পাওয়া না-পাওয়ার খেরো খাতায় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 22 April 2017, 05:09 AM
Updated : 22 April 2017, 05:09 AM

ইলিশ, চৈত্রসংক্রান্তি, হালখাতা ইত্যাদি বাংলা নববর্ষের অনুষঙ্গ। সদ্য শেষ হওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর বক্তৃতার শুরুতে বাংলা নববর্ষ সামনে রেখে শুভেচ্ছা জানান বাংলাদেশের জনগণকে। শেখ হাসিনার দিল্লি সফর দুই দেশের বন্ধুত্বের আরেকটি 'সোনালি যুগের অধ্যায়' বলে উল্লেখ করেন তিনি।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় রাষ্ট্রপতির জন্য নিয়ে যান ইলিশ। ইলিশ কিংবা চৈত্রসংক্রান্তি নয়, বরং সদ্য হওয়া এ সফরের প্রাপ্তি না-প্রাপ্তি তথা বাকির হালখাতা মেলাতে কেউ কেউ হতাশ হতেই পারেন।

প্রধানমন্ত্রী ভারতের রাজধানী দিল্লিতে 'প্রটোকল-ভাঙা' ব্যতিক্রমধর্মী সংবর্ধনা পেয়েছেন। বিমানবন্দরে নরেন্দ্র মোদী ব্যক্তিগত উদ্যোগে সব আইনি আচার এক পাশে রেখে বরণ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের অভ্যর্থনায় যে নিয়ম, রাষ্ট্রাচার রয়েছে, তার বাইরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সশরীরে বিমানবন্দরে হাজির হয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। তাঁর এই আন্তরিক উদ্যোগ প্রমাণ করে ভারত সরকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ সফরকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে।

দুদেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা একে অন্যের দেশ সফর করেছেন এবং তাদের সবসময় উষ্ণতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু যখনই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে সফরগুলো অন্য মাত্রা পেয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না।

নরেন্দ্র মোদীর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরের আগে সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য সংবিধান সংশোধনী বিল পেশ ও রাজ্যসভায় তা পাস করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ল্যান্ড বর্ডার বিল সইয়ের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের এক নতুন মাত্রা।

প্রাজ্ঞজনেরা বলেন, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যে উচ্চতায় উঠেছিল, ওই বিল পাস হওয়ায় সেই সম্পর্ক আবার সেই উচ্চতায় পৌঁছেছিল। এর আগে রাষ্ট্রহীন ছিটমহলবাসীদের কোনো দেশ ছিল না; এখন স্থলসীমান্ত নির্দিষ্ট হওয়ায় নিজেদের দেশ পরিচয় পেয়েছে। বিলটি পাস হওয়ার মাধ্যমে ১৯৭৪ সালের বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরা গান্ধী চুক্তি বাস্তবায়নের সব বাধা দূর হয়।

প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব গ্রহণ করেই। চুক্তি হওয়ার আগে তিনি একাধিকবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ ব্যাপারে আশ্বাসও দেন, পরে রূপায়ন করেন। এবারের সফরে অনিষ্পন্ন তিস্তা চুক্তি করে সম্পর্কের পুনর্নবায়ন করা যেত, না হওয়ায় অপেক্ষা বাড়ল।

একমাত্র শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই শান্তি নিশ্চিত করে। দুই দেশের মধ্যে যা কিছু কথাবার্তা, শান্তিপূর্ণভাবেই তার সমাধান সম্ভব বলে মনে করি। স্থল সীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে আমাদের সদিচ্ছার দৃষ্টান্ত রেখেছি। দুদেশে প্রবাহিত নদী (এখন আলোচ্য তিস্তা) ছাড়া কিছু বিষয়ের সমাধান প্রয়োজন।

ভারতের জনগণ ও নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখতে চাই আমরা। সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে, তবু এই সীমিত সম্পদই আমরা দুদেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারি। আমরা একই সংস্কৃৃতি ও ঐতিহ্যের উত্তরসূরি। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের অনেক কিছুই মেলে। লালন, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দ আমাদের উভয়েরই। বাংলা ভাষা আমাদের উভয়ের। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা নদীর জল পায় দুদেশই। সুন্দরবন উভয়েরই গর্ব। শেখ হাসিনার নিবন্ধের এই অংশে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রায় পুরো চিত্রাভাস পাওয়া যায়।

বিশাল বহর নিয়ে ভারত সফরে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। জানা গেছে, এ সফরে দুই দেশের অনেক দেরিতে হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যেসব সেনা শহীদ হন, তাদের মরণোত্তর সম্মাননা দেওয়া হয়। এই সম্মাননার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের আত্মত্যাগকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হল।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র হিন্দি সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করেছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী মিলে। তবে শেখ হাসিনার সফরে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় পদ্মা (গঙ্গা) ব্যারাজ নির্মাণ, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, নদীর অববাহিকাভিত্তিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত সুরক্ষা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, আন্তঃযোগাযোগ তথা কানেকটিভিটি, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা, জনযোগাযোগ, নিরাপত্তা সহযোগিতা, মাদক চোরাচালান, মানবপাচার রোধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে।

ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রভাবিত থিংকট্যাংক ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের এক সংবর্ধনায় শেখ হাসিনার ভারতের সঙ্গে বন্ধুুতা ও তার মাত্রা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর আগে সরকারি সংবর্ধনা ছাড়া এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের আয়োজনের কথা মনে করা যায় না। আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বন্ধু কংগ্রেস, এটা সত্য। কিন্তু এ সফরের পর বিজেপি ও আওয়ামী মিত্রতা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

অর্থনীতিতে বাংলাদেশ যেভাবে দ্রুত এগোচ্ছে, আর আগামী ২০ বছরে কোথায় পৌঁছাবে, এই রোডম্যাপ বাকি বিশ্বকে বাংলাদেশকে হিসাবে রেখে পথ চলতে হবে। বাকি বিশ্বের আগ্রহ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির উপজাত। একইসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। এর প্রেক্ষিতে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এমন হতে হবে যেন ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়।

বাংলাদেশের জন্য চীনের সামরিক সহযোগিতার বিষয়টি নতুন নয়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে চীনের বিতর্কিত ভূমিকা থাকলেও গত চার দশকে চীনের সঙ্গে গড়ে উঠেছে আমাদের সামরিক সহযোগিতার কৌশলগত সম্পর্ক। আমাদের সমরাস্ত্রের ৭০ শতাংশের বেশি চীন থেকে আমদানি করা হয়। যদিও 'সব ডিম যেমন এক ঝুঁড়িতে রাখা' বুদ্ধিমানের কাজ নয়, তেমনি একক কোনো দেশেকে সামরিক সরমঞ্জামাদির সরবারহের একক সোর্স বিবেচনা করাও সমীচিন নয়।

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ বেশি মাত্রায় চীনের প্রতি ঝুঁকে গেছে, এমন একটা মনোভাব ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কাজ করছিল। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে দুটি চীনা সাবমেরিন কমিশনিংয়ের পর ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি করতে প্রায় মরিয়া হয়ে উঠে। এর অংশ হিসেবে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পরিকর ও ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াতের ঢাকা সফরের প্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়েছে ভারতের সঙ্গে।

দুদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে একধরনের সহযোগিতা যদিও আগে থেকেই ছিল। চুক্তির ফলে এখন তা একটি আইনি আনুষ্ঠানিকতা পেল। জানা যায়, ভারতীয় প্রশিক্ষকরা সেনাবাহিনীর স্টাফ কলেজে আসবেন, আর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা ভারতীয় স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণ নেবেন। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বিনিময় হলেও বাংলাদেশ যৌথ মহড়া ও সমুদ্রে যৌথ টহলে অসম্মতির কথা জানিয়ে দেয়।

ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী সফরের আগেই বিভিন্ন মাধ্যমে অনবরত বলে আসছিলেন, এই সফরের সময় তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। তারপরও সংবাদমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে প্রত্যাশার এমন আবহ তৈরি করা হয় যেন তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করতেই এই সফর।

নীতি-ন্যায্যতা কোনোকিছুর প্রতি কোনোরকম সম্মান না দেখিয়ে অভিন্ন নদী তিস্তার পানি উজানের দেশ ভারত একতরফাভাবে ব্যবহার করায় ভাটির দেশ বাংলাদেশের কৃষি খাত কেবল নয়, প্রাণ-প্রতিবেশ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বলতে-লিখতে সবাই ক্লান্ত।তিস্তার পানি না পাওয়ায় কৃষকরা কীভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় নিয়মিত বিরতিতে।

এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের অংশে তিস্তার পানি একচেটিয়াভাবে প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশ অংশে নদীটিতে পানির অভাবে বোরো মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের দিনাজপুর ও রংপুরের বিশাল এলাকায় গত কয়েক বছরে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে সেচ কার্যক্রম প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হয়েছে। দেশের 'শস্যভাণ্ডার' হিসেবে খ্যাত উত্তরাঞ্চলে শুষ্কতায় ফসল আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে চাল তথা খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের ধারাবাহিকতা না-ও থাকতে পারে।

তিস্তা নদী সিকিম পাড়ি দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশের পর পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। সিকিমে নির্মাণাধীন বিশালাকৃতির তিস্তা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ছাড়াও রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য ড্যামের নেটওয়ার্ক। ভারতের জলপাইগুড়িতে নির্মিত গজলডোবা ব্যারাজ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-কালিম্পং অঞ্চলে রয়েছে বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প। এসব প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে তিস্তার পানি। এসব প্রকল্প চালাতে গিয়ে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

দুদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর পানির ন্যায্য বণ্টন আন্তর্জাতিক আইনেরও মৌল নীতি। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির প্রস্তাবনায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে দুদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিবণ্টনের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ভারতের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও ১৯৮৪ সালের ২১ মার্চ লোকসভায় এক বিতর্কে অংশ নিয়ে অভিন্ন নদী তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

(সূত্র: India-Bangladesh Relations, Volume 1, Edited by Avtar Sing Bhasin)

১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার পানি ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে এক অস্থায়ী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যদিও দুবছর ব্যাপ্তি ছিল এ বোঝাপড়া। তিস্তার ৩৯ শতাংশ পানি ভারত ব্যবহার করবে, বাংলাদেশ করবে ৩৬ শতাংশ, আর বাকি ২৫ শতাংশ নদীর স্বাভাবিক গতিকে অক্ষুণ্ন রাখবে এমন শর্তে চুক্তি হয়েছিল। তিস্তার গতিপথে নির্মিত গাজোলডোবা জলাধারে সঞ্চিত পানির কারণে ছাড়াও বিভিন্ন ড্যাম ও জলাধারের কারণে তিস্তার প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমছে।

একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালের মার্চ মাসের শেষ দশ দিনে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ৫৫০ কিউসেক এবং ২০১৫ সালের একই সময়ে তা ছিল মাত্র ৩১৫ কিউসেক। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, যদি তিস্তায় এত কম পানি থাকে তাহলে পশ্চিমবঙ্গের কতটুকু আর বাংলাদেশের কতটুকু থাকে। এসব কারণেই তাঁর তিস্তার জলবণ্টন ঘিরে আপত্তি।

তিস্তার পরিবর্তে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়েছেন:

"তিস্তা নয়, তোর্সা নদী থেকে পানি নিক বাংলাদেশ।"

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন প্রস্তাবে উভয় দেশের সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। যে তোর্সা, ধানসিঁড়ি ইত্যাদি নদী থেকে বাংলাদেশকে পানি নিতে বলেছেন সেটি একধরনের কূট রাজনীতি। কারণ ওই নদীগুলোর ওপর বাঁধ নেই। তাই পানি আসতেও বাধা নেই। স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে চুক্তির প্রশ্ন অবান্তর।

মমতার নতুন প্রস্তাবের সারবত্তা নেই, কারণ ভারতে যেসব নদীতে বাঁধ নেই সেসব নদীর পানি বিনাবাধায় বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এসব নদীর পানির বাড়া-কমায় তিস্তা অঞ্চলে কোনো প্রভাব পড়বে না। তিস্তাপারের মানুষ উপকৃত হবে না।

তাহলে এই বিকল্প প্রস্তাবের কী বার্তা দেয়? তিস্তা সমস্যায় নতুন মোড়, মমতার এ প্রস্তাব। বাংলাদেশ এখনও তিস্তা নিয়ে মমতার প্রস্তাবের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশ সরকার অতি অবশ্যই মমতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে এবং তিস্তা নিয়ে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে।

তোর্সা থেকে পানি নেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টত এই বার্তা দিয়েছেন যে, তিস্তার ব্যাপারে তিনি তাঁর পুরনো অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র টলেননি। আমাদের সরকার নরেন্দ্র মোদী যে ওয়াদা করেছেন তার উপর ভরসা রেখে অপেক্ষা করতে চায়। এটা মমতার সময়ক্ষেপণের একটা প্রচেষ্টা, একইসঙ্গে 'তিস্তা কার্ড' নিয়ে মমতার রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চান।

সম্প্রতি মমতার রাজ্য সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী আর নেতা-নেত্রী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। মমতা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিকে জিম্মি করে এসব অভিযোগ থেকে নিজের লোকজনের দায়মুক্তি আদায় করে নিতে চান। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, মমতা নরেন্দ্র মোদীকে 'ব্ল্যাকমেইল' করতে চান। ছিটমহলবাসীর পুনর্বাসনের জন্য বিপুল পরিমাণের অর্থ আদায় করে নিয়েছিলেন, তিস্তার বিনিময়ে সেরকম প্যাকেজের দর কষাকষি করছেন।

বিগত কয়েক বছরে ভারত-বন্ধু আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতবিরোধী রাজনৈতিক ও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির তৎপরতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ নিরসনে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসনীয়। এই নিরাপত্তার বিষয়টি বেসামরিক ও সামরিক উভয় স্তরে বিস্তৃত করতে চায় ভারত। এসব বিবেচনায় ভূরাজনৈতিক কৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপুর্ণ।

তিস্তা চুক্তি হবে এবং তা শেখ হাসিনা আর নরেন্দ্র মোদীই করবেন, তা যেন সত্য হয়। আর তা করতে ব্যর্থ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উভয় দেশই। কারণ ২০১৮ সালের শেষে বাংলাদেশে একটি সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। সে বিবেচনা মাথায় রেখে উভয় দেশই তাদের পাওয়া না-পাওয়ার খেরো খাতা পুনঃপুনঃ পরীক্ষা করবে এই নীতিসিদ্ধ।