অমঙ্গলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মঙ্গলযাত্রা

স্বদেশ রায়
Published : 14 April 2017, 03:42 PM
Updated : 14 April 2017, 03:42 PM

বাংলা নববর্ষকে এখন আর হিন্দুয়ানি বলারও সময় নেই, আবার আকবরের আমলে চালু হয়েছিল এমনটি বলে মুসলমানিত্ব প্রতিষ্ঠিত করারও কোনো দরকার নেই। বাংলা নববর্ষ আমাদের আধুনিক বাঙালি জাতিসত্তার একটি চালিকাশক্তি। রামমোহন, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, শেখ মুজিবুর রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক এক নতুন ইয়ং বেঙ্গল সমাজ– এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাঙালির যে অংশ আধুনিক বাঙালি জাতিসত্তার ধারক হয়েছে, যারা একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করেছে তাদের অন্যতম চালিকাশক্তি বাংলা নববর্ষ।

বাংলা নববর্ষের মধ্যে একটি বহুত্বের ধারণ আছে, একটি উন্মুক্ত বোধ কাজ করে এখানে। কারণ, ইংরেজি নববর্ষের মতো শুধু একটি ছুটি আর আরেকটি নতুন বছরে পা দেওয়ার জন্যে এই বাংলা নববর্ষ নয়। বাংলা নববর্ষের আহ্বান মূলত আমাদের শরীরে যে ধর্মীয় খোলস আছে, যে কূপমণ্ডুকতা আছে, নিজেকে নিয়ে পৃথিবীর পথে বের হয়ে পড়তে না পারার যে স্থবিরতা আছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্যে।

আজ যখন আমরা বাংলা নববর্ষ পালন করছি, এই বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ষাটের দশকে শহুরে মধ্যবিত্তের হাত ধরে যেদিন আধুনিক নববর্ষ পালন শুরু হয়েছিল তার থেকেও অনেক কিছু পালটে গেছে। এখন যে নববর্ষ পালিত হয়, তা একটি একক বিশ্বে একটি জাতিকে সবার সঙ্গে হাত ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে, কোনোক্রমেই নিজেকে একটি গণ্ডি বা নতুন করে পুরানোয় ফিরে যাওয়ার বা নস্টালজিয়া সামনে টেনে আনার জন্যে নয়।

আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়, যা এখন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে– এ কোনোমতেই পেছনে ফেরার কোনো যাত্রা নয়। মঙ্গল সবসময়ই ভবিষ্যতমুখী, কখনও অতীত স্মরণ করার বা অতীত নিয়ে কাল কাটানোর ভেতর কোনো মঙ্গল নেই। এ কারণে যে কোনো অতীতমুখিতা মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধী হয়। তারা মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত পাখির ডানা ভয় পায়, বিশাল গতিশীল প্রাণীর প্রতিকৃতি ভয় পায়, ভয় পায় মুখোশ। কেন তাদের এ ভয়?

তাদের এ ভয়ের কারণ খোঁজা খুবই সহজ। আমরা রবীন্দ্রনাথের 'বলাকা'য় চোখ রাখলেই দেখতে পাই পাখির ডানার কী দুরন্ত গতি! সে শুধু সামনে যায়, শুধুই সামনে যায়: "হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।"

পাখির ডানার অর্থই নিয়ত পরিবর্তনশীলতা। নিয়ত পরিবর্তনশীলতাই আধুনিকতা। এখানে অতীত ধরে বসে থাকার কূপমণ্ডুকদের কোনো স্থান নেই। বরং এই পাখার ঝাপটায় কূপমণ্ডুকতা ভেঙে যায়, পাখি বা দুরন্ত প্রাণীর মতোই গতিশীল হয়। এ গতির ধাক্কায় খসে পড়ে মুখোশ। যে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্ধত্ব ও স্বার্থ।

এছাড়াও এ কথা আজ খুব সহজে বলতে হবে, জটিল করে বলার কিছু নেই– বাংলা নববর্ষ আমাদের জীবনে কী? বাস্তবে যেদিন আমি বাঙালি হয়েছি, সেদিনই আমি আধুনিকতার পথে পা রেখেছি। আমি পরিবর্তনের পথে পা রেখেছি। পৃথিবীর এগিয়ে যাওয়ার গতির সঙ্গে আমার পরিবর্তন তো থাকবেই। পৃথিবী যে দানবটিকে শেকলে বেঁধে এগিয়ে চলছে ওই দানবটি মাঝে মাঝে নড়েচড়ে ওঠে। তার পায়ের চাপে, নখের আঘাতে রক্তাক্ত হয় পৃথিবী। আমাদের ছোট ছোট দানবগুলো আমাদের দেশটাকে রক্তাক্ত করছে। তারা আধুনিকতার বাহক বাংলা নববর্ষ থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

আমাদের যারা দেশ পরিচালনা করছেন, তারা এদের সঙ্গে আপস করছেন। তারা মনে করছেন, ক্ষণিকের আপস কোনো কিছু নয়, ক্ষণিকের ভালোবাসার মতো। ভালোবাসা পবিত্র, তার শরীর ফুলের পাপড়ির মতো আর অন্যদিকে দানবের নখ শুধু ধারালো নয়, ময়লায় পরিপূর্ণ। তাই ক্ষণিকের আপস বলে কিছু নেই; নখ ও ময়লা সমাজে প্রশ্রয় দেওয়া। এই প্রশ্রয়ই আপস।

