মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বাংলার ঐতিহ্য নববর্ষ

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 14 April 2017, 04:23 AM
Updated : 14 April 2017, 04:23 AM

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনের 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' বর্তমানে ইউনেসকোর (জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা) স্বীকৃতি লাভ করেছে। এমন একটি সাংস্কৃতিক মিছিল বা শোভাযাত্রা বিরল ঘটনা হিসেবে সমাদৃত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এই শোভাযাত্রায় নয়নাভিরাম পোশাকের সমাহার, চিত্রাঙ্কনের উৎকর্ষ, চারুকলার অসামান্য রচনাশৈলী সমগ্র বিশ্বে বিরল ঘটনা।

এটি শুধু একটি শোভাযাত্রা নয়, বাংলার ঐতিহ্য ও শিল্পকলার পারদর্শিতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি মানুষের প্রচণ্ড অনুরাগ– সবই প্রকাশ পেয়েছে এই শোভাযাত্রার মাঝে। এমন শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিক্যে ভরপুর শোভাযাত্রা বিশ্লেষণ করেই ইউনেসকোর বিশারদগণ আন্তর্জাতিকভাবে অভিনন্দিত করেছেন এই শোভাযাত্রাকে এবং তাদের তালিকায় স্থান দিয়েছেন।

নববর্ষের এই শোভাযাত্রা বাংলার গ্রাম ও শহরের চিত্রকে তুলে ধরেছে তা-ই নয়, বাংলাদেশের আদিবাসীদের জীবনের প্রতিচ্ছবিকে তুলির আঁচড়ে অবয়বের অবকাঠামোর মাঝে অপরূপভাবে দৃশ্যমান করে তোলে প্রতিবছর এই পয়লা বৈশাখের প্রথম প্রহরে।

পুবের আকাশে বিশাখা নক্ষত্রের (তারা) উদয়ের সঙ্গে প্রকৃতিতে আসে নতুন প্রেরণা, শীতকালীন ফসল বিক্রির পর বাৎসরিক খাজনা পরিশোধ করে চাষী পায় মুক্তির স্বাদ, হৃদয়ে আসে চরম স্বস্তি, ভাবনায় আসে অনেক নতুনের স্বপ্ন। আসবে বোরো ধান, চাষীরা ক্ষেত থেকে তুলবে আগাছা, জুম চাষীরা জুম পুড়িয়ে অপেক্ষায় আছে বৈশাখী বৃষ্টি আসবে বলে। তারা বুনবে হলুদ, আদা, তিল, তিসি। হিমালয় থেকে আসবে জল, তাই হাওরের ধান উঠবে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাংমা, তঞ্চগা, গারো, সাওতাল সবার কাছে বাংলার প্রকৃতি, বাংলার সম্পদ এবং পয়লা বৈশাখ অনেক প্রিয় দিন। এই ঐতিহ্য ধারণ করে সবাই উদযাপন করে নববর্ষ, যোগ দেয় মঙ্গল শোভাযাত্রায় একসঙ্গে।

বৈশাখকে ঘিরে আছে বিয়ু পরব, ২৯ চৈত্রের রাত থেকে ২ বৈশাখ। চৈত্র সংক্রান্তির মহা ধুমধাম, চিড়া-মুড়ি-দই খাওয়ার পালা। চাকমাদের কাছে এ হচ্ছে 'বিজু', অসম বা অহোমিয়াদের কাছে 'বিহু', ত্রিপুরীরা বলে 'বৈসু', বোমরাদের কাছে এ হচ্ছে 'কুমঠার', খুমিরা বলে 'সাংক্রাইন', রাখাইনরা বলে 'সাংগ্রাইন', তঞ্চাঙ্গাদের কাছে পয়লা বৈশাখ হচ্ছে 'বিষু'।

বাংলাদেশের সর্বত্র সব ধর্ম ও বিশ্বাসের মহামিলনের দিন হচ্ছে পয়লা বৈশাখ, তাই সবার ঐক্য-মিলনের মাঝে উদযাপিত হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা, দেশবাসীর মঙ্গল ও সমৃদ্ধি কামনার মাঝে চলে মহা সমারোহে, নিজস্ব ঐতিহ্য তুলে ধরার ঐকান্তিক প্রয়াসে।

নববর্ষ আসবে বলে বনিকদের ঘরে ঘরে শুরু হয় হালখাতার আয়োজন, মহা ধুমধামে। শহর-বন্দরে হালখাতার আয়োজন এতই জনপ্রিয় যে উৎসাহ-উদ্দীপনার মাঝে হালখাতার আয়োজন শুরু হয় চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে। শুরু হয় দেনাপাওনার হিসাবনিকাশ, সে অন্য এক ভাবনা। হালখাতা উৎসবে চলে মিঠাই-মন্ডার ব্যাপক আয়োজন। প্রচুর জিলাপি ও রসগোল্লার সমারোহ। যত পার খেয়ে নাও, কোনো কথা নেই কারো মুখে।

এর মাঝেই চলে নতুন কাপড় পরার এক ভিন্ন ভাবনা, মেলা ও সাংস্কৃতিক উৎসবের মাঝে মনে লাগে ফুরফুরে হাওয়া। নতুন বৌ দেখার সুযোগটিও সেরে নেয় অনেক যুবক বৈশাখের এই শুভ দিনে, গ্রামীণ মেলার কেনাকাটার মাঝে।

নববর্ষ উদযাপিত হয় পৃথিবীর দেশে দেশে। তবে এ নিয়ে বিভিন্ন সংস্কারের অভাব নেই। ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা মনে করে বছরের প্রথম দিনে যে মানুষটির সঙ্গে দেখা হবে তার যদি লাল চুল হয় এবং সে যদি অসুন্দর মহিলা হয়, তবে বছরটি হবে অবশ্যই দুর্ভাগ্যের। কালো চুলের অধিকারী, রুটি, টাকা অথবা হাতে লবণ নিয়ে আসা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে প্রথম দেখা হলে বুঝতে হবে বছরটি হবে আনন্দঘন।

ইংল্যান্ডের ছেলেমেয়েরা নববর্ষে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিবেশীদের বাড়িতে গান গাইতে গাইতে যাবে। প্রতিবেশীরা তাদের হাতে দেবে আপেল, মুখে দেবে মিষ্টি, পকেটে ভরে দিবে পাউন্ডের চকচকে মুদ্রা। মজার ব্যাপার হল অনেক মেয়েরা সকালের প্রথম প্রহরে ডিমের সাদা অংশ ছেড়ে দেবে পানিতে সুপাত্রের সঙ্গে বিয়ে হবে বলে। লন্ডনবাসীরা ট্রাফালগার স্কয়ারে অথবা পিকাডেলি সার্কাসে জড়ো হয়ে বিগবেনের ঘণ্টাধ্বনি শোনে, স্বাগত জানায় নববর্ষকে, প্রার্থনা করে গ্রেট ব্রিটেনের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে। বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজে বাজতে থাকে নববর্ষের আগমনী বার্তা।

জাপানিরাও জানুয়ারির প্রথম দিনকেই নববর্ষ হিসেবে উদযাপন করে। সব দোকানপাট, কল-কারখানা ও অফিস বন্ধ রাখে এবং পরিবারের সব লোকদের নিয়ে দিনটি উদযাপন করে। এ উদযাপনের মধ্যে আছে কিছু লোক সংস্কৃতির আমেজ। কিছু খড়কুটা দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘরের সামনে ঝুঁলিয়ে দেয়, ভূতপ্রেত ও শয়তানদের এ গৃহে প্রবেশ বন্ধ হবে বলে। নববর্ষকে জাপানিরা বলে 'উষাগাটসু'।

সিন্টো ধর্মের অনুসারীরা বছরের প্রথম দিনে প্রার্থনা করে সুখ ও সৌভাগ্যের প্রত্যাশায়। নতুন বছরের ঘণ্টা বাজলে অনেক জাপানি শুধু শুধু হাসতে শুরু করে, মনে করে বছরটি হবে হাসিখুশি ও আনন্দময়।

কোরিয়ার জনগণ নতুন বছরকে বলে 'সোল-নাল'। নতুন বছরে ঘরের সামনে খড়ের সেচনি, ঝাঁঝরি বা চালনি ঝুলিয়ে দেবে। নতুন কাপড় পরে ছোটরা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করবে, তারা আশীর্বাদ করবে। 'টুক্কুক' নামক সুপ খাবে চালের পিঠা দিয়ে। তাদের বিশ্বাস, সুপ খেলে বয়স বাড়ে। অনেকেই বয়সের হিসাব করে নববর্ষ থেকে, জন্মতারিখ ধরে নয়। আমেরিকাতে আতশবাজি ও নাচ-গানের মাঝে নিউ ইয়র্কের টাইম স্কয়ারে নববর্ষকে স্বাগত জানায় উৎফুল্ল জনতা। গাড়িতে হর্ন বাজায়, বন্দরে জাহাজের সাইরেন বাজে মহাসমুদ্রে নাবিকদের যাত্রা হবে বলে।

দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে মধ্যরাতে নববর্ষের প্রথম প্রহরে বাড়ির জানালা দিয়ে ঘরের নোংরা পানি বাইরে ছুড়ে মারে, যেন গত বছরের সব অশুভ শক্তি বহিষ্কৃত হয়। পুর্তগিজরা ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২টি আঙ্গুর খাবে। তাদের আশা আগামী ১২ মাস যেন খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে সৌভাগ্যের সঙ্গে গান গেয়ে কাটাতে পারে। বলিভিয়াতে বাড়ির আঙ্গিনায় কাঠের পুতুল সাজিয়ে ঝুলিয়ে রাখে যেন বছরটি ভালোভাবে কাটে।

মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও চীনে নববর্ষে একে অন্যের গায়ে পানি ছুড়ে মারে। এই পানিতে ভিজে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আত্মশুদ্ধির অভিযান। চীনের জনগণ নববর্ষে ড্রাগন ও সিংহের প্রতীক নিয়ে নাচ-গান করে। ড্রাগন হচ্ছে দীর্ঘায়ু ও সম্পদের প্রতীক, সিংহ হচ্ছে বীরত্বের। কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে জানুয়ারির প্রথম দিনকে নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে বিবেচনা করে না, তাদের বছর শুরু হয় আমাদের বৈশাখের কাছাকাছি সময়ে।

অবশ্য বাংলাদেশেও নববর্ষকে ঘিরে বা চৈত্র সংক্রান্তিতে ভূত ও অপদেবতা তাড়ানোর সংস্কৃতি প্রচলিত আছে। নববর্ষ পৃথিবীর সব দেশেই বিভিন্নভাবে উদযাপিত হয় দেশীয় সংস্কৃতি, জনগণের অনুভূতি, আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সবার প্রত্যাশা থাকে, নতুন বছরে অতীতের সব ব্যথা, দায়-দেনা ধুয়ে-মুছে নতুনভাবে শুরু হবে জীবন, সৌভাগ্যের রাজটিকা শোভিত হবে ললাটে, বিষাদ ও বিড়ম্বনার হবে অবসান।

প্রত্যাশার জোয়ারে ভাসে নববর্ষ, ঘরে ঘরে চলে ভালোখাবার তৈরি ও রান্নার প্রতিযোগিতা, সারা বছর ভালো খাবে বলে।

বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকায় মহরমের মিছিল ও জন্মাষ্টমীর মিছিল অনুষ্ঠিত হয় অত্যন্ত জাকজমকভাবে। এই দুটির মিছিল বা শোভাযাত্রা উদযাপিত হয় প্রধানত ধর্মীয় অনুভূতি থেকে। কিন্তু বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা অসাম্প্রদায়িক এবং সর্বজনীন সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে পালন করা হয়। মানুষের মাঝে যতই শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং নিজস্ব ঐতিহ্য তুলে ধরার ভাবনার বিকাশ হচ্ছে ততই মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো আয়োজনে সব স্তরের, সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলার মানুষের চিন্তায় ও চেতনায় সর্বজনীন ভাবনার মানসিকতা যুক্ত হয়েছে।

"সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে"– এমন ভাবনা বিকশিত হচ্ছে সর্বত্র। জাতি হিসেবে উন্নতির সোপানে অধিষ্ঠিত হতে হলে ঐক্যের ভাবনায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। শিক্ষার মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির চর্চা হবে তারই বাহন।