বধ্যভূমি, বৃক্ষরোপণ ও চিকিৎসক দিবস

মামুন আল মাহতাব
Published : 19 April 2017, 03:42 AM
Updated : 19 April 2017, 03:42 AM

৩০ মার্চ ছিল 'ডক্টরস ডে' বা চিকিৎসক দিবস। শতাধিক বছর আগে মার্কিন মুলুকে একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্টকে সম্মান জানাতে দিবসটির সূচনা আর পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট বুশের সময়ে এক আনুষ্ঠানিক ফরমানে এটির পালন বাধ্যতামূলক হয়।

ভারতবর্ষে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের স্মরণে অন্য একটি দিন 'চিকিৎসক দিবস' হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশে চিকিৎসকদের জন্য আলাদা দিবস নেই। এ নিয়ে ভাবেন না কেউ, সম্ভবত চিকিৎসকরাও নন। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসক দিবসটি এদেশে যৎকিঞ্চিৎ পালন করা হয়।

বরাবরের মতোই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বছরের চিকিৎসক দিবসেও ছিল স্ট্যাটাস, আলোচনা, 'লাইক' আর 'আনলাইক'এর ঝড়। সঙ্গত কারণে এই ঝড় বয়ে গেছে চিকিৎসকদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টগুলোতে।

এবারের চিকিৎসক দিবসের প্রেক্ষাপট কিছুটা আলাদা। চিকিৎসক-অচিকিৎসকদের মধ্যে একে-অপরকে না-বোঝার ফারাকটা ইদানিং যেন একটু বেশি। নিজেদের আর নিজেদের অবস্থান সাধারণ্যে তুলে ধরার উদ্যোগও চিকিৎসকদের তরফ থেকে ছিল অন্যবারের চেয়ে আরেকটু বেশি। আয়োজন করা হয়েছিল বর্ণাঢ্য র‌্যালির। এত সব উদ্যোগও চিকিৎসকদের বাইরে জনমানসে খুব একটা সাড়া তুলেছে বলে মনে হয় না। তবে র‌্যালি আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লেখালেখির ফুলঝুড়ি– আমার ধারণা– আখেরে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান আর গ্রহণকারীর মধ্যেকার দূরত্বটুকু কমিয়ে আনবে।

আসলে চিকিৎসকদের পেশাটাই এমন যে আমরা কীভাবে যেন ক্রমাগত 'আমাদের কেন্দ্রিক' হয়ে পড়ি। এটা সত্য যে, আমাদের এই পেশায় জনসম্পৃক্ততা খুবই বেশি। আবার পাশাপাশি এটাও সত্য যে, আমাদের আনন্দ-বিনোদন, হাসি-কান্না আর সকাল-সন্ধ্যা-রাতগুলো বড় বেশি হাসপাতালকেন্দ্রিক– যেখানে মানুষ যায় না পারতে– অসুস্থ হলে অথবা অসুস্থ কাউকে দেখতে।

এই অসুস্থদের আঙ্গিনাতেই কেটে যায় আমাদের যৌবন। তারও আগে ডক্টরস ক্লাবে কার্ড খেলে কিংবা হাসপাতাল করিডোরে প্রেয়সীর হাত ধরে কেটে যায় আমাদের তারুণ্য। আরও পরে বার্ধক্যে এসে সন্তানের পাত্র-পাত্রী আমরা খুঁজে ফিরি এই হাসপাতালগুলোতেই আমাদের জুনিয়র কলিগদের ভিড়ে। কাজেই আমদের সকাল-সন্ধ্যাগুলো যে অন্যদের চেয়ে আলাদা, আমাদের না বুঝতে পারার দলই যে সংখ্যায় ভারী তাতে আর অবাক কী!

এর উল্টোটাও কিন্তু বাস্তবতা। নিজের জীবন দিয়ে স্বৈরাচারের গদি উল্টে দেওয়া শহীদ মিলন ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। তারও অনেক আগে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন আমাদের পূর্বসূরিরাই। শহীদ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীকে আমরা সবাই চিনি একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে। কিন্তু কজন জানি তিনি একজন ভাষাসৈনিক?

একাত্তরে আমাদের শতাধিক পূর্বসূরি অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গকারী পেশাজীবীদের তালিকায় সংখ্যাধিক্যে চিকিৎসকদের অবস্থান উপরের দিকে। আর নিকট অতীতে আমাদের পরিচিত চিকিৎসকদের মধ্য থেকেই আমরা পেয়েছি সফল স্বাস্থ্যমন্ত্রী এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। চিকিৎসকরা এদেশে প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতিও হয়েছেন।

এমনি নানা সাত-পাঁচ আলোচনা করছিলাম বিমানে বসে চিকিৎসক দিবসে পাশে বসা প্রিয় অগ্রজ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়ুয়ার সঙ্গে। সঙ্গে ছিলেন আরও একজন চিকিৎসক, সরিষাবাড়ীর সাবেক সফল সাংসদ ডা. মুরাদ হাসান, যিনি পেশায় ক্যানসার বিশেষজ্ঞ। চিকিৎসক দিবসে আমাদের গন্তব্য রাজশাহী। তবুও উত্তমদা সকালে হাসপাতালে নিজ হাতে চিকিৎসক দিবসের পোস্টার লাগিয়েছেন, সহকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছেন হাসিমুখে চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য আর নেতৃত্ব দিয়েছেন চিকিৎসা দিবসের র‌্যালিতে। আমি বা ডা. মুরাদ সেসবের কিছুই করিনি।

আমরা চলেছি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃত্বে রাজশাহী আর নাটোরের বধ্যভূমিতে শহীদ স্মরণে শহীদ বীথি রোপণের তাগিদে। ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবসে বঙ্গভবনে এই কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধন করেছেন এই প্রজাতন্ত্রের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্তির সুবাদে আমাদের এই সুযোগ পাওয়া। আর তা হাতছাড়া করতে রাজি নেই আমাদের তিনজনের কেউ।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে বৃক্ষ রোপণের সম্পর্কটা অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য। একাত্তরের নয়টি মাসে আমাদের দেশে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবে তা একটি 'বিশ্ব রেকর্ড'। কারণ বিশ্বের কোথাও কখনও এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ হত্যার নজির নেই। যুদ্ধকালীন নয়টি মাসের প্রতিদিন আমরা গড়ে হারিয়েছি ১১ হাজারের বেশি মানুষ।

এই সংখ্যার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি কেউ। পারেননি চেঙ্গিস খান, এমনকি হিটলারও। তাই শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নয়, পুরো বিশ্বের পটভূমিতে এটি জঘণ্যতম মানবিক বিপর্যয়। এই বিপর্যয়ের কুশীলবদের বিচারের আওতায় এরই মধ্যে আনা হয়েছে এবং হচ্ছে।

ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিকে একটি কলঙ্ক থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। শহীদজননী জাহানারা ইমামের হাত ধরে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নিরন্তর ধরণা আর সংগ্রাম এই দাবিতে। আর এর সফল পরিসমাপ্তি শেখ হাসিনার হাত ধরে।

কিন্তু এই যে ৩০ লাখ জানা-অজানা শহীদ, কী করেছি আমরা তাদের জন্য? তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে আজ আমি বাংলাদেশের লিভার বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশের বিমানে চড়ে উড়ে চলেছি বাংলাদেশের বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে। জানি, তাদের রক্তঋণ আমরা শুধতে পারব কোনোদিন। কিন্তু তাদের জন্য ন্যূনতম শ্রদ্ধা জানাতে আমি-আপনি কী করেছি? কী করেছে পাশের বাসার মফিজ, অফিসের আবুল কিংবা দোকানের কুদ্দুস? আর যদি কিছু করেও থাকি তা শুধুই অবহেলা আর ধৃষ্টতা। কারণ এদেশেরই কিছু তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা আর ভুঁইফোড় বুদ্ধিজীবী প্রশ্ন তোলেন শহীদের সংখ্যা নিয়ে, প্রস্তাব দেন এ নিয়ে গবেষণারও। ধিক!

ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে বিশ্ব আজ অন্যরকম এক দুর্যোগের মুখোমুখি। নির্বিচারে গাছ কেটে আমরা ধরিত্রীর শ্রীহানিই শুধু করছি না, অপর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ আর 'গ্লোবাল ওয়ার্মিং'এর উত্তাপে মানবসভ্যতা তার ইতিহাসে ভয়াবহতম বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে আজ। এই শতাব্দীর পাতা উল্টানোর আগেই তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রতিবেশি মালদ্বীপ।

স্বস্তিতে নেই আমরাও। তলিয়ে যাবে আমদের এক-তৃতীয়াংশ ভূভাগ। বিপর্যয় ঘটবে দেশে দেশে। 'আইস এজ' একসময় পৃথিবী থেকে পরাক্রমশালী ডাইনোসরদের নাম-নিশানা মুছে দিয়েছিল। সেটি কোনো মানবিক বিপর্যয় ছিল না। কারণ সে সময় পৃথিবীতে মানবের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু আজ 'মানবরূপী' দানবদের দানবীয় তাণ্ডবে সভ্যতা দানবীয় মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। আর এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের সবচাইতে কার্যকর এবং সম্ভবত একমাত্র উপায় হচ্ছে বৃক্ষরোপণ।

আর এখানেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই 'চ্যাম্পিয়ন'। দেশে দেশে ঘুরে তিনি জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজ করে চলেছেন। জুটেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও; পেয়েছেন 'চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ' পদক।

এবার এ যুদ্ধে শামিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, তিতুমীর-ঝাঁসির রাণী-ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনসহ ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সব শহীদ আর দেশে দেশে গণহত্যার শিকার সব শহীদের স্মরণে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি রোপণ করবে ৩০ লক্ষাধিক বৃক্ষ, দেশে ও বিদেশে। আর প্রতিটি বৃক্ষের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে একজন শহীদের নাম। স্বযত্ন পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা এসব বৃক্ষ পরবর্তী প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেবে তাদের আগের প্রজন্মের ত্যাগ আর বীরত্বগাথা।

এভাবেই শোধ হবে শহীদের রক্তঋণ আর নিরাপদ হবে দেশে দেশে হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বদেশভূমির ভবিষ্যত।