এখন যদি আমরা পহেলা বৈশাখের সঙ্গে প্রতিবছর ছোট ছোট আপস করি, এগুলো একসময় বড় হবে। তবে তারা যতই বড় হোক না কেন, পহেলা বৈশাখ শেষ হয়ে যাবে না। বরং পহেলা বৈশাখের সঙ্গে অতীতে পড়ে থাকা দানবদের একটা যুদ্ধ হবে। সে যুদ্ধ সাধারণ কোনো যুদ্ধও নয়। রক্তাক্ত একটি যুদ্ধ। ইতিহাসের পাতায় বার বার এমন যুদ্ধ হয়েছে। সংস্কৃতি মুছে দেওয়ার জন্যে, জাতিসত্তা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্যে, আধুনিকতার পথ থেকে টেনে-হিঁচড়ে অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনেক যুদ্ধ হয়েছে পৃথিবীতে। রক্তপাত হয়েছে। নারীর আব্রু গেছে। শিশু হত্যা হয়েছে।

পৃথিবী যেমন শান্ত, সৌম্য নিয়তি সঙ্গে নিয়ে চলছে তেমনি অসুন্দরের বিরুদ্ধে এই নিজেকে বলিদানের যুদ্ধের এ নিয়তিও সমানে সঙ্গে নিয়ে চলছে।

বাংলাদেশের সামাজিক ও মানসিক 'ডেমোগ্রাফি' যেদিকে যাচ্ছে তাতে আজ হোক আর ভবিষ্যতে হোক একটা যুদ্ধ করতেই হবে। অনেকখানি সেই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে আমরা এখন চলেছি। এ যুদ্ধের ফলও সবার জানা। এ যুদ্ধে রক্তপাতসহ কঠিন কোনো যুদ্ধে যা যা হয় সবই হবে, তারপরেও জিতবে পহেলা বৈশাখ। জিতবে আধুনিকতা। সৌরমণ্ডলের গতির ফলে যেমন পৃথিবীকে নিয়মিত সূর্যের চারপাশে ঘুরতে হয়, ঠিক তেমনি আধুনিকতার নিজস্ব গতিতেই আধুনিকতা জেতে, জেতে পহেলা বৈশাখ।

প্রশ্ন আসতে পারে, যেখানে গান, নাচ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, যেখানে নতুন কাপড় পরা সেখানে আবার যুদ্ধ কেন? পৃথিবীর সব যুদ্ধই শুধু দানবে-দানবে নয়, অসুন্দরের বিরুদ্ধে সুন্দরের অনেক যুদ্ধ আছে। তাছাড়া সুন্দরের মঙ্গল হাতে একটি রক্তফোঁটাও আছে। পৃথিবীতে বারবারই সুন্দরকে রক্তের ওপর দাঁড়াতে হয়েছে। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অনেক রক্তের প্রতীকও থাকে। মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন একটি দিনের জন্যে, একটি দিবস পালনের জন্যে একটি মানবগোষ্ঠী এক রক্তপাতের দিকে এগিয়ে যাবে? আসলে কি বাংলা নববর্ষ একটি দিন? পহেলা বৈশাখ কি শুধুমাত্র রুদ্র বৈশাখের একটি দিন? কোনোমতেই নয়।

পহেলা বৈশাখ আমাদের জীবনের সার্বক্ষণিক, আমাদের সন্তানদের একটি আধুনিক বাসভূমিতে উন্মুক্ত আকাশের নিচে নিশ্বাস নেওয়ার এক অপরিহার্য সঙ্গি। একে কোনো সংজ্ঞায়, কোনো ইতিহাসের ক্যালেন্ডারে বা কোনো টোডরমলের ট্যাক্স কালেকশনের গণ্ডিতে আটকানো নয়। বাস্তবে পহেলা বৈশাখ 'চির-নূতন'এর এক ডাক। যে নতুনের ডাকের কারণে পৃথিবীতে প্রতিদিন সূর্য ওঠে একটি নতুন পৃথিবীর পথে মানুষ ছোটে, যে গভীর অন্ধকারে বসে মানব-মানবী নতুন ভোরের জন্যে অপেক্ষা করে, পহেলা বৈশাখের জন্যে অপেক্ষা করা সেই একই অপেক্ষা। আমাদের জীবন থেকে একে বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই, সংকুচিত করারও কোনো সুযোগ নেই।

যারা সংকুচিত করার মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন তারা পহেলা বৈশাখের অর্থ বোঝেন না এবং শক্তিও বোঝেন না। আর যদি তারা অনেক কৌশলী হন, যদি তারা যুদ্ধের সঠিক সময় নির্বাচনের জন্যে আপসের নামে সময়ক্ষেপণ করার পথ নিয়ে থাকেন তাহলে সে পথ আরও কঠিন, সে পথ এক জুয়া খেলা। সেখানে জয় আসতে পারে বিনা রক্তপাতে বা দিতে হতে পারে আরও বেশি মূল্য।

অন্যদিকে যারা পহেলা বৈশাখকে, মঙ্গল শোভাযাত্রাকে উপড়ে ফেলতে চাইছে তারা আধুনিক মানুষ তো নয়ই, বর্তমান পৃথিবীতে কোনোমতে তারা মানুষই নয়। তাদের পরাজয় হবে যুদ্ধের চরম মূল্য শেষে নতুন সূর্যের আলোয় আসা ভোরে।

এবার এই আকাশের কোণে জেগে ওঠা কালবৈশাখীর মেঘের দিনে তাদের বিরুদ্ধেই আসুক পহেলা বৈশাখ তার আপন শক্তিতে, আপন মঙ্গলযাত্রায়।