বঙ্গাব্দকে শিক্ষাবর্ষ ও করবর্ষ করলে কেমন হয়?

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 30 Oct 2011, 02:41 PM
Updated : 18 April 2017, 04:18 PM

যে সনটি আমরা 'বঙ্গাব্দ' বলি তার সূচনা হয়েছিল মোঘল আমলে। বৈশাখ মাসে শুরু হওয়া এই সন মূলত ছিল করবর্ষ, আজকের ভাষায় 'অর্থবছর'। তুর্কি ও সুলতানি আমলে সরকারি কাজকর্মে ব্যবহৃত হত হিযরি সন। বাবর-হুমায়ুন-শেরশাহের সময় ক্রমাগত যুদ্ধবিগ্রহের পর আকবরের রাজত্বকালে এসে মোঘল সাম্রাজ্য যখন একটু থিতু হল তখন দেখা গেল, কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষে হিযরি সন ব্যবহারের কয়েকটি অসুবিধা রয়েছে।

প্রথমত, চান্দ্র বর্ষ হওয়ার কারণে হিযরি নববর্ষ অর্থাৎ মহররম মাসের পহেলা তারিখটা ফসল তোলার সময়ে পড়বেই এমন কোনো কথা নেই (ঠিক যেমন ঈদ কখনও শীতকালে, আবার কখনও-বা গ্রীস্মকালে পড়ে)।

দ্বিতীয়ত, হিযরি সনে থাকে ৩৫৪ দিন এবং সৌর সনে থাকে ৩৬৫ দিন। হিযরি সন ছোট হবার কারণ সম্ভবত এই যে, চাঁদ চর্মচক্ষে দেখা না গেলে হিজরি সন শুরু হতে পারে না। আবুল ফজল লিখেছেন, কোনো দেশে যদি চান্দ্র বর্ষ অনুসরণ করে খাজনা আদায় করা হয়, তবে কৃষক বা জনগণ অবশ্যই আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কারণ ৩০ সৌর বর্ষ= ৩১ চান্দ্র বর্ষ। যার মানে হচ্ছে, প্রতি ত্রিশ বছরে কৃষক এক বছরের খাজনা বেশি দেয়।

আইন-ই-আকবরী অনুসারে ৯৯২ হিযরিতে (১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ) নতুন ফসলি সন 'তারিখ-ই-এলাহি' চালু হবার ফরমান জারি করা হয়। তারিখ-ই-এলাহি শুরু হওয়ার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল আরও ২৮ বছর আগে, ৯৬৩ হিযরি বা ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে দুটি কারণ ছিল:

১) ৯৬৩ হিযরিতে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে ইব্রাহিদ লোদিকে পরাজিত করে সম্রাট আকবর দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন;

২) ৯৬৩ হিযরিতে (শকাব্দ/বিক্রমাব্দের) বৈশাখ মাস আর হিযরি মহররম মাস একসঙ্গে পড়েছিল। সুতরাং আজ থেকে (২০১৭১৫৫৬) ৪৬১ বছর আগে এলাহি সন বা আজকের বঙ্গাব্দ চালু হয়।

প্রশ্ন হতে পারে, হিযরি সাল আর বঙ্গাব্দ যদি একই হবে, তবে ৪৬১ বছর পরে (৯৬৩+৪৬১) আজ ১৪২৪ বাংলা, কিন্তু ১৪৩৭ হিযরি হল কেন? বাংলা সৌর-চান্দ্র বর্ষের তুলনায় ছোট বলেই কমবেশি সাড়ে চার শতকের মাথায় ১৩ বছর এগিয়ে গিয়েছে হিযরি চান্দ্রবর্ষ। হিসাবটা খেয়াল করুন: সৌর বর্ষের ৩৬৫দিন  হিযরি সনের ৩৫৪ দিন= ১১ দিন  ৪৬১ বছর= ৪৯৯৪ দিন হিযরি সনের ৩৫৪ দিন= ১৩ বৎসর ১২৫ দিন। এর মানে হচ্ছে, আকবর যদি এলাহি সন চালু না করতেন, তবে বাংলার জনগণকে এতদিনে কমপক্ষে ১৩ বছরের অতিরিক্ত খাজনা পরিশোধ করতে হত।

বাংলাদেশ ছাড়াও ১৩/১৪/১৫ তারিখে নববর্ষ পালিত হয় শ্রীলঙ্কা, ভারতের তামিলনাডু, উড়িষ্যা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব, বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, চীনের দাই জাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলে। প্রশ্ন হতে পারে, আকবরই যদি বঙ্গাব্দ শুরু করে থাকেন, তবে কখনও আকবরের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না এশিয়ার এমন অনেক স্থানে কেন একই দিনে নববর্ষ পালন করা হয়?

বৎসরের প্রথম দিন নির্ধারণের ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি প্রতিবন্ধ থাকে: একটি জ্যোতিষশাস্ত্রগত আর অন্যটি অর্থনৈতিক। জ্যোতিষ গণনার দুটি ভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে: একটি পৃথিবী-কেন্দ্রিক ও অন্যটি নক্ষত্র-কেন্দ্র্রিক। আকাশে বিভিন্ন নক্ষত্রের মধ্যে কল্পিত রেখা টেনে সিংহ, বৃষ, কর্কট ইত্যাদি বারটি রাশি কল্পনা করা হয়। পৃথিবী-কেন্দ্রিক জ্যোতিষশাস্ত্রে পৃথিবীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় সূর্য কোন রাশিতে অবস্থান করছে। নক্ষত্র-কেন্দ্রিক জ্যোতিষশাস্ত্রে বিভিন্ন নক্ষত্রের সঙ্গে সূর্যের তুলনামূলক অবস্থান বিচার করে স্থির করা হয় সূর্য কোন রাশিতে অবস্থান করছে। ভারতবর্ষে নক্ষত্র-কেন্দ্র্রিক গণনা অনুসরণ করা হয়; পাশ্চাত্যে অনুসরণ করা হয় পৃথিবী-কেন্দ্রিক গণনা। তবে ইদানিং পাশ্চাত্যেও অনেক জ্যোতিষী নক্ষত্র-কেন্দ্র্রিক গণনার দিকে ঝুঁকছেন বলে জানা গেছে।

সূর্য যখন এক রাশি পার হয়ে অন্য রাশিতে প্রবেশ করতে যায়, তখনই হয় একটি 'সংক্রান্তি'। বার মাসে বারটি সংক্রান্তি, পৌষ মাসে 'পৌষ-সংক্রান্তি', চৈত্র মাসে 'চৈত্রসংক্রান্তি' ইত্যাদি। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রমতে রাশিচক্রের প্রথম রাশি হচ্ছে মেষ। সুতরাং সূর্য যেদিন মেষ রাশিতে প্রবেশ করে, সেদিনই বছর আরম্ভ করা যুক্তিযুক্ত। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি চৈত্রসংক্রান্তিতে সূর্য যখন মিন রাশি থেকে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে, ঠিক সেদিন সূর্যোদয়ে বঙ্গাব্দ শুরু হয়। একে 'মহাবিষুব সংক্রান্তি'ও বলা হয়, কারণ এই সময়ে সূর্য বিষুবরেখা অতিক্রম করে।

১৪২৪ সনের ১৫ এপ্রিল তারিখে সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করেছে বলে বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গের সব বাঙালি এই দিন নববর্ষ পালন করেছে। সূর্যের অবস্থান অনুসারে, কখনও কখনও ১৩ বা ১৪ এপ্রিল তারিখেও পহেলা বৈশাখ হয়। তবে আশির দশকের শেষদিকে এরশাদের শাসনামলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ১৪ এপ্রিল তারিখেই পহেলা বৈশাখ হতে হবে। এই সিদ্ধান্ত সঠিক কী ভুল সেটা পুনর্বিবেচনার ভার পণ্ডিতের উপর ছেড়ে দিলাম। তবে বাংলাভাষী অঞ্চলের সর্বত্র যে এক দিনেই নববর্ষ পালিত হওয়া উচিত এতে সম্ভবত কারও দ্বিমত নেই।

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত বর্ষগুলো শুরু হয় সাধারণত সেই সংক্রান্তিগুলোতে যেগুলোর অবস্থান অক্টোবর থেকে এপ্রিল– অর্থাৎ ফসলকাটার সময়ে বা তার পরে। এর কারণ, জমির ফসল ওঠার পর কৃষকের হাতে দু পয়সা থাকত বলে তারা অনায়াসে খাজনাটা দিতে পারত। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। দক্ষিণ চীনে থাকার সময় এবং থাইল্যান্ডে আসার অব্যবহিত পরে থাই জাতি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া চীনা নববর্ষ পালন করত। কিন্তু পরবর্তীকালে থাইরা হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে, এপ্রিল মাসে বা মহাবিষুব-সংক্রান্তিতে নববর্ষ হলে থাইল্যান্ডের আবহাওয়ার সঙ্গে বর্ষটি সঙ্গতিপূর্ণ হয়। অবশ্য হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাবেও থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া বা বার্মায় মহাবিষুব-সংক্রান্তি বা ১৩/১৪/১৫ এপ্রিল তারিখে বছর শুরু হয়ে থাকতে পারে। তারিখ-ই-এলাহির প্রথম দিনটি এপ্রিলের মাঝামাঝি বিষুব-সংক্রান্তিতে স্থির করার প্রথম কারণ ছিল খাজনা আদায়; দ্বিতীয় কারণ ছিল ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র।

শশাঙ্ক-আকবরের জন্মেরও বহু আগে, মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু, এমনকি বাঙালি হতে শুরু করারও অনেক আগে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক জাতি-উপজাতির মতো আমাদের আদিবাসী-উপজাতি পূর্বপুরুষরাও বিষুব সংক্রান্তিতে বছর শুরু করত। বঙ্গাব্দ নাম সনটি ভারতবর্ষীয় এই অর্থে যে, বঙ্গাব্দের মাসের নামগুলো ব্যুৎপত্তিগতভাবে আকাশের বিভিন্ন নক্ষত্রের বহু যুগ ধরে চলে আসা সংস্কৃত নাম 'উত্তর-আষাঢ়া' (আষাঢ়), 'শ্রবণা' (শ্রাবণ), 'কৃত্তিকা' (কার্তিক), 'ফাল্গুনী' (ফাল্গুন) ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত। সনটি আন্তর্জাতিক এই অর্থে যে, এশিয়ার একাধিক জাতি এটি ব্যবহার করে। সনটি জ্যোতিষশাস্ত্রসম্মত। কারণ সূর্য রাশিচক্রের প্রথম রাশিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই সনটি শুরু হয়। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সনটির যোগ আছে। কারণ বহু হাজার বছর ধরে তাঁরা এটি অনুসরণ করে আসছেন।

বঙ্গাব্দ ইসলামি ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কারণ, হিযরি সালের উপর ভিত্তি করেই এই অব্দের বর্ষসংখ্যা স্থির করা হয়েছিল। এটি 'বাংলা' সন এই অর্থে যে, কোনো অজ্ঞাত কারণে মোগল সাম্রাজ্যের বাংলা সুবায় এই সনটি সসম্মানে বহাল আছে। বহু শত বৎসর ধরে ধর্মবিশ্বাসনির্বিশেষে বাংলা অঞ্চলের অধিবাসীরা এবং আদিবাসীরা এই সন ব্যবহার করে আসছেন তাদের দৈনন্দিন জীবনে, প্রধানত কৃষিকাজে। হিন্দু ও বৌদ্ধরা এই সাল ব্যবহার করে আসছেন তাদের ধর্মচর্চায়। সংস্কৃতি মাত্রেই বহু বিচিত্র উপাদানের সমন্বয়ের ফসল। বঙ্গাব্দের মতো সমন্বয়ের এত ভালো উদাহরণ বিরল।

গত কয়েক দশকে সম্প্রদায়নির্বিশেষে সব বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে বাংলা নববর্ষ। দুঃখের বিষয়, ২ বৈশাখ থেকে পরবর্তী পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত বঙ্গাব্দ 'কাজীর গরুর' মতো 'হিসাবে থাকে গোয়ালে থাকে না'– অন্ততপক্ষে শহুরে-হুজুগে-শিক্ষিত বাঙালির কাছে। 'পহেলা' শব্দের 'প' বর্ণটি বেমালুম ভুলে গিয়ে নববর্ষটি তারা 'হেলাফেলার'র বস্তু বলেই মনে করে। সুখের বিষয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৪২৪ সন থেকে বঙ্গাব্দ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ যদি আসলেই বঙ্গাব্দ প্রচলনে আন্তরিক হয়, তবে অনতিবিলম্বে বঙ্গাব্দকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবর্ষ হিসেবে ব্যবহার শুরু করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রীও দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বঙ্গাব্দ প্রচলনের ব্যাপারটি ভেবে দেখতে পারেন।

আজকের বাঙালিরা যদি তাদের জীবৎকালে সর্বস্তরে বঙ্গাব্দের প্রচলন দেখে যেতে চায়, তবে আকবরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বঙ্গাব্দকে করবর্ষ ঘোষণার বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে চৈত্রসংক্রান্তি হবে 'রাষ্ট্রীয় হালখাতা দিবস', কর দেবার সর্বশেষ বা সর্বপ্রথম দিন। যে সরকারপ্রধান, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী বা উপাচার্য এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হবেন, বঙ্গাব্দের ইতিহাসে তাঁরা প্রত্যেকে আকবরের মতো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

যে ঐতিহ্য দৈনন্দিন জীবনের, অভ্যাসের অংশ নয়, সেটা আগে-পরে বাধ্যতামূলক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়। শিক্ষা, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনসহ সর্বস্তরে ইংরেজি ভাষায় প্রাধান্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন যেমন নিছক ভাবের ঘরে চুরি, জনগণভুলানো এক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তেমনি বঙ্গাব্দটি যদি করবর্ষ বা শিক্ষাবর্ষে পরিণত করা না যায়, তবে পহেলা বৈশাখ আরও বহুকাল মাটির সানকিতে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার মতো 'এক প্রহরের লীলা' হিসেবেই কোনোমতে টিকে থাকবে।

স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাংলা ভাষা ও বঙ্গাব্দসহ অন্য আরও যে কয়েকটি খুঁটির উপর আমাদের সংস্কৃতির 'বাংলা ঘর'টি দাঁড়িয়ে আছে একে একে সেগুলোকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে বাঙালি জীবনের অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত করতে হবে। এ যদি করা না যায়, তবে 'পল্লীসাহিত্য' প্রবন্ধে ডক্টর শহীদুল্লাহ্ যেমনটি বলেছিলেন– 'সকলই ভুয়া, সকলই ফক্কিকার!'