যেদিন স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়

আনোয়ার কবির
Published : 17 April 2017, 05:24 AM
Updated : 17 April 2017, 05:24 AM

১৭ এপ্রিল বাঙালি জাতির জীবনে এক ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এদিনে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে হারানো স্বাধীনতার সূর্য পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশের বৈধ প্রতিনিধি বা সরকার মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। ১০ এপ্রিল প্রবাস কলকাতায় এই সরকার গঠন করা হয়েছিল। এক আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় আরেক আম্রকাননে জন্মলাভ করল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যের! এই মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।

২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বর্ণনা পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার 'Witness to surrender' গ্রন্থে দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন:

"…এইভাবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এখন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহুর্তে (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল। যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হল, ঠিক সেই মুহুর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের (ওয়েভ লেংনথ) কাছাকাছি একটি থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হল আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন।"

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত 'বাংলাদেশ ডকুমেন্টস' এই ঘোষণার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। ঘোষণায় বলা হয়:

"এই-ই হয়তো আপনাদের জন্য আমার শেষ বাণী হতে পারে। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি আপনাদের আহ্বা জানাচ্ছি– যে যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন এবং হাতে যার যা আছে তা-ই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃস্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান যতদিন না দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে।"

পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর সহযোগী নেতৃবৃন্দ, '৭০-এর নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের অধিকাংশ পার্শ্ববর্তী ভারতে গিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনায় এগিয়ে যান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সারা দেশে সাধারণ জনগণ, পুলিশ, ইপিআরের বাঙালি সৈনিক, সেনাবাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সারা দেশে বিক্ষিপ্তভাবে শুরু হয় জনযুদ্ধ। জনগণের এই মুক্তিসংগ্রামকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সহযোগী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভারতে একত্রিত হতে থাকেন।

পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ করা 'রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাইকমান্ড' বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামকে চূড়ান্ত রূপ দিতে ঐক্যবদ্ধ হন। '৭০-এর নির্বাচনে জনগণের নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের প্রতিনিধিগণ দীর্ঘদিনের মুক্তিসংগ্রাম, সর্বশেষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আইনগত বৈধতা প্রদান এবং সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১০ এপ্রিল গঠন করে স্বাধীন বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকার। সরকারের প্রধান রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম), উপ রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, সংসদীয় বিষয়ক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এইচএম কামারুজ্জামান এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে এম মনসুর আলী দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সশস্ত্র যুদ্ধের অধিনায়ক (প্রধান সেনাপতি) হিসেবে কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

সেসময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহচর ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিলেন তখন এই নেতৃবৃন্দকে 'হাইকমান্ড' হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সে হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়। সরকার গঠনের পর ১০ এপ্রিল কলকাতার 'আকাশবাণী' থেকে এই সংবাদ সম্প্রচারিত হয়। ১১ এপ্রিল 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ প্রচারিত হয়। ১০ এপ্রিল সরকার গঠনের পর ১৭ এপ্রিল প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের জনগণের বৈধ প্রতিনিধি বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে।

যেভাবে সরকার গঠন
১৭ এপ্রিল সকাল ৯টায় তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বৈদ্যনাথতলায় এসে পৌঁছায়। নেতৃবৃন্দের বসার জন্য আশে-পাশের গ্রামগুলো থেকে কিছুসংখ্যক চেয়ার জোগাড় করা হয়। সেসব চেয়ারের অধিকাংশগুলোরই হাতল ছিল না। বেলা ১১টা নাগাদ অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে আশে-পাশের গ্রামের প্রায় দুই হাজার লোক জমায়েত হয় এবং শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিভি ক্যামেরাম্যান উপস্থিত থাকেন।

আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান ও ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম কোলকাতা থেকে এই সাংবাদিকদের নিয়ে আসেন। মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসক ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জিপে করে তাজউদ্দীন আহম্মদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এমএজি ওসমানী ও অন্যান্য কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তোরণের কাছে নিয়ে গেলেন। মঞ্চ হতে ৮০ গজ দূরে কাঁচামাটির উপর আর একটি মণ্ডপ তৈরি করা হয়। সেই মণ্ডপেই উপবিষ্ট বিশিষ্ট অতিথিবর্গ। এছাড়াও প্রধান মঞ্চের পেছনদিকে ছোট একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। তার সঙ্গেই লাগানো পতাকাদণ্ড।

