া যাবে, সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। অতঃপর চলুক স্থায়ী সমাধানের কৌশলপত্র নিয়ে কৃষক, ছাত্র, যুবক, সংবাদকর্মী, আইনজীবী, কবি-কলাম লেখকদের সম্মিলিত আন্দোলন। অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলুক মুভমেন্ট।