বাস্তবতা প্রগতিশীলতা নয়, বাস্তবতায় বিদ্যমান অন্ধচিন্তা প্রত্যাখ্যানই প্রগতিশীলতা

নাদির জুনাইদ
Published : 19 April 2017, 11:33 AM
Updated : 19 April 2017, 11:33 AM

কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যধারা এবং পাঠ্যবিষয় সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিক ও যুগোপযোগী না করেই এই শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরকে স্নাতকোত্তর সমমানের স্বীকৃতি দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত, গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার প্রতিনিধিদের বৈঠকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গনে স্থাপিত বিচারব্যবস্থায় নৈতিক শক্তি বা ন্যায়বিচারের ধারণা প্রতীকীভাবে তুলে ধরা 'লেডি জাস্টিস'এর ভাস্কর্য অপসারণের জন্য হেফাজতে ইসলামের দাবির পক্ষে পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস প্রদান প্রভৃতি ঘটনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, ছাত্রসংগঠন, ইসলামি সংগঠন এবং সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকরা তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও প্রগতিশীল মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও ছাত্রসংগঠন সরকারের এমন সিদ্ধান্ত-আশ্বাস পছন্দ করেনি। কট্টর ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের জন্য হবে আত্মঘাতী– এমন মনোভাব মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে হাঁটার মতো এবং হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে নেওয়া হলে দেশে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার আরও ঘনীভূত হবে– এমন নানা বক্তব্য তুলে ধরেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

ধর্মীয় অন্ধত্ব আর অসহিষ্ণুতা আমাদের দেশের টিকে থাকা সমস্যা যা সমাজকে পীড়িত করছে বর্তমান সময়েও। পাকিস্তানি আমলে এই দেশে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, আজ থেকে ১৬ বছর আগেই পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে হয়েছিল বোমা হামলা। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক রূপ কখনও পছন্দ করে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। কদিন আগেই বাংলা নতুন বছর বরণ করে নেওয়ার সাংস্কৃতিক আয়োজনের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্র রাতের অন্ধকারে পোড়া তেল দিয়ে নষ্ট করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বর্ষবরণের উৎসবের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আক্রোশ এখনও কতটা তীব্র তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। দেয়ালচিত্র নষ্ট করার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। কিস্তু তারা হাল ছেড়ে দেয়নি। আবার নতুন করে তারা এঁকেছে বাংলা নববর্ষের জন্য দেয়ালচিত্র।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ এক হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধের মাধ্যমে অর্জন করেছিল এই দেশের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের ও বাঙালি সংস্কৃতির সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা এই দেশের অগণিত মানুষ ধারণ করে গভীরভাবে। ফলে ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক ও অসহিষ্ণু চিন্তা এই দেশে প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে সেটাই স্বাভাবিক।

যুক্তিবাদী, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তার মানুষদের সঙ্গে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর এই দ্বন্দ্বই প্রগতিশীল আর প্রতিক্রিয়াশীলদের পার্থক্য স্পষ্ট করে দেয়। একদা প্রগতিশীল কাউকে কখনও হঠাৎ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাকে কিন্তু আর প্রগতিশীল বলা যায়নি। একইভাবে কোনো কৌশলগত কারণের কথা বলে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার অনুসারীদের সঙ্গে প্রগতিশীলদের সুসম্পর্ক তৈরি হওয়া স্বাভাবিকতা নির্দেশ করবে না; তা নির্দেশ করবে প্রগতিশীলতার মূল আদর্শ আর বোধ থেকে বিচ্যুতি।

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে স্থাপিত ভাস্কর্যটি সরানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে– এই ব্যাপারে কওমি মাদ্রাসাগুলোর প্রতিনিধিদের আশ্বাস দেওয়ার কয়েকদিন পর এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ভাস্কর্য সরানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের। এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষমতাসীন দলের প্রচার সম্পাদক বলেছেন:

"সুপ্রিম কোর্ট একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, তা সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। এখানে এই ভাস্কর্য থাকবে কী থাকবে না, এটা একান্তই সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার।"

হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির একটি ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য স্থাপন বন্ধ করা। হয়তো ভবিষ্যতে তারা দেশের অন্য বিভিন্ন ভাস্কর্য, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, সেসবের অপসারণও দাবি করতে পারে। কিন্তু যুক্তিনির্ভর মানুষ জানেন এসব ভাস্কর্য হল শিল্পকর্ম। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক শৈল্পিক কাজের মাধ্যমে এই ধরনের ভাস্কর্যে তুলে ধরা হয়েছে। মূর্তিপূজা করার জন্য এসব ভাস্কর্য নির্মাণ করে পথে স্থাপন করা হয়নি, সেটা সাধারণ বুদ্ধি দিয়েও বোঝা সম্ভব।

ভাস্কর্য অপসারণের কথা বললে বিরোধিতা করা হয় শিল্পকর্মের। আর শিল্পকর্ম প্রত্যাখ্যান করার অর্থ মানুষের নান্দনিক বোধ, সৃজনশীলতা আর উদ্ভাবনী শক্তি বাতিল করে দেওয়া। সংকীর্ণ, অন্ধচিন্তা মনে লালন করলে কোনো শিল্পকর্মের সৌন্দর্যই বোঝা সম্ভব নয়। আর কোনো শিল্পকর্ম তো ধর্মীয় আচার পালনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কারণ গভীর ও আন্তরিক বিশ্বাস নিয়ে যে ধর্মীয় আচার পালন করা হয় তা তো ঠুনকো কোনো ব্যাপার নয় যে, শিল্পকর্মের উপস্থিতি থাকলেই সেই আচার পালন বিঘ্নিত হবে।

পাশ্চাত্যের অনেক শহরের পথে নানা ধরনের ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখা যায়। সেসব শহরেও আছে বিভিন্ন মসজিদ। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বহুদিন ধরেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন সেসব স্থানে এবং তারা ধর্মানুরাগী। তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন তো বিঘ্নিত হচ্ছে না। যদি হত তাহলে কি তারা যুগের পর যুগ সেসব শহরে বসবাস করতেন?

সৌন্দর্য অনুধাবনের জন্য রুচিশীল মন প্রয়োজন। কার্ল মার্কস বলেছিলেন:

"যে কানে সুরবোধ নেই সেই কানে কি মনোগ্রাহী সঙ্গীতের মাধুর্য পৌঁছুবে কখনও?"

একইভাবে বলা যায় যার সৌন্দর্য বোঝার মন নেই, সেই মানুষ কি আকাশ, নদী, অরণ্য বা পাখির উড়ে যাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করতে পারবে? মন অনুভূতিশীল না হলে কি শক্তিশালী কোনো উপন্যাস বা কবিতা কেউ পাঠ করবে বা পড়ার পর তার মন মানবিকতার বোধে আন্দোলিত হবে? এখানেই সৌন্দর্যবোধ আর সংকীর্ণ, উগ্র মানসিকতার পার্থক্য।

সাম্প্রদায়িক চিন্তায় আচ্ছন্ন মানুষ গল্প বা কবিতা বিচার করবে লেখার মান দিয়ে নয় বরং তা মুসলমান লেখক না হিন্দু লেখক লিখেছে সেই অযৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। মুসলমান পাঠকরা তাই পড়বেন না শেকসপিয়ার আর রবীন্দ্রনাথের লেখা। আর ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন বা আল-ফারাবির দর্শন হিন্দু আর খ্রিস্টান পাঠকরা পাঠ করা থেকে বিরত থাকবেন। সংকীর্ণমনাদের যুক্তিহীন ভাবনার অসারতা বুঝতে তাই সমস্যা হয় না। আর ধর্মান্ধ চিন্তার উত্থান ঘটলে যেহেতু বিপদগ্রস্ত হয় যুক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা আর সৌন্দর্যবোধ, তাই প্রগতিশীল মানুষ সবসময় এগিয়ে আসেন অন্ধচিন্তা আর সংকীর্ণতা প্রতিরোধের জন্য।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার প্রতিনিধিদের বৈঠকের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমালোচনা শুরু হওয়ার পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন যে, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের কোনো জোট বা আপস হয়নি। ওবায়দুল কাদের সেই সময় বলেছেন আরও একটি কথা:

"বাস্তবতাই হচ্ছে প্রগতিশীলতা। বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে কেউ প্রগতিশীল হতে পারে না।"