নেতৃবৃন্দ সেখান থেকে মুক্তিসেনাদের অভিবাদন গ্রহণ করেন। অভিবাদনের সময় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কর্নেল (জেনারেল) ওসমানী। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন পতাকা উত্তোলন করছিলেন তখন সাংবাদিকরা তাদের চতুর্দিকে ঘিরে দাঁড়ান। পতাকা উত্তোলনের সময় একটি ছোট দল জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা' গায়। গার্ড অব অনারের পর মন্ত্রিসভার সদস্যরা মঞ্চে উপবেশন করেন। এরপর মন্ত্রিসভার সদস্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, আইন সংসদীয় বিষয়ক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এইচএম কামারুজ্জামান এবং অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি তৈরি করেন ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম। অধ্যাপক আব্দুল মান্নান অনুষ্ঠানসূচি ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের পর অধ্যাপক ইউসুফ আলী নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। শপথ অনুষ্ঠানের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিভাষণ দান করেন। রাষ্ট্রপতির পরে তাজউদ্দীন আহম্মদ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। তিনি ঘোষণা করেন লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের নিচে পাকিস্তান সমাধিস্থ হয়েছে। আর সেই সমাধির ওপর একটি নতুন জাতির জন্ম হল, সেই জাতি হল বাংলাদেশ। উপস্থিত জনগণ এই ঘোষণাকে অভিনন্দিত করে।

এই অনুষ্ঠান চলাকালীন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, ক্যাপ্টেন হাফিজ, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ সেখানে উপস্থিত হন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এরপর অনুষ্ঠানে উপস্থিত মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের এবং যশোর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গার কয়েকজন পদস্থ প্রকৌশলীকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

এভাবেই বেলা দেড়টার দিকে অনুষ্ঠান শেষ হয়। একই দিন ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ম্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে 'আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ' নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের যেসব আইন চালু ছিল তা রক্ষার্থে এটি করা হয়।

সেসময়ে ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ঢাকা থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মদের কোলকাতায় যাওয়া, সরকার গঠন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়নসহ সব ঘটনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম। সেসময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি তাঁর 'মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি' গ্রন্থে। সরকার গঠনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে। স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন:

"১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন। সারা রাত ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম. মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ওসমানী একটি গাড়িতে রওয়ানা হয়ে যান। আমি ও আব্দুল মান্নান ভোরের দিকে পূর্ব কর্মসূচী অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। সেই ভোরেও ক্লাবে লোক ধরেনি। ক্লাবের বাইরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল।

"১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রধান প্রশ্ন ছিল সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তার সাথে আমাদের চিন্তার (বিস্তর) যোগাযোগ রয়েছে।

"আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দি। কিন্তু আমরা তা বলতে চাইনি। পাক বাহিনী বলুক এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমরা যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে, আর তারা যদি তা অস্বীকার করে তাহলে সমূহ বিপদের আশংকা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি তিনি দেশের ভেতর থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন হানাদাররা বলে বসবে তিনি বন্দি আছেন।

"আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভর দুপুরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি শ্লোগান। আমার কাজ ছিল দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে সাংবাদিকদের ফেরত পাঠানো। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলো। সাংবাদিকদের গাড়িযোগে ফেরত পাঠানো হলো। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফিরে সন্ধ্যায়। অনুষ্ঠানের পর কলকাতা গিয়ে সাংবাদিকরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই সংবাদ পরিবেশন করেন।"

('মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি', আমীর উল ইসলাম, পৃষ্ঠা: ৪৯-৫৫)

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম রচিত, অধ্যাপক ইউসুফ আলী পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের মূল সাংবিধানিক ভিত্তি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আইনগত বৈধতা প্রদান করে স্বাধীনতা সংগ্রামের। বাংলাদেশের সংবিধানেও সংযোজিত রয়েছে এই ঘোষণাপত্র। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি নিম্নে দেওয়া হল:

"যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল, যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ উক্ত অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭টি নির্বাচিত করেছিলেন, যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন, যেহেতু আহুত এই পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন, যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সাথে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতিবহির্ভুত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভুত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বা জানান, যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করছে এবং এখনো বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে, যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করে তুলেছে, যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, সেইহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে বাংলাদেশের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ গঠনের কথা ঘোষণা করছি এবং এই ঘোষণা দ্বারা আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বে যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন সেই পবিত্র ঘোষণাকে অনুমোদন করছি এবং এতদ্বারা আমরা আরও অনুমোদন করছি ও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করবেন। রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনী সমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হবেন। তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজনবোধে মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যদের নিয়োগ করতে পারবেন।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা যথাযথভাবে পালন করবো।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে ও নিয়মানুগ উপায়ে রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে তাকে এই কাজের জন্য নিযুক্ত করলাম।

স্বাক্ষর (এম ইউসুফ আলী)"

সরকারের ভেতর ষড়যন্ত্র
২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৭ এপ্রিল সরকার গঠন সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকে একটি কাঠামো এনে দেয়। মুজিবনগর সরকার সাংবিধানিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালনা করতে থাকেন সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ। বন্ধুপ্রতীম ভারত সরকারসহ বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যায় এই সরকার। জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা এভাবে প্রবাসী সরকার গঠন করে একটি সফল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ইতিহাস বিশ্বে বিরল। মুক্তিফৌজ, মুক্তিবাহিনীসহ দেশের ভেতরে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা আঞ্চলিক বাহিনীসমূহ একটি পতাকাতলে সম্মিলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মুজিবনগর সরকারের ভেতর নানা অন্তর্দ্বন্ধ শুরু হয়ে কষ্টলব্ধ মুক্তিসংগ্রামকে নসাৎ করার একটি প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতাকারী বৃহৎ পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে সরকারের ভেতরে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র গ্রুপ পাকিস্তানের সঙ্গে আপসের নানা আয়োজন করতে থাকে।

