বিজেপি সরকারের তিন বছর ও গেরুয়াকরণ

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 5 April 2017, 04:42 AM
Updated : 5 April 2017, 04:42 AM

ভারতের বিজেপি সরকারের তিন বছর পূর্তি হতে আর কয়েক সপ্তাহ মাত্র বাকি। এই তিন বছরে ভারত নামক একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের কাজকর্ম শুধু দেশের মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলেনি, তিন বছর ধরে বিজেপি-শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে গোমাংস খাওয়া শুধু নিষিদ্ধই করেনি, গত মাসে উত্তরপ্রদেশে বিপুল জয়ের পর বিজেপি-শাসিত মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশে কেউ গোমাংস রাখলে তার সাজা হবে অন্তত দশ বছর জেল-হাজত, এমন ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছে।

এ তো গেল অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এবার নরেন্দ্র মেদির গেরুয়া বাহিনী ব্রিটেন ও আমেরিকার মতো গোটা দেশে সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব উসকে দিয়েছে। সম্প্রতি এই উত্তরপ্রদেশে আফ্রিকার এক ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়। সেই সঙ্গে চলছে বিজেপি-শাসিত রাজ্যে আফ্রিকার ছাত্রছাত্রীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার।

আফ্রিকার প্রায় ৫৬টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা দিল্লিতে এক বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রী মোদী ও উত্তরপ্রদেশের গেরুয়া মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা জাতিসংঘের কাছেও বিষয়টি তুলে ধরেছেন। স্বাধীনোত্তর ভারতে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আফ্রিকার দেশগুলো শোষণমুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই নেহরুর দেশেই এখন ব্রিটেন ও আমেরিকার মতো কালো-সাদার বিভেদ সৃষ্টি করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন সে দেশে কালো ও সাদার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে সে দেশ থেকে কালোদের সরানোর উদ্যোগ নিয়েছেন, ঠিক একই কায়দায় ভারতের এই নতুন উপদ্রব সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার।

ভারত একটি সভ্য গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের মানুষের চামড়ার রং দেখে বিচার হয় না। জাতিসংঘে অভিযোগ জানানোর পর কার্যত কোনো প্রতিক্রিয়াই দিতে পারেনি নরেন্দ্র মোদীর সরকার।

কোনোরকমে দায়সারা একটি বিবৃতি দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছে। আফ্রিকার ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর নিগ্রহের ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনার পর ভারত সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অথবা এমন কিছু করেনি যা দেখে বোঝা যায়, আফ্রিকার ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় ভারত সরকার আদৌ উদ্বিগ্ন।

এদিকে আফ্রিকা গ্রুপ অব হেড মিশনের করা অভিযোগের পরেই হইচই পড়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিক কালে কোনো দেশই ভারতের বিরুদ্ধে এত তীব্রভাবে জাতিবিদ্বেষের অভিযোগ তোলেনি। একসঙ্গে এতগুলি দেশ মুখর হওয়ায় একেবারে ব্যাকফুটে চলে গেছে ভারত। কারণ এই দেশগুলি নির্জোট আন্দোলনের (ন্যাম) সমর্থক। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা বিষয়ে তারা ভারতকে সমর্থন করে থাকে। তাদের দিক থেকেই এত গুরুতর অভিযোগ আসায় বেশ বিপাকে পড়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। পরে অবশ্য পরিস্থিতি সামলাতে এই দূতাবাসগুলির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক।

তাদের কাছে ভারত অহিংসার পূজারী মহাত্মা গান্ধীর দেশ। সেখানে শাসক দলের প্রশ্রয়ে যেভাবে হিংসা ছড়াচ্ছে তা তাদের কল্পনারও অতীত।

আবার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ভারতে সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব উসকে দিয়েছে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। তারা ভারতকে খণ্ডবিচ্ছিন্ন করতে চায়। এর পরিণাম কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, তা গেরুয়া বাহিনী বুঝতে পারছে না। যদি কখনও বুঝতে পারে তাহলে ভারত বিশ্বের দরবারে আর মুখ দেখাতে পারবে না।

এবারে দেখা যাক গোমাংস নিয়ে কী হচ্ছে। গোমাংস নিয়ে যারা হইচই করছেন তারা কি রামায়ণ, মহাভারত, বেদ এমনকি রামকৃষ্ণ কথাম্মৃত পড়েছেন? কালীকৃষ্ণ সিংহের মহাভারতে আছে:

মহাভারতের যুদ্ধের সময় ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের দুঃসম্পর্কের ভাই বিদুরের কাছে এসে বলেন, তিনি ক্ষুধার্ত।

বিদুর তাঁকে বলেন, "আমার কাছে গোবৎস আছে। তোমাকে আমি রেঁধে দিতে পারি।"

অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ গোমাংস খেয়েছেন। আবার বেদে আছে, অতিথিরা এলে মনিষীরা তাদের গোমাংস দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।

ওদিকে এদিকে গোমাংস নিয়ে সারা ভারতের মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে। তারা প্রচলিত একটি বাক্য উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন, আমাদের দেশের প্রচলিত কথা: 'আপ রুচি খানা, পর রুচি পরনা।' এর মধ্যে রাজনীতি কোথায় আছে? গোরুয়া বাহিনী না বুঝলেও তাদের পরামর্শদাতারা তো এ কথা জানেন। তাহলে দেশে কে কী খাবে, না-খাবে তাতে সরকারের মাথাব্যথা কেন?

বিশিষ্টজনরা আরও মনে করেন, উত্তপ্রদেশসহ গোটা দেশে যেভাবে গোমাংস ভক্ষণের ওপর কড়াকড়ি শুরু হয়েছে তার সুদূরপ্রসারী ফল হতে পারে। ক্ষমতায় আসার পর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সে রাজ্যের বেশিরভাগ কসাইখানা এবং মাংসের দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। ঝাড়খণ্ডেও খাসি এবং মুরগির মাংসের দোকানগুলির লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করা হয়নি। এ ছাড়া ছত্তিশগঢ়, উত্তরাখণ্ড মধ্যপ্রদেশসহ বিজেপি-শাসিত রাজ্যে যে কোনো ধরনের মাংসের ওপর কার্যত ঘুরপথে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। গুজরাটে গো-নিধনই নয়, গরু নিয়ে যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

এই রাজ্যগুলির মানুষ (সংখ্যালঘুসহ) ক্রমশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। যদি বেআইনি ও পুরনো কসাইখানাগুলি বন্ধ করে অত্যাধুনিক এবং স্বাস্থ্যকর কশাইখানা বা দোকান খোলা হত, তাহলে সাময়িক অসুবিধা হলেও আপত্তি খুব একটা হত না। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। বাস্তবে যা ঘটাতে চাইছে গেরুয়া বাহিনী তার খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপালির কথায়। তিনি বলেছেন:

"সমগ্র গুজরাটকে আমি নিরামিষাশী বানাতে চাই।"

তার রাজ্যে গো-নিধন করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিং অবশ্য চান গরু নিধন করা হলে সরাসরি ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হোক।

সারা দেশ থেকে যত মাংস রপ্তানি হয় তার অর্ধেকের বেশি যায় উত্তরপ্রদেশ থেকে। প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার মহিষের মাংস রপ্তানি করা হয়। শুধু গোমাংস ভক্ষণকারী নয়, এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে রেয়েছে কয়েক লক্ষ মানুষ ও তাদের পরিবারের রুজি-রোজগার। গোহত্যা বন্ধ করতে কয়েক মাস আগেই পথে নেমেছিল আরএসএসের 'গো-রক্ষক বাহিনী'। তারা গো-রক্ষার নামে বস্তুত সংখ্যালঘুদের নির্যাতন শুরু করেছিল। সে সময় একরকম বাধ্য হয়েই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, গো-রক্ষার নামে বাড়াবাড়ি বন্ধ করা হোক। সে কথা মোদী যে লোক দেখাতে বলেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ গো-রক্ষার নামে গৈরিক বাহিনীর তাণ্ডব এখনও কমেনি।

এর ফলে ভারতবর্ষের বিদেশি মুদ্রা রোজগারও ব্যাহত হয়েছে। এ বিষয়ে রাজ্যগুলিও তাদের প্রাপ্য কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ব্যবসায়ী মহলের বক্তব্য গোমাংস ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত গুজরাট ও রাজস্থানের বড় বড় কালোবাজারের হিন্দুরা। মুসলিমরা বেশি কাজ করেন কসাই খানাগুলোতে। অভিযোগ উঠেছে আরএসএস সদর দপ্তর থেকে গোমাংস বন্ধ করার জন্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির সরকার সব রকম সাহায্য করবে। পুনে থেকে আরও নির্দেশ জারি হয়েছে ঘরে ঘরে রাম পূজা করার জন্য।

পশ্চিমবঙ্গের দিদিও অবশ্য কম যান না। তিনি মঙ্গলবারই নির্দেশ জারি করেছেন ঘরে ঘরে হনুমান পূজা করতে। রামায়ণে হনুমানের ভূমিকা ছিল গন্ধমাদন পর্বত মাথায় করে নিয়ে এসে লক্ষণকে সুস্থ করে দেওয়া এবং সীতার অপমানের জবাব দিতে স্বর্ণলঙ্কা ল্যাজের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। রামের সঙ্গে হনুমানের সখ্য রামায়ণের অন্যতম উপজীব্য।

এ ব্যাপারে সংবিধান কী বলে। নরেন্দ্র মোদীসহ সব মন্ত্রী এই সংবিধানের নামেই শপথ নিয়েছেন। সেখানে স্পষ্ঠ বলা হয়েছে:

JUSTICE social, economic and political.

LIBERTY of thought, expression belief faith and worship.

EQUALITY of status and of opportunity Fraternity assuring the dignity of the individual.

অর্থাৎ মানুষের রুচি ও পছন্দের ওপর হস্তক্ষেপ করে মোদী আসলে সেই সংবিধানেরই অবমাননা করছেন, যার শপথ নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে বসেছেন।