বাস্তবতার রূপ তো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং সমাজে বহু আলোকিত মানুষের উপস্থিতি যেমন বাস্তবতা হতে পারে তেমনি কখনও অর্থনৈতিক শোষণ, যুক্তিহীনতার অন্ধকার, গণহত্যা, স্বৈরশাসনের অত্যাচারও তো বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারে। সমাজের প্রগতি আর গণমানুষের মুক্তির জন্য বিপদ সৃষ্টি করা সেই নেতিবাচক বাস্তবতাও কি তাহলে প্রগতিশীলতা? না, সেই অত্যাচারী আর অন্ধকারাচ্ছন্ন বাস্তব পরিস্থিতি অবশ্যই প্রগতিশীলতা নয়।

বিদ্যমান বাস্তবতায় যুক্তি-বিবর্জিত অন্ধচিন্তায় আচ্ছন্ন মানুষদের উপস্থিতি দেখলেও রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য তাদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা কখনও প্রগতিশীল আচরণ নয়। বরং যদি দেখা যায় সাম্প্রতিক বাস্তবতা প্রগতি, যুক্তিবোধ আর মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, বেড়ে চলেছে নৈতিক আর রাজনৈতিক অধঃপতন, তখন সেই নেতিবাচক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, প্রতিরোধ অব্যাহত রাখাই প্রগতিশীলতা। সাম্প্রদায়িক এবং যুক্তিহীন চিন্তা ধারণ করে যারা প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে থাকে বর্তমান সময়ে তাদের উপস্থিতি দেখলেও তাদের খুশি রাখার চেষ্টা করা প্রকৃত প্রগতিশীলদের কাজ নয়।

পাকিস্তানি আমলে রবীন্দ্রসংগীত বন্ধ করে দেওয়া, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসরদের পরিচালিত নির্মম গণহত্যা, তারপর স্বাধীন দেশে সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন, ক্ষমতায় যুদ্ধাপরাধীদের অবস্থান– সবই তো ছিল বাস্তবতা। এমন বাস্তবতার সঙ্গে রাজনৈতিক কৌশলের কথা বলে যারা তাল মিলিয়ে চলেছে তারা কি প্রগতিশীল? না, তারা প্রগতিশীল নয়। বরং প্রগতিশীল শক্তি এমন বাস্তবতা প্রতিরোধ করেছে সবসময়।

সমাজে যদি ধর্মীয় অন্ধত্ব আর সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিস্তার দেখা যায়, তা প্রতিরোধ না করলে সমাজ তো ঢেকে যাবে যুক্তিহীনতার অন্ধকারে। প্রগতিশীলতা তাই প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপক্ষে থাকে সবসময়। ইংরেজিতে appeasement বলে একটি শব্দ আছে। এর অর্থ হল উগ্রচিন্তা ধারণ করা কোনো রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীকে বিভিন্ন ছাড় প্রদান করে তাদের শান্ত রাখার রাজনৈতিক কৌশল। যারা এই কৌশল ব্যবহার করে তাদের appeaser বলা হয়।

প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও ঝানু রাজনীতিবিদ হিসেবে সুপরিচিত স্যার উইনস্টন চার্চিল তীব্র সমালোচনা করেছিলেন এই appeaser দের। একটি উপমা দিয়ে তিনি বলেছিলেন:

"An appeaser is one who feeds a crocodile hoping it will eat him last."

অর্থাৎ উগ্রবাদী রাজনৈতিক শক্তিকে ছাড় দেওয়া কুমিরকে খাওয়ানোর মতো– এমন চিন্তা করে যে খাওয়ানো হলে কুমির সহজে আক্রমণ করবে না।

চার্চিল এমন মন্তব্য করেছিলেন হিটলারের উগ্রনীতির সামনে নতজানু ইউরোপীয় রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কে। সেই নেতারাও তখন হিটলারকে তোয়াজ করছিলেন এই কথা বলে যে, এটাই নাকি বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু চার্চিলের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। হিটলারের নাৎসি বাহিনী তাদের উগ্র, বিধ্বংসী নীতি নিয়ে ছাড় দেয়নি তাদের মতের বিপরীতে থাকা কোনো রাষ্ট্রকেই।

চার্চিলের এই কথাটি প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীলদের সম্পর্ক বোঝাতেও ব্যবহার করা যায়। যেহেতু এই দুই গোষ্ঠীর চিন্তাধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন তাই প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিরোধ না করে ছাড় দেওয়া হলে প্রগতিশীলদের অবস্থান শক্তিহীন আর নড়বড়ে হবে। আর ছাড় পেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, উগ্রবাদীরা হয়ে উঠবে ক্ষমতাশালী। যে প্রতিকূল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা ছাড় দিচ্ছেন চার্চিলের ভাষায়:

"সেই পরিস্থিতি নিরাপদ হয়ে উঠবে না। বরং তা হয়ে উঠবে আরও ভয়াল, বিপদ হবে আরও বিস্তৃত।"

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেছেন:

"কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির পর হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী এক জনসভায় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটা লাভজনক নয় কি?"

এই কথার অর্থ কি এমন হল না যে, হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে নেওয়ার পরই তাদের আমির জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছেন? তাহলে তো অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে, তাদের সন্তুষ্ট করা হলে কেবল তখনই তারা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবে, মন থেকে তারা জঙ্গিবাদের মতো অন্ধত্ব ও দানবীয় কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে না। তাই যদি হয় তাহলে শাহ আহমদ শফী আর তার অনুসারীদের জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রাখার জন্য সামনের দিনগুলিতে তাদের আরও কত দাবি একের পর এক মানতে হবে ক্ষমতাসীন দলকে?

জঙ্গিবাদের মতো অন্যায় মন থেকে ঘৃণা না করলে কেবল স্বার্থপ্রাপ্তির পর জঙ্গিবাদ-বিরোধিতা কতটা কার্যকর আর আন্তরিক হবে? ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যের পর সচেতন নাগরিকদের মনে এই প্রশ্নগুলি তৈরি হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।

দেশের সচেতন নাগরিকরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী এবং প্রগতিশীলতা কী তা জানেন। আর এই দিকগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা সচেতন মানুষদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতে চাই তাহলে আমাদের অনুসরণ করতে হবে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের যারা নিজ স্বার্থের জন্য আদর্শবাদিতা বিসর্জন দেননি, সংগ্রাম করেছেন অত্যাচারী ও সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি, তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এই দেশে সমুন্নত রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মনে ধারণ করে যারা রাজনীতি করছেন সেই রাজনীতিবিদদের তাই খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, তাদের কথা ও কাজ যেন তরুণ প্রজন্মের মনে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সম্পর্কে কোনোরকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে।

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন:

"তরুণদের ধোঁকা দেওয়া সহজ, কারণ তরুণরা খুব দ্রুত আশা করে।"

তরুণদের মনে যেন যুক্তিবোধ তৈরি হয়, তারা যেন নিজ সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতা আর ইতিহাসের বিভিন্ন দিক গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারে এবং অন্ধ আর নীতিহীন লোভী চিন্তা থেকে যেন তারা দূরে থাকে। তাদের মনে সেই আদর্শবাদিতা তৈরি করার দায়িত্ব সফলভাবে পালনের উপরই নির্ভর করছে দেশের মঙ্গলময় ভবিষ্যৎ।

এই দায়িত্ব পালন করতে হবে বয়োজ্যেষ্ঠদের যাদের মধ্যে আছেন রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, আইনজীবীসহ আরও বিভিন্ন পেশার মানুষ। বয়োজ্যেষ্ঠরা নতুন সময়ের মানুষদের আলো আর অন্ধকার, যুক্তি আর অন্ধচিন্তার পার্থক্য কতটা কার্যকরভাবে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং এই প্রশ্নটির উত্তর আমাদের সচেতনভাবে সন্ধান ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

অ্যারিস্টটলের গুরু বিখ্যাত গ্রিক চিন্তাবিদ প্লেটোর একটি উক্তি দিয়েই লেখা শেষ করি–

"যে শিশু অন্ধকার দেখে ভীত হয়ে ওঠে তাকে আমরা সহজেই ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হল সেটি যখন বয়োজ্যেষ্ঠরা আলোর কাছে যেতে ভয় পায়।"

মনীষী প্লেটোর এই বক্তব্যটি উপলব্ধি করতে পারলেই আমাদের উপকার হবে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।