আত্মঘাতী জঙ্গিবাদ: উৎসের স্বরূপ সন্ধানে

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 20 April 2017, 04:58 AM
Updated : 20 April 2017, 04:58 AM

সিলেটে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে মারা গেছেন র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদসহ সাতজন এবং আহত হয়েছেন ৪৫ জনের বেশি। বাংলাদেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে এই প্রথম আত্মঘাতী বোমা হামলায় এত অধিকসংখ্যক মানুষ হতাহত হলেন। জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনাও এই প্রথম।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব থাকলেও এ ধারার রাজনীতিতে পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের অনুকরণে আত্মঘাতী জঙ্গি হওয়ার প্রবণতা সর্বসাম্প্রতিকতম সংস্করণ।

সাম্প্রতিক সময়ে সরকার উদ্ভাবিত এবং মিডিয়ায় বহুল ব্যবহৃত শব্দ 'জঙ্গিবাদ' শুনে আমাদের অনেকের মনে হতে পারে এটি বোধহয় বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন উপাদান। তারা যেভাবে 'মৌলবাদী' রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে ক্রমাগত জঙ্গিবাদ বলে আখ্যায়িত করে চলেছে তা শুনলে হটাৎ করে মনে হতে পারে এ যেন পাড়া-মহল্লার কিছু মাস্তানের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে 'মৌলবাদ', জঙ্গিবাদ হল মূলত সেই মৌলবাদী রাজনীতিরই সন্ত্রাসবাদী রূপ, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত দুই দশক ধরে সবসময়ই কমবেশি বিদ্যমান ছিল।

'মৌলবাদী' রাজনীতিতে যারা বিশ্বাস করেন তাদের কেউ কেউ মনে করেন নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় তাদের পক্ষে রাজনৈতিক লক্ষ হাসিল করা সম্ভব হবে না; তাই রাজনৈতিক লক্ষ হাসিল বা ক্ষমতা দখল করতে হবে সন্ত্রাসের মাধ্যমে। একথা শুধু মৌলবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, বামধারার রাজনীতির ক্ষেত্রেও এ সন্ত্রাস-নির্ভরতা দেখা গেছে, তাদের রাজনৈতিক লক্ষ অর্জনের মাধ্যম হিসেবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা 'নকশাল বাড়ি আন্দোলন' অনুসরণে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির এবং জাসদের গণবাহিনীর রাজনৈতিক সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করেছি। এরও পূর্বে যখন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন হিসেবে পাকিস্তান আমলে ইসলামি ছাত্র সংঘের প্রতিষ্ঠা হয়, শুরু থেকেই এ সংগঠনটিকে সীমিত পর্যায়ে হলেও (প্রতিষ্ঠালগ্নে সীমিত সাংগঠনিক শক্তির কারণে) সেক্যুলার এবং বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করে টিকে থাকার স্ট্র্যাটেজি নিতে দেখা যায়। সীমিত পর্যায়ের সন্ত্রাস রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পেলে কি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে তার উদাহারণ আমরা দেখতে পাই ১৯৭১ সালে ইসলামি ছাত্র সংঘের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মদদে আল বদর নামক সন্ত্রাসী সংগঠন গঠনের মাধ্যমে ব্যাপক গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যায় সক্রিয় ভূমিকা পালনের মধ্যে।

স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের সময় জামায়াত যখন আবার তাদের ছাত্র সংগঠন 'ছাত্রশিবির' নাম দিয়ে পুরুজ্জীবন ঘটায়, তখনও এ ছাত্র সংগঠনটি তার সাংগঠনিক বিকাশের কৌশল হিসেবে ভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর উপর সন্ত্রাস বেছে নেয়। এ সন্ত্রাসের স্বীকার শুধু যে বাম ও সেক্যুলার ধারার ছাত্র সংগঠনই হয় তা-ই নয়, এমনকি যারা রাজনীতিতে তুলনামূলকভাবে সীমিত পর্যায়ে ধর্মের ব্যবহারের পক্ষপাতী এবং যে রাজনৈতিক দলটি তাদের পুনরায় স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার অনুমতি প্রদান করে, সেই দলের অর্থাৎ বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদলের বহু নেতাকর্মীও শিবিরের সন্ত্রাসের স্বীকার হন। তাদের সন্ত্রাসের উপর নির্ভরশীলতার এ কৌশল তাদের জাতীয় রাজনীতিতে খুব দ্রুত লাইমলাইটে নিয়ে আসতে সাহায্য করে।

ধর্মনির্ভর রাজনৈতিক দল বা তাদের ছাত্র সংগঠন কর্তৃক সন্ত্রাস বলতে মূলত প্রতিপক্ষ সংগঠনগুলোর কর্মীদের উপর হামলা বা কোনো ব্যক্তিবিশেষকে টার্গেট করে রাতের অন্ধকারে খুন বা চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়াকেই বোঝাত। বারবার হামলার স্বীকার হলেও বামসহ মূলধারার দলগুলির মধ্যে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাংগঠনিক ক্ষমতা বা সন্ত্রাস করার ক্ষমতা সম্পর্কে একটা অবজ্ঞার ভাব পরিলক্ষিত হত।

ধর্মনির্ভর রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসের নতুন রূপ দেখা যায় গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকে। ১৯৭৮ সালে 'the Saur Revolution'-এর মাধ্যমে আফগানিস্তানে যখন বামপন্থী পিপলস ডেমোক্রাটিক পার্টি ক্ষমতায় আসে তখন এ সরকারকে উৎখাত করার জন্য মুজাহিদিন বাহিনী গড়ে উঠে। মুজাহিদিনরা এ বাম সরকারকে 'নাস্তিকবাদী' মনে করত এবং পরিবর্তে শরিয়াভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পিপলস ডেমোক্রাটিক পার্টির সরকার উৎখাতের পথ ধরে।

ফলে তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট নূর মোহাম্মদ তারাকি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে মুজাহিদিন বাহিনীকে দমন করার জন্য সৈন্য পাঠাতে অনুরোধ করেন। প্রাথমিক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ করে এবং এর ফলে বিশ্ব প্রথমবারের মতো ইসলামপন্থার রাজনীতির সশস্ত্র রূপটি প্রত্যক্ষ করে সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্রে।

পাকিস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ তখন এ সরকারবিরোধী মুজাহিদিন বাহিনীকে নানাভাবে সাহায্য করতে থাকে। প্রখ্যাত পাকিস্তানি সাংবাদিক জাহিদ হুসেইন তাঁর 'Frontline Pakistan: the Struggle with Militant Islam' (New York: Columbia University Press, 2007) গ্রন্থে বিভিন্ন মার্কিন সূত্র ধরে উল্লেখ করেছেন:

"এ সাহায্য শুধুমাত্র সামরিক ও অর্থনৈতিক খাতে সীমাবদ্ধ ছিল না। গেরিলা যুদ্ধের ফলে যে লক্ষ লক্ষ আফগান শরণার্থী হয়ে পাকিস্তানে চলে যান তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য পাকিস্তান সরকার সীমান্ত এলাকায় যে অসংখ্য মাদ্রাসা স্থাপন করেছিল সেসব মাদ্রাসার কারিকুলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের University of Nebraska তে প্রণীত হয়েছিল।"

এসব মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকে শেখানো হত:

"একজন কমিউনিস্টকে হত্যা করা ৮০ হাজার বার নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম।"

এরকম অসংখ্য মনগড়া বিষয় এসব মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল আফগান জনগণকে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে সম্পৃক্ত করার জন্য। আফগান জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এ সবকিছুই ইসলামের বিধান মনে করে সোভিয়েত বাহিনী এবং কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

আফগান যুদ্ধ শুধুমাত্র আফগান জনগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধকে তাদের ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার এক মহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে দেখে। ফলে পাশ্চাত্যের সহায়তায় পাকিস্তান যাতে সারা বিশ্ব থেকে মুসলিমরা সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিতে পারে তার ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। যেটি হওয়ার কথা ছিল জাতীয় প্রতিরোধ যুদ্ধ, সারা বিশ্বের মুসলমানদের এ যুদ্ধে সম্পৃক্ত করার জন্য সেটিকে 'জিহাদ' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, এবং মুসলিমদের উদাত্ত চিত্তে এ জিহাদে অংশগ্রহণের আহবান জানানো হয়।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ থেকেও অনেকে, বিশেষত যারা বিভিন্ন 'ইসলামপন্থী' দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল, এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে আফগানিস্তান যায়। সেসময় বাংলাদেশের জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে আফগান মুজাহিদদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব ছিল। অনেকেই তখন মনে করতেন যে নাস্তিক, কাফের বাহিনীর বিরুদ্ধে ইসলামের সৈনিক মুজাহিদরা লড়াই করছে।

মূলধারার প্রায় সব সংবাদপত্রই সে সময় মুজাহিদিন বাহিনীকে সমর্থন করে ইতিবাচক সংবাদ এবং সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করত। অর্থাৎ শীতল যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান সম্পর্কে যে নীতি অনুসরণ করত আমাদের দেশের সরকারি মিডিয়াসহ মূলধারার সংবাদপত্রসমূহ সে নীতিকে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা চালাত।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পর ১৯৯২ সালে পাকিস্তান সমর্থিত মুজাহিদিন বাহিনীর হাতে কমিউনিস্ট নাজিবুল্লাহ সরকারের পতন ঘটার পর বাংলাদেশ থেকে যারা যুদ্ধে গিয়েছিল তারা দেশে ফেরত আসতে থাকে। আফগান যুদ্ধ সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমগুলোর ক্রমাগত ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশনের ফলে জনগণের অনেকের মধ্যে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছিল।

আফগান যুদ্ধফেরত মুজাহিদিন বাহিনীর সদস্যরা দেশে এসে আলকায়েদার চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে ইসলামপন্থী রাজনীতিতে নতুন ধারা যোগ করে সন্ত্রাসনির্ভর, আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে। মূলধারার ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের বিশেষত তরুণ সদস্যদের মধ্যে সশস্ত্র পন্থায় আফগানিস্তানে সফলতা আসার পরে বিতর্ক শুরু হয় নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় বাংলাদেশে 'ইসলামি বিপ্লব' সফল করা সম্ভব কি না।

এ ধরনের বিতর্ক আমরা গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তর দশকের বাম দলগুলোর তরুণ কর্মীদের মধ্যে দেখি, যার ফল হল এসব দল থেকে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য বেরিয়ে গিয়ে গোপন সন্ত্রাসবাদী, রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলে। পশ্চিমবঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তরুণ ক্যাডারদের একটি অংশ চারু মজুমদারের নেতৃত্বে বেরিয়ে গিয়ে ষাটের দশকের শেষ দিকে গড়ে তোলে 'নকশালবাড়ি আন্দোলন'। এর প্রভাবে সে সময় সিরাজ সিকদার গড়ে তোলেন সর্বহারা পার্টি।

অনেকটা ঠিক একইভাবে এ ধরনের বিতর্কের ফলে নব্বইয়ের দশক থেকে মূলধারার বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল থেকে তরুণ সদস্যরা এসব সন্ত্রাসনির্ভর, গোপন ধর্মভিত্তিক সংগঠনে যোগ দিতে থাকে, যে যোগদানের ধারা এখনও অব্যাহত।

বাম রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন প্রধান শত্রু থাকে যাদের তারা 'শ্রেণিশত্রু' বলে অভিহিত করে, তেমনি এসব ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোরও প্রধান শত্রু রয়েছে। এককথায় বাম রাজনৈতিক দলসমূহ শিল্পপতি, বনিকশ্রেণি, জোতদার (তাদের ভাষায় 'বুর্জোয়া', 'পেটি বুর্জোয়া' ইত্যাদি), এদের সমাজ বিকাশের প্রধান প্রতিবন্ধক মনে করে। সুতরাং সমাজের বিকাশ ঘটাতে হলে এসব শ্রেণির বিলোপ সাধন করতে হবে। নকশালবাড়ি, সর্বাহারা ইত্যাদি গোপন বাম সংগঠনগুলো মনে করত এসব শ্রেণির লোকজনদের হত্যা করার মধ্য দিয়েই সমাজের প্রগতিশীল বিকাশ ঘটবে।

বাম রাজনৈতিক দলগুলির মতো মূলধারার 'ইসলামপন্থী' এবং গোপন সংগঠনগুলোরও প্রধান শত্রু রয়েছে যাদের তারা ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজ কায়েমের প্রধান অন্তরায় মনে করে। এদের কাছে প্রথম ও প্রধান শত্রু হল বাম ও কমিউনিস্টরা যাদের এরা 'নাস্তিক' মনে করে।দ্বিতীয় শত্রু হল সেক্যুলাররা, যাদের তারা নাস্তিক মনে না করলেও নাস্তিকদের কাছাকাছি মনে করে।

'ইসলামপন্থী' রাজনীতি যারা করেন, সেক্যুলার রাষ্ট্র তারা চান না। কারণ তারা মনে করেন এ ধরনের রাষ্ট্র যেহেতু সব ধরনের চিন্তার বিকাশ উৎসাহিত করে, ফলে সেক্যুলার রাষ্ট্র সমাজে নাস্তিকবাদী চিন্তারও বিকাশ ঘটতে পারে।

'ইসলামপন্থী' দলসমূহের কমিউনিস্টদের নাস্তিকতার তকমা লাগিয়ে শক্ত বিরোধিতা করাকে পাশ্চাত্য সেসময় ইতিবাচক হিসেবে দেখেছিল। তারা মনে করত এ ধরনের বিরোধিতা মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার বিকাশ রুদ্ধ করবে। কিন্তু যে বিষয় তারা সেসময় মাথায় রাখতে পারেনি, তা হল সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিজমের সঙ্গে 'ইসলামপন্থা'র রাজনীতির দ্বন্দ্ব শুরু হতে পারে, এ বিষয়টি।

বাংলাদেশে গোপন 'ইসলামপন্থী' সংগঠনগুলোর এখন পর্যন্ত সব টার্গেটের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে বাম ও সেক্যুলার চিন্তাধারার রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।

বিএনপিসহ যেসব দল ও সংগঠন সমাজে ও রাষ্ট্রে ইসলামের নূন্যতম হলেও ভূমিকা পালন করা উচিৎ বলে মনে করে তারা আপাতত থাকছে নিরাপদ। যদিও একটা সময় পর এরাও নিরাপদ থাকবে কি না– এটি প্রশ্নসাপেক্ষ। অপরদিকে বিএনপি মনে করে আসছে এসব হামলা যেহেতু সেক্যুলারদের উপর হচ্ছে, এটি বিএনপির রাজনীতির জন্য সহায়ক। ফলে বিএনপি সবসময় তাদের বক্তব্য এমনভাবে দিয়ে আসছে যা কিনা জঙ্গিবাদের রাজনীতিকে কোনো না কোনোভাবে সহায়তা করছে।

এতদিন পর্যন্ত জঙ্গিবাদী হামলার ধরন সন্ত্রাসবাদী হলেও সেখানে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা ছিল না। আত্মঘাতী বোমা হামলার ধারণা আধুনিক বিশ্বে প্রথম আনে শ্রীলঙ্কার The Liberation Tigers of Tamil Eelam (LTTE)। ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ ১৯৭৬ সালে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন সংখ্যাগুরু সিংহলীদের জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সিংহলীরা হলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী; অপরদিকে তামিলরা হলেন হিন্দু ধর্মের অনুসারী।

এলটিটিইর আত্মঘাতী বোমা হামলা বহু মানুষের শুধু প্রাণ কাড়েনি, তাদের সন্ত্রাসবাদের এ ধরন সেদিন সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল এবং একইসঙ্গে ঘৃণারও কারণ হয়েছিল। এলটিটিইর এক আত্মঘাতী নারী বোমা হামলাকারীর হাতে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী প্রাণ হারান।

আত্মঘাতী বোমা হামলা করে একটি জাতির মুক্তি আন্দোলন করা যায় কি না– সে প্রশ্নটি তখন নানা মহলেই উঠেছিল। বাংলাদেশের মুসলমান সমাজে তখন সন্ত্রাসবাদের এ ধরন অত্যন্ত ঘৃণিত ছিল। অনেকেই এটাকে 'হিন্দুত্ববাদী' ভারতীয় ধারণা মনে করতেন এবং শ্রীলঙ্কাকে অস্থিতিশীল করার ভারতীয় চক্রান্ত হিসেবে দেখতেন।

এলটিটিইর আত্মঘাতী বোমা হামলার ধারণার চেয়েও বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় বোধহয় মুসলমান সমাজের কারো কারো এ ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। সেদিন যা ছিল 'হিন্দুত্ববাদী' ভারতীয় ধারণা, তাকেই আজ 'জিহাদি' ধারণা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

শিয়া ও সুন্নি মতের যত মাজহাব আছে তার কোথাও আত্মঘাতী বোমা হামলার ধারণা পাওয়া যায় না। যে ওয়াহাবি/সালাফি মতের কথা অনেকে বলে থাকেন সেখানেও আত্মঘাতী হওয়ার কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। বিস্ময়ের ব্যাপার হল কোনো মাজহাবেই যার সমর্থন নেই এমন একটা বিষয়কে মুসলমান সমাজের কারো কারো কাছে আকর্ষণীয় করা গেল কীভাবে?

মুসলমান সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য হল ধর্মকে তারা যতটা না জানেন তার চেয়েও ধর্মকে ভয় পান তারা বেশি, যাকে এককথায় বলা যায় 'ধর্মভীরু'। আর এ ভীরুতা কাজে লাগিয়ে অনেক সুযোগসন্ধানী যুগে যুগে ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ সাধারণ মুসলমানের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছেন।

এক্ষেত্রে আলেম সমাজ হিসেবে যারা নিজেদের দাবি করেন তারা যে ভূমিকা পালন করতে পারতেন অনেক ক্ষেত্রেই তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অমুসলিম কর্তৃক মুসলিম জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হলে আলেম সমাজ সহজে প্রতিবাদ করতে পারেন, কিন্তু মুসলমান কর্তৃক মুসলমান যখন সন্ত্রাসের শিকার হন তখন আলেম সমাজ অনেকটাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। পাশাপাশি ইসলামবিরোধী কোনো বিষয়কে যত সহজে আলেম সমাজ প্রতিবাদ করতে পারে, কোনো একটা বিষয় যখন ইসলামের নাম দিয়ে করা হয় তখন আলেম সমাজ সেটা ইসলাম সম্মত নয় বুঝলেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ততটাই ইতস্তত করে।

এই ইতস্তত করার মূল কারণ হচ্ছে মুসলমান সমাজে মতবিরোধ হলেই কথায় কথায় নাস্তিক, মুরতাদ, বা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছে– এ ধরনের ফতোয়া দিয়ে দেওয়া। ফলে ইসলামের নামে কোনো অন্যায় হলেও প্রতিবাদ করে নাস্তিক, মুরতাদ ইত্যাদি তকমা যাতে গায়ে না লাগে এ ব্যাপারে অনেকেই সতর্ক থাকেন। আর এ দুর্বল জায়গাটার সু্যোগ নেন ধর্ম ব্যবসায়ী, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সন্ত্রাসবাদী গোপন সংগঠনসমূহ।

গোপন সংগঠনসমূহের সদস্য রিক্রুটের মূল টার্গেট হল তরুণ সমাজ। বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দূরত্ব কমে এসেছে। এর ফলে পাশ্চাত্য এবং অন্যান্য অমুসলিম দেশের জীবনাচারণ ও সংস্কৃতির প্রভাব পড়ছে মুসলমান প্রধান দেশগুলোর তরুণ সমাজের উপরে। এর ফলে মুসলমান তরুণদের মধ্যে একধরনের মনোজাগতিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। একদিকে তারা পাশ্চাত্যের জীবনাচারণ, সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। উচ্চশিক্ষাসহ নানাবিধ কারণে অনেকেই যে কোনো মূল্যে পাশ্চাত্যের নানা দেশে যেতে চাচ্ছেন। অপরদিকে তাদের ট্র্যাডিশনাল জীবনাচারণ, যেটাকে তাদের অনেকে ইসলামিক বলে মনে করেন তার সঙ্গে পাশ্চাত্যের জীবনাচারণ ও সংস্কৃতির সংঘর্ষ হচ্ছে। এ সংঘর্ষের কারণ বুঝতে না পেরে তাদের কেউ কেউ নৈরাজ্যবাদিতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে আত্মঘাতী হওয়ার পথ বেছে নিচ্ছে। তরুণ সমাজের এ মনোজাগতিক দ্বন্দ্বের বিষয়টাকেই কাজে লাগাচ্ছে জঙ্গিবাদী সংগঠনসমূহ।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের ফলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে পরিবর্তন ঘটে চলছে আলেম সমাজ ইসলামের আলোকে এর ব্যাখ্যা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। পরিবর্তনশীল যে কোনো কিছুকেই এককথায় 'ইসলামবিরোধী' আখ্যা দিয়ে দায় সারছে। কিন্তু দুই শব্দের এ ব্যাখ্যা তরুণ সমাজের ট্র্যাডিশনাল Mindset নিয়ে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় বসবাসের মনোজাগতিক দ্বন্দ নিরসন করতে সাহায্য করছে না, যা আখেরে কাউকে কাউকে আত্মঘাতী হওয়াসহ জঙ্গিবাদী হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বাংলাদেশের যে 'অ্যাপ্রোচ' নিয়েছে তা হল জঙ্গিবাদী সংগঠন বা জঙ্গিদের দমন করা, জঙ্গিবাদ দমন করা নয়। এ অ্যাপ্রোচের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল জঙ্গিবাদের যে রাজনীতি, তা উপেক্ষা করা।

জঙ্গিবাদের উৎস হল একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদ। এ মতবাদকে যতক্ষণ পর্যন্ত আরেকটি মতবাদ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত শুধুমাত্র সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যাবে না।