হাসিনার সফর ও দিল্লির অঙ্গন

স্বদেশ রায়
Published : 10 April 2017, 04:10 AM
Updated : 10 April 2017, 04:10 AM

ভারতের ক্ষমতাসীন দলের প্রথম সারির নেতাদের একটিই প্রশ্ন: হাসিনাজি বা বাংলাদেশের মানুষ নিশ্চয়ই সঠিক বার্তা পেয়েছেন, মোদি সরকার বাস্তবে কী ধরনের সম্পর্ক চায় বাংলাদেশের সঙ্গে?

তাদের কথার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়, মোদি যে নিজের জন্যে কোনো নিরাপত্তারক্ষী না নিয়ে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমান বন্দরে গিয়েছিলেন, এ ছিল শুরুতেই বাংলাদেশের মানুষ ও শেখ হাসিনাকে ভারতের ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে একটি বার্তা দেওয়া: কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায় ভারত সরকার তাদের বন্ধুত্ব বাংলাদেশের সঙ্গে।

বিজেপি অনেক বেশি সুসংগঠিত একটি দল। তাদের নিজস্ব দলীয় কাঠামো তিন স্তরের। তাই সরকারের বড় সিদ্ধান্ত কখনও দলীয় সিদ্ধান্তের বা দলের নেতাদের চিন্তার বাইরে হয় না। সে হিসাবে শেখ হাসিনার সফরের শুরুতে বাংলাদেশকে মোদি যে বার্তা দেন তা তাঁর একক সিদ্ধান্ত যেমন হতে পারে, তেমনি দলীয় সিদ্ধান্তও হতে পারে।

শেখ হাসিনার সফর এখনও শেষ হয়নি। তবে এই সফরের প্রতিটি স্তরে, ভারত শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশকে সম্মানিত রাখার চেষ্টা করেছে। সফরের প্রথম দিনেই বাংলাদেশ হাই কমিশনারের দেওয়া ডিনারে তাই দেখা যায় ভারত সরকারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার অজিত ডোভালকে। এ মুহূর্তে যারা ভারতের কেন্দ্রের সরকারের ভেতরের কাঠামোগত খোঁজখবর রাখেন এবং তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে কে কী ভূমিকা রাখছেন– এ বিষয়ে জানেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন, ভারতের এই ক্ষমতাধর ডোভাল সাহেবের উপস্থিতিও কম কোনো বার্তা ছিল না প্রথম দিনে।

আর এ কারণে চার দিনের সফর মূলত দুই দিন না হতেই শেষ হয়ে যায়। সাধারণত যে কোনো সফরের শেষ দিনে যৌথ বিবৃতি আসে। কিন্তু এই সফরের সব থেকে বড় দিক হল দ্বিতীয় দিনের মধ্যাহ্নেই যৌথ বিবিৃতি দেওয়া হয়। অবশ্য এই যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের জন্যে একটা আশাহত হওয়ার বিষয় আছে। যদিও বিষয়টি আগের থেকে স্পষ্ট ছিল যে, এই সফরের ভেতর দিয়ে তিস্তা চুক্তি হবে না; তারপরও একটি ক্ষীণ আশা জাগিয়েছিল সাধারণ মানুষের মনে, যেহেতু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ অবধি দিল্লি যেতে রাজি হন।

মমতার রাজি হওয়ার বিষয়টিতে সব থেকে বেশি কাজ করেছে তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক নিঃসঙ্গতা। দিল্লির রাজনীতিক মহলের মতে, তিস্তা নিয়ে মমতা যে অবস্থান নিয়েছে তাতে তিনি ভারতের অনান্য রাজনৈতিক দলগুলোর একেবারে বিপরীতে চলে গেছেন। অন্যদিকে মমতার ওপর কেন্দ্রের চাপ বেড়েছে জঙ্গি সমস্যা নিয়ে।

দিল্লির ক্ষমতাসীনরা অনেক বেশি ওয়াকিবহাল, বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় পাচ্ছে। তাই তাদের এখন সিদ্ধান্ত কেন্দ্রকে বিষয়টি বেশ শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে। এবং তারা সে কাজটি করবে এমন তাদের কথাবার্তার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায়। মমতা যেমন আগামী নির্বাচনকে জড়িয়ে তার তিস্তার বিষয়টি দেখছেন, তেমনি আগামী নির্বাচনের আগে কেন্দ্র যদি কঠোরভাবে পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গি দমনে নামে তা-ও মমতার ভোটের ওপর প্রভাব ফেলবে– এ বিষয়টিও তিনি চিন্তা করছেন। যে কারণে মমতাকে এখন একটি পথ খুঁজতে হচ্ছে। কিভাবে তিনি তিস্তা নিয়ে একটি সমঝোতায় আসতে পারেন কেন্দ্রের সঙ্গে– এ পথটি তিনিও খুঁজছেন।

মমতাও কিন্তু তার আভাস দিয়েছেন; তিনি বলেছেন, তাঁর রাজ্যের পানি ঠিক থাকলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। তাই কেন্দ্র এখন সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ভেতর পানি বণ্টনের বিষয়টি চিন্তা করছে। এ নিয়ে কাজ করে তারা এ বছরের ভেতর একটি অবস্থানে পৌঁছাতে যান বলে মনে করেন বিজেপির প্রথম সারির কোনো কোনো নেতা। তাদের এই কাজের আভাসও পাওয়া যায় মোদির সাংবাদিক সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে। সেখানে তিনি বলেছেন, তাঁর সরকার ও হাসিনা সরকারই তিস্তা সমস্যার সমাধান করবে।

বাস্তবে তিস্তা নিয়ে মোদি আরেকটি চমক দেওয়ার জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন। এই চমকটি যে মোদির জন্যে প্রয়োজনীয় তা কিন্তু মোদি এক হিসাবে রাখঢাক করছেন না। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণোৎসর্গকারীদের দেওয়া সম্মননা প্রদান অনুষ্ঠানে মোদি তাঁর ভাষণে বলেন, পড়শিকে ছাড়া একা একা বড় হওয়া যায় না। এক পড়শি আছে তারা সেটা বোঝে না। তাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে বাংলাদেশ চলছে, যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অনেক দিক থেকে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে– এই নেতৃত্বের সঙ্গে বন্ধুতের ভেতর দিয়েই ভারতকে চলতে হবে।

মোদির এই কথার ভেতর গুজরাল ডকট্রিনের একটি প্রতিধ্বনি শোনা যায়, অর্থাৎ ভারত তার 'বড় ভাই' অবস্থান থেকে সরে এসে এক কাতারে নেমে এখন প্রতিবেশীর সঙ্গে বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে হাতে হাত ধরে চলতে যাচ্ছে।

মোদির ভাষণ ও বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের বক্তব্য আরও একটি বিষয় এবার স্পষ্ট করে যে, ভারত এখন আর বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি কেবল মাত্র সিকিউরিটি ইস্যুর ভেতর রাখতে চায় না। তারা অর্থনৈতিক, সামজিক ও সাংস্কৃতিক সব দিক সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশসহ অন্য প্রতিবেশীদের নিয়ে এগোতে চায়।

কেবলমাত্র পাকিস্তান যে এখান থেকে দূরে আছে তা মোদি তাঁর ভাষণেই জানালেন। এবারই প্রথম দিল্লির রাজনৈতিক মহলে একটি বিষয়ে একমত দেখা গেল, বাংলাদেশের বিষয়ে তারা সব ডিম এক ঝুড়িতেই রাখতে চায়। এর আগে দিল্লিতে বাংলাদেশ নিয়ে এই 'ডিপ্লোম্যাটিক টার্ম' খুব বেশি ব্যবহার হত। তারা বারবারই বলতেন, সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা কি ঠিক হবে?

এখন তাদের বক্তব্য ভারতকে শান্তিপূর্ণভাবে এগোতে হলে, প্রতিবেশীদের নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হলে, ভারতের সব ডিম শেখ হাসিনার ঝুড়িতেই রাখতে হবে। এ কৃতিত্ব অবশ্য শেখ হাসিনার। তিনি নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তারপরে ভারতের রাজনৈতিক মহলের অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই।

শেখ হাসিনার এই সফরের আগে বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল, কিছু বুদ্ধিজীবী তাদের কল্পিত এক সামরিক চুক্তি নিয়ে অনেক পানি ঘোলা করেছিলেন। ৮ তারিখের যৌথ ঘোষণার পর নিশ্চয়ই তাদের বলার কিছু নেই। কারণ যে সামরিক সমঝোতা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের হয়েছে সেখানে অস্ত্র কেনাবেচার থেকেও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে নলেজ বিনিময়– ট্রেনিং, শিক্ষা ইত্যাদি বিনিময়। এ ধরনের সামরিক সমঝোতা আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়াসহ অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশের আছে।

কেউ কেউ মনে করেন, ভারতকে একটু নড়েচড়ে বসতে দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশ চীন থেকে দুটি সাবমেরিন কেনার পর। কথাটি খুব সঠিক তা কিন্তু ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন না। তবে তাদের বক্তব্য হল, বাংলাদেশ ও ভারতের ভেতর যত বেশি ট্রেনিংসহ বিভিন্ন নলেজ একচেঞ্জ হবে ততই একে অপরকে উন্নত হতে সাহায্য করবে, যা এশিয়ার শান্তির জন্যে ভালো।

চীনের প্রতিবেশী পূর্ব এশিয় অনেক দেশের মতো দক্ষিণ এশীয় বড় দেশ ভারতের শান্তির জন্যেও, চীনও একধরনের হুমকি হয়ে উঠছে বলে মনে করেন ভারতের অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক। তাদের বক্তব্য হল, এ জন্যে বাংলাদেশ তাদের প্রয়োজনীয় সমারাস্ত্র চীনের কাছ থেকে কিনছে এ নিয়ে চিন্তা করার আগে, ভারতকে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। ভারতকে চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো শক্তি অর্জন করতে হবে।

এ কাজে বাংলাদেশেরও প্রয়োজন নেই ভারতের সঙ্গে সামরিক সমঝোতার বাইরে কোনো সামরিক চুক্তি করা, অন্যদিকে ভারতেরও প্রয়োজন নেই বাংলাদেশর সঙ্গে সামরিক কোনো চুক্তি করা। তারা মনে করেন, সত্তরের দশকে জেনারেল জিয়াউর রহমান চীনের সঙ্গে যে সামরিক চুক্তি করেছিলেন, সেখান থেকে শেখ হাসিনা তাঁর দেশকে অনেকখানি বের করে নিয়ে এসেছেন। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর যত বেশি সামিরক সক্ষমতা বাড়বে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে ততই চীনের সামরিক একাধিপত্য কমে যাবে।

নয়াদিল্লি, ৯ এপ্রিল ২০১৭