সেসময়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহচর মঈদুল হাসানের
'মূলধারা '৭১', মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎসের গবেষণা গ্রন্থ 'আন ফিনিশড রেভ্যুলেশন' থেকে অনেক তথ্য জানা যায়।

"৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রস্তাব করেন, কোলকাতায় বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে (খন্দকার মোশতাক) তারা জানিয়ে রাখতে চান যে, ইয়াহিয়া মোশতাকের সঙ্গে গোপন আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছেন। ফারল্যান্ডের এই প্রস্তাবে ইয়াহিয়া রাজি হন।"

('মূলধারা '৭১', পৃষ্ঠা: ৮৬)

১৯৭১ সালে কোলকাতা এবং অন্যান্য জায়গায় খন্দকার মোশতাক চক্রের সঙ্গে আটটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এইসব গোপন বৈঠকে খোন্দকার মোশতাকের সঙ্গে মাহবুবব আলম চাষী এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুর সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন (পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডেও এই ত্রয়ী চক্র সরাসরি অংশগ্রহণ করে)। খোন্দকার মোশতাক চক্রের গোপন ষড়যন্ত্রে মুজিবনগর সরকারের ভেতরে একটি প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। সারা জাতির সুক্ষ্মতম জায়গা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইমেজ কাজে লাগিয়ে এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে চায় এই চক্রটি।

তখন পাকিস্তানের কারাগারে জীবন-মৃত্যুর সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। 'স্বাধীন বাংলাদেশ চাও না জীবিত বঙ্গবন্ধুকে চাও'– এই চক্রের প্রোপাগান্ডার বিষয়ে দাঁড়ায়। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শক্তহাতে এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেন। সরকার থেকে বলা হয় আমরা দুটিই চাই।

খোন্দকার মোশতাকদের এই ষড়যন্ত্র সরকারের কাছে প্রকাশিত হওয়ায় আমেরিকায় জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল থেকে মোশতাককে প্রত্যাহার করা হয় এবং সরকারের কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়।

(এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে 'মূলধারা '৭১', 'আনফিনিশড রেভ্যুলেশন', লরেন্স লিফশুলৎস ও কাইবার্ডের প্রতিবেদন এবং কার্নেগি পেপার্স অবলম্বনে 'মুজিব হত্যায় সিআইএ' গ্রন্থ দেখুন)

মোশতাক চক্রের ষড়যন্ত্র ব্যতীতও যুবনেতা শেখ মনি, সিরাজুল আলম খানদের সঙ্গে সরকার পরিচালনা, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে মুজিবনগর সরকারের একটি দূরত্ব থেকে যায়।

যাহোক, ষড়যন্ত্র, নানাবিধ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ১৭ এপ্রিল যে স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়, সে সরকারের নেতৃত্বে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্মলাভ করে। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে। একটি সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দৃষ্টান্ত
প্রাচীনকাল থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বলা হয়েছিল, যদি কখনও শাসকগোষ্ঠী জনগণের উপর কোনো নির্যাতন, গণহত্যা চাপিয়ে দেয় তাহলে জনগণেরও অধিকার আছে তার আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের উপর যে নির্যাতন এবং গণহত্যা চালিয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা 'মুজিবনগর সরকার' গঠন করে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা এবং বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে তার আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে।

জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এক জনযুদ্ধের মধ্য দিয়েই জন্ম লাভ করেছে বাংলাদেশ। প্রাচীনকাল থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বলা জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে মুজিবনগর সরকার এবং বাংলাদেশ প্রথম ও একমাত্র সফল দেশ। বাংলাদেশের জন্মের আগে আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকারের এই বিষয়টি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শুধুমাত্র থিওরি অর্থাৎ কাগজ-কলমের তত্ত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশ তার বাস্তব দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই বাস্তব এবং একমাত্র উদাহরণ সৃষ্টিকারী মুজিবনগর সরকার যে কোনো বিচারেই দেশের সবচেয়ে সফল এবং বিশ্ববাসীর জন্য দৃষ্টান্তমূলক সরকার।

বাংলাদেশে অসংখ্য সরকার গঠিত হবে, কিন্তু সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যে গড়ে ওঠা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকার, সরকার পরিচালনায় যে সফল নেতৃত্ব প্রদান করেছে তা যুগ যুগ ধরে সারা জাতিকে দুঃসময়ে পথ দেখাবে। সারা জাতির অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে মুজিবনগরের প্রথম প